বাইরের ডাক
শাশুড়ি বজ্রকঠিন স্বরে বললেন, "না!"
ঘোমটার ভিতর থেকে সরলার মুখটা দেখা না গেলেও আন্দাজে বলা যায় তার চোখে জল বিন্দুমাত্র
ছিল না। একটা জেদের আগুণ ছিল বরং। দু'বছরের মেয়ের হাত ধরে শাশুড়ির ঘর থেকে বেরিয়ে মনস্থির
করল সরলা।
স্কুল তো দূর, চৌকাঠ ডিঙোনো বারণ। পড়াশোনা তো দূর অস্ত! মেয়ে নাকি বাচাল হয়ে যাবে!
লাজলজ্জার মাথা খেয়ে বসবে।
একান্নবর্তী সংসার। বাড়ির ছেলেরা পড়ছে সার দিয়ে বসে। সরলা ঠেলে দিলেন মেয়েকে,
"যা, দাদাদের কাছে গিয়ে বোস।"
মেয়েও গুটগুট করে মা'র নির্দেশ পালন করল। দাদাদের সামনে বসে পড়া শুনতে আর লেখা দেখতে
তার মজাই লাগত।
"আশা বর্নপরিচয় শিখে ফেলেছে গো!" সরলা ঘরের একান্তে গলা জড়িয়ে ধরে বলল।
"চুপ! চুপ! মা জানতে পারলে রক্ষা থাকবে না!" মাতৃভক্ত সরল স্বামীর ওপর রাগ করতে পারে না সরলা। খুশিটা মনেই চেপে রাখে। আড়াই বছরের মেয়ে বর্ণপরিচয় শিখে ফেলেছে!
সরলার শিকে ছিঁড়ল আরো তিন বছর পরে। বাড়িতে জায়গা কম পড়ায় বাধ্য হয়ে তাদের আলাদা বাড়ি নিতে হল। খান্না সিনেমার কাছে। খাস কোলকাতা। অতএব সরলা এবার মহারানী! তার বাড়িতে আসা শুরু হল বই। সরলা বিরামহীন পড়তে পারে। মাসে উনিশ-কুড়িটা বই আর পত্রপত্রিকা!
আশা তো মায়েরই মেয়ে। ছ'বছর থেকে শুরু হয়ে গেল তার বই গেলা। যা পায় হাতের কাছে সব! শুধু স্কুলের মুখ তার দেখা হল না আর কোনদিন।
"মা, আমি কবিতা লিখেছি।" আশা তখন তেরো। হাতে একটা ম্যাগাজিন। শিশুসাথী।
সরলা কাঁদেন না বড় একটা। কিন্তু বই হাতে তার চোখ চিকচিক করে উঠল। মেয়ের প্রথম ছাপা কবিতা। 'বাইরের ডাক'।
"সম্পাদক বলেছেন আরো লেখা দিতে। গল্পও।" জানালার গরাদ ধরে বাইরের ব্যস্ত কোলকাতার দিকে তাকিয়ে আনমনা কিশোরী। যদি পড়াশোনাটা শিখতে পারত!
সাহিত্যমেলা প্রাঙ্গণে ঢুকে আশা বাবার হাতটা আরো জোরে চেপে ধরল। কত লোক! কত বই! সবাই কত মার্জিত, সুশিক্ষিত। ভয়ে বুক ঢিপঢিপ। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে যদি কথাই না বলতে পারে!
"লেমোনেড খাবে?" দু'দিকে বিনুনি করা সমবয়সী একটা মেয়ে। ভারী মিষ্টি হাসিটা। আশার দিকে বাড়ানো হাত।
আশা কিন্তু কিন্তু করে হাত বাড়িয়ে দিল।
"তুমি বুঝি লেখো?" সপ্রতিভ মেয়েটা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল।
আশা বিব্রত। এই ভয়টাই করছিল। কিন্তু আশা দুর্বল না। বলেই ফেলল, "আমি ইংরেজি জানি না।"
ব্যঙ্গ আসবে ভেবেছিল, কিন্তু আশাকে অবাক করে মেয়েটা বলল, "এমন কিছু ব্যাপার না। আমি বাংলাতেই লিখি।"
"লেখো?" এবার আশার মেয়েটাকে ভালো লাগতে শুরু করেছে। "কি লেখো?"
"গল্প।"
"কি গল্প?"
"পড়বে? এই দেখো, এখানে ছেপেছে। তবে আগে বলো, তুমি কি করো?" হাতের পত্রিকাটা বাড়িয়ে বলল মেয়েটা।
"আমার কবিতাও ছেপেছে। আমিও এবার গল্প লিখব।"
সন্দেশ। পত্রিকাটার সুচিপত্রে আঙ্গুল দিয়ে নিজের নাম আর গল্পটা দেখিয়ে দিল মিষ্টি মেয়েটা। 'লক্ষ্মীছেলে' - লীলা রায়।
"তোমার নাম বললে না তো!" লীলা হাসল।
"আমি আশা। আশাপূর্ণা।"