আয়শা বেগম আদিয়াতের রেজাল্ট কার্ড
টা হাতে নিয়ে পাথরের
মত বসে আছে, নাম্বারগুলো দেখে
খুব রাগ,দুঃখ উথলে উঠছে
রাগ হচ্ছে নিজের ওপরই
।কেন
যে আর একটু খেয়াল
করলন না
নাতিটার পড়া লেখার দিকে
! অবশ্য তিনি খেয়াল করার
সময়ই বা কখন পান?
সারাদিন ব্যস্ত
থাকেন ঘর সামলাতে,আর আদিয়াতকে স্কুল
থেকে আনা নেওয়াও বেশীরভাগ
সময় তাকেই করতে হয়
তার ওপর আর্শির দেখাশোনাও
ত আছে । তাঁর ভয়
হচ্ছে আজ আদির নানুভাই,
মামা- মামী অফিস থেকে এসে
এই নাম্বার
দেখেই সুমি
মানে আদির মায়ের সাথে
হৈ চৈ করবে
;এইসব অশান্তি আয়শা বেগম
একদমই পছন্দ করেন না
অথচ মেয়েটাকে তিনি কিছুতেই
বোঝাতে পারছেন না যে
যা শেষ তা নিয়ে
ভেবে লাভ নেই এখন
ছেলেটাকে ভালো করে মানুষ
করতে হবে, এখন
মায়ের আদরের পাশাপাশি বাবার
স্নেহ শাসন সব সুমিকেই
পুরন করতে হবে । আবার ভাবেন সুমিকেই
কি সব কিছুর জন্য
দোষ দেয়া যায়?
কতই বা বয়স ওর!
এই বয়সে কি ভীষণ
একা হয়ে গেল মেয়েটা , জীবনের পথে
পা বাড়াতে না বাড়াতেই
হোঁচট খেল ।
বেলা অনেক হয়েছে রোদের তেজ
আজ বড্ড বেশি,
শুয়ে থেকে থেকে ঝিমুনি এসে গিয়েছিল
চোখ খুলেই সুমি খেয়াল
করলো মার ত সেই কখন আদিকে
দিয়ে স্কুল থেকে ফেরার
কথা ,তবে কি
ফেরেনি এখনো ? আর্শিকে নিয়ে যাননি
,সুমি বিছানা ছেড়ে
নামলো অমনি তিন বছরের
আর্শি বলে উঠলো ফুপি
আমি বাথরুম করব ।
মহা বিরক্ত হয়ে সুমি
আর্শিকে বাথরুম করিয়ে এনে
মার ঘরে
গেল ; দেখল মা জানালার
দিকে মুখ করে বসে
বসে চোখ মুছছেন ।
সুমি জিজ্ঞেশ করলো মা
কি হয়েছে ? আদি কই
?
আয়াশা বেগম
উঠে দাঁড়ালেন আর রেজাল্ট
কার্ডটা সুমির হাতে দিয়ে
চলে গেলেন আদি আর
আর্শিকে স্নান করিয়ে খেতে
দিতে হবে । আরও অনেক
কাজ তার এখনো বাকী
।
সুমি পাশে
এসে দাঁড়ালো বলল
...মা আমি জানি আজ
আমাদের মা - ছেলেকে
নিয়ে বাড়িতে খুব অশান্তি
হবে ; তার আগেই আমি
নিজের হাতে ওকে শাস্তি
দেব তুমি কিন্তু ওকে
আজ খেতেও দেবে না
, আর মাস্টার কেও জিজ্ঞেশ
করবো কি পড়ায় যে
এত খারাপ নম্বর পায়
...। মা শুধু বললেন
কাল স্কুলে তোকে ডেকেছে
।
সুমি আদিকে
ডাকল অনেক্ষণ ধরে, কিন্তু
আদি শুনেও কাছে এলনা
ভয়ে,
এখন এলে মা খুব
মারবে । ও জানে মা
একটু পর
আবার ঘুমিয়ে পড়বে ।
তখন নানুর কাছে গিয়ে
খেয়ে নেবে।
ও জানে
আজ এই
নম্বর পাওয়ার জন্য মামা
-মামীর কাছে বকুনি খেতে
হবে মামী ত মাকে
বাবার প্রসঙ্গ তুলে বেশ
কথা শোনাবে আর নানুভাই শুধু
বলবেন কাল থেকে বই
নিয়ে আমার কাছে বসবে
।ছয় বছরের আদিয়াত
অনেক কিছু বোঝে যা
তার সমবয়সী অন্য বাচ্চারা
বোঝেনা । ও জানে ওর
বাবা নেই , ওর
আর একটা মা আছে
অথচ ওর বন্ধুদের একটা
মা আর ওরা বাবা
মার সাথেই থাকে ।
যদিও আদি খুব
ভয়ে ভয়ে ছিল কিন্তু
তেমন কিছুই
হল না ।বিকেলে সবাই বাসায় ফিরল
, রেজাল্ট
ও দেখল কিন্তু কেউ
তেমন কিছু বলল না
, শুধু মামী বললেন মা
এভাবে ঘুমের
ওষুধ খেয়ে পড়ে থাকলে
ছেলেত পরীক্ষায়
এরকমই করবে , এখনো
সময় আছে সুমির ঠিক
হওয়া উচিত ছেলের দিকে
নজর দেয়া উচিত ।আদি নির্ভয়ে আর্শির
সাথে খেলায় মেতে উঠলো
।
সন্ধা হতেই টিচার এলো কিন্তু
আদির পড়ার ঘরে না ঢুকে
মামা আর নানুর
সাথে কথা
বলতে চাইলেন । আদির ভয়
হল না জানি স্যার
কি নালিশ করে আজ
নানুভাইএর কাছে !দুপুরে
মা ত স্যার কে
ফোন করে খুব বকেছে
। স্যার কি যে
এত কথা বলছে একা
দরজা বন্ধ করে,
আদিরখুব কৌতূহল হল কিন্তু
লাভ নেই এখন কিছুই
জানা যাবে না । এক সমর দরজা
খুলে গেল আর
আদিয়াতকে পড়াতে
এলো টিচার
।
ওদিকে মাজেদ
সাহেব, আয়শাবেগম ,শাহেদ আর
সোমা গেলেন সুমির ঘরে
তারা সুমিকে
বোঝালেন জীবনটা
এভাবে নষ্ট করার কোন
মানে নেই ; ও
বিয়ে করে সব কিছু
নতুন করে শুরু করুক
, কায়েস সব জেনে শুনে
বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে এতে
দুজনেরই ভালো হবে তাছাড়া
কায়েস আদিকে পড়ায় ওকে
ভালো ও বাসে খুব
।
কিন্তু সুমি কিছুতেই
রাজী হল না ।বলল প্রয়জনে চাকুরী
করে একা থেকে আদিকে
মানুষ করে তুলবে তবুও
বিয়ে করবে না।অনেকক্ষণ
ধরে বুঝিয়েও যখন কাজ
হোল না তখন রাগ
হয়ে যে যার ঘরে
চলে গেলেন আর বাবা
সাফ জনিয়ে দিলেন এভাবে
দিনের পর দিন ও
যদি ঘুমের ওষুধ খেয়ে
পরে থাকে বাবা ওকে
মানসিক কোন হাসপাতালে রেখে
আসবেন ,এভাবে জীবন চলতে
পারেনা ।
সুমি কোন
উত্তর দিল না
,ওষুধ ত ও নিজে
খায়না ! আদির বাবা চলে
যাওয়ার পর সুমি খুব
ডিপ্রেশনে ভুগছিল তখন ডাক্তার
ওকে ওষুধ দিয়েছেন
,যন্ত্রণা
ভুলে থাকার জন্যই সে
এগুলো খায় । সে জানে
সবাই ওকে
অন্য রকম চোখে দেখে
যেন সংসার ভাঙ্গার জন্য
সুমিই দায়ী।
আত্মীয় স্বজন মাঝে মধ্যেই
বলেন '' এ জিবনে স্বামী
সংসার নিয়ে সুখে থাকা
হোল তোমার সুমি । বন্ধুরা ত বলেই
বসে স্বামীর ভালোবাসা পেতে
হলে তেমন মেয়ে হওয়া
চাই । কেউ কেউ ত
এও বলে আরে তুই
আরেক বিয়ে করলেও সংসার
টিকাতে পারবিনা রে সে
গুন তোর নেই এত
গুডি গুডি গার্ল হয়ে
কোন লাভ নেই তার
চেয়ে স্মার্ট হ
, সেই স্মার্ট হওয়া যে
কি রকম তা সুমি
বুঝতেই পারেনা।
এ সমাজে টিকে থাকা
দায় । এসব কষ্ট আর
আদির বাবার করা অপমান
ভুলতেই ও ঘুমের ওষুধ
খেয়ে পরে থাকে
...একমাত্র
মাইই ওকে কিছু বোঝে
এ বাড়িতে।
সুমি আজ
আবার নতুন করে নিজেকে
নিয়ে ভাবতে লাগলো কেন কায়েস
তাকে বিয়ে করতে চাইছে
? চাইলে সে কত ভালো
মেয়ে পেতে পারে
, কায়েস অবিবাহিত শিক্ষিত ছেলে
হিসেবে ভালই ,শুধু
যে ব্যাবসাটা করে তাতে
রোজগার খুব বেশি নয়
। তবুও ত তার
জন্য পাত্রীর অভাব হবার
কথা নয় ? সে
কেন ওকে বিয়ে করতে
চাইছে ? তবে কি ওর বাবার টাকার
জন্যই কায়েস এই প্রস্তাব
দিয়েছে ? পুরুষমানুষকে ওর আর
বিশ্বাস হয়না । আদির বাবাও
ত ওকে ভালোবেসেই বিয়ে
করেছিল ,কিন্তু দুবছর যেতে
না যেতেই আদির জন্মের পরই
ত ওর অফিস কলিগ
কে বিয়ে করে আলাদা
হয়ে যায় শুধু ওই
মহিলার বাড়ি -গাড়ি
আর টাকার লোভে
...না হলে কি ছিলনা
সুমির ? সুমিও ত দারুন
সুন্দরী ছিল লেখা-
পড়া গান -নাচ
সবই জানে শুধু চাকরী
করেনি প্রয়োজন পড়েনি বলে।ভাবতে
ভাবতে ঘুমিয়েই পড়লো একসময়
।
ঘুম ভাংতেই
সকালটা কেমন বিবর্ন মনে
হল ,মনে পড়লো
সুমিকে আদির স্কুলে যেতে হবে
। স্নান সেরে সুমি স্কুলে গেল
, ওখানে মিস এর কাছে
যা শুনল তাতে এটাই
বুঝল যে ওর গাফিলতির
জন্যই আদির আজ এই
অবস্থা ! প্রায় দিনই আদি
স্কুলে আসেনা , সুমি জানে
মা অনেক সময় নিয়ে
আসার সময় পায়না ।
তাতে পড়াশুনায় সে
পিছিয়ে পড়ছে ওর বন্ধুরা
দূরে সরে যাচ্ছে
,আজকাল সে কারো সাথে
খেলতে চায় না কথা
বলতে চায় না।
মিস বললেন এভাবে
চলতে থাকলে আদি মানসিকভাবে অসুস্থ
হয়ে যেতে পারে তাই
সুমিকে আদির বন্ধু হতে
হবে পাশে থাকতে হবে
ওর সমস্যাগুলো বুঝতে হবে
।মিস
আশ্বাস দিলেন আমরা যথাসাধ্য
চেষ্টা করবো ওকে স্কুলের
সময়টুকু আনন্দে রাখার ।
স্কুল থেকে বেরিয়ে
বাসায় আসতে আসতে সুমি
দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিল যেকোনো
মূল্যে আদিকে ভালো রাখতে
হবে , মানুষের মত মানুষ
করে তুলতে হবে ।আর সেই জন্য
এখন ওকে নিজের পায়ে
দাঁড়াতে হবে আর নয়
...বাবা ভাইয়ের বোঝা হয়ে
আর থাকবে না সুমি
।
বাড়ি ফিরে সুমি
সব সার্টিফিকেটগুলো বের করে জেরক্স
কপি করল তারপর একের পর
এক দরখাস্ত করতে থাকে
আর অপেক্ষায় থাকে কবে
একটা ভালো খবর আসবে
এদিকে দিনে দিনে
বাড়িতে টিকে থাকা
অসম্ভব হয়ে ওঠল ।
বিয়ের প্রস্তাব মেনে
নেয়নি বলে ঘরে থাকলেই
সোমা কথা শোনায় এমন কি
বাবাও আজকাল দুই একটা
কথা শোনাতে ছাড়েন না। সুমির অসময় যেন
কিছুতেই ফুরোয় না ।
সুমি দিন গোনে কবে
চাকরী হবে ...কবে
আদিকে নিয়ে আলাদা থাকবে
আর মা ছেলের একটা
ছোট্ট সুন্দর সংসার হবে ।