গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ২৬ জুন, ২০১৭

শাশ্বতী চৌধুরী

রম্য গদ্য

পশু-ছাপ ও প্রেম
কস্মিনকালেও আমি পশুপ্রেমী ছিলাম না,আজও নই। কিন্তু ওই এ্যনিম্যাল প্রিন্টের উপর কি ভয়ানক এক দুর্বলতা যে আছে আমার,সেটা হঠাৎ আবিষ্কার করলাম ২০০৯ সালে। জীবন তখন মালয়েশিয়ায় অতিবাহিত হচ্ছে। স্বামী কর্মসূত্রে,আমি ভ্রমণসূত্রে। স্বামীর বিদেশ বিভুঁইয়ে একা কত রকম সমস্যা! কাজের চাপ,তারই সাথে সারাদিন পর হাত পুড়িয়ে রান্না.... উপযুক্ত স্ত্রী থাকতে সেটা কি হতে দেওয়া যায়,না যাওয়া সম্ভব!! তার সাথে ইমোশনাল ব্যাপার স্যাপারকে তো ইগ্নোর করা যায় না। দেশের এক প্রান্তে বউ আর পুচকে ফুটফুটে বাচ্চা পড়ে থাকলে বিদেশে কি আর স্বামীর কাজে মন লাগতে পারে!! 
না, না.... এত বড় অন্যায় কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না। তাই অনুগামিনী হলাম। মনে যদিও লাড্ডু ফুটছে। বিদেশ ভ্রমণ না,এত বিদেশ বাস হচ্ছে। ভগবান বড় সদয়!

হ্যাঁ, যে কথা হচ্ছিলো... ওই মালয়েশিয়া গিয়ে আশেপাশের নাক চ্যাপ্টা চৈনিক প্রতিবেশী এবং প্রতিবেশিনী দেখে শুরুতেই তো হেভি কমপ্লেক্স! একি রে! এত সরু কাঠি আইলো কই দিয়া! এরা খায় দায় না নাকি! এরই মধ্যে একটি হৃষ্টপুষ্ট চৈনিক প্রতিবেশিনী দেখে একটু উৎফুল্ল হলাম। তা ওনার অঙ্গেই একদিন এ্যনিম্যাল প্রিন্টের একটি হাল্কা পাতলা জামা দেখে চোখ আর ফেরে না। কি রঙ! কি রূপ! কি প্রিন্ট আর কি গ্লেজ দিচ্ছে রে বাবা!ভাঙা ভাঙা ইংরাজীতে ( এই কারণেই ভাঙা,তেনাদের উচ্চারণ বুঝতে আমার বেশ গলদঘর্ম অবস্থা হত, এতটাই যে নিজের ইংরাজী আধা ভুলে যেতুম) জানলাম, এনাকে বলা হয় এ্যনিম্যাল প্রিন্ট! সেই থেকে বেজায় ফ্যান হয়ে গেলাম। কত্তা অফিস গেলে সাংসারিক কাজ কারবার সেরেই দু'বছরের ছেলে ট্যাঁকে করে বেড়িয়ে পড়তে শুরু করলাম, এ্যনিম্যাল প্রিন্টের ড্রেসের খোঁজে।  মোল্লার দৌড় তো মসজিদ অবধি! বাড়ির ২ কিলোমিটার এদিক ওদিকের মধ্যের শপিং মল বা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের বাইরে একা যাওয়ার সাহস হচ্ছে না। একা যাওয়া যদিও বা সম্ভব ছিলো,ছেলে ট্যাঁকে নিয়ে ইম্পসিবল বাবা! 

বিধি বাম! এ্যনিম্যাল প্রিন্ট পেলেও সেটা এই খাতা-পিতা ঘরকা বিশালাকায় বপুর জন্য তৈরী হয়নি! সবই ওই হাড্ডিসার চৈনিক সমাজের জন্য তৈরী হয়েছে। অবশ্য ওদের দোষ দিয়েও লাভ নেই, আমায় আগে দেখেনি তো!  তাহলে আন্দাজ পেতো,এমনও বপু হয়!!!
তবে হাল ছাড়িনি জানেন!  বছর কাটিয়ে দেশে ফেরার আগে কিছু পাই না পাই, একখানি এনিম্যাল প্রিন্ট সমৃদ্ধ স্কার্ফ কিনে আনার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম বৈকি! কিন্তু ওই যে! মস্তিস্ক হইয়া এমনই মরমে পশিল পশু-ছাপ, দেশে-বিদেশে যেখানেই যাই নজরে যদি একবার পড়ে,স্থবির হয়ে যাই।  বরের খিঁচুনি,  ছেলের টানা-হ্যাঁচড়া কিছুই সেই একাগ্রতাকে টলাতে পারে না। অগত্যা, উপায়ন্তর না দেখে পতি-দেবতা স্থির করলেন, যেখান থেকে পান না কেন, একটি পশু-ছাপ মার্কা জামা যোগাড় করতেই হবে! ওই যে কোথায় যেন শুনেছিলাম.. "ক্যাহেতে হ্যয় কি...... আগর কিসি চিজ কো দিল সে চাহো তো পুরি কায়নাৎ উসে তুমসে মিলানে কি কৌশিশ মে লাগ জাতি হ্যায়।" আমারও তেমন হলো... পাঁচতারা মলের খ্যাতনামা একটি দোকানে ঘটনাচক্রে এই বিশালায়তন বপুর থেকেও কিঞ্চিৎ বড় মাপের একটি পশ্চিমী ঢঙ-এর জামা পাওয়া গেলো অবশেষে। কি তার রঙের বাহার! সেদিন রাতে খুব ভালো ঘুমিয়ে ছিলাম জানেন! 
কিন্তু নেশা পিছু ছাড়লো না। তক্কে তক্কে সর্বদা থাকি,যদি কোনো পশু-ছাপের দর্শন মেলে! আর আমিও ব্যাঘ্রসম ক্ষীপ্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়বো। 
ওই দেখেছেন! ঠিক বাঘ এসে পড়লো!  কি যে মুশকিলে পড়েছি। এই হপ্তা দুয়েক আগেই চট করে সাত দিনের একটা পুচকে ট্যুরে ঘুরে এলাম থাইল্যান্ড। শিশু-ট্যুরে আর কত ঘোরা যায় বলুন! ওই ব্যাংকক আর পাটায়া। আর তাতেই কেল্লাফতে! চারদিকে যে কত প্রকার পশুছাপ! আমায় রোখে কে আর! দিল হামেশা গার্ডেন গার্ডেন! আয় ভাই এবার অঙ্গে আয়! বরের পকেট খালি হতে থাকে যত, আমার মনের উৎফুল্লতার পারদ বাড়তে থাকে তত! এপারে সদা হাস্যময় মুখ, ওপারে বরের পকেটের দুঃখ। সে যাক গে! পকেটের মত এত তুচ্ছ ব্যাপার স্যাপারে মন দিলে জীবনের লক্ষ্যে উত্তীর্ণ হওয়া যায় না।

একদিন গন্তব্য টাইগার পার্ক, পাটায়া। জ্যান্ত, আসল, মুক্ত বাঘেদের সাথে কিছুকাল সময় ব্যায় করার সৌভাগ্য পেলাম। দুগ্ধপোষ্য শিশু বাঘ থেকে শুরু করে একদম ধেড়ে খোকা অবধি। সে সব গল্প একদিন পড়ে বেশ সময় নিয়ে হবেখন। 

যে কথা হচ্ছিলো। পাটায়ার শান্ত শিষ্ট বাঘমামাদের দেখে আমি তো পরম মুগ্ধ। আসল ব্যাপার যেটা, একদম বোটকা গন্ধ নেই গায়। কি পরিষ্কার বাঘ বাঘিনী সব। রোজ লাক্স মেখে চান করে কিনা কে জানে!  তাদের গায়ে এত হাত বোলালাম.... লেজ নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া করলাম... কই বাপু তারা মোটেও বিরক্ত হলো না। আহ্লাদিত হয়ে ধেড়ে খোকারা মাঝে মাঝে গা ঝাড়া দিয়ে আমাদের দিকে তাকালে আমাদের অবশ্য তখন বুকের ভিতরে হাতুড়ি ভালোই পিটছিলো। একবার তো সগোতক্তি করেই ফেল্লুম,"এদিকে তাকাসনি ভাই। আমি ঐশ্বর্য নই। এত নধরকান্তি দেখে শেষ মেষ লোভ সামলাতে না পারলে আজ ই আমার বীরের সদগতি হবে।" তা যাক বাবা, পাটায়া বাঘ সম্প্রদায় অতীব ভদ্র বলেই এ যাত্রা বেঁচে গেছি। খাঁচার বাইরে বেড়িয়ে উৎসাহের সাথে গাইডকে বললাম,"খুব ভালো বাঘ। একদম সোনামণি।"

গোল বাধলো তার পরেই। এত সোনামণি বাঘ দেখে যে আমার বাঘ প্রেম উথলে উঠেছে আগে তো বুঝিনি!  বুঝলাম তখনই,যখন টাইগার পার্কের রিসেপশনের পাশে একটা শো রুমে ঢুকে বাঘের মুখ ওয়ালা গেঞ্জি জামা নজরে পড়লো। যতটা সম্ভব রোম্যান্টিক দৃষ্টি নিয়ে বরের দিকে তাকালাম। তিনি এমন ভাব করলেন যেন পরস্ত্রী ওনার দিকে কুনজর দিচ্ছেন! কিন্তু হাল ছাড়লে চলবে না বন্ধু, বরং কন্ঠ ছাড়ো জোরে..... মহা সুবিধা ওদিকে বাংলা কেউ বুঝবে না। আর বৌয়ের গলার জোরের কাছে সব পুরুষই অসহায়! অতএব..... পশুছাপ টুপি,বাঘ ছাপ জামা করায়ত্ত হলো। কি যে প্রশান্তি,সে কি আর ভাষায় প্রকাশ করা যায় গো!! 

মনে মনে স্থির করলাম,এ যাত্রায় বরটাকে আর জ্বালাবো না। একদম ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা করলাম। নাহ, অনেক হয়েছে। বিদেশ বিভুঁইয়ে আর নয়। লাগাম টানো মন... লাগাম টানো। 
দু দিন। মাত্র দুদিন জানেন! পারলাম না। ফিরে আসার ঠিক আগের দিন পায়ে হেঁটে একটু শহর পরিক্রমা করছিলাম। ওই করতে গিয়ে পথে পড়লো একটা শপিং মল। কি কুক্ষনে যে ভিতরে ঢুকলাম!  সেই এক ঘটনা। আমি স্থবির। ভুলে গেছি আমি কোথায়, কে আছে আমার সাথে,কেন আমি এসেছি এখানে.... চারপাশ আমার আবছা হয়ে গেছে। শুধু সামনে জ্বল জ্বল করছে বাঘ মুখ ওয়ালা একটি কাফতান কুর্তি। জগৎ সংসার ভুলে চরম সত্য তখন আমি আর ওই বাঘ-মুখ কাফতান কুর্তি! সম্বিত তখনই ফিরলো, যখন দেখলাম কুর্তিটি প্যাক হয়ে আমার হাতে এলো। পরম মমতায় আমার জীবন সঙ্গীর দিকে তাকালাম। প্রত্যুত্তরে ওনার দীর্ঘ-নিশ্বাসের শব্দ শুনলাম। 
খুব লজ্জা এলো। ছিঃ ছিঃ, আমি এত স্বার্থপর কি করে হতে পারলাম! নিজের কাছে দেওয়া কথারও কোনো দাম নেই!  এতই কম মনের জোর আমার! ভেবেই পেলাম না কি হবে আমার! 

শপিং মলের দোতলা। নত মস্তিস্কে অনুগমন করছি শুধু। তাকাবো না,নিজের কাছে প্রমিস... কিছুতেই তাকাবো না কোনোদিকে। কিন্তু পাপী নজর যাবে কোথায়!! ঠিক চোখে পড়বি পড় ব্যাগের দোকানে। আর সেইইইই.... পশুছাপ ব্যাগ। একটা নয়, দুটো নয়.... সারি সারি ব্যাগ। থরে থরে সাজানো। নাহ,হয় না! এত বড় অনাচার আমি মেনে নিতে পারি না। কত্তাটিকে ইনফর্ম করে নিচে নেমে এসে হাবিজাবি জিনিষপাতিতে মন দেওয়ার আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। 
এক সময় উপর থেকে নেমে এলেন পতিদেবতা এবং আমার শিশুদেবতা। তিনজনে মিলে ফিরে চললাম হোটেল অভিমুখে। এতই লজ্জায় অধোবদন (মনে মনে) ছিলাম যে জানতেই ভুলে গেলাম,বর ছেলে উপরে নিজেদের জন্য কি কেনাকাটা করলো। 
হোটেলে ফিরে জানতে চাইলাম। বর একগাদা প্যাকেট আর ব্যাগ এগিয়ে দিলেন। দেখতে দেখতে আবিষ্কার করলাম একটি স্পেশাল প্যাকেট। প্যাকেট খুলে অপার বিস্ময়!  আমার সাধের পশুছাপ ব্যাগ!!! 

গদগদ প্রেমময় দৃষ্টি নিয়ে পতিদেবতার মুখের দিকে তাকালাম। তিনি মুচকি হাসলেন। দুচোখে প্রশ্রয়।
ওরে!  আজ যে আমার নদের নিমাই হতে ইচ্ছা করছে!আমি যে আশাই করতে পারিনি! এই শিশু-ট্যুরের দৌলতে আমার পশু প্রেম আসুক না আসুক, পশুছাপ প্রেমের সুবৃদ্ধি ঘটেছে। সংগ্রহও সমৃদ্ধ হয়েছে। তবে কি,শুধু পশুছাপ নয়... বাঘমুখের প্রেমেও আমি এখন গদগদ। 

ঈশ্বর করুন,এ প্রেম যেন উত্তরত্তোর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। আমার আলমারিটিও যেন পশু-ছাপ সংগ্রহশালায় পরিণত হয়। 
জয় পাটায়ার বাঘমামার জয়!!!!