প্রচন্ড
ঝড়বৃষ্টির এক বিকেল। এই বিকেলেই আলো বেশ কমে এসেছে। রেডিও টিভির খবরে বারবার
নিম্নচাপ ঘনীভূত হয়ে প্রবল বেগে ধেয়ে আসার সতর্ক বার্তা জানাচ্ছে। রাস্তাঘাটে লোক
প্রায় নেই বললেই চলে।
রাস্তার ঠিক পাশ দিয়ে মাঝে মাঝে সিমেন্টের স্ল্যাব দিয়ে
ঢাকা, একটা চওড়া গভীর বাঁধানো নালা। বিস্তীর্ণ এলাকার নোংরা কালো জল এই
নালা দিয়েই বয়ে গিয়ে, সম্ভবত নদীতে গিয়ে পড়ে। সমস্ত অঞ্চলের যত আবর্জনা, পলিথিন ক্যারি প্যাক,
এমনকী মরা জীবজন্তু পর্যন্ত
এলাকার মানুষ পরম নির্লিপ্ত ভাবে এই নালায় ফেলে থাকে।
সন্ধ্যার
ঠিক আগে ঐ নালার পাশে অনেক ছাতার জটলা। ঠিক কি হয়েছে বুঝতে না পারায় কাছে গিয়ে
দেখা গেল সবাই খুব ব্যস্ত। একজন দু’টো লম্বা কাঠি দিয়ে প্রবল স্রোতের জলে আটকে যাওয়া একটা
আবর্জনার
স্তুপের
ভেতর থেকে কিছু তুলবার চেষ্টা করছে। কেউ এক হাতে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে অপর হাতে
ছাতা ধরে নির্দেশ দিচ্ছে, কেউ
কৌতুহল মেটাতে মাথার ছাতা উঁচু করে ধরে আর সকলকে ছাতার জলে ভিজিয়ে তদারকি
করছে।
খোঁজ নিয়ে
জানা গেল,
ছোট্ট একটা কাঠবিড়ালীর বাচ্চা জলে পড়ে গিয়ে ঐ আবর্জনায় আটকে
গেছে। যে কোন মুহুর্তে আবর্জনা মুক্ত হয়ে সেটা জলের তোড়ে ভেসে যেতে পারে। একটা বড় কাঠবিড়ালী, সম্ভবত বাচ্চাটার
মা, বারবার
একটা গাছের কোটর থেকে ডাকতে ডাকতে নেমে এসে নালার কাছটায় যেতে গিয়েও, এতোগুলো
লোকের ভয়ে যেতে পারছে না।
এমন সময়
কোথা থেকে ভিজে কাক হয়ে ন্যাপলা এসে ভিড়ের মাঝে উদয় হ’ল। গায়ে শতচ্ছিন্ন দুর্গন্ধযুক্ত নোংরা পোশাক, এক হাতে একটা কাপড়ের বোঁচকা। ন্যাপলা এক বদ্ধ পাগল, সারাদিন
রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু কোনদিন কারো কাছে একটা পয়সাও চায় না। তাকে দেখেই
নিজেদের গা বাঁচাতে সবাই সরে গিয়ে তাকে মারতে উদ্যত হ’ল। ন্যাপলাকে কেউ কখনও কথা বলতে শোনেনি নি, আজও কোন কথা না বলে, নালার ভিতর এক পলক দেখে, বোঁচকাটা পাশে রেখে ঝপ করে নালার নোংরা কালো জলে নেমে
পড়লো। সকলে কাঠবিড়ালীটার ভবিষ্যৎ ভেবে চিন্তিত হয়ে, ন্যাপলাকে সেখান থেকে তাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
ন্যাপলা
কোন কথা না বলে, কাঠবিড়ালীর বাচ্চাটাকে তুলে এনে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে একটা
গ্যারেজের নীচে বসে, বোঁচকা থেকে একটা নোংরা কাপড় বার করে, তাকে মুছে পরিস্কার করলো। তাতেও সন্তুষ্ট না হয়ে বোঁচকা
থেকে বিড়ি ধরাবার আধভেজা দেশলাইটা বার করে অনেক চেষ্টার পর, হাতের কাপড়টাতে আগুন ধরাতে সক্ষম হ’ল। জমায়েত সকলে হৈহৈ করে উঠলেও, সে নির্বিকার ভাবে কাঠবিড়ালীর বাচ্চাটাকে আগুনের বেশ
কাছাকাছি অনেকক্ষণ ধরে রেখে বেশ সুস্থ করে ফেললো। বাচ্চাটাকে গ্যারেজের একপাশে
রেখে চলে যাবার সময় পাশের গাছটার কোটর থেকে বড় কাঠবিড়ালীটার ডাক শুনে একবার মুখ
তুলে চাইলো। কাঠবিড়ালীটা সম্ভবত তার সন্তানকে রক্ষা করার জন্য ন্যাপলাকে কৃতজ্ঞতা
জানালো। ন্যাপলা ফিরে এসে বাচ্চাটাকে নিয়ে হাঁচড় পাঁচড় করে গাছ বেয়ে উঠে, কোটরটায় রেখে নেমে এসে কোন কথা না বলে, বোঁচকা
নিয়ে ভিজতে ভিজতে চলে গেল। দূরে কোথাও শঙ্খ ধ্বনি শোনা গেল, নালার ধার ফাঁকা হয়ে গেল।