গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ২৬ জুন, ২০১৭

নীহাররঞ্জন চক্রবর্তী

বেদন-বিধুরা

সেদিন সকালবেলা ।
জয়ন্ত ডাকল তার-স্বরে ডাকল ওর বৌ আরতিকে,''ওগো,শুনছো ?''
আরতি তখন উঠোনে ছিল । তাই ওর কানে গেলো না ওর কথা । কিন্তু ছুটে এলো একজন । সেও আরতি । ওদের বাড়ির কাজের মাসী । তরুণী বিধবা সে ।
''আমাকে কিছু বলছেন,বাবু ? কী করতে হবে আমাকে,শুনি ?''
শুনে বেশ অবাক জয়ন্ত । কিছু সময় ওর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো । সারা মুখে তখন ওর গুঁড়ো-গুঁড়ো হাসি ।
 
তারপরেই জয়ন্ত আরতিকে বলল,''শুনছো কথাটা বুঝি তোমার কানে যায়নি ? আমি তোমাকে কি বলি ?''
জয়ন্তর কথা শুনে আরতি তখন মাথা নিচু করে নিলো । বেশ কিছু সময় অমন করেই থাকলো । দেখে বেশ বিচলিত হল জয়ন্ত ।
অস্ফুটে জিজ্ঞেস করলো,'কী হল তোমার গো ? মাথা তোল দেখি ।''
জয়ন্তর কথা বলা শেষ হওয়ার সাথে-সাথে ওর বৌ আরতি উঠোন থেকে ঘরের বারান্দায় উপস্থিত হল । আরতিকে অমন করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ও বেশ অবাক ।
জিজ্ঞেস করলো জয়ন্তকে,''কী হয়েছে গো ? তুমি কি আরতিকে বকেছ ?''
 
আরতি কিন্তু এবার ছলছল চোখ নিয়ে মাথা তুলল ।
 
জয়ন্তর বৌ ওকে বলল,''কী হয়েছে গো তোমার ? বাবু কিছু তোমাকে বলেছে বুঝি ?'
জয়ন্ত বেশ অস্থিরবোধ করতে থাকলো ওর বৌয়ের কথায় । মাটির দিকে মুখ করে থাকলো সারা সময় ।
 
এক চিলতে কষ্টের হাসি হেসে আরতি তখন বলল জয়ন্তর বৌকে,''তেমন কিছু না,বৌদি । অনেকদিন পর যেন তার গলা শুনতে পেলাম । ওগো,শুনছো ? আপনাকে বাবু এমন করেই ডাকছিল । আমার ভুল হয়েছিলো । তাই ছুটে এলাম । বাবুর কিন্তু আমার আসাটা পছন্দ হয়নি । বাদ দিন । আজ আসি । মনটা খুব উতলা গো,বৌদি ।''
সখেদে কথাগুলো বলে জয়ন্তদের বাড়ির কাজের মাসী আরতি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো মন্থর পায়ে ।
সে চলে যাওয়ার পর জয়ন্ত নিচু-স্বরে ধরা-গলায় বলল ওর বৌ আরতিকে,''এক নাম তো । তাই ও ছুটে এসেছে । খুব খারাপ লাগছে এখন আমার ।''
ওর বৌ কান্না-ভেজা গলায় তখন উত্তর দিলো,''সেও নয় গো । এ স্বামীহারা নারীর চিরন্তন আর্তি । আমি বুঝেছি । খুব কষ্টের গো । খুব কষ্টের । কাল কাজে এলে ওকে একটু বুঝিও । আমিও থাকবো সাথে ।''
কিন্তু কাল কেন ? 
কালান্তরেও আরতি আর কাজে আসেনি জয়ন্তদের বাড়িতে । পথেও দেখা হয়েছে কয়েকবার তার সাথে জয়ন্ত আর ওর বৌয়ের সাথে । 'পেন্নাম হই' ভঙ্গীতে সে সাথে-সাথে নিজের পথ বদলে নিয়েছে । আরতির সে উপেক্ষা আজো ভুলতে পারেনি জয়ন্ত আর আর বৌ আরতি ।
 
তবে আরতি ভুলতে চায় । ভুলেও যায় কখনো-কখনো । কিন্তু জয়ন্ত ভুলতে পারে না কখনো । প্রতিদিনের সকালটা ওকে খুব উন্মনা করে তোলে ।