মুহুর্তের মধ্যে খবরটা
গোটা পাড়ায় রাষ্ট্র হয়ে গেল, রনি
মাসিমা বিদেশ যাচ্ছেন। গোটা অঞ্চলের তিন প্রজন্মের একজনকেও
খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে রনি মাসিমাকে চেনে না। সেই চোদ্দ বছর বয়সে পাল
পরিবারের তিনতলা বাড়িতে তিনি বড় বউ হয়ে এসে, আজ পঁষষট্টি বছরের বৃদ্ধা। তিন ছেলে,
চার মেয়ে ও এগারোটা নাতি নাতনি নিয়ে তাঁর সাধের বিরাট সংসার।
সকাল থেকেই পালা করে দলে দলে প্রায় সব বাড়ি থেকেই প্রতিবেশীরা খোঁজ নিয়ে
শুভেচ্ছা জানিয়ে যাচ্ছে, কোন
কিছু প্রয়োজন আছে কী না জেনে যাচ্ছে। আর
আসবে নাই বা কেন, গত একান্ন বছরের মধ্যে কেউ তাঁকে কখনও কোথাও যেতে দেখে
নি। দুই কিলোমিটার দূরত্বে তাঁর ননদের বাড়ি। বাবার মৃত্যুর পর নন্দাই এই ননদটিকে
নিয়ে সাত দিনের জন্য দেশের বাড়ি গেলে, রনি মাসিমা তাঁর স্বামীর সাথে সেই
ফাঁকা বাড়ি পাহাড়া দিতে যান। বলা যায় এটাই তাঁর মধুচন্দ্রিমা যাপন। তাঁর
স্বামীর সাথে বিয়ে হয়ে এসে অবধি সংসারের কাজ কে সামলাবে, শ্বশুর শাশুড়িকে কে দেখবে, মোচা বা ডুমুর কে কুটবে,
ভাবতে
ভাবতেই জীবনটা প্রায় শেষ হয়ে গেল, কোথাও আর যাওয়া হয়ে ওঠে নি। স্বামী
মারা গেছেন অনেকদিন, আজ
তাঁর প্রথম বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ হ’ল। বিদেশ মানে দেওঘর। রনি মাসিমার মতে বিদেশ মানে তো
পশ্চিমে ভ্রমণ শুনি, তা দেওঘরও তো ঐ পশ্চিমেই বলে শুনি, তাহলে দেওঘর যাওয়াটা কেন বিদেশ ভ্রমণ নয়?
পাড়ার এক ভদ্রলোক, মুকুন্দবাবু তাঁর স্ত্রী, মা,
ও শাশুড়িকে নিয়ে বাবা বিশ্বনাথ দর্শনে যাচ্ছেন। তাই শুনে রনি মাসিমা তাঁদের দলে
ভিড়ে গেলেন। রনি মাসিমাকে সবাই ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন,
তাই মুকুন্দবাবু ও তাঁর
সঙ্গী তিনজন আপত্তি করা তো দূরের কথা, বরং খুশিই হলেন। খুশি হলেন রনি মাসিমাও, বিদেশ
ভ্রমণের আনন্দে থোর, মোচা, নাতির
দুধ গরম,
লক্ষ্মীর পাঁচালি
পাঠ ভুলে গোছগাছ শুরু করে দিলেন। পুরাতন বাঁধানো দাঁত জোড়া ত্যাগ করে, চীনাদের দোকান থেকে বেশ খরচ
করেই এক জোড়া বাঁধানো দাঁত তৈরি করে ফেললেন, আর এতেই যত বিপত্তির সুত্রপাত শুরু হ’ল। ঝাঁ চকচকে দামী দাঁত
জোড়ার রক্ষণাবেক্ষণ, সাবধানতা
অবলম্বন,
জলে ধুয়ে রোদে
শোকানো, আগলে রাখা,
ইত্যাদির পিছনে প্রচুর সময় ব্যয় করতে গিয়ে, দুধ উৎলে উঠে শুকিয়ে গিয়ে পাত্র পুড়ে
গেল, রোদে দেওয়া হিং-এর
বড়ি ছাদ থেকে হনুমানে নিয়ে গেল।
নির্দিষ্ট দিনে বাক্স
প্যাঁটরা নিয়ে রনি মাসিমা বিশ্বনাথ দর্শনে যেতে অনেক দেরি করে ফেললেন। বাবা বিশ্বনাথের জন্য নবীন স্যাকরার দোকান থেকে একটা ছোট রূপোর ত্রিশুলও কিনে
এনে সঙ্গে নিয়েছেন। বাড়ি থেকে রওনা হওয়ার আগে মুখের ভিতর হাত দিয়ে পরখ করে নিলেন,
নতুন দাঁত জোড়া ঠিক আছে কী না। তাড়াহুড়োয় হাত না ধুয়ে ব্যাগের চেন খুলে ত্রিশুলটা
নিয়ে একবার দেখে নিলেন, সেটা
ঠিক আছে কী না। ফলে গঙ্গাজল দিয়ে ত্রিশুল ধুয়ে, মুছে, ঠিক জায়গায় আবার রেখে,
ব্যাগে গঙ্গাজল ছিটিয়ে রওনা দিতে বেশ দেরি হয়ে গেল।
ট্রেনে উঠে মালপত্র
গুছিয়ে রেখে বসার কিছু পরেই ট্রেন ছেড়ে দিল। রনি মাসিমারা চারজন ছাড়া আরও দু’টি যুবক ঐ কিউবিকল্-এর
সংরক্ষিত আসন দখল করে বসেছে। তারা নিজেদের মধ্যে হাসি ঠাট্টার মাঝে বারবার
রনি মাসিমার দিকে লক্ষ্য করায়, তাঁর ছেলে দু’টোকে
কিরকম সন্দেহ হ’ল।
কিছুক্ষণ সহ্য করার পর তিনি আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। স্থান কাল পাত্র ভুলে
তিনি মুকুন্দবাবুকে বেশ চিৎকার করেই বলে বসলেন,
যে ছেলে দু’টোকে তাঁর সন্দেহ হচ্ছে। ওদের উদ্দেশ্য ভালো বলে মনে
হচ্ছে না,
কিছু হাত সাফাই করার
মতলব থাকলেও থাকতে পারে। আশপাশের যাত্রীরা এই কথা শুনে হাসাহাসি শুরু করলে, যুবক দু’টি যাচ্ছেতাই ভাবে রনি মাসিমাকে
গালমন্দ শুরু করে দিলো। মুকুন্দবাবু অপ্রস্তুত হয়ে তাদের কাছে ক্ষমা টমা চেয়ে,
পরিস্থিতি কিছুটা ঠান্ডা করলেন।
রাতে নিজের বিছানায়
শুয়ে ছেলেদুটোর ভয়ে কিছুতেই তাঁর ঘুম না আসায়, তিনি বাথরুমে গিয়ে মুখে চোখে ভালো
করে জল দিয়ে নিজের বিছানায় ফিরে এসে ত্রিশুলের ব্যাগটা থেকে গায়ে দেওয়ার চাদর বার
করে ব্যাগটা পাশে নিয়ে শুয়ে বেশ দুশ্চিন্তা নিয়েই একসময় ঘুমিয়ে পড়লেন।
অন্ধকার থাকতে কাকভোরে
চা বিক্রেতার হাঁকডাকে ঘুম ভাঙ্গতেই ব্যাগের চেন খুলে নতুন একটি শাড়ি বার করতে
গিয়ে,
সব ঠিক আছে দেখে তিনি নিশ্চিন্ত হলেন। বাথরুম থেকে মুখে চোখে জল দিয়ে, পরনের কাপড় বদল করে ফিরে এসে কাপড় ও চাদর
ব্যাগে রেখে, তিনি এক ভাঁড় চা নিয়ে
পরম শান্তি ও তৃপ্তিতে পান করলেন। এবার যশিডিতে নামতে হবে।
স্টেশনে গাড়ি এসে থামলে,
হড়োহুড়ি করে সবাই নামতে শুরু করলো। ঐ দুই যুবক রনি মাসিমাকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়েই
সরিয়ে দিয়ে স্টেশনে নামলো, আর
ঠিক তখনই রনি মাসিমা আবিস্কার করলেন, যে তাঁর কোমরে গোঁজা পুঁটুলিটা নেই। তাঁর
চিৎকার চেঁচামিচিতে দু’জন পুলিশ ছুটে আসলো। যুবক দু’টি তখনও স্টেশনের গেট পার হয়ে বাইরে
যায় নি। রনি মাসিমা পুলিশদের জানালেন, যে ঐ দুই যুবক তাঁর মূল্যবান জিনিস
হাতিয়ে নিয়ে পালাচ্ছে। একজন পুলিশ ছুটে গিয়ে ঐ দুই যুবকে টানতে টানতে ধরে নিয়ে এলে, তাঁদের ঘিরে বেশ ভিড় জমে গেল। তাঁর
কি খোয়া গেছে জিজ্ঞাসা করায় রনি মাসিমা পুলিশকে জানালেন, যে এই দুই ছোঁড়া তাঁর দাঁত খুলে
নিয়েছে। পুলিশ দুটো অবাক হয়ে বললো, “দাঁত তো আপনার মুখের
ভিতর ছিল,
আর দাঁত খুলে নিলে তো লাগবে, রক্তপাত হবে। আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে না যে আপনার
কোন কষ্ট হচ্ছে”। উত্তরে
রনি মাসিমা হাঁ করে ফোকলা মাড়ি দেখিয়ে বললেন, “দাঁত তো আমার মুখে ছিল
না, দাঁত তো ছিল আমার কোমরে।
ওদের ভয়ে কাল রাতেই আমি বাঁধানো দাঁত জোড়া খুলে রুমালে বেঁধে আমার কোমরের কাপড়ে
গুঁজে রেখেছিলাম। এই হতভাগা পাজি বেল্লিক দু’টো
ট্রেন থেকে নামার সময় আমার ট্যাঁক থেকে পুঁটুলিটা নিয়ে নিয়েছে। যুবক দুটিকে
খানা তল্লাশ করে কিছুই পাওয়া গেল না। সবাই হাসাহাসি শুরু করলে মুকুন্দবাবু অনেক
বুঝিয়ে,
যুবকদের কাছে আবার ক্ষমা চেয়ে, তাঁকে মুক্ত করে আনলেন।
স্টেশনের বাইরেটা এখনও
বেশ ঠান্ডা ও অন্ধকার। রনি মাসিমা কয়েক পা এগিয়েই আর্তনাদ করে ভুলুন্ঠিত হলেন।
একটা বেশ বড় পাথরের টুকরো তাঁর কপালে এসে আঘাত করায় রক্তারক্তি কান্ড। মুকুন্দবাবু
সব বুঝেও চুপ করে রইলেন। পাথরের উৎস সন্ধানে আর আগ্রহ প্রকাশ না করে,
রনি মাসিমাকে নিয়ে ছুটলেন স্থানীয় এক নার্সিং হোমে। বয়সের
ভার, রক্ত ক্ষয়,
ও সম্পদ হারানোর
শোকে তিনি তখন বড়ই অসহায় ও ক্লান্ত। তাঁকে ভর্তি করে নেওয়া হ'ল।
দেওঘরের পরিবর্তে
যশিডিতেই একটা হোটেল ভাড়া করে, মুকুন্দবাবু তাঁর ভ্রমণ সঙ্গীদের
নিয়ে উঠতে বাধ্য হলেন। তিনদিন সকাল সন্ধ্যা হোটেল আর নার্সিং হোম করে, রনি মাসিমাকে নিয়ে বাসায় ফেরার ট্রেনের টিকিট
কাটলেন। বাবা বিশ্বনাথের আর রূপোর ত্রিশুল ব্যবহার করা হ’ল না। বাবার নাম করে এতদুর নিয়ে আসা, তাই স্টেশনের পাশে রাস্তার
ওপর বট গাছের তলায় একটা ছোট্ট শিব মুর্তির হাতে ত্রিশুলটি সমর্পণ করে রনি মাসিমা ট্রেনে
চেপে বসলেন।
পরদিন বাসায় ফিরে বাথরুমে
ব্যাগের কাপড়, চাদর
ইত্যাদি কাচার জন্য রাখতে গিয়ে রনি মাসিমার চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল। কাপড়ের ভিতর
থেকে ঠক্ করে রুমালে বাঁধা দাঁত জোড়া মাটিতে পড়ে গেল। হাসি মুখে কাপড় ছেড়ে পরিস্কার
হয়ে বাথরুম থেকে বেড়িয়েই জয় বাবা বিশ্বনাথ বলে দাঁত জোড়া মুখে পরে কুটনো কাটতে বসে
গেলেন। অনেক কাজ পড়ে আছে। কলাই ডাল ভিজিয়ে, বেটে, হিং মিশিয়ে,
বড়ি দিতে হবে। ছোট
নাতির কাঁথা বানাতে হবে। পূজোয় বসার আসন বোনা শেষ করতে হবে।