বছর
ছয়েক হতে চলল পুলিশের চাকুরী থেকে অবসর নিয়েছেন সুপ্রতিম বাবু।রিটায়ারমেন্টের পরে
লেকের ধারে মর্নিং ওয়াক করতে যাওয়াটা প্রথম দিকে উনার একটা অভ্যাস ছিল,
এখন সেটা একটা তাড়নার পর্যায়ে চলে গেছে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরত কোন কিছুই আর উনাকে আটকাতে পারে না
এই অভ্যাস তথা তাড়না বজায় রাখা থেকে।এই নিয়ে তেত্রিশ বছরের ঘরণী সুলতা আর পুত্রবধু
দোলন মাঝে মাঝে ফোঁড়ন কাটে। বিশেষ করে ছেলের বউ দোলনের সাথে সম্পর্কটা শ্রদ্ধা আর
স্নেহের গণ্ডি ছাড়িয়ে একটা সাবলীল বন্ধুত্বের আঙ্গিনায় পা রেখেছে অনেক দিনই। যে
কারণে দোলন অম্লান বদনে বলে দিতে পারে, “বাবা দেখবেন,
আমার শাশুমা কে ভুলে যাবেন না যেন”।
কেডস এর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন সুপ্রতিম বাবু। বলেন, “অসুবিধা কোথায়? তোমরা আছো তো। তারপরে তোমার
শাশুমার তেত্রিশ কোটি দেব দেবী আছেন”।
প্রতিদিনই
পুরো ঢাকুরিয়া লেকটা বিভিন্ন গতিতে এক চক্কর মেরে ছায়া ঘেরা বেঞ্চগুলোর একটাতে এসে
বসেন। তার সাথে দেখা, পরিচয়, ঘনিষ্ঠতার আগে বেশ কিছুক্ষণ অন্য মর্নিং ওয়াকারদের সাথে কিছু হাল্কা
গল্প গুজব করে, লেকের এক পাশে বিনা অনুমতিতে সংকোচে গড়ে
ওঠা গোপালের মায়ের চায়ের দোকানে লিকার চা আর একটা বিস্কুট খেয়ে ধীর পায়ে হাঁটতে
হাঁটতে দেশপ্রিয় পার্কের বাড়ীতে ফিরে আসা। এই ছিল তার ধরাবাঁধা রুটিন। ৬৫ বসন্ত
পার করলেও সুপ্রতিম বাবু এখনো সুঠাম দেহের অধিকারী। যদিও মনের শক্তিতে একটা টান
ধরেছে বুঝতে পারেন।বড্ড মায়া বাড়ছে সব কিছুতেই।আগে এমনটা ছিল না।হয়তো ছিল কিন্তু
তাঁর বহিঃপ্রকাশকে সংযত রাখতে পারতেন। পুলিশের চাকুরীর কাঠিন্যের আড়ালে চাপা ছিল
সব সুকোমল বৃত্তি।
দোলের
পরে পরেই লেকটা যেন আরও মনোরম হয়ে ওঠে।গাছ গাছালির ফাঁক গলে বসন্তের হাওয়া যেন
একটা অন্য ভালো লাগা এনে দেয়। ইট কাঠ পাথরের জঙ্গলে এই একটা জায়গা এখনও শহরটার
শরীরে যৌবন ধরে রেখেছে।
বেশ
কয়দিন হোল তার দেখা নেই।সঠিক দিন মনে না রাখতে পারলেও কম করে সপ্তাহ খানেক তো হবেই,
আর আসছে না সে। এখন রোজই তীর্থের কাকের মতো উনার দৃষ্টি ঘুরে
ফেরে তার দেখা পাবার জন্য। কেমন যেন একটা অভ্যাস, নাহ
অভ্যাস নয়, নিশিতে পাওয়ার মতো হয়ে গেছিল এই কয়েক মাস।
মর্নিং ওয়াকার বন্ধুরাও মজা করে বলতেন, “সুপ্রতিম বাবু
বৃদ্ধ বয়েসে প্রেমে পড়েছেন”। বলবেন নাই বা কেন, শেষের দিকে তাদের থেকে তাকেই যে অনেক বেশী সময় দিতেন।
সুপ্রতিম
বাবুর সব স্পষ্ট মনে আছে। সেই তো প্রথম পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। সেদিন মর্নিং ওয়াক
সেরে সবে বেঞ্চে বসেছেন, পেছনে ঘাড়ের কাছে আর
একজনের অস্তিত্ব টের পেলেন। একটু চমকে পেছনে তাকিয়েছিলেন। প্রথম দিন পরিচয় পর্ব,
এলোমেলো আলাপচারিতা। তারপরে প্রায় রোজ। আসতও সে ঠিক যখন সুপ্রতিম
বাবুর লেকের চক্কর কাটা শেষ হতো তখন। হয়তো বা একটু আগেই আসতো, সুপ্রতিম বাবুর জন্য অপেক্ষা করত।অনর্গল কথা, কোন
বাঁধা ধরা বিষয় ছিল না।প্রশ্নের পর পশ্ন।উত্তর দিতে দিতে জেরবার হয়ে যেতেন এক
সময়ের দুঁদে পুলিশ অফিসার। মনে মনে হাসতেন এক সময় অপরাধীদের জেরা করেছেন তো,
ভগবান তাই চাকুরী জীবনের শেষে উলটো ব্যাবস্থা করেছেন। কথার
পৃষ্ঠে কথা, একটা উত্তর দিতে না দিতেই আবার প্রশ্ন। মাঝে
মাঝে উত্তর দিতে না পারলে, একটা পাহাড়ি ঝর্নার মতো উচ্ছল
তরঙ্গ বয়ে যাবার মতো হাসি। সুপ্রতিম বাবু মাঝে মাঝেই নানা রকম উপহার নিয়ে আসতেন।
খুশি মুখের সহজ সরল হাসি দেখে বড় আনন্দ পেতেন ।দীর্ঘ চাকুরী জীবনে নানা টানা পোড়েন,
ঝঞ্ঝাট ঝামেলা আর অপরাধীদের মোকাবিলা করতে করতে নিজের মনের
অন্তঃপুরে যে একটা সুকোমল মন লুকিয়ে ছিল, তার হদিশ পান
নি। পেলেন অবসর জীবনে এসে, বিশেষ করে তার সাথে দেখা হবার
পরে।
এখন
বড় আফসোস হয়,বাড়ীর ঠিকানাটা জানা হয় নি।কাকুলিয়া
রোডের ওইদিক থেকেই তো আসতো। কয়েকজনকে হাল্কা ভাবে জিজ্ঞাসাও করেছিল, কেউ সঠিক বলতে পারে নি।
মর্নিং
ওয়াকের বন্ধুরা টিজ করে বলে, “ভাগ্যিস
সুপ্রতিম বাবুর প্রেমিকা ল্যাং মেরেছে, তাই আমরা আবার
উনাকে ফিরে পেলাম”। বিমর্ষ হেসে নিরুত্তর থাকেন।রুটিন
মেনে সবই করছেন কিন্তু কোথাও একটা অভাব বোধ যেন মনের মধ্যে কুড়ে কুড়ে খায়।
দোলন
কে বলেছেন সব, আশ্বাস মিলেছে- “আসবে বাবা, হয়তো শরীর টরির খারাপ হয়েছে।ভাববেন
না অতো”।
যথারীতি
আজও শূন্য দৃষ্টি নিয়ে ফেরার পথে গোপালের মায়ের চায়ের দোকানে এসে বসলেন।সাথে থাকা
জলের বোতল থেকে জল খেয়ে, কিভেবে একবার গোপালের
মাকে বললেন, “তুমি নিশ্চয় লক্ষ্য করেছ, একটা ছোট্ট মেয়ে তার কাজের মাসীর সাথে এখানে আসতো।আমার সাথে অনেক গল্প
করত।এখন আর আসছে না। কোথায় ……”।
কথা
শেষ হবার আগেই গোপালের মা হা হা করে বলে উঠল, “ কেন
চিনব নি গো,দাদা? তুমি শোন নি?
তার তো খুব অসুখ গো, হার্টে ফুটো না কি
ধরা পইরেছে।যার সাথে আইসতো, পলাশী আমাদের একই বস্তিতে
থাকে। চিকিচ্ছে হচ্ছে শুনেছি...”।
এবার
সুপ্রতিম বাবু বাধা দিলেন, “কোথায় থাকে বলতে পারো?”
- কাকুলিয়া রোড ধইরে সোজা গেলে
একটা পিরাইমারি ইস্কুল। তার পাশেই সুখসারি ফ্যালেটে থাকে।
সুপ্রতিম
বাবু যাবার উদ্যোগ করতে শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
- চা কইরেছি, দাদা। চা টা খেইয়ে যান।
- নাহ! আজ আর চা খাব না। দেরী
হয়ে যাবে।
আর
কোন কথা না বলে হনহন করে কাকুলিয়া রোডের দিকে হাঁটা লাগালেন সাত বছরের তিন্নির
প্রিয় “ফ্রেন্ড দাদু”।