গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১১ জুন, ২০১৭

অসিত বরণ চট্টোপাধ্যায়

ভুতের আশীর্বাদ

প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলায় বিনুপন্ডিতের বাড়ী যেতাম টিউশান পড়তে। বিনুপন্ডিতের তোবড়ানো গাল,ভাটার মত চোখ, মাথায় টিকি, পরনে ধুতি আর ফতুয়া। হাতে থাকতো তেঁতুলের চাবুক।

বাড়ি হতে সিকি মাইল দুরে পন্ডিত মশায়ের বাড়ি। পথে পড়তো বাঁশবন, রাস্তার দুপাশে সোনাঝুরি, অর্জুন, আর শ্যাওড়া গাছ। যাওয়ার সময় ঠিকই যেতাম। কিন্তু বাড়ি ফেরার সময় বুক দুরদুর করতো। মনে মনে মায়ের শেখানো ছড়াটা আওড়াতাম।
"ভুত আমার পুত
পেত্নী আমার ঝি
বুকে আছে রাম লক্ষন
করবে আমায় কি?"

এহেন টিউশান যাত্রা হঠাৎই একদিন বন্ধ হয়ে গেলবিনুপন্ডিত ওলাওঠায় মারা গেলেন। সামনে পরীক্ষা। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম মনে মনে। কিন্তু কষ্ট হলেও তো এসব মেনে নিতে হয়।

শ্রাদ্ধশান্তি চুকে গেলো দশদিন পরেই।
আমার বাড়ির কাজের দুটো খাতা ছিল ওনার কাছে। একদিন বিকেল বেলায় গেলাম ওনার বাড়ি। ছেলে অমিত কবিরাজ ন্যাড়ামাথায় অনেক খোঁজাখুঁজি করে খাতা দুটো বার দিলেন। ভেবেছিলাম দিন বেলাবেলি  বাড়ি ফিরবো। কিন্তু বিধিবাম। হঠাৎ শুরু হলো ঝড়বৃষ্টি। থামতেই চায় না।

সন্ধ্যে ঘনিয়ে এল। বুক দুরদুর করছে বাড়ি যাওয়ার কথা ভেবে। কিছুক্ষন পরে বৃষ্টি থামতেই বেরিয়ে পড়লাম। আলো আঁধারি রাস্তা। সেই বাঁশবন। কে যেন ফিসফিস করছে। দুটো চামচিকে ফরর করে উড়ে গেলো সামনে দিয়ে। শ্যাওড়া গাছের তলা দিয়ে যেতেই দেখি কে যেন ঝুপ করে গাছ থেকে লাফিয়ে পড়লো। একটা চাঁই পাথরে বসে খ্যানখ্যান গলায় বলে উঠলো
---- কেঁ যাঁয়? বিঁজন নাঁ। বঁস বাঁবা বঁস। ভঁয় পাঁসনে। তাঁ খাঁতাগুঁলো পেঁয়েছিস তোঁ? পঁড়ার টেঁবিলের পাঁশের কাঁঠের আঁলমারীর দুঁ নম্বর তাঁকেই তো ছিঁলো খাঁতাগুলো।

দেখলাম বিনুপন্ডিত। সেই অবিকল পুরোনো পোষাকে।আমার গা ছমছম করতে লাগলো। তবু সাহস করে পাশে বসলাম। পন্ডিতমশায় বলে চলেছেন
---- পঁলাশীর যুঁদ্ধ, স্বাঁধীনতার যুঁদ্ধ, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের চ্যাঁপ্টার গুঁলো ঠিঁক ভাঁবে মুখস্ত কঁরেছিঁস বাঁবা? তাঁছাড়া (a+b)2, (a-b)2, a3+b3 এঁর ফঁরমুলা মুঁখস্ত কঁরেছিস? ইঁংরাজীর ক্যাঁসাবিয়াঙ্কা, সঁলিটারি রিপারটা ঠিঁক ভাঁবে পঁড়েছিস? বাঁংলার অভাগীর স্বর্গ গঁল্পটা ভাঁলোভাঁবে পঁড়েছিস। ওঁটা পঁরীক্ষায় আঁসবেই।

আমার অবস্থা তখন কাহিল। বললাম
----আমার ভয় করছে মাস্টারমশায়।
----ভঁয় কিঁরে, আঁমি তোঁ আঁছি। চঁল তোঁকে রাঁস্তা পাঁর কঁরে আঁসি। এঁখানে যাঁ ভুঁতের উঁপদ্রব। খোঁড়াভুত, মাঁমদোভুত  শুঁটকি পেত্নী, এঁরা বেঁজায় বঁদ। চঁল তোঁকে রাঁস্তার ঐ ল্যাঁম্পপোষ্ট পঁর্যন্ত এঁগিয়ে দিঁয়ে আঁসি। আঁর ভাঁলো ভাঁবে মাঁথা ঠাঁন্ডা কঁরে পঁরীক্ষা দিঁস বাবা। আঁশীর্বাদ কঁরি বঁড় হঁও। মাঁনুষ হঁও।

রাস্তার ল্যাম্পপোষ্টের আলোর কাছ আসতেই চোঁ চাঁ দৌড়। আর কিছু মনে নেই।