গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ২৬ জুন, ২০১৭

তাপসকিরণ রায়

ধারাবাহিক

জবলপুর, হ্যান্টেড কাহিনী--  

শাস্ত্রীব্রীজ একটি কালো  বিড়াল


সেদিনের কথা মনে পড়েছে রমেন বাবুর। অস্তিত্ব অস্তিত্বহীনতার মধ্যে কতটা পার্থক্য ? যে মরে যায় সে অস্তিত্বহীন হয়ে যায়, তবু, তবু কেন সে অলীক হয়ে আমাদের চোখে ধরা পড়ে ? আর যাকে আমরা অলীক বলি তাকে, তাকে আমরা অস্তিত্বের চোখে কি ভাবে দেখে নিতে পারি ?

হ্যাঁ, আজ থেকে প্রায় বছর দশেক আগের কথা, আজ আবার নতুন ভাবে রমেন বাবুর মনে পড়ে যাচ্ছে। শাস্ত্রীব্রীজ মধ্যপ্রদেশের জবলপুর নগরীর মাঝখানটাতে বলা যেতে পারে। দিন সারা জনারণ্য থাকে--সারাক্ষণ সেখানে হৈহৈ, রৈরৈ চলতেই থাকে। তারপর মাঝরাত থেকে হয়ে পড়ে জনশূন্য, নির্জনতা মগ্ন। রাত একটার পর থেকে ব্রীজ বুঝি অসীম ভরদিনের  ব্যস্ততার ভারশেষে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে !
রমেন বাবু সেদিন মেডিকেল হসপিটাল থেকে একলাটি ফির ছিলেন। তাঁর স্ত্রী তখন দিন তিন যাবত হসপিটালে এডমিট ছিলেন। সারাদিন স্ত্রীর পাশে হসপিটালে থাকতেন তিনি। প্রতিদিনই রাতে তাঁকে বাড়ি ফিরতে হত। ঘরের চৌকি দেওয়া সে সময়টা খুবই প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে ছিল। কারণ সে     দিনগুলিতে বেশ চোরের উপদ্রব চলছিল। রাইট টাউনের স্টেডিয়ামের কাছাকাছি রমেন বাবুদের ঘর। মেডিকেল থেকে ঘরের দূরত্ব হবে তা প্রায় বিশ কিলোমিটারের কাছাকাছি। যাতায়াতের বিশেষ একটা অসুবিধা ছিল না। নিজের ইন্ডিকা কার ছিল। স্বল্প দৈর্ঘ্যের দূরত্বগুলি তিনি নিজে ড্রাইভ করে যাতায়াত করতেন।

সেদিনও স্ত্রীর পাশে সারাদিন থেকে রাত প্রায় সারে বারটায় ঘরের দিকে রওনা দিয়েছিলেন রমেন বাবু। মনের দিক থেকে একটু স্বস্তি চলছিল। স্ত্রী তখন অনেকটা সেরে উঠেছেন। আর দু দিন পরেই হসপিটাল থেকে ওঁর ছাড়া পাবার কথা ছিল। শাস্ত্রীব্রীজের কাছাকাছি তিনি পৌঁছে গেলেন। অন্য দিনের তুলনায় আজ বেশ রাত হয়ে গেছে ফিরতে, সেটা তিনি সামনের ঘুমন্ত ব্রিজের দিকে তাকিয়েই টের পেলে গিয়েছিলেন। ব্রিজের ওপরে ইনসাফিসিয়েন্ট লাইট। আলো আছে, অন্ধকার আছে। আলো-অন্ধকারে চারদিক তখন মাখামাখি-- কেমন যেন নিঃশব্দ থমথম নিশীথ।

কয়েক মুহূর্তে রমেন বাবু পৌঁছে গেলেন ব্রীজের মাঝামাঝি। আর মুহূর্তের মাঝে হঠাৎ তাঁর গাড়ি আপনি আপনি ক্যাঁচ শব্দ করে থেমে গেলো। গাড়ির এক্সিলেটার দাবিয়ে স্পিড বাড়াবার বারবার চেষ্টা করতে লাগলেন রমেন বাবু। কিন্তু আশ্চর্য, গাড়ি এক চুলও নড়ছিল না। গাড়ি তো স্টার্টে ছিল তার আওয়াজ অনেক কমে গিয়ে ছিল বটে কিন্তু এমনি গতিশূণ্যতা কেন ? রমেন বাবুর বুদ্ধিতে কিছুতেই তা আসছিলো না। তাঁর মনের মধ্যে তখনও কোন রকম ভয় ঢোকে নি। মিনিট দুই তিন এমনি ভাবেই কেটে গেলো। শীতের কাঁপানো রাতে রমেন বাবু গাড়ির বাইরে বেড়িয়ে এসে ভাবলেন গাড়ি ঠেলবেন কি না ! ধীরে ধীরে গাড়ির পেছনের দিকে গিয়ে তিনি ভাবলেন একবার ঠেলা দিয়ে দেখলে কেমন হয় ?

গাড়ি ঠেলতে যাবার পূর্বমুহূর্তে রমেন বাবুর পাশ থেকে হঠাৎ একটা বিড়াল ডেকে উঠল। ডাক শুনে তিনি চমকে উঠলেন, দেখলেন, তাঁর পাশে একটা কালো বেড়াল দাঁড়িয়ে। একটা হুলো বেড়াল বলে মনে হল। বড় গম্ভীর গভীর ছিল ওর আওয়াজ। বেশ বলিষ্ঠ দেহ তার। আর আবছা অন্ধকারে তার  চোখ জ্বলজ্বল জ্বলছে ! বেড়াল হতেই পারে, কালো বলিষ্ঠ  বেড়াল আর তার অন্ধকারে চোখ জ্বলা এমনটাও কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার না। এদিকে গাড়ি ঠেলতে শুরু করেছেন তিনি। না, বারবার চেষ্টার পরেও এক তিল জাগাও এগোচ্ছে না গাড়ি, সামান্য গোঁ গোঁ আওয়াজ করছে বটে কিন্তু ডাউনে থেকেও নড়ছে চড়ছে না। ব্যাপার কি ?
এবার রমেন বাবু দেখতে পেলেন কালো বেড়ালটা আর একবার ডেকে উঠে সামনের দিকে হেঁটে চলছে। বাড়ি পার করছে বেড়ালটা, আর কি ! গাড়িটা এবার চলা শুরু করেছে, বেড়ালের পেছনে পেছনে গাড়ি এগিয়ে চলেছে ! বেড়ালের গতি বেশী ছিল না, গাড়িও সেই গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। এটা কি হচ্ছে, হচ্ছে টা কি ! এবার রমেন বাবুর মন একটু টলে গেলো, তিনি ভয় পাচ্ছিলেন। অলৌকিক একটা ভয় তাকে ক্ৰমশঃ জড়িয়ে ধরছিল। তিনি ছুটে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটে এসে বসলেন। আচমকা এক্সিলেটরে চাপ দিলেন, স্বাভাবিক ভাবে চাপে গাড়ি লাফ দিয়ে অন্তত পঞ্চাশ কিলোমিটার বেগ নিত--কিন্তু না--গাড়ি বেশী হলে পাঁচ কিলোমিটার বেগে বিড়ালের চলার গতিতেই এগিয়ে যাচ্ছিল। বিড়াল মাঝে মাঝে গুরুগম্ভীর মেউ মেউ ডেকে উঠছিল আর মেউ ডাকের সঙ্গে সঙ্গে বারবার রমেনের দিকে তাকাচ্ছিল। তখন রমেনের বুকের মধ্যে যেন ভয়ের কাঁপন ঢুকে গেছে। ভয়ে তার শরীর ঈষৎ কেঁপে কেঁপে উঠছিল। তবু বাঁচার তাগিতে তিনি বারবার এক্সেলেটার দাবিয়ে চলেছেন। ব্রীজ প্রায় শেষ হতে চলেছে। সামান্য দূরেই বেশ আলোর ঝলক, চোখে এসে লাগছে। ব্যাস, ব্রীজ শেষ হবে হবে অবস্থা। বেড়ালটা ব্রিজের শেষ রেখাতে এসেই যেন থেমে গেলো। এবার, এবার কি হবে ? এমনি আতঙ্কিত প্রশ্ন এসে রমেনের মনে ধাক্কা দিয়ে গেলো। মুহূর্ত, মুহূর্ত, নেই, বেড়াল নেই আর কিছুই নেই। আশপাশে আর তাকিয়ে দেখার অবস্থা রমেনের ছিল না। গাড়িও পুরো দমে স্ট্যার্ট হয়ে গেলো। গাড়ির এক্সিলেটরে পা রাখার আগে রমেন একবার ঘাড় ফিরালেন, কেন যেন তিনি সেই বেড়ালের অস্তিত্ব খুঁজে দেখার ইচ্ছে এত ভয়ের মাঝেও দমন করতে পারছিলেন না। হঠাৎ তিনি দেখলেন, শূন্যতার মাঝখানে চারদিক থেকে কিছু ধোঁয়া ছুটে আসছে আর মুহূর্ত মাঝে তা এক নারীর আকার ধারণ করে নিয়েছে। সে নারী যেন তাঁর সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। নিশ্চল এক ছায়াছবি দেখছিলেন রমেন। পর মুহূর্তে সে ধোঁয়া ছিঁড়ে ছিঁড়ে আবার খালি জাগায় পরিণত হয়ে গেলো। না, আর না, রমেন তাঁর অজান্তেই বুঝি সব কিছু এত সময় ধরে দেখে যাচ্ছিলেন। তাঁর সম্বিৎ যখন ফিরল তখন, আর না, এক্সিলেটারে পা রেখেই তিনি পঞ্চাশের স্পীডে এগিয়ে গেলেন তাঁর ঘরের দিকে।