গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ২৬ জুন, ২০১৭

অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

প্রথম কাহিনি 
        
        বিয়োগান্তীয় নায়ক - আমার বাল্যবন্ধু কেলো

যেমন সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায়, তেমনই কুকুর-বেড়ালে। সেরকমই শুনে আসছি এতকাল।  তুমুল বৃষ্টি হলে ইংরেজদেরও ক্যাটস অ্যান্ড ডগস-দের কথা মনে পড়ে। সেটা কি তাদের তুমুল ঝগড়ার অনুষঙ্গে না কি অন্য কোনো কারণে কে জানে। তবে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা কিন্তু অন্য রকম বলে। যে সব কুকুর এবং বেড়াল কাছাকাছি থাকে তাদের মধ্যে দেখি বেজায় ভাব। কুকুরদের সহিষ্ণুতার তো কোনো সীমা-পরিসীমাই নেই। মানুষ তাদের কাছে দিব্যি সহিষ্ণুতার পাঠ নিতে পারে। কুকুর-মা বেড়াল বাচ্চাকে নিজের বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে – এমন দৃশ্য অনেকেই দেখেছেন। তবে কিছু বদরাগি কুকুর আছে যারা অপরিচিত বেড়াল দেখলেই তেড়ে যায়। মোল্লার দৌড় অবশ্যি মসজিদে গিয়েই শেষ হয়। কোণঠাসা হলে বেড়ালসুন্দরী লেজ ফুলিয়ে, শরীর বেঁকিয়ে, হাড়-হিম-করা এমন ফোঁস দেয় যে কুকুর-পুঙ্গব লেজ গুটিয়ে পালাবার পথ পায় না। হাজার হোক, বাঘের মাসি তো! তবে ব্যতিক্রমী কুকুরও থাকে। যেমন ছিল আমাদের ‘কেলো’।

সে আমার ছেলেবেলার কথা। কেলো ছিল আমারই সমবয়সী। তবে আমি নিতান্ত বালক হলেও কেলো তখন ভরপুর যুবক। তার গায়ের রঙ কালো, লেজটি কাটা। কীভাবে তার লেজ কাটা পড়েছিল জানি না। তবে অনুমান করা যায় যে আমার কোনো লড়াইবাজ অগ্রজই কেলোর ছেলেবেলায় তার লেজটি কেটে দিয়েছিলেন। তখন গেঁয়ো লোকদের ধারণা ছিল যে কুকুরের লেজ কেটে দিলে সে ভয়ানক তেজি হয়ে ওঠে। এইসব লেজকাটা কুকুরদের ‘বেড়ে’ নামে অভিহিত করা হত। রবি ঠাকুর তাঁর এক কবিতায় একটি ‘লেজকাটা ভক্ত কুকুর’-এর কথা বলেছেন। আমাদের গাঁয়ের বেড়েদের যে খুব ভক্তি ছিল, তেমন প্রমাণ অবশ্যি বড় একটা পাইনি। ভিন গাঁয়ের কুকুরদের সঙ্গে লড়াইয়ে তাদের তেজ ঠিক কতখানি ফুটে উঠত, সেটাও বুঝে উঠতে পারিনি। তবে কেলোর কথা আলাদা। সে ছিল এক অসাধারণ কুকুর। আর তার সঙ্গে ছিল আমার গলায় গলায় ভাব। আমার সমস্ত খাবার আমি তার সঙ্গে ভাগ করে খেতাম। কুল, খেজুর কিংবা পেয়ারাটা সে বেচারি খেতে পারত না। সেটা আমি মেনেই নিয়েছিলাম, কিছু মনে করতাম না। খালপাড়ে বুড়ো তেঁতুল গাছের নির্জনতায় সারাটা দিনের অনেকটা সময় আমরা দুজনে কাটাতাম। আমি তেঁতুলের মোটা কাণ্ডে শুয়ে থাকতাম, কেলোকে আমার ভাবনার কথা বলতাম। সে কান খাড়া করে আমার কথা শুনত। আসলে আমি ছোটবেলায় ভীষণ তোতলা ছিলাম। একটা পুরো বাক্যি বের করতে প্রাণান্ত হত। অন্যেরা হাসত, আমাকে ভেঙাত। কেলোকে নিয়ে সেই সমস্যা ছিল না। তাছাড়া সে নিজেও ছিল তোতলা। এই নিগূঢ় তথ্যটি অবশ্যি একমাত্র আমিই জানতাম।  অন্যেরা তাকে বোবা ভাবত। কারণ তার মুখের আওয়াজ প্রায় শোনাই যেত না। অন্য কুকুররা দিন নেই রাত নেই, কারণে অকারণে ঘেউ ঘেউ করে মরে। কেলো সেখানে নির্বিকার। অথচ সেই উদাসীন মাঝারি গড়নের কেলোর চোখে এমন কিছু ছিল যে তাকে দেখেই বড় বড় চেহারার কুকুররা লেজ নামিয়ে বসে পড়ত তার পায়ের কাছে। একেই বোধ হয় বলে সারমেয়ত্ব, মানুষের যেমন ব্যক্তিত্ব। আমি অবশ্যি জেনে গিয়েছিলাম তার রহস্য আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে। দু-একবার এমন হয়েছে, উদমা(হঠকারী)কোনো কুকুর নিজের এলাকায় পেয়ে ঘেউ ঘেউ করে কেলোকে তেড়ে এসেছে। এসব ক্ষেত্রে কেলো কোনোরকম বাগবিতণ্ডায় যায় না, উদাস ভঙ্গীতে নিজের পথে চলতে থাকে। কিন্তু আমি জানি, যতই তাকে উদাসীন দেখাক, তার একটি চোখ দুরূহ কোণ থেকেও লক্ষ্য করতে থাকে আক্রমণকারীর প্রতিটি পদক্ষেপ। যে মুহূর্তে সে কেলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার উপক্রম করেছে, সে মুহূর্তেই অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় নিঃশব্দে পাল্‌টা আক্রমণে নির্ভুল লক্ষ্যে কেলো তার কান কিংবা টুঁটি কামড়ে ধরেছে। এই দুটোই কুকুরদের অতি দুর্বল জায়গা। আর কেলোর চোয়াল তো চোয়াল নয়, চাবি-হারানো তালা। বিপক্ষের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ না হওয়া পর্যন্ত তার চোয়াল খুলবে না। তখন অত বুঝতাম না। আজ বুঝি, কেলোর বুনো পূর্বপুরুষের শিকার ধরার ইন্‌স্টিংক্টের জন্যে দায়ী যে জিন, সেটি পূর্ণমাত্রায় সক্রিয় ছিল তার জিনোমে। তা সে যাই হোক, মকরের এক পুণ্য দিনে সে এই বালকটিকে বড়োই দুঃখ দিয়েছিল। আমি অন্য সব লোভী বাচ্চাদের লুকিয়ে তাকে নিয়ে তেঁতুলতলায় গেলাম নারকেলরূপী অমৃত নিয়ে। তারপর সেটিকে ভেঙে সমান দু-ভাগে ভাগ করে একটি ভাগ তাকে খেতে দিয়ে অন্যটি নিজে খেতে শুরু করলাম। আর কেলো সেটিকে শুঁকে, চেটে, ধুলো-মাখামাখি করে ফেলে দিয়ে আমার দিকে লাজুক চোখে চেয়ে রইল। আমি তখন নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছি না। নারকেল কেউ না খেয়ে ফেলে দিতে পারে! আমি চেঁচিয়ে বললাম, -- খা, খা বলছি। কেলো বুঝল, আমি রেগে গেছি। সে একবার পুরো টুকরোটাকেই একদিকের চোয়ালের ভেতর ঢুকিয়ে শ্বদন্ত দিয়ে ভাঙার চেষ্টা করল। আবার পরক্ষণেই সেটাকে উগরে মাটিতে ফেলে দিল। তারপরে আবার আমার দিকে অপরাধীর মতো তাকাল। নারকেল টুকরোর দুর্দশা দেখে আমার কান্না পাচ্ছিল। তারপর টানা তিনদিন আমি কেলোকে আমার কাছে ঘেঁষতে দিইনি। আমার পিছু নিলেই খেজুর ডালের ছিপটি দিয়ে তাকে মেরেছি। তবু সে আমাকে চোখের আড়াল করেনি। খানিক দূরে পেছনের দু-পা মুড়ে পাছার ওপর ভর দিয়ে উদাস চোখে আমাকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছে। এমনকি, প্রতি রাতে আমার বিছানার পাশে শুয়ে থেকে আমাকে সঙ্গ দেওয়ার কর্তব্যও সে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছে। তার মাটির বিছানা এবং দড়ির খাটে আমার বিছানার মধ্যে অবশ্যি থাকত একটি জানালা সহ নিরেট দেওয়াল। বিবেচক কেলো কোনোদিন সেই দেওয়াল টপকানোর চেষ্টা করেনি। সে জানত, সে যদি তার ছায়া দিয়েও আমার বাড়ির শাড়ি-পরা কোনো মনুষ্যকে ছুঁয়ে দেয়, তাহলে কুরুক্ষেত্রীয় কলরব উঠবেই যার জেরে তার বন্ধুর পিঠে চড়-চাপড়ও পড়তে পারে।

তো এ হেন সহিষ্ণু ও বিবেচক কেলোর একটি ভয়ানক গোঁয়ারতুমি ছিল। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেও তার সেই রোগ সারাতে পারিনি। বেড়াল দেখলেই কেলো নিমেষেই এমন এক হিংস্র জানোয়ারে পরিণত হত যে তার তুলনা বন্য প্রাণীদের মধ্যেও পাওয়া যাবে না। কারণ, বন্য প্রাণীদের হিংস্রতা খাবার সংগ্রহ ও এলাকা দখলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু কেলো সম্পূর্ণ অকারণে বেড়ালের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত এবং তার প্রাণটুকু শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে ছাড়ত না। আর আশ্চর্যের কথা, যে-বেড়ালকে আমি কতবার আক্রমণের মুখে প্রবল বিক্রমে রুখে দাঁড়াতে দেখেছি, সে-বেড়ালও কেলোর সামনে পড়ে গেলে যেন নিজের চরিত্র হারিয়ে ফেলত। আমি নিজেও বেড়াল জাতটাকে বিশেষ পছন্দ করতাম না। তবুও তাকে আটকাতে প্রাণ-পণ করতাম। কিন্ত তখন যেন সে অন্য কেলো, আমাকে গ্রাহ্যিই করত না। একবার হল কি, কেলো একটা বেড়ালকে তাড়া করতেই সে সুযোগ পেয়ে একটা নিম গাছে উঠে পড়ল। কেলো কিন্তু হাল ছাড়ল না। সে চুপটি করে গাছের তলায় ধ্যানমগ্ন যোগীর মতো চোখ বুজে বসে থাকল। আমি বহু চেষ্টা করলাম তাকে সেখান থেকে সরিয়ে আনতে। মারধর করেও যখন কোনো কাজ হল না, আমি মুচিপাড়া গিয়ে সব বাড়ি ঢুঁড়ে একজনের বাড়ি থেকে এক টুকরো নুন-হলুদ মাখানো মাংস জোগাড় করে আনলাম। তারা দেবে না কিছুতেই। কেউ জানতে পারলে তাদেরও বিপদ, আমারও বিপদ। সবাই বলত, মুচিরা নাকি গরু মরলে ভাগাড় থেকে তার চামড়া কেটে আনতে গিয়ে বেছে বেছে কিছু মাংসখণ্ডও লুকিয়ে নিয়ে আসে। মুচিরা তা স্বীকার করত না মোটেই। তবে তাদের বাড়িতে প্রায় সারা বছরই শুকনো মাংস মজুত থাকত। এই তথ্যটি আমারই আবিষ্কার, কেলোর সৌজন্যে। মুচিপাড়াটি মূল গ্রাম থেকে বেশ কিছুটা দূরে বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপের মতো থাকত বলে গাঁয়ের লোকেরা তাদের সম্বন্ধে নিশ্চিত করে কিছু জানত না। যা বলত সবই গজব অর্থাৎ গুজব-চরিত্রের। আমাদের বামুন-অধ্যুষিত গাঁয়ের লোকেরা নেহাত ফাঁপরে না পড়লে মুচিপাড়ার ছায়া মাড়াত না। আমাদের মতো উড়নচণ্ডী বালকদের পইপই করে বলে দেওয়া ছিল মুচিপাড়ায় ত্রিসীমানায় না ঘেঁষতে। আর সেজন্যেই বোধ হয় আমি কেলোকে সঙ্গে নিয়ে বেলা-অবেলায় সেখানে ঢুঁ মারতাম। এই করতে করতেই মুচি বালকবালিকাদের সঙ্গে আমার বেজায় ভাব হয়ে গেল। তাদেরই একজন একদিন বড়োদের লুকিয়ে কেলোকে এক টুকরো মাংস দিয়ে আপ্যায়িত করেছিল। তারপর থেকে দেখা গেল, মুচিপাড়ার পথ ধরলে কেলো আমাকে ফেলে এগিয়ে যায়। সেই জ্ঞান থেকেই আমি সেদিন বেড়ালটাকে বাঁচাবার আশায় মাংস দিয়ে কেলোকে যোগভ্রষ্ট করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হায়, মাংস নিয়ে নিমতলায় ফিরে এসে দেখি, কেলো নেই, কিন্তু তার কাজ সারা; বেড়ালটির নিথর দেহ পড়ে আছে গাছতলা থেকে একটু দূরে। কী করে কী হল জানি না। সম্ভবত, গাছের ওপর থেকে লক্ষ্য করে বোকা বেড়াল কেলোকে ঘুমন্ত ভেবে গাছ থেকে লাফ দিয়ে নেমে পালাতে গিয়েছিল। আর কেলো তো সেই অপেক্ষাতেই ছিল, চকিত-লাফে সে বেড়ালের টুঁটি কামড়ে ধরে তার আরব্ধ কাজ সম্পন্ন করে ফেলেছে। এইভাবেই একদিন আমাদের গ্রাম বেড়ালশূন্য হয়ে গেল; আর তার কিছুদিন পরে একদিন কেলো নিজেই অন্তর্হিত হল আমার জীবন থেকে।


সেদিন সকাল থেকেই মেঘঘন আকাশ। মাঝে মাঝে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। কেলো কুণ্ডলী পাকিয়ে ঢেঁকিশালে শুয়ে। আমার মাথায় কী যে ভূত চাপল, কেলোকে ডেকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ঘর থেকে। এই ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে মাঠের কাঁকড়ারা দলে দলে বেরিয়ে আসে গর্ত থেকে। কেলো কাঁকড়া ধরায় ওস্তাদ। গর্তের মুখে কাঁকড়ার আভাস পাওয়া মাত্রই সে ঠিক শিয়ালের ভঙ্গীতে পেছনের দু-পায়ে ভর দিয়ে সামনের পা-দুটি আকাশে তুলে চকিতে মুখ নামিয়ে চেপে ধরে কাঁকড়ার দুই দাঁড়াসহ শরীরের সামনের অংশ। কাঁকড়া খেতেও খুব ভালবাসে কেলো। সে ততদিনে জেনে গেছে তার ধরা কাঁকড়া মানুষরা খায় না। কেলো গুঁড়ি মেরে জমির আলে পেট ঘসটাতে ঘসটাতে সন্তর্পণে এগিয়ে চলেছে একটা গর্তের দিকে। আমি ঠিক তার পেছনে। এমন সময় সেই ভয়ানক ঘটনাটা ঘটে গেল। আমি কিচ্ছুটি টের পাইনি। হঠাৎ কেলো সপাটে পেছন ঘুরে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার গায়ে। আমি ছিটকে পড়লাম জমিতে। আর ধানের চারার ওপর কাদাজলে চিত হয়ে শুয়ে সেই মুহূর্তেই দেখলাম কালো গোখরোর ফনা আছড়ে পড়ল কেলোর মাথায়। আতঙ্কে আমি তখন বিবশ। এমনই দিশেহারা যে উঠতেও পারছি না জমি থেকে। গোখরো ততক্ষণে অদৃশ্য। অস্ফুট কুঁই কুঁই আওয়াজ করতে করতে কেলো নেমে এসে শুয়ে পড়ল আমার পাশে। আমি দেখলাম তার বোজা চোখে আটকে থাকা পিচুটি প্লাবিত করে ফোঁটায় ফোঁটায় গড়িয়ে পড়ছে জল আর তার শরীর থেকে থেকেই থির থির করে কেঁপে কেঁপে উঠছে। আর ওঠেনি কেলো। আমাদের মধ্যিখানের নিরেট দেওয়াল সরিয়ে আমার গায়ে গা লাগিয়ে সেই তার প্রথম ও শেষ শোওয়া।