একজন মেজরের নেতৃত্বে পনের জন জওয়ানের একটি দল চলেছে হিমালয়ের কোন দুর্গম ঘাঁটির উদ্দেশে যেখানে তাদের আগামী তিন মাস থাকতে হবে । এই দলটি ঐ ঘাঁটিতে গিয়ে পৌঁছালে ওখানে যে দলটি আছে তারা ফিরে আসবে অপেক্ষাকৃত কোন নিরাপদ জায়গায় বা তাদের মধ্যে কেউ কেউ যাবে নিজের নিজের বাড়ীতে তাদের আপনজনদের সাথে কিছুদিন কাটাতে । অত্যন্ত দুর্গম পথে রাতের অন্ধকারে প্রাণ হাতে করে কনকনে ঠাণ্ডা এবং মাঝে মাঝে তুষার পাতের মধ্য দিয়ে দলটি এগিয়ে চলেছে নিজেদের গন্তব্যে । হাড় হিম করা ঠাণ্ডায় তাদের শরীর ঠকঠক করে কাঁপছে , চোখ বন্ধ হয়ে আসছে, শরীরের রক্ত বরফ হয়ে যাবার উপক্রম । ইতিমধ্যে তাদের তিন ঘণ্টা হাঁটা হয়ে গেছে, আর যে নড়ে না হাত পা । এই পরিস্থিতে মেজর ভাবছেন এই সময় যদি গরম গরম এক কাপ করে চা পাওয়া যেত, তাহলে কি ভালই না হত । কিন্তু ওই দুর্গম জায়গায় হিমালয়ের কোলে এই রাত্রে ঠাণ্ডার মধ্যে চায়ের কথা স্বপ্নেও ভাবা যায় না । কি আর করা যায় । অগত্যা এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কীই বা করা যায় । হঠাৎ এবং অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে তারা লক্ষ্য করে ওই দুর্গম গিরি পথের ধারে একটা ভাঙাচোরা গুমটি ঘর, চায়ের দোকানের মতই মনে হচ্ছিল । কাছে পৌঁছে গভীর হতাশায় দেখতে পায় ঘরটি চায়েরই দোকান, কিন্তু তালা বন্ধ ।রাত্রি তখন প্রায় দুটো বাজে । ঐ দুর্যোগের রাত্রে দোকানের মালিককে খুঁজে বার করার কথা ভাবাও অবান্তর । মেজর ভাবেন বাড়ী বাড়ী গিয়ে দরজায় কড়া নাড়া নিরাপত্তার দিক দিয়ে কোনমতেই উচিৎ হবে না । তাই তিনি নিরুপায় হয়ে আবার হাঁটা শুরু করার কথাই ভাবছিলেন ।
কিন্তু দলপতির নিরুপায় অবস্থা এবং তার মনের
কথা অনুধাবন করে একজন জওয়ান বলেন ," একটা উপায় কিন্তু আছে "। মেজর অবাক
চোখে তার দিকে তাকিয়ে জানতে চান কী উপায় আছে । সে বলে,
" স্যার ,
যদি অনুমতি দেন তাহলে তালাটা ভেঙ্গে ফেলতে
পারি "। মেজরের তখন দোলাচল অবস্থা । কিন্তু এক কাপ চায়ের কথাও উপেক্ষা করতে
পারছেন না । মনের সাথে অনেক যুদ্ধ করে শেষমেশ তিনি আদেশ দিলেন,
" ঠিক আছে,
তালাটা ভেঙ্গে ফেলো " । জোয়ানরা
দোকানের তালা ভেঙ্গে ফেললো । কী ভাগ্য তাদের, ওটা সত্যিই চায়ের দোকান এবং চা তৈরির সমস্ত
সরঞ্জাম হাজির এবং সাথে কয়েক প্যাকেট বিস্কুটও আছে । সাথে সাথে চা তৈরি হয়ে গেল ।
বিস্কুট সহযোগে চা খাবার পর তাদের শরীরের জড়তা কিছুটা কাটল এবং পরবর্তী আরোহণের
জন্য তারা কিছুটা ইন্ধন পেয়ে গেল । তারা যাত্রার জন্য তৈরি হতে লাগলো ।
কিন্তু অফিসারের মনে বিবেকের দংসন। ভাবছেন,
মালিকের অনুমতি ছাড়া তালা ভেঙ্গে চা বানিয়ে
খেলেন, বিস্কুট খেলেন
অথচ পয়সা দেওয়া হল না । এতো অন্যায়, শাস্তিযোগ্য অপরাধ । তাঁরা তো চোর বা
দুষ্কৃতি নন, তাঁরা
শৃঙ্খলাপরায়ণ সৈন্যদল , দেশ সেবক । তাই কিছু একটা অবশ্যই করা দরকার । এই ভেবে তিনি
পকেট থেকে একটি এক হাজার টাকার নোট বের করে টেবিলের উপর চিনির কৌটো চাপা দিয়ে
রাখলেন যাতে মালিক আসার পর প্রথমেই সেটি দেখতে পান । এখন তার নিজেকে অনেকটা অপরাধ
মুক্ত মনে হতে লাগল ।
দিন যায় , সপ্তাহ যায় , মাস পার হয়ে যায় । যে কাজ নিয়ে এই সৈন্য দলটি
ঐ অতি দুর্গম হিমালয়ের কোলে অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে কর্মরত ছিলেন,
অতি দক্ষতার সাথে সেই কাজ তাঁরা করে
যাচ্ছিলেন । এইভাবে তিন মাস কেটে যায়, এখন তাঁদের ফেরার পালা । মেজর খুবই খুশি যে
তার অধীনস্থ জওয়ানরা এই কটা মাস কোমর বেঁধে শত্রুর মোকাবিলা করেছে এবং অনেক
রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করেও তার দলের কোন ক্ষতি হয়নি এবং প্রত্যেকেই তাঁরা সুস্থ আছেন ।
মনে দারুন আনন্দ এবং তৃপ্তি নিয়ে তাঁদের ফেরা শুরু হল । হাঁটতে হাঁটতে তাঁরা এক
সময় ঐ দোকানে এসে পৌঁছলেন , হ্যাঁ সেদিন দোকানটি খোলা
ছিল এবং দোকানের মালিকও সশরীরে হাজির । অতি
বৃদ্ধ সেই ব্যক্তিকে দেখলেই বোঝা যাবে যে তিনি অত্যন্ত দুস্থ এবং জীবন যুদ্ধে
ক্লান্ত । তবুও তাঁর চোখ দুটি চকচক করে উঠলো , ভাবলেন যাই হক এখন পনের কাপ চা তো বিক্রী হবে
।
তাঁরা সকলে দোকানে বসে চা খেতে খেতে বৃদ্ধকে
তাঁর জীবন, জীবিকা ও জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে এবং এমন একটা দুর্গম জায়গায় চাএর দোকানই বা
কিভাবে শুরু করলেন, এই সব নিয়ে আলোচনা করছিলেন । গরীব,
বৃদ্ধ ওই ব্যক্তি অনেক কাহিনীই শোনালেন যার
প্রতিটি অক্ষরে ভগবানের উপর তাঁর অগাধ ও অপরিসীম বিশ্বাস এবং আস্থা ফুটে উঠলো ।
তিনি বলে চলেন, " ভগবান আছেন, প্রকৃতপক্ষেই আছেন " । তিনি বলেন, " কয়েক মাস আগে আমি তার প্রমাণ পেয়েছি "।
তিনি বলতে থাকেন ,
" অত্যন্ত দুঃসময়ের
মধ্য দিয়ে আমার দিন কাটছিল কারণ আমার একমাত্র ছেলের উপর জঙ্গিরা অকথ্য অত্যাচার
চালিয়ে তাকে নির্মম ভাবে মারধোর করে । তারা আমার ছেলের কাছ থেকে কোন একটা খবর বের
করতে ছাইছিল যা ওর জানা ছিল না । আমি সেদিন তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে ছেলেকে
হাসপাতালে নিয়ে গেছলাম । ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওর জন্য ওষুধ কেনার পয়সাও
আমার কাছে ছিল না । বড় অসহায় লাগছিলো নিজেকে । কোন আশার আলোই দেখতে পাচ্ছিলাম না
চোখের সামনে । চোখের জলে আমার বুক ভেসে যাচ্ছিল । সেদিন আমি হাতজোড় করে ভগবানের
কাছে কাতর প্রার্থনা জানিয়েছিলাম । সত্যি বলতে কি সেদিন ভগবান আমার দোকানে
ঢুকেছিলেন " ।
তিনি আরও বলতে থাকেন ,
" সেদিন আমি ফিরে
এসে দেখি আমার দোকানের তালা ভাঙ্গা । ভেবে নিলাম আরও একটা ভাগ্য বিপর্যয়ের কথা,
নিশ্চয় আমার অনুপস্থিতির সুযোগে কেউ আমার
দোকানের তালা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকে যা কিছু বা অবশিষ্ট ছিল,
সব নিয়ে গেছে । ভিতরে ঢুকে আমি হতবাক । অবাক
বিস্ময়ে চেয়ে দেখি আমার চিনির কৌটোর নীচে একটা এক হাজার টাকার নোট । চোখে জল আর
ধরে রাখতে পারলাম না । ভগবান আমার দুঃখ বুঝেছেন, আমার কাতর প্রার্থনা উপলব্ধি করেছেন । আমি
নিশ্চিত হলাম ভগবান ঐ এক হাজার টাকা আমার দোকানে রেখে গেছেন । আমি তোমাদের বলে বোঝাতে
পারবো না সেদিন ঐ টাকাটা কত অমূল্য ছিল আমার কাছে । ভগবান আছেন,
অতি অবশ্যই আছেন " ।
বৃদ্ধ আরও বলেন ,
" আমি জানি,
আমি দেখতে পাই এখানে প্রতিদিন কত মানুষ মারা
যাচ্ছে । তোমরা অতি ভাগ্যবান, তোমরা সুস্থ শরীরে ফিরে যাচ্ছ এবং অচিরেই তোমরা তোমাদের
প্রিয়জনদের সাথে মিলিত হবে । এ জন্য তোমাদের অবশ্যই ভগবানকে ধন্যবাদ জানানো উচিৎ ।
তিনি আমাদের সবাইকে দেখছেন । তিনি আছেন । ছেলের চিকিৎসা করাতে যে টাকার জন্য আমি
পাগলের মত উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি, সেই টাকাটা আমায় দেবার জন্য দোকানের তালা
ভেঙ্গে ভগবান ভিতরে ঢুকেছিলেন । আমার স্থির এবং দৃঢ় বিশ্বাস তিনি তাই করেছিলেন "।
বৃদ্ধের চোখে মুখে উপচে পড়া বিশ্বাস,
ভগবান আছেন, নিশ্চয় আছেন । প্রশান্তি তে তাঁর মুখখানা
জ্বলজ্বল করে জ্বলছিল । সে এক আবেগঘন পরিবেশ, মনে দাগ কেটে যাওয়ার মত অনুভুতি । পনের জোড়া
চোখ নিবদ্ধ তাঁদের মেজরের চোখে , যে চোখে স্পষ্ট আদেশ " শান্ত থাকো , চুপ থাকো "। এরপর মেজর উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর বিল মিটিয়ে দিয়ে তাঁকে গভীর
আবেগ আর ভালবাসায় আলিঙ্গনাবদ্ধ করে খুব মিষ্টি করে বললেন, " হ্যাঁ, আমি জানি ভগবান আছেন । আর হ্যাঁ, আপনার চাও অতি সুন্দর ও সুস্বাদু "। তাঁদের মেজরের চোখ যে ঝাপসা হয়ে আসছে, পনেরো জোড়া চোখের
তা নজর এড়ায় না । সে এক দুর্লভ মুহূর্ত ।
প্রকৃত সত্য হল এই যে আমাদের মধ্যে যে
কেউ অন্য কারও ভগবান হয়ে উঠতে পারে ।