গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

তাপসকিরণ রায়

ইস্পাত


লোহার শক্ত আধারেই ইস্পাত হয়। আবার লোহা পিটিয়ে কামারের হাপরের জোরে তৈরি হতে থাকে বিভিন্ন আকৃতির হাতিয়ার। 
সমরের জীবনটাও ঠিক এমনি গড়ে পিটে উঠে ছিল। তার মধ্যে অদ্ভুত একটা চুপচাপ ভাব রয়ে গেছে। ছেলেটি যেন বোবা, কিন্তু চেহারা তার ইস্পাত চকচকে। সমরের বাবার নিষ্ঠুর ব্যবহারই হবে সমরকে স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে উঠতে দেয় নি। আর কিছু না হোক যখন তখন শাসনের দণ্ড অন্তত সমরকে সহনশীল মজবুত একটা শরীর দিয়েছে।
বাবার এই হিংসক ব্যবহার কেন ? সমরের মার প্রতি অযথা সন্দেহই এর সবচে বড় কারণ ছিল। 
সমরের শক্ত ইস্পাত দেহ তৈরি হয়েছে। পরিশ্রম আর ক্রমাগত আঘাতের ফলেই বোধহয় সে আজ নিশ্চুপ প্রায়। লক্ষ কথার ওপর হয়ত তার মুখ ফুটে বেরিয়ে আসে একটা দুটো শব্দ ! এটুকু কথাও হয় তো বের হত না যদি না মার স্নেহাদরটুকু তার প্রতি না থাকত। 
তবু টেনে হিঁচড়ে কলেজ পর্যন্ত গিয়েছে সমর। বেশী দিন না হলেও কলেজের বুড়ি সে ছুঁতে পেরে ছিল।  
মূলত এ কাহিনীর শুরু এখান থেকেই। কলেজে প্রবেশের পরেই শুরু হয়ে ছিল তার প্রতি ছেলেদের অবহেলা, হাস্য-বিদ্রূপ, পরিহাস। সুযোগ পেলেই তার পেছনে ছাত্ররা লেগে যেত। বন্ধুহীন হয়ে প্রতিদিন কলেজের শেষ বেঞ্চিতে বসে থাকাই ছিল তার কাজ। 
কলেজের মেয়েরাই বা কম যাবে কিসে ! হাইস্কুল ছেড়ে কলেজের বৃহৎ গণ্ডির অপেক্ষাকৃত মুক্ত পরিসরের দুরন্তপনা তাদের, তাদের কাছে এ যেন স্বাধীন হাওয়ার মুক্তাঙ্গন ! অনেক সময় ওদের লাগাম ছাড়া ইচ্ছেগুলি স্বেচ্ছাচারীর রূপ নিয়ে নেয়। প্রমীলা, বিশাখা, তানির দলও তেমনি। কলেজের হোস্টেলে থেকে ওদের ভাব-ভাবনাগুলি বেশ উদগ্র হয়ে উঠেছিল। প্রমীলা ছিল বড় ডেয়ার ডেভিল। সাহস ও শয়তানিতে উটকো ছেলেদের সে ছাড়িয়ে যেত। ওরা সবাই সমরের পেছনে লেগে থাকত। ওকে ওরা হাঁদারাম, বলে ডাকত।  
সে দিন প্রমীলাদের দল সমরের পেছনে লেগেছিল। শনিবারের কলেজ ছুটি হয়ে গেছে। সমর একলাটি ক্লাস রুমে তখনও গুমসুম বসে ছিল। স্কুলের দারোয়ান এসে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠেছিল, এই যা যা, রুমে তালা লাগাবো--
সমর ধীরে ধীরে তার খাতা বই হাতে তুলে নিচ্ছিল, দারোয়ান চেঁচিয়ে উঠেছিল, যা, বেরো তাড়াতাড়ি, তারপর ধাক্কা মেরে তাকে রুমের বাইরে ঠেলে দিল। সমরের চোখটা মুহূর্তের জন্যে জ্বলে উঠে আবার নিভে গেল। রেগে গেলে এমনি হয়, ক্ষণিকের জন্যে হলেও ওর চেহারা কেমন ধারালো হয়ে ওঠে ! কিন্তু তা মুহূর্তের ঝিলিক মাত্র বলা যায়। না, আহ, কি হচ্ছে, শেষে মেষ এটুকুই হয় তো তার অভিব্যক্তি ! 
কলেজ বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে এলো সমর। ধীরে ধীরে কলেজ চত্বর ধরে হাঁটছে। কলেজের গার্লস হোস্টেলের পাশ দিয়ে এগিয়ে তাকে বড় রাস্তায় উঠতে হবে। মেয়েদের দল পাশটাতেই জটলা করছিল, হবে আগে থেকেই ওরা পরিকল্পনা করে ছিল সমরকে ধরে কিছু রগড় তামাশা করবে বলে ! প্রমীলা হঠাৎ এসে সমরের জামার কলার ধরে বলে উঠলো, কি গো হাঁদারাম, চল না--আমাদের হোস্টেল একবার পরিদর্শন করে যাও না গো ! বিশাখা, তানি ওরা কয়েকজন তাকে তখন ঘিরে নিয়েছে। 
বিশাখা সমরের থুতনি নেড়ে বলে উঠলো, কোথায় যাচ্ছ সোনা, চল আমাদের রুম একবার ঘুরে দেখবে--। মেয়েরা সবাই হেসে কুটিপাটি।
সমর চুপ থাকে। প্রমীলা উচ্ছল প্রগলভ হয়ে বলে ওঠে, এমন শক্ত সমর্থ চেহারা তোমার--কেমন নায়ক নায়ক ভাব আছে--তবু এমন ভিজা বিড়াল হয়ে থাকো কেন বাপ !
পাঁচ, সাতজন মেয়ে তাকে ঘিরে আছে। অবহেলিত, লাঞ্ছিত হচ্ছিল সমর। একটু একটু করে তার মাঝে প্রতিবাদী ভাব জন্ম নিচ্ছিল। কৌতুকের ছোবল তার শরীরে বিদ্ধ হচ্ছিল--বারবার প্রতিশোধের স্পৃহা জেগে উঠেই আবার ঘুমিয়ে পড়ছিল । 
এদিকে হা হা, হি হি হাসির ধুম চলছিল। প্রমীলা সমরের একটা হাত টেনে নিয়ে প্রেমিকার ভঙ্গীতে বলে চলছিল, হে প্রেমিক ! আমি যে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না--তোমায় ছাড়া আমি যে আর বাঁচব না গো ! প্রমীলা জড়িয়ে ধরে আছে সমরকে। এক ভয়ঙ্করী আবেগের অভিনয় চলছিল। আবহ সঙ্গীতে হা হা, হি হি, হু হু হাসির মহড়া চলছিল।
অন্যদিকে জ্বালা যন্ত্রণার একটা ঢেউ ক্রমশ: দীর্ঘ হয়ে হয়ে সমরের বুকের ওপর উঠে আসছিল। বুকের অভ্যন্তরে কামারের হাতুড়ির আঘাত পড়ছিল। তাপমান বোধের তীব্রতা বেড়ে চলেছিল। অপমান বোধের বিন্দু ক্রমশ ছড়িয়ে যাচ্ছিল রক্তের ভেতরে। লোহা ক্রমে ক্রমে ইস্পাতে রূপান্তরিত হয়ে আসছিল। হঠাৎ সমরের রাগ ফেটে পড়ল। প্রমীলার মুখ থেকে, আঃ আঃ, শব্দ বেরিয়ে এলো, এক ঝাঁকুনি খেয়ে তার শরীরটা দুরে ছিটকে পড়ল। প্রচ্ছন্ন ধোঁয়া ভেঙে তখন সমরের লৌহ দেহ ইস্পাত হয়ে গেছে !
প্রমীলা ধুলো ঝেড়ে উঠে এসেছে--মুখে অদ্ভুত এক প্রেমিকা সুলভ হাসি দিয়ে বলে উঠলো, বাবা, আসল হিরো যে ! সমরের গায়ে সামান্য ঠেলা দিয়ে বলে ওঠে, কি রে হিরোমি জেগে উঠছে নাকি তোর ?
আচমকা কলের পুতুল থেকে কথা বেরিয়ে এলো, আয় প্রমীলাহঠাৎ প্রমীলাকে লৌহ হস্তে জড়িয়ে ধরল সমর। সজোরে তাকে চুম্বনের পর চুম্বন দিতে থাকলো। সমরের দেহের মাঝে প্রমীলা নিষ্পেষিত হতে থাকলো। সমরের দেহ বেষ্টনীর শক্ত কাঠামোর মধ্যে থেকে চীৎকার করছে প্রমীলা। ভয়ে মেয়েরা চীৎকার, সোরগোল করে যাচ্ছে। তখন তারা যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়  হয়ে গেছে। তাদের চোখের সামনে এক ধর্ষণ চিত্র স্বপ্নের মত ভেসে যাচ্ছে !
প্রমীলাকে মাটিতে ফেলে রেখে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে সমর। প্রমীলা চীৎকার করছে, ছটফট করছে। এবার হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো প্রমীলা, ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও, প্লীজ, আমি অন্যায় করেছি--প্লীজ...প্লীজ...
গরম ইস্পাতে জল গড়িয়ে পড়ছে--কামারের কাজ পূর্ণ হবার আগেই সমর তার নিজের আকৃতিতে ফিরে আসছে—এত কিছু হয়ে যাবার পরও সমর কিন্তু প্রমীলার দেহ বিদ্ধ করেনি।  
এবার প্রমীলাকে ছেড়ে নির্বিকার উঠে দাঁড়ালো সমর, আর নির্বাক হেঁটে চলল বড় রাস্তার দিকে...
সমাপ্ত