গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

সাঈদা মিমি / দুটি গল্প

কুতুরুন্নেসা বানু এবং ভাকু সদাগর

কুতুরুন্নেসা বানুর হাঁস মুরগিগুলো বড়ই পরিপুষ্ট, তেল চকচকে বছরকাবারী ডিম খেয়ে, বেঁচে, হাতে জমা বেশ ভালোই থাকে এসব তার না করলেও চলে, স্বামী ভাকু সদাগর মস্ত ব্যাবসায়ী, টাকার অভাব নেই তিনজন কাজের মানুষ, গাছপালা ঘেরা বিশাল বাড়ি, দুই ছেলে, সুখ তার অঙ্গে অঙ্গে ভাবতরঙ্গে
সে যখন জন্মেছিলো, তখন ওয়া করে কান্নার পরিবর্তে কোঁ কোঁ শব্দ করে উঠেছিলো, সেই থেকে তার এমন ছন্নছাড়া নাম তারপর বিয়ের পরে পড়লো আজদাহা পরিবারে, পাঁচ দেবর, চার ননদ! কুতুরুন্নেসার কোঁ কোঁ গেলো হাপানীর মত বেড়ে দেবরদের কেউ বিয়ে করে আলাদা হলো, ননদদের বিয়ে হলো সে দুই ছেলের মা হলো এবং ভাকু সদাগর আলাদা বাড়ি কিনে বৌ বাচ্চাদের নিয়ে খুলনা শহরে স্থায়ী হলো
যদিও তার সদাগরী ব্যাবসা, বাড়িতে আসে মাসে দুইবার কুতুরুন্নেসা একাকীত্ব ভুলতে হাঁস-মুরগী, গাছগাছালী নিয়ে ব্যস্ত থাকে, নিয়ম মেনে কাজের মানুষদের সাথে প্রবল চেচামেচি করে, ছেলেদের পিটুনি দেয় এবং সবশেষে কাঠের চেয়ারে বসে কোঁকায়
ভাকু সদাগরের সমান অংশীদার লেকু মুন্সি, খুবই ধূর্ত লোক, ভাকু তাকে দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকে, জানে, লেকু ঠিকই কাজ উঠিয়ে আনবে দুইজনের বন্ধুত্বও মজবুত আর সেই সূত্র ধরেই কিনা লেকু সদাগরের কালিগঞ্জের বাড়িতে ভাকুর যাতায়াত
লেকুর কালোমতন কুশ্রী চেহারার যে বোনটির বিয়ে হয়নি, সে ভাকু সদাগর কে বড়ই যত্নাদি করে ভাকুও ভাবে, আহা রে, কেবল কালো কুচ্ছিত বলে মেয়েটার বিয়ে হচ্ছে না! কে বিয়ে করবে? সে নিজেই কখনও এই জিনিস ঘরে তুলতে রাজি হবে না
তারপর পরের সপ্তাহ এলো, খুলনায় যাওয়া হলো না ভাকুর লেকু অনুনয় করে পড়েছে, 'দোস্ত, আমার সাথে কালিগঞ্জে চল, সাবেরার একটা বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে, যত টাকা লাগুক, এবার ওকে পার করবই মানবিক আবদার, ভাকু গেলো
সবাই রাতের খাবার খাচ্ছে, সাবেরা কে দেখা যাচ্ছে না, হয়তো লজ্জা নিয়ে কোথাও লুকিয়ে আছে সে খাওয়া শেষে খানিক গল্প সেরে, পান খেয়ে, শুতে গেলো ভাকু, কামরায় ঢুকে দরজার খিল লাগিয়ে দিলো, ডাসা ও
কুতুরুন্নেসা কে মনে পড়লো তার, আহা, এখন বৌ কে বুকে নিয়ে ঘুমাতে যাওয়ার কথা ছিলো!!! খাটের দিকে এগিয়ে যেতেই ভাকুর ওপর ঝাপিয়ে পড়লো সাবেরা... 'না, না, আপনে আমার এত বড় সর্বনাশ কইরেন না...!! কোনমতে দরজা খুলে বের হয়ে আসতেই চোখ কপালে উঠলো ভাকুর দরজার সামনে লেকু, তার বাবা-মা, ভাইয়েরা বউসহ, তিন বোন এবং বোনের জামাইয়েরা এতক্ষণে সবকিছু পরিস্কার হয়ে উঠলো ভাকুর কাছে কাজিসায়েব এলেন, পাড়াপ্রতিবেশীরা এলো, ভাকু বর সাজলো
সন্ধ্যা পার হয়েছে অনেকক্ষণ ছেলেদের পড়াতে বসে মন দিতে পারছে না কুতুরুন্নেসা তার বুকের মধ্যে কেবলই কুকপক্ষী ডেকে যাচ্ছে

একটি পেশেন্ট বেডের আত্মকাহিনী

নিন, শুয়ে পড়ুন, আমি হাতুড়ি দিয়ে আস্তে টোকা দেবো, যেখানে ব্যথা প্রবল অনুভূত হবে, সঙ্গে সঙ্গে জানাবেন ডাক্তার সাহেব কাজে লেগে পড়লেন, পেশেন্ট কিঞ্চিত আতংকিত সন্দেহ করা যাচ্ছে রোগী কয়েকবার বাতজ্বরে ভুগেছিলো
রোগাভোগা যে দুজন এলো, একজন তরুণ, আরেকজন যুবক কেবল রোগাই নয়, মুখের পেশিতে ঝুলে পড়া দাগ, কোটরাগত লাল চোখ, চারপাশে শিরা জেগে আছে, এরা দুই ভাই সারাদিন কারখানায় কাজ করে, রাতে বাসায় ফিরে রান্না - খাওয়াl এরপর তারা মরার মত ঘুমায় না, কারণটা বড় লজ্জার নারীবর্জিত জীবন কিসব প্রয়োজনে দুইজন সমকামী হয়ে গেছে এই সমস্যার সমাধান আমার কর্ম নয় ডাক্তার সাহেব পেশেন্ট বেডে এদের চেকাপ করে সমাধান দেবেন
এক তরুণী এসেছিলো তার স্বামীকে নিয়ে, সে গর্ভপাত করাতে চায়, ডাক্তার সাহেব যেন শারীরিক দূর্বলতা সহ আরও কারণ দেখিয়ে একটা কাগজ লিখে দেন! হতভম্ভ ডাক্তার ব্যাপারটা বুঝে ওঠার পর হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন, এটা গাইনির সমস্যা, আর আপনারা এসেছেন মেডিসিনের ডাক্তারের কাছে! দম্পতির বিবিধ-বিচিত্র কান্না শুনে তিনি একজন গাইনি ডাক্তারের নাম লিখে কাগজটা ধরিয়ে দেন ওদের কৃতজ্ঞতাবশত স্বামীটি একটি তথ্য দিয়ে যায়, তারা মূলত স্বামী স্ত্রী নয়, ঢাকা শহরে সিংগেল বাসা না পেয়ে দুইজন একত্রে থাকে দম্পতি পরিচয়ে একই কারখানায় কাজ করে তাই সখ্যতা একটু বাড়াবাড়ি রকমের নেক্সট বেলে চাপ দেয়ার আগে ডাক্তার মশায় খানিক ভাবুক হয়ে পড়েন, আহা, কি সমৃদ্ধ জীবন ওদের!!
বুড়ি মানুষটা এসে সোজা পেশেন্ট বেডে সটান, -আপনার সমস্যা তো বলেন আগে? -কোন সমস্যা নাই বাজানl বুড়া মানুষ, দুইমাইল হাইট্টা জিরানের যাগা পাইনাই আমনের সামনের ঘরে বইয়া এট্টু ঝিমাইছি, এইহানে কাইত হইয়া আরাম লাগতাছে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ডাক্তার চেয়ারে বসে পড়েন এমন হলে তিনি ডাক্তারী ভুলে যাবেন, রোজগারপাতি শেষ
আজ অনেক রোগী ছিলো রাত নয়টা পর্যন্ত কোন অবকাশ মেলেনি ফাতরা লোকের আনাগোনা ছিলো না অষুধ কোম্পানী আর ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকেও লোক এসেছিলো পকেট এখন ঝলমল করছে এতক্ষণে ক্লান্তিটা টের পাওয়া গেলো, বাসায় ফেরার আগে পেশেন্ট বেডে শুয়ে পড়লো সে, একটু জিরিয়ে নেয়া যাক চোখটা মুদে এলে আজকের তরুণী পেশেন্টের কথা মনে পড়লো, কানে না শুনলেও চোখের ভাষা সে ভালোই বোঝে

[ বিঃ দ্রঃ ডাক্তারদের নীচু করার জন্য এই লেখা নয় আমাদের শহরে প্যারামেডিক পাশ একজন ছিলেনl সবাই তাকে ডাকতো ডকরছাব তার কথা মনে করে অথবা তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে ]