গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

কসাই


 রে এ সাবন, এ পওবন ...আ যা, আ যা বেটা, আরে এ পবনিয়া’ ----একটা ছাগল বাচ্চাকে একহাতে ধরে বাকী দুটো  ছাগল  বাচ্চাকে  একটা দড়িতে বেঁধে টানতে টানতে গোয়ালে ঢোকালো ছগন। তার একটাই ঘর। লম্বা টানা  মাটির ঘর, খাপরার চাল। উপরে ভাঙ্গা টিন ইঁট চাপা দিয়ে রেখেছে। মাঝে খাপরা কোথাও কোথাও ভেঙ্গে গেছে, বৃষ্টির জল আটকাতে এই ব্যবস্থা। ইয়ে টিনা ভি ছৌধুরী সাহাবকা পুরানা মকান সে মিললো, তব না! নইলে এই ভরা  বর্ষায় ছগনের যে কি হাল হত!     
লম্বা টানা ঘরটাকে লোকে বলে ছগনের গোয়াল। বোলনে দো, বোলনে সে পয়সা নহী লগতা। এই ঘরেই থাকে  তিনটে  ছাগল, একটা গাই, চারটে মুরগী আর ছগনের পেয়ারের নেড়িকুত্তার বাচ্চা, শাহজাদা। তাদের একপাশেই ঘরের কোনে ছগনের শোবার জায়গা। পিয়ারীলাল, ছগনের জিগরি দোস্ত, মাঝে মাঝেই বলে--আরে এ ছগনবা, ই তেরা কা হাল হ্যায় রে, তু ভি গাই বন গয়া, ক্যা ? তোহার জরু কিধর রইব?’  
ছগন উত্তর দেয় না। তার সামর্থ্য কোথায়? তবে সে এখন অন্য ধান্ধা করছে। গাইটাকে বেচে দেবে। দো পয়সা  আয়েগা, অউর ইস পয়সা সে দো খাসি ভি খরিদ করবে। ই মহল্লা মে বহুত ধুমধাম সে কালি মাঈকি পূজা আছে, সব পূজা চড়াবে তো খাসি কিনবে, বলি দিবে। যানে কা ওয়াক্ত বাবুলোগসে ছগনকা ভি পরসাদি মান্‌স মিলতা। মাঝে মাঝে ছগনেরও মাংসভাত হয়ে যাবে।  
ছগনের আগে সাতটা খাসি ছিল। ছোট ছোট চারটে বিক্রি করে দিয়েছে। ইসমে বহুত পয়সা মিলতা। গাই বেচবে, বদলামে অউর দো খাসি  খরিদ তো করবে, গাই ভি বেচবে, লেকিন শা...লা দারু সব পয়সা  টেনে  লিচ্ছে। ঘরে কেউ নেই। এক আউরত চাহিয়ে। আউরত বিনা ঘর শুনা ভি অউর দেখনেওয়ালা ভি কোই তো চাহিয়ে, নহি তো হিসাব-কিতাব বেকার হোইয়ে যাবে। সব কা আউরত মিলতা, খালি ছগন কা বরাত মে নহি। রাতের অন্ধকারে গরু, ছাগলের সঙ্গে একঘরে শুয়ে শুয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছগন।
(২)
সকালবেলায় রোদ উঠেছে। আজ ছগনের কপালেও রোদ। সাত সকালেই মুনিরাম এসে হাজির। কথায় কথায় গাই বেচবার অভিলাষ জানিয়েছিল মুনিরামকে। মুনিরাম রাজি। তারই দর-দাম করতে ছগনের গোয়ালে এসে হাজির। ছগন তখন সবে গাই-ছাগলকে ঘরের সামনে একফালি উঠোনে এনে বেঁধেছে, খানিক পরে মাঠে ছেড়ে আসবে। মুনিরাম এসে হাঁক দেয়...আরে, এ ছগনবা...কঁহা হো?  
একথা সেকথার  পর গাইয়ের কথায় আসে।
হাঁক পাড়ে ছগন---পুরা পঁচ্চিস হাজার, এক পয়সা ভি না কম! 
মুনিরাম কুড়িতে থমকে আছে। শেষে অনেক কথা চালাচালি, ঈষৎ রাগারাগি, থোড়ি বহুত গালি ভি...তারপর মুনিরামও রাজি, তো ছগন ভি। বাইস্‌ হাজারে ছগন রাজি হয়। পুরা বাইস্‌ হাজার গুনে গুনে দিতে হবে মুনিরামকো ছগনকে লিয়ে।  কাল সকালে এসে পহেলে পয়সা দিবে অউর ফির গাই লিয়ে যাবে  মুনিরাম। ছগনের চোখে বিজলি বাত্তি, মনেও বিজলি, রামনবমীর মেলাতে দেখা বিজলিরাণী মনের ভিতরে  উঁকি মেরে যায়। গাই বেচবে, পয়সা হবে, বিজলিরাণী আসবে...ছগন মনে মনে লিস্টি বানিয়ে ফেলে। দো নহি, তিন খাসি খরিদ করবে সে, ছোটা ছোটা খাসি, তিন তিন হাজার। তো তিন খাসি মে নো হাজার, আচ্ছা দস্‌ হাজার। বাকি পাঁচ মে এক  ঘর বানাবে ছগন,  শা লা...গাই-খাসি কে সাথ অউর না রইবে। বাকি আভি তো রুপেয়া হ্যায় না! ইস্‌ পাঁচ  হাজার মে ...মনে মনে খুশিতে ডিগবাজি খেল ছগন। বাকি পাঁচ হাজার দিয়ে সে বিজলিরাণিকে নিয়ে আসবে।কেয়া আউরত, একদম চোস্ত! ঘর মে ভি বিজলি জ্বলেগি। কিন্তু তারপরেও তো রুপেয়া  থাকবে...আর কি করবে ভেবে পায়  না ছগন। গাইটার দিকে তাকিয়ে একবার গলায় হাত বুলিয়ে দিল---তু হমার লছমি আছিস রে...একদম  লছমি, সচ্‌মুচ্‌ লছমি! চল, তোকে আজ নিজের হাতে ঘাস-খাওয়াব। গাইটাকে আদর করে সংসারের কাজে মন দিল ছগন। এখন সকালে অনেক কাজ। গোয়াল পরিষ্কার করা, রান্না করা,আরো  কত কি! মনের মধ্যে খুশিটা লেগে রইল।
(৩)
সকাল গেল, দুপুর গেল। সন্ধ্যে হল। গাই, ছাগল, মুরগী, সবগুলোকে একে একে গোয়াল ঘরে ঢোকালো  ছগন। নেড়িকুত্তার বাচ্চাটাকে দেখতে না পেয়ে তু-তু করে ডাক দিল, পায়ে পায়ে তার আদরের শাহজাদা  এসে হাজির হল একেবারে কোল ঘেঁসে। হঠাতই কোল থেকে নেমে কুঁইকুঁই আওয়াজ ভুলে যেন জোরে  ডাক দেবার চেষ্টা করল কুত্তাটা। ব্যাপার কি, বেটা  চিল্লাতা কিঁউ? ঘরের বাইরে এসে ছগন দেখল মুনিরামের সঙ্গে দুটো লোক এসে দাঁড়িয়েছে তার ঘরের সামনে। একজন বদরুদ্দিন, আর একজনকে সে চেনে না। ব্যাপার কি, মুনিরাম আবার কি বলতে চায়! কি যেন একটা আশঙ্কা ছগনের মনের মাঝে উঁকি  দিয়ে গেল। সামলে নিয়ে মুনিরামকেই জিজ্ঞেস করল ছগন---- কা রে মুনিরাম, কা  হইল, কুছ হুয়া , কেয়া? ‘
উত্তর দেয় বদরুদ্দিন, তারা গাইটাকে নিতে এসেছে।
--ই সাম কা টাইম মে, কিঁউ?’ কিন্তু বদর কেন, তাকে তো সে গাই বিক্রি করেনি। বদরুর সঙ্গে এই নিয়ে কোন কথা নয়। মুনিরাম বলুক, সে তার সঙ্গে কথা বলবে, বদরু নহি। কিন্তু মুনিরাম চুপ, একটি কথাও তার মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে না। বদরুও চীৎকার করে---কিঁউ নেহি, আল্‌বাত বলবে! মাগনা নহি, পয়সা দেকে খরিদ করছি, অউর উ ভি পুরা পঁচ্চিস্‌ হাজার, কিঁউ নেহি বোলেগা? মুনিরাম কো পয়সা গিন গিনকে দিয়ে, পুছো উসে...। কাল সুবহ এক হোটেল মে খানাপিনা হ্যায়, মুঝে টাইম নহি মিলেগা,আভি ইয়ে গাই চাহিয়ে, সাহাব লোগোঁকা খানাপিনা কি বন্দ্‌বস্ত করনা হ্যায়...মুঝে ভি তো কাম হ্যায়! পয়সা দিয়া, হমে ভি সামান চাহিয়ে।
ছগনের মনে সন্দেহ ঘনিয়ে আসে। গাই কিজন্য খরিদ করছে? কোই ফালতু মতলব তো নহি! মুনিরাম কে সে দেবে না গাই।
--শা...লা মুনিরাম,হরামি কা বাচ্চা,...গাই বেচবি খানে কে লিয়ে অউর বোলে কি বাচ্চা দুধ পিবে...ঝুটা  আদমী! নহি বেচেগা...চল্‌ ভাগ হিঁয়াসে...।রাগে আগুন হয়ে  মুনিরামকে ধাক্কা মারে ছগন।
রাতের অন্ধকারে এক হাতে শাহজাদাকে কোলের কাছে নিয়ে গাইটার গলায় হাত বোলাতে বোলাতে বিড়বিড় করে ছগন----তু না যাইয়ো , তু মেরা লছমি রে... । হামি খাসি বেচব, পয়সা করব, বিজলিকে ভি আনব, ...তু দেখতে যা, হম গাই বেচনে বালা নহি হ্যায় রে...। 

সেদিন সারা রাত ছগন দারু খেল। টাকার দুঃখে না বিজলির দুঃখে, নাকি লছমিকে বিক্রির দুঃখে ঠিক বোঝা গেল না। সকাল হতে না হতেই গাইটাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল হাটে, বেচবে বলে।