মন্দিরাকে
খুব বিচলিত দেখাচ্ছে । সারা ঘরে পায়চারি করছে, যেন গভীর কোন সমস্যায় পড়েছেন, বেরোবার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছেন না । একটু আগে একটা
ফোন এসেছিল । তাঁর পরেই এই অস্থিরতা । এমনিতে খুব সুখী সচ্ছল পরিবার । স্বামী সুশান্ত
একলাখী কর্পোরেট এক্সিকিউটিভ, সে নিজেও সমাজের বেশ কেউকেটা – মহিলা সমিতির
সম্পাদক। মহল্লার মান্যিগন্যি মানুষ, পাড়ার ক্লাবের পূজোয় মোটা অঙ্কের চাঁদা দেন ।
একমাত্র ছেলে বুবুন শহরের নামি ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ে । এহেন
মন্দিরাকে বেশ বিচলিত দেখায় । যেন যা হবার নয় তাই ঘটে গিয়েছে । যেন কেউ ষড়যন্ত্র
করে তাঁর জীবনে একটা ওলটপালট ঘটিয়ে দিয়েছে । খুবই বিচলিত মন্দিরা ।
সকালে
একটা ফোন এসেছিল । তারপর থেকেই অন্য কোন কাজে মন নেই । একটা হেস্তো-নেস্তো করতেই
হবে, এখনই । কাজের ছেলে শক্তিকে ডাকলেন, জিজ্ঞাসা করলেন বুবুনকে কখন স্কুল থেকে
আনতে যাবে । শক্তি অবাক, এরকম জিজ্ঞাসা তো কখনো করেনা মন্দিরা । শক্তি বলে “সে কি
দিদি, এখনতো সবে সাড়ে দশটা । “দাদাবাবুকে তো আনতে যাবো সাড়ে এগারোটায় । মন্দিরা আর
কিছু বলে না । আপনার কি শরীর খারাপ দিদি” ? ধমক দিলো মন্দিরা “ বেশি কথা বলিস না,
এককাপ চা দিয়ে যা” ।
শক্তি চা দিয়ে
গেলো । কোন ভ্রুক্ষেপ নেই মন্দিরার । ফোনের রিসিভার তুললো মন্দিরা । “ হ্যালো,
সুশান্ত রায়ের সঙ্গে কথা বলবো । কি ? ব্যস্ত আছেন ? রাবিশ । বলুন ওনার স্ত্রী মন্দিরা
কথা বলবে । ফোনটা ধরে সুশান্ত । মন্দিরার কন্ঠস্বরে দুনিয়ার উদ্বেগ । ‘হ্যালো
সুশান্ত ? আজ কি হয়েছে জানো ? মারাত্মক ব্যাপার। বুবুন ..., আরে না না শরীর
খারাপের ব্যাপার নয়, অন্য ব্যাপার । কি বললে, ব্যস্ত আছো ? তাতো থাকবেই, নাহলে অত
টাকা মাইনে দিয়ে কোম্পানী তোমাকে পুষবে কেন ? হ্যাঁ, হ্যাঁ কাজের কথাই তো বলতে
চাইছি । শুনবে তবে তো । কি বললে ? পাঁচ মিনিট পরে ফোন করবে ? বেশ তাই করো, দরকারি
কথা আছে, তোমার ছেলের কীর্তি ... ততক্ষণে ফোনটা রেখে দিয়েছে সুশান্ত । আওয়াজ করে
ফোনটা রাখে মন্দিরা নিজের মনেই বলে ‘ডিসগাস্টিং, ফিরিঙ্গি মেয়ে পি এ টার সঙ্গে কথা
বলার সময় হয় আর আমার সঙ্গে কথা বলতেই দুনিয়ার ব্যস্ততা’ !
মিনিট পাঁচেক
পরে টেলিফোন বাজে । ফোন তোলে মন্দিরা । হ্যা বলছি । মন দিয়ে শোন , আজ স্কুলে বুবুন
কি করেছে জানো ? আরে না না কি যা তা বলছো , মারপিট করেনি, বুবুন কি সে রকম ছেলে
নাকি ? আহা, শুনবে তবে তো । ডোন্ট ইন্টারাপ্ট । বুবুনের কীর্তিটা শোন । স্কুলে
টাস্ক দিয়েছিল রাইট এ প্যারাগ্রাফ অন লাঙ্গুয়েজ ইউ প্রেফার , বুবুন লিখেছে আই লাভ
মাই মাদার টাং । মোদের গরব মোদের আশা, আমরি বাংলা ভাষা এই সব ট্র্যাস । তুমি হাসছো
? এটা হাসির ব্যাপার ? ওদের স্কুলের প্রিন্সিপাল মিসেস মাথুর আমাকে ফোন করেছিলেন,
জানতে চাইলেন কোথা থেকে এসব শিখছে ? না না সুশান্ত , এটা সাধারণ ব্যাপার নয়। আমাদের
সব স্বপ্ন চূরমার হয়ে যাওয়ার সিম্পটম। লাষ্ট ইউনিট টেস্ট’এ বুবুন নন্দিতার ছেলের চেয়ে দু
নম্বর কম পেয়েছে তুমি জানো না ? কেন পেল ? কি এমন চাকরী করে নন্দিতার হাসব্যান্ড ?
স্কুলে কি আমাদের চেয়ে বেশি ডোনেশন দেয় ? দৃশ্যত ক্ষিপ্ত মন্দিরা, একনাগাড়ে বলে
চলে । টেলিফোনের অন্য প্রান্ত থেকে সুশান্তর কন্ঠ – ‘ঠিক আছে আমি বাড়ি গিয়ে সব
শুনবো । বুবুন ফিরে আসুক’
।
মন্দিরা
থামতেই চায় না বলে – কি বললে, বিচলিত হবার মত কিছু হয়নি ? না না, তুমি ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবোনা,
তার আগেই সব ব্যবস্থা করবো । ঐ যে ম্যাথসের মাষ্টার, শুনেছি, বাংলা কবিতা লেখে, কি
যেন নাম ব্যানার্জী না কি, ওকে ফোন করে কাল থেকে আসতে মানা করে দিয়েছি, বলেছি কাল
এসে পুরো মাসের মাইনাটা নিয়ে যেতে । মিসেস গোমেজ রাজী হয়েছেন । কাল থেকে
বুবুনকে পড়াবেন মিসেস গোমেজ ।
ফোনটা
রেখে অস্থির ভাবে পায়চারি করতে লাগলো মন্দিরা । কাজের ছেলে শক্তিও মন্দিরার
অস্থিরতা লক্ষ্য করেছে । মন্দিরা শুধোয় কোথায় যাচ্ছিস শক্তি ? বুবুনকে স্কুল থেকে
আনতে যাচ্ছে শক্তি । মন্দিরা জানে, রোজ শক্তি ঠিক এই সময়েই বুবুনকে আনতে যায় ।
শক্তি অবাক হল ‘বুবুনকে আনার সময় হ’ল তো দিদিমণি’ । ‘ও যা’ শুধু এইটুকুই বললো
মন্দিরা । শক্তি পা বাড়ায় । মন্দিরা আবার ডাকে শক্তিকে । বলে - আচ্ছা শক্তি বুবুনকে
পড়ানোর সময় ওর ঘরে তুইতো যাস যাস তো মাজে মধ্যে
?
হ্যা, চা দিতে
যাই তো । জানেন দিদিমনি, বুবুনের স্যার খুব ভালো গান গায়, আমি শুনেছি পাড়ার ফাংসনে
।
রাগ চড়ে যায়
মন্দিরার, বলে তোকে এতো কথা বলতে কে বলেছে ? যে কাজে যাচ্ছিস যা । মন্দিরা নিশ্চিত
হয় । এ তবে ব্যানার্জী ছেলেটার কাজ । গান গায়, কবিতা লেখে । ওইই বুবুনের মাথাটা
খাচ্ছে ওকে বাংলা শিখিয়ে !
শক্তি
যায় । আরো অস্থির হয় মন্দিরা । বুবুনের পড়ার ঘরে যায়, ওর খাতাপত্তর পাতা উলটে দেখে
। পড়ার বই ছাড়া অন্য বইগুলোও ঘাঁটে মন্দিরা । না, কোন বাংলা বইএর নামগন্ধ তো নেই ।
মন্দিরার কিনে দেওয়া ইংরাজি কমিকস বইগুলোই রয়েছে । তবে ? ডোর বেল বাজে । শক্তি
ফিরলো বুবুনকে নিয়ে । বুবুন ‘মাম্মি’ বলে ঘরে ঢুকলো । তার মা কেমন অস্থিরভাবে
পায়চারি করছে । বুবুনের ডাকে সাড়া না দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো ‘হোয়াট হ্যাপেন্ড টুডে ইন
ইওর ক্লাস’ ? বুবুন হকচকিয়ে যায়, বলে ‘কিছু হয়নি তো মাম্মি’ ।
‘দেখি ইংরাজি
খাতাটা দাও’ । দেখলেন । ইংরাজির শিক্ষিকা মিসেস মাথুর লাল কালিতে লিখেছেন ‘গার্জেন
টু বি কনসালটেড’ ।
খাতাটা ফেরত দিয়ে জানতে চাইলো ‘কে ? কে
শেখাচ্ছে এই সব ? আমরি বাংলা ভাষা, রাবিশ ! এসব তোমার কোন বইতে আছে ?
বুবুন
কিছু বুঝতে পারে না । বলে ‘বইএ কেন থাকবে মাম্মি ? দাদু বলেছে । জানো মাম্মি দাদু
কত গল্প বলে । সেদিন বলছিল নিজের মাতৃভাষায় কথা বলার জন্য নাকি লড়াই করতে হয়েছিল,
এইসব’ । মন্দিরা
ধমক দিল বুবুনকে । থামো, যাও পড়ার ঘরে যাও ।
হতবাক,
দৃশ্যত ক্রুদ্ধ মন্দিরা সোফায় বসে পড়লো । যেন তার সমস্ত স্বপ্ন, ভরসা চুরমার হয়ে
গেছে ।
ঘরের ভেতর থেকেই এই ষড়যন্ত্র, তার স্বপ্ন চূরমার করে দেবার ! বছর দুএক আগে বুবুনের
দিদা মারা যাবার পর মন্দিরা আর একসঙ্গে থাকতে চায়নি । রীতিমত ঝগড়া অশান্তি করে
সুশান্ত রাজি হয়েছিল বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে চালান করতে । বুবুনের দাদুও মেনে
নিয়েছিলেন, কেননা তিনি বুঝেছিলেন এই সংসার থেকে সরে না গেলে তাঁর ছেলের জীবনটাই
বীষময় করে দেবে মন্দিরা । তবে সুশান্ত একটা শর্ত দিয়েছিল মন্দিরাকে প্রত্যেক
রবিবার বুবুনকে নিয়ে কয়েক ঘন্টা কাটিয়ে আসবে ওর দাদুর সঙ্গে । মন্দিরা মেনে
নিয়েছিল । সেই মেনে নেওয়াই কাল হল । নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হচ্ছে মন্দিরার ।
ফোন ঘোরায়
মন্দিরা । সুশান্ত ধরে । মন্দিরা বলে চলে –
শোন, বুবুন আর
প্রত্যেক সপ্তাহে ওর দাদুর কাছে যাবে না , আমি এলাউ করবো না । কি করেছেন ? উনিই তো
যত নষ্টের গোড়া । বুবুন বললো, যত সব রাবিশ ওর দাদুই নাকি শেখাচ্ছে ওকে । বুবুনকে আর আমি ওর
দাদুর কাছে পাঠাতে পারবো না । না না, তা হয় না বললে চলবে না । বুবুন তো তোমারও
ছেলে নাকি ? আবার জিজ্ঞাসা করছো কি করেছেন তোমার বাবা ? বুবুনের ইংরাজি খাতায় আমরি
বাংলা ভাষা লিখতে শেখাচ্ছেন, আর তুমি নির্বিকার ? দেখো , সোসাইটিতে মন্দিরা সেনের
একটা স্ট্যাটাস আছে, তার ছেলেকে বাংলা শিখিয়ে স্কুল মাস্টারি করানোর ফন্দি করবেন
তোমার বাবা এটা আমি মেনে নেবো না, বুবুনের দাদুর কাছে যাওয়া বন্ধ করবো । কি ?
সম্পর্ক ছেদ ? একে যদি তোমার বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ বলো তাই হোক । কি? আমি
বাড়াবাড়ি করছি ? আমি মানসিকভাবে অসুস্থ্য ?
ফোনের
ওপারে সুশান্ত একটু রুঢ় হয়েছিল মনে হয় । ক্ষিপ্ত, উত্তেজিত মন্দিরা রিসিভারটা ক্রেডলে
রাখতে পারলো না । হাত থেকে খসে ঝুলে রইলো । ঝুলে থাকা রিসিভারে সুশান্তর শেষ কথাটা
শোনা গেলো ‘ রক্তের ঋণ বোঝ ? চোখের আড়ালে গেলেই কি রক্তের ঋণ শোধ হয়ে যাবে ? হয় না
। রক্তের ঋণ শোধ হবার নয়’ । আমি পারিনি, বুবুন সেই ঋণ শোধ করছে ।
বিধ্বস্থ
মন্দিরা সোফায় বসে পড়লেন ।