গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

রক্তের ঋণ

মন্দিরাকে খুব বিচলিত দেখাচ্ছে । সারা ঘরে পায়চারি করছে, যেন গভীর কোন সমস্যায় পড়েছেন, বেরোবার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছেন না একটু আগে একটা ফোন এসেছিল । তাঁর পরেই এই অস্থিরতা । এমনিতে খুব সুখী সচ্ছল পরিবার । স্বামী সুশান্ত একলাখী কর্পোরেট এক্সিকিউটিভ, সে নিজেও সমাজের বেশ কেউকেটা – মহিলা সমিতির সম্পাদক। মহল্লার মান্যিগন্যি মানুষ, পাড়ার ক্লাবের পূজোয় মোটা অঙ্কের চাঁদা দেন । একমাত্র ছেলে বুবুন শহরের নামি ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ে । এহেন মন্দিরাকে বেশ বিচলিত দেখায় । যেন যা হবার নয় তাই ঘটে গিয়েছে । যেন কেউ ষড়যন্ত্র করে তাঁর জীবনে একটা ওলটপালট ঘটিয়ে দিয়েছে খুবই বিচলিত মন্দিরা ।
সকালে একটা ফোন এসেছিল । তারপর থেকেই অন্য কোন কাজে মন নেই । একটা হেস্তো-নেস্তো করতেই হবে, এখনইকাজের ছেলে শক্তিকে ডাকলেন, জিজ্ঞাসা করলেন বুবুনকে কখন স্কুল থেকে আনতে যাবে । শক্তি অবাক, এরকম জিজ্ঞাসা তো কখনো করেনা মন্দিরা । শক্তি বলে “সে কি দিদি, এখনতো সবে সাড়ে দশটা । “দাদাবাবুকে তো আনতে যাবো সাড়ে এগারোটায় । মন্দিরা আর কিছু বলে না । আপনার কি শরীর খারাপ দিদি” ? ধমক দিলো মন্দিরা “ বেশি কথা বলিস না, এককাপ চা দিয়ে যা” ।
শক্তি চা দিয়ে গেলো । কোন ভ্রুক্ষেপ নেই মন্দিরার । ফোনের রিসিভার তুললো মন্দিরা । “ হ্যালো, সুশান্ত রায়ের সঙ্গে কথা বলবো । কি ? ব্যস্ত আছেন ? রাবিশ । বলুন ওনার স্ত্রী মন্দিরা কথা বলবে । ফোনটা ধরে সুশান্ত । মন্দিরার কন্ঠস্বরে দুনিয়ার উদ্বেগ‘হ্যালো সুশান্ত ? আজ কি হয়েছে জানো ? মারাত্মক ব্যাপার। বুবুন ..., আরে না না শরীর খারাপের ব্যাপার নয়, অন্য ব্যাপার । কি বললে, ব্যস্ত আছো ? তাতো থাকবেই, নাহলে অত টাকা মাইনে দিয়ে কোম্পানী তোমাকে পুষবে কেন ? হ্যাঁ, হ্যাঁ কাজের কথাই তো বলতে চাইছি । শুনবে তবে তো । কি বললে ? পাঁচ মিনিট পরে ফোন করবে ? বেশ তাই করো, দরকারি কথা আছে, তোমার ছেলের কীর্তি ... ততক্ষণে ফোনটা রেখে দিয়েছে সুশান্ত । আওয়াজ করে ফোনটা রাখে মন্দিরা নিজের মনেই বলে ‘ডিসগাস্টিং, ফিরিঙ্গি মেয়ে পি এ টার সঙ্গে কথা বলার সময় হয় আর আমার সঙ্গে কথা বলতেই দুনিয়ার ব্যস্ততা’ !
মিনিট পাঁচেক পরে টেলিফোন বাজে । ফোন তোলে মন্দিরা । হ্যা বলছি । মন দিয়ে শোন , আজ স্কুলে বুবুন কি করেছে জানো ? আরে না না কি যা তা বলছো , মারপিট করেনি, বুবুন কি সে রকম ছেলে নাকি ? আহা, শুনবে তবে তো । ডোন্ট ইন্টারাপ্ট । বুবুনের কীর্তিটা শোন । স্কুলে টাস্ক দিয়েছিল রাইট এ প্যারাগ্রাফ অন লাঙ্গুয়েজ ইউ প্রেফার , বুবুন লিখেছে আই লাভ মাই মাদার টাংমোদের গরব মোদের আশা, আমরি বাংলা ভাষা এই সব ট্র্যাস । তুমি হাসছো ? এটা হাসির ব্যাপার ? ওদের স্কুলের প্রিন্সিপাল মিসেস মাথুর আমাকে ফোন করেছিলেন, জানতে চাইলেন কোথা থেকে এসব শিখছে ? না না সুশান্ত , এটা সাধারণ ব্যাপার নয়। আমাদের সব স্বপ্ন চূরমার হয়ে যাওয়ার সিম্পটমলাষ্ট ইউনিট টেস্ট’এ বুবুন নন্দিতার ছেলের চেয়ে দু নম্বর কম পেয়েছে তুমি জানো না ? কেন পেল ? কি এমন চাকরী করে নন্দিতার হাসব্যান্ড ? স্কুলে কি আমাদের চেয়ে বেশি ডোনেশন দেয় ? দৃশ্যত ক্ষিপ্ত মন্দিরা, একনাগাড়ে বলে চলে । টেলিফোনের অন্য প্রান্ত থেকে সুশান্তর কন্ঠ – ‘ঠিক আছে আমি বাড়ি গিয়ে সব শুনবো । বুবুন ফিরে আসুক’
 ।
মন্দিরা থামতেই চায় না বলে – কি বললে, বিচলিত হবার মত কিছু হয়নি ?  না না, তুমি ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবোনা, তার আগেই সব ব্যবস্থা করবো । ঐ যে ম্যাথসের মাষ্টার, শুনেছি, বাংলা কবিতা লেখে, কি যেন নাম ব্যানার্জী না কি, ওকে ফোন করে কাল থেকে আসতে মানা করে দিয়েছি, বলেছি কাল এসে পুরো মাসের মাইনাটা নিয়ে যেতে । মিসেস গোমেজ রাজী হয়েছেন কাল থেকে বুবুনকে পড়াবেন মিসেস গোমেজ ।

ফোনটা রেখে অস্থির ভাবে পায়চারি করতে লাগলো মন্দিরা । কাজের ছেলে শক্তিও মন্দিরার অস্থিরতা লক্ষ্য করেছে । মন্দিরা শুধোয় কোথায় যাচ্ছিস শক্তি ? বুবুনকে স্কুল থেকে আনতে যাচ্ছে শক্তি । মন্দিরা জানে, রোজ শক্তি ঠিক এই সময়েই বুবুনকে আনতে যায় । শক্তি অবাক হল ‘বুবুনকে আনার সময় হ’ল তো দিদিমণি’ । ‘ও যা’ শুধু এইটুকুই বললো মন্দিরা । শক্তি পা বাড়ায় । মন্দিরা আবার ডাকে শক্তিকে । বলে - আচ্ছা শক্তি বুবুনকে পড়ানোর সময় ওর ঘরে তুইতো যাস যাস তো মাজে মধ্যে ?
হ্যা, চা দিতে যাই তো । জানেন দিদিমনি, বুবুনের স্যার খুব ভালো গান গায়, আমি শুনেছি পাড়ার ফাংসনে ।
রাগ চড়ে যায় মন্দিরার, বলে তোকে এতো কথা বলতে কে বলেছে ? যে কাজে যাচ্ছিস যা । মন্দিরা নিশ্চিত হয় । এ তবে ব্যানার্জী ছেলেটার কাজ । গান গায়, কবিতা লেখে । ওইই বুবুনের মাথাটা খাচ্ছে ওকে বাংলা শিখিয়ে !

শক্তি যায় । আরো অস্থির হয় মন্দিরা  বুবুনের পড়ার ঘরে যায়, ওর খাতাপত্তর পাতা উলটে দেখে । পড়ার বই ছাড়া অন্য বইগুলোও ঘাঁটে মন্দিরা । না, কোন বাংলা বইএর নামগন্ধ তো নেই । মন্দিরার কিনে দেওয়া ইংরাজি কমিকস বইগুলোই রয়েছে । তবে ? ডোর বেল বাজে । শক্তি ফিরলো বুবুনকে নিয়ে । বুবুন ‘মাম্মি’ বলে ঘরে ঢুকলো । তার মা কেমন অস্থিরভাবে পায়চারি করছে । বুবুনের ডাকে সাড়া না দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো ‘হোয়াট হ্যাপেন্ড টুডে ইন ইওর ক্লাস’ ? বুবুন হকচকিয়ে যায়, বলে ‘কিছু হয়নি তো মাম্মি’ ।
‘দেখি ইংরাজি খাতাটা দাও’দেখলেন । ইংরাজির শিক্ষিকা মিসেস মাথুর লাল কালিতে লিখেছেন ‘গার্জেন টু বি কনসালটেড’ ।  খাতাটা ফেরত দিয়ে জানতে চাইলো ‘কে ? কে শেখাচ্ছে এই সব ? আমরি বাংলা ভাষা, রাবিশ ! এসব তোমার কোন বইতে আছে ?

বুবুন কিছু বুঝতে পারে না । বলে ‘বইএ কেন থাকবে মাম্মি ? দাদু বলেছে । জানো মাম্মি দাদু কত গল্প বলে । সেদিন বলছিল নিজের মাতৃভাষায় কথা বলার জন্য নাকি লড়াই করতে হয়েছিল, এইসব’মন্দিরা ধমক দিল বুবুনকে । থামো, যাও পড়ার ঘরে যাও ।

হতবাক, দৃশ্যত ক্রুদ্ধ মন্দিরা সোফায় বসে পড়লো । যেন তার সমস্ত স্বপ্ন, ভরসা চুরমার হয়ে গেছে ঘরের ভেতর থেকেই এই ষড়যন্ত্র, তার স্বপ্ন চূরমার করে দেবার ! বছর দুএক আগে বুবুনের দিদা মারা যাবার পর মন্দিরা আর একসঙ্গে থাকতে চায়নি । রীতিমত ঝগড়া অশান্তি করে সুশান্ত রাজি হয়েছিল বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে চালান করতে । বুবুনের দাদুও মেনে নিয়েছিলেন, কেননা তিনি বুঝেছিলেন এই সংসার থেকে সরে না গেলে তাঁর ছেলের জীবনটাই বীষময় করে দেবে মন্দিরা । তবে সুশান্ত একটা শর্ত দিয়েছিল মন্দিরাকে প্রত্যেক রবিবার বুবুনকে নিয়ে কয়েক ঘন্টা কাটিয়ে আসবে ওর দাদুর সঙ্গে । মন্দিরা মেনে নিয়েছিল । সেই মেনে নেওয়াই কাল হল । নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হচ্ছে মন্দিরার ।

ফোন ঘোরায় মন্দিরা । সুশান্ত ধরে । মন্দিরা বলে চলে –
শোন, বুবুন আর প্রত্যেক সপ্তাহে ওর দাদুর কাছে যাবে না , আমি এলাউ করবো না । কি করেছেন ? উনিই তো যত নষ্টের গোড়া । বুবুন বললো, যত সব রাবিশ  ওর দাদুই নাকি শেখাচ্ছে ওকে । বুবুনকে আর আমি ওর দাদুর কাছে পাঠাতে পারবো না । না না, তা হয় না বললে চলবে না । বুবুন তো তোমারও ছেলে নাকি ? আবার জিজ্ঞাসা করছো কি করেছেন তোমার বাবা ? বুবুনের ইংরাজি খাতায় আমরি বাংলা ভাষা লিখতে শেখাচ্ছেন, আর তুমি নির্বিকার ? দেখো , সোসাইটিতে মন্দিরা সেনের একটা স্ট্যাটাস আছে, তার ছেলেকে বাংলা শিখিয়ে স্কুল মাস্টারি করানোর ফন্দি করবেন তোমার বাবা এটা আমি মেনে নেবো না, বুবুনের দাদুর কাছে যাওয়া বন্ধ করবো । কি ? সম্পর্ক ছেদ ? একে যদি তোমার বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ বলো তাই হোক । কি? আমি বাড়াবাড়ি করছি ? আমি মানসিকভাবে অসুস্থ্য ?

ফোনের ওপারে সুশান্ত একটু রুঢ় হয়েছিল মনে হয় । ক্ষিপ্ত, উত্তেজিত মন্দিরা রিসিভারটা ক্রেডলে রাখতে পারলো না । হাত থেকে খসে ঝুলে রইলো । ঝুলে থাকা রিসিভারে সুশান্তর শেষ কথাটা শোনা গেলো ‘ রক্তের ঋণ বোঝ ? চোখের আড়ালে গেলেই কি রক্তের ঋণ শোধ হয়ে যাবে ? হয় না । রক্তের ঋণ শোধ হবার নয়’ । আমি পারিনি, বুবুন সেই ঋণ শোধ করছে ।
বিধ্বস্থ মন্দিরা সোফায় বসে পড়লেন ।