পানু
জন্মাবধি দেখে আসছে রেললাইনের ধারে ঘিঞ্জি এই বস্তিটাতে তার সকাল থেকে রাত কাটাবার
এই বাঁধাধরা ছক – যে ঘরে ওরা থাকে তার আয়তন জনা দশেক মানুষ পরিমান। একটা মাপমত
তক্তপোশ কোনঠাসা করে দেওয়ালের সাথে লাগান, সেই ঘরেই আর এক কোনায় রান্না। বাকি সামান্য
কিছু আসবাব – যা না হ’লেই নয় এমন ধরনের। এই সংসারে রোজগেরে বলতে বাবা আর মা।
আহামরি কিছু রোজগার যে হয় না তা বুঝতে আর বাকি
নেই বছর বারো এই ছেলেটার। পড়াশুনার ইতি ঘটেছে তার ইতিমধ্যেই, বোনটা অবশ্য এখনও
যাচ্ছে করপোরেশান ইস্কুলে। তবে সেও আর কতদিন সে নিয়ে তার বেশ সন্দেহ আছে। সবচেয়ে
যেটা পানুকে ইদানীং ভাবিয়ে মারে তা হ’ল বাবার ভাব গতিক, সে বেশ বুঝতে পারে তাকেও
রোজগারের জন্যে কোথাও একটা জুতে দেবার তালে আছে তার বাবা। কিন্তু নিত্য নতুন ইচ্ছেরা
উত্যক্ত করে মারে পানুকে অন্য কিছু একটা করে দেখাবার জন্য।
অনিশ্চিত
এমন একটা জীবন, যেখানে বাবা মায়ের পথ অনুসরণ করা মানে একই যাপনের কাটা রেকর্ড বেজে
চলা। এ সংসারে পানু এক ব্যতিক্রম। এইটুকু বয়সেই সে বাস্তব কে নিজের মত করে বুঝতে
শিখে গেছে বেশ। স্বপ্ন কিছু কিছু দেখতে শিখেছে সে এর মধ্যেই। এ অবস্থা থেকে মুক্তি
পেতে সে জানে, স্বার্থক হোক না হোক, স্বপ্ন কিছু তাকে দেখতেই হবে। সে এদিক ওদিক
ঘোরাফেরা করে সজাগ মন নিয়ে। স্টেশ্ন রোডের ভিতর দিকটায় শাড়িতে জড়ির কাজ করে
কতকগুলো লোক, সেখানে গিয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে, একমনে দেখে ওদের কাজ। লোকগুলো
ওকে প্রথমে তেমন পাত্তা না দিলেও, ধীরে ধীরে কেমন মায়া পড়ে যায় ওর ওপর। এক বুড়ো
চাচা ছিল ওদের মধ্যে, তারই দোকান। তবে সে মালিক হয়েও নিজে হাতে কাজ করে বাকী
কর্মচারীদের সঙ্গে। সে একদিন পানুকে ডেকে
নিয়ে পাশে বসায়। বলে – হ্যাঁরে তুই হা ক’রে হরবক্ত কি দেখিস রে? আমাদের এই কাম
তোর আচ্ছা লাগে? পানু চাচার দিকে চেয়ে ঘাড় নেড়ে জানায় যে টান টান করা রং-বেরঙের
শাড়ির ওপর জড়ির ফুলতোলা কাজ দেখতে ওর খুব ভাল লাগে। চাচা হেসে বলে – বহুত খুব।
একদিন একজন ওকে ডেকে বলে – তুই পড়াশুনা করিস না। থাকিস কোথায়? পানু জানায় - ওই
লাইনের ধারে বস্তীতে থাকি আমরা। পড়াশুনা করতাম আগে, এখন আর করি না। চাচা একদিন
হঠাৎ পানুকে জিজ্ঞাসা করে – শিখবি এই কাম? পানু তো ভাবতেই পারেনা ওর মত একটা ছোট্ট
ছেলেকে এরা কাজ শেখাবে। হাতে চাঁদ পাওয়ার মত অবস্থা তার। সে বলে – আমাকে শেখাবে? আমি
পারব? তখন একজন পাশ থেকে বলে ওঠে – কেন পারবি না?
চাচা শিখিয়ে দেবে।
তবে
তোর বাবাকে একবার লিয়ে আসতে হবে। কি রে লিয়ে আসবি তো?- চাচা পানুকে বলে।
পানু
বাড়ি ফিরে মাকে পুরো ঘটনাটা বলে। মার তো বিশ্বাস ই হয় না। এই একরত্তি ছেলে বলে কি?
কে জানে আবার কোনও কুচক্রে গিয়ে পড়বে কিনা!
পানু তবু মাকে বোঝায় – না মা, ওরা আমাকে খুব ভালবাসে। ওরা কি সুন্দর জড়ির
কাজ করতে জানে গো মা! ওরা বলেছে আমাকে ওরা
এ কাজ শেখাবে। মা কে চুপ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে, মার গলা জড়িয়ে ধরে
প্রচণ্ড আবদার ক’রে বলে – তুমি শুধু বাবাকে একটু রাজী করাও। ওরা বাবাকে নিয়ে যেতে
বলেছে যে!
রাতে
পানুর বাবাকে সমস্ত কিছু বলল তার মা। পানুর বাবা মুখে না প্রকাশ করলেও ভিতরে ভিতরে
একটা আশার আলো দেখতে পেল যেন। ভাল ভাবেই জানে পানুকে আবার পড়াশুনা করাবে এমন আশা
একেবারেই ক্ষীণ। তবু যদি অল্প বয়সে কোনও হাতের কাজ শিখতে পারে, মন্দ হয় না। সে
মুখে বলে – ঠিক আছে আমি যাব ওকে নিয়ে সেখানে। দেখাই যাক না ভাগ্যে কি আছে? মায়ের
মনে তবু যেন কোথায় একটা সন্দেহের দানা বেঁধেই থাকে, যদিও তা নিয়ে আর বিশেষ কিছু আর
বলে না তখনকার মতো।
পরের
দিনই বেলাবেলি পানু তার বাবাকে নিয়ে সেই জড়ি-মহল্লায় গিয়ে হাজির। চাচা ওদেরকে দেখে
আদাব জানাল পানুর বাবাকে, ভিতরে নিয়ে গেল দুজনকে। আপনার বেটা পানু? – চাচা ওর
বাবাকে জিজ্ঞাসা করে - বেটার আপনার এই কাজে খুব দিলজস্বি আছে। আপনার নাম?
বিরু
– পানুর বাবা উত্তর দেয়।
তা
আপনি কি কোরেন?
একটা
সাইকেলের দোকানে কাজ করি।
বেটাকে
যদি আমরা শিখিয়ে লিই, ও খুব ভাল কাম করবে এ লাইনে, উমিদ্ আছে আমার। কোই ইতরাজ্
তো নহি আপকা?
না
তা নেই, তবে ছেলের আমার পড়াশুনা বেশিদূর হয়নি। পারবে তো?
এ
কামকাজে পড়াই এত লাগে না, সবসে যাদা জরুরত আছে দিমাগ্ কা। বেটার আপনার সেটা বেশ
ভালই আছে। তবে ওর উমরটা একটু কম, আভি আভি উস্কো কাম মে লগানা ঠিক নহি হোগা। লেকিন
কাজ শিখতে গেলে এটাই ঠিক উমর। যদি রাজী থাকেন, ওকে ইখানে পাঠিয়ে দিবেন, আমি নিজে
ওকে সব শিখিয়ে লেব। আওর হাঁ ! কুছ রুপয়া- পয়সা ভি মিলেগা উনকো, ছোটা-মোটা কুছ কাম
তো উসসে করওয়ানা হি পড়েগা।
আপনি
নিজে যখন এত সদয় ওর ওপর, ও ঠিক পারবে হাতের কাজ শিখে নিতে – বিরু আবেগতাড়িত গলায়
বলে।
তো
কাল থেকেই পানুকে ইখানে পাঠিয়ে দিবেন। - ব’লে চাচা বিরুর হাতে এক ভাড় চা এগিয়ে
দেয়, - আসুন আমরা একটু চা পিয়ে লি।
চাচাকে
কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয় বিরু আর পানু।
বিরু
ও তার বৌ মোটামুটি বেশ খুশিই হ’ল। পুরো
কৃতিত্বটাই যে পানুর নিজের চেষ্টায় তা ভেবে মনে মনে খানিক গর্বই হ’ল। পানুও এক
নতুন আনন্দে মশগুল হয়ে রইল সারা রাত। বোনকে ও বেশ রঙ চড়িয়ে ওর নতুন কাজের গল্পোও
শোনাল সেদিন। দাদা শাড়ির দোকানে জড়ির কাজ শিখবে, ওর কাছে যেন স্বপ্নের চেয়েও
সুন্দর মনে হল।
এমনটাই
ছিল পানুর বরাত খুলে যাওয়ার প্রাথমিক কাহিনী। পানু এরপর থেকে নিয়মিত সে দোকানে
যাওয়া শুরু করল। চাচা সযত্নে তাকে হাতে ধরে জড়ির কাজের খুটিনাটি শেখাতে শুরু করল।
প্রথম দিকে পানু ওদের কাজ গুছিয়ে রাখত দিনের শেষে, বাইরের টুকিটাকি ফাই-ফরমাইস্
খাটত। তবে এতে পানুর কোনও রকম খারাপ লাগত না কারণ দোকানের যে মালিক - চাচা তাকে
নিয়ে একদম নিজের পাশে বসিয়ে সূঁচের ফোঁড় কেমন কায়দা করে দিতে হয়, হড়হড়ে পিচ্ছিল
সিল্কের শাড়ীগুলোকে কিভাবে ফ্রেমে টানটান করে বেঁধে নিতে হয়, সরু সরু জড়ি আর চুমকি
কিভাবে সাজাতে হয় নক্সা অনুসারে – এমন সব সুক্ষ্ম কাজ ওর মাথায় ঢুকিয়ে দিল চাচা কত
অনায়াসে। প্রথম দিন থেকেই পানুকে চাচার বেশ পছন্দ হয়ে গিয়েছিল, সেটা দোকানের বাকি
কর্মচারীদের বুঝতে বাকি রইল না। চাচার সামান্য অনুপস্থিতিতে অনেকেই পানুকে নিয়ে
রগড়াতে ছাড়ত না। তারা বলত – বেটা তোর বরাত খুবই ভাল বলতে হবে। তুই তো পাকা
ওস্তাদের নেক্নজরে পড়ে গেছিস। চাচা এত সহজে কাউকে চ্যালা বানায় না, তোকে তো
পাক্কা চেলা বানিয়ে নিয়েছে। তোর আর চিন্তা কি? বড় কারিগর বনে যাবি তুই, দেখিস।
লেগে থাক।
এসব
জটিল ব্যাপার তার মাথায় খুব একটা ঢুকত না। তবে এটা সে বেশ বুঝতে পারত চাচা ওকে
বড্ড স্নেহ করে। কাজও শেখায় বড় যত্ন করে। তাই সে নিজের সবটা উজার করে দিত চাচার
জন্য, সে কাজ শেখায় হোক, বা চাচার যে কোনও হুকুম তামিলেই হোক।
রাতে
মাকে রোজ গল্প করে পানু ওর এই স্বপ্নযাত্রার রোজনামচা। মা এই ভেবে খুশি হয় যে
ছেলেটা কাজ করে মনের আনন্দে, কোন জবরদস্তি বা চাপে নয়। বিরু কে সে বলে – ঠাকুরের
অশেষ দয়া, দেখো ছেলেটা কে আমরা পড়াশুনা করাতে পারলাম না বটে, তবে ও যে কাজ শেখার
সুযোগ পেয়ে গ্যাছে, আমাদের মত ঘরে কজন পায় ?
বিরু
সব শোনে বউ এর মুখে, মনে মনে খুশি যে হয় না তা নয় – মুখে সে প্রকাশ করে কম। শুধু
বলে – দ্যাখো, ওর কপালে কি আছে!
কপালে
হাত দুটো ঠেকিয়ে পানুর মা পাশ ফিরে শোয়।
বছর
পাঁচেক সময় কেটে গেল। মেয়েটা ক্লাস এইটে পড়ে। ইতিমধ্যে পানুকে চাচা কাজে বেশ পোক্ত
করে তুলেছে আর তার জন্য মাস মাইনেও বরাদ্দ করেছে চাচা। দোকানে একদিন বিরু গিয়েছিল
ছেলে কাজে কতটা মুরুব্বি হয়েছে নিজের চোখে দেখতে। গিয়ে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। দ্যাখে ছেলেটা আর
পাঁচটা কর্মচারীর মতই নিজে একটা গোটা শাড়ি নিয়ে বসে নিজের মনে কি সুন্দর জড়ি আর
চুমকির কাজ ফুটিয়ে তুলছে। বিরুকে দেখতে পেয়ে চাচা একগাল হাসি হেসে তাকে ভিতরে
ডাকে। বলে – দেখ্কে যাইয়ে, বেটা আপ্কা কিস্ তরহা কাম শিখ লিয়া। বিরু কৃতজ্ঞতার
এক তৃপ্ত হাসি হেসে চাচাকে বলে – সবই তো আপনার দয়ায়, চাচা! চাচা প্রতিবাদী সুরে
বলে ওঠে – কভী নহি ভাই সাব! আল্লা মেহেরবান। দোয়া যদি করেন তো উস্নে হি কিয়া!
বেটা ভি আপনার বহত্ কাবিল হ্যাঁয় ইস্ কামকে লিয়ে।
চাচা
আপনি একদিন আসুন আমাদের গরীবখানাতে। আপনি মানুন আর না মানুন, আপনি আমাদের কাছে ভগবান
– বিরু বলে চাচার উদ্দেশ্যে।
হামে
শরমিন্দা মত কিজিয়ে। বেটার আপনার শিখবার মন আছে, ও তো হামার পহেলা দিন সে হি মালুম
থা। এখোন ও খুব ভাল কাজ শিখে লিয়েছে।
বিরু
বেরিয়ে এল চাচার দোকান থেকে। সারা পথ বিরু ভগবানকে ধন্যবাদ দিতে দিতে এল। ছোটবেলা
থেকে ছেলেটা যদি একটু অন্য রকম না হোতো তাহলে এই বাজারে ওকেও হয়ত গতর খেটে
উপার্জনের পথ বেছে নিতে হ’ত – বিদ্যা তো কেবল ক্লাস এইট পর্যন্ত। কিন্তু পানু এখন
যে কাজ রপ্ত করে নিয়েছে, কজনে তা পারে! ভাবতে ভাবতে কখন যেন নিজেদের বস্তির
দোরগড়াতে এসে পৌঁছে যায়। নিজের অদৃষ্টকেই যেন জিজ্ঞাসা করে সে দিন কি বদলাবে এবার?
পানু
এখন একজন বড় মাপের পাকা কারিগর। একদিন সে চাচার কাছে জানতে চায় – চাচাজী, এই এত
সুন্দর সুন্দর রঙ্গীন জড়ি কোথা থেকে আসে? কোথায় তৈরী হয় এসব। অন্য
কেউ হ’লে চাচা নিশ্চয়ই রাগ করত, কারণ এ লাইনটাই এমন, কাজ শিখে সব ফুরুৎ হওয়ার তাল
খোঁজে। আরও টাকা কামানোর ধান্দায়। কিন্তু চাচা জানে পানু সে ধাতের নয়, তা ছাড়া ওর
বয়সই বা কি? ও জানতে চায় নিজের জানার খিদেয়, কোনও বদ মতলবে নয়। চাচা ওকে আদর করে
সামনে টেনে নিয়ে বলে যে সুরাট বলে একটা জায়গা আছে গুজরাতে। ওখানে এইসব তৈরী হয়
অনেক। পানুর চোখে তখন অগাধ বিস্ময়- এতদিন জড়ির কাজ করে খুব ভালবেসে ফেলেছে এই নানা
রঙের তন্তুগুচ্ছকে। ও যখন কোনও নক্শা তোলে দামী দামী সিল্কের শাড়ির পরে, কোনও
কুর্তার গলায়, বুকে, পিঠে – ও যেন ওর মানসচক্ষে সব রাজকুমার, রাজকুমারীদের দেখতে
পায়, যাদের পরনে এই সব রাজকীয় জড়ির পোশাক।
জড়ির জৌলুষ ওর চোখে মায়া ধরায়। কিন্তু নিজের জন্য কোন লোভ তার নেই, চাচা তা
বিলক্ষণ বুঝে গেছে।
কি
রে বেটা, জানা হ্যাঁয় সুরাট, অপনা আঁখোসে দেখ্না চাহতে হো? – চাচা পানুকে বলে।
পানুতো আর আগের মত ছোটটি নয়। সাবধান হয়ে যায়, চাচা রাগ করবে ভেবে বলে – না চাচা,
এমনি জানতে চাইলাম। আমি তোমার কাছেই বেশ আছি।
কেনো
রে, শখ্ যায় না তোর? আমাদের এতো খাটনির মূলধন এই জড়ি কাঁহাকা ধন হ্যাঁয়, একবার
যাবি নাকি রে দেখতে? – চাচা নিজে থেকেই পানুকে বলে। পানুর স্বপ্ন রাজ্য বিশাল,
সবটাই প্রশস্ত খোলামেলা, দিগন্ত বলে কিছু নেই। সে টপ করে বলে বসল চাচাকে – যাবে,
যাবে গো আমাকে নিয়ে?
চাচা
বলতে শুরু করে আবার – না রে, হমারা যানা মুশকিল্ আছে, তুই যাবি কি না সোচ্কে
বতা, উধার জান-পয়চান আদমী বহত আছে, আওর উনমে
সে বহত হ্যাঁয় জিনকো ইস্সে জিয়াদা বড়া কারবার হ্যাঁয়, এহি জড়িকা কাম।
বাবা
মাকে বলে দেখতে হবে চাচা।
হাঁ,
হাঁ, আলবৎ বলবি। ওয় লোগ না বোলে তো, হম্ ভি পাঠাবে না।
আজই
আমি বলব, কিন্তু চাচা, তুমি রাগ করবে না তো। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি...সে দেশ দেখে
আমি আবার ফিরে আসব।
আওর
শুন্, বাবাকে বলবি রুপয়া ভি উধার ইখান থেকে অনেক, অনেক জিয়াদা মিলবে। চাচা
নিজের
মনেই হাসে। এই বয়সে তার এটুকু বুঝতে বাকি থাকে না যে পাখি একবার উড়ে গেলে খাঁচায়
সে ফিরে আসে না কোনদিন। তবে চাচা এটাও জানে এই ছেলেটা আর সবার থেকে অন্যরকম। এর
চোখে চতুর লোভের কোনও ছায়া পড়ে নি, ওর নিজের বুকে জমানো স্বপ্নরা ওকে দৌড় করিয়ে
বেড়ায়। এটা বয়সের ধর্ম। তাই চাচা মনে মনে ভেবে নেয়, সুরাটে ওর যে দোস্তের বড়
কারবার আছে এই জড়ি আর চুমকির কাজের, একটা চিঠি দিয়ে পানুকে পাঠালে, ও পানুকে
ফেরাবে না – তার কাজ দেখলে তো আরও নয়। চাচা বলে – শুন বেটা এতো বাত তুই বাবাকে
বলতে পারবি না, একদিন তু মুঝে লে চল্ তেরা ঘর।
তুমি
যাবে ওস্তাদজী? কালই তোমাকে নিয়ে যাব আমাদের বস্তিতে – পানু খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ে।
ওস্তাদজী ডাকটা সে অন্য কর্মচারীদের মুখে সব সময় শোনে বলে নিজেও কখনো সখনো চাচাকে
ওই নামে ডেকে ফেলে।
রাতে
পানু বাবা-মা কে জানায় চাচা আসতে চেয়েছে তাদের বাড়ি। বিচক্ষণ ছেলে ইচ্ছে করেই
উদ্দেশ্যটা চেপে রেখে দিল। তাছাড়া চাচাজী ই তো বলেছে যে সে বাবা-মাকে এত কথা
বুঝিয়ে বলতে পারবে না। বাবা-মা খুশীই হ’ল খুব তবে বিরুর বউ তো খানিক ভাবনাতে ও পড়ে
গেল ছেলের অফিসের মালিক – সে আস্লে কিভাবে কি আপ্যায়ন করবে তাই ভেবে।
পানু
পরদিন বিকেলবেলা তার ওস্তাদজীকে নিজেদের বাড়ি নিয়ে চলল। বিরুও সেদিন তাড়াতাড়ি বাড়ি
ফিরে এল। পানুর মা যতদুর সম্ভব ঘরটাকে একটু দুরস্ত করে রেখেছিল। চাচাকে নিয়ে পানু
বাড়িতে এসে পৌঁছোতেই বিরু তাকে ঘরের ভিতর নিয়ে বসাল। চাচা হেসে বিরুকে বলে - পহেলে আপ ইয়ে বতাইয়ে,
ক্যায়সে হ্যাঁয় আপলোগ।
ভাল
আছি আপনাদের আশীর্বাদে। ছেলেটার একটা গতি করে দিলেন আপনি, আমরা এখন অনেক নিশ্চিন্ত
– বিরু জানায়।
চাচার
মুখে এক তৃপ্তির হাসি লক্ষ্য করে বিরু। ইতিমধ্যে পানুর মা দু-গ্লাস ঘোলের সরবত এনে
রাখে তাদের সামনে। বিরু চাচাকে বলে – নিন, সরবতটুকু খেয়ে নিন। চাচা সরবতে প্রথম
চুমুক মেরে এবার বলা শুরু করে – শুনুন, হামি আজ আরও একটা সুখবর দিতে এসেছি। বেটা
আপনাদের এত ভালো কাজ শিখেছে, ওর ঠিক দাম ইখানে কেউ দিবে না। হামার দোস্ত গুজরাটে
থাকে। ওর বহত্ বড়া কারোবার হ্যাঁয় সিখানে। জড়ির কাজ, নক্শার কাজ, আরো বহত্
কিসিম্ কা কারোবার। হামি চাই, বেটা ওর বেওসায় কুছ দিন কামমে লাগ যায়ে। অওর ভাল
কাম শিখবে ও। হামি ওকে উখানে পাঠাতে চাই। আপলোগো কা মত হোনা চাহিয়ে।
কিন্তু
ও তো এখনও খুবই ছোট, একা একা অতদূরে থাকতে পারবে? – মনের উৎকণ্ঠা গলায় ঝরে পড়ে
বিরুর। চাচা হেসে মাথা ঝাকায়। বলে – এহি তো উমর হ্যাঁয় ভাইসাব, তরক্কি করনে
কা। উখানে গেলে ও আরও দাম পাবে। পয়সা ভি
ইহা সে বহ্ত বহ্ত জিয়াদা মিলেগী। উসকো আপ ভেজ্ দিজিয়ে, না মত্ কহনা! বেটা কা
কই তকলিফ্ হোবে না। হামি পাঠাচ্ছি, বেটার দেখভালের কোনো কমি নহি হোগা, দেখ্
লিজিয়ে গা।
বিরু
ওর বউ এর দিকে তাকায়। তখন পানুর মা আর থাকতে না পেরে বলে ওঠে – চাচাজী, ও আমাদের
একটাই ছেলে। ও অতদূরে গেলে আমাদের ভাল লাগবে না।
ঠিকহি
বলেছেন, লেকিন কুছ দিনকা বাদ সব ঠিক হো যায়েগা। বেটা বহ্ত বড়া হোগা ইয়ে সোচ্কে
তো আপলোগো কো ইতনা কর্না হি পরেগা।
বিরু
তখনকার মতো সামাল দিতে বলে – চাচাজী, একটু সময় দিন ভাবার। তারপর জানাব। আপনি যে
আমার ছেলেটা কে এত ভালবাসেন, সে আমাদের বড় সৌভাগ্য।
নহি
নহি, বেটা আপ্কা আনমোল যো হ্যায়। লেকিন ঠিক ওয়ক্ত পর উসে মদত করনা চাহিয়ে হামলোগোকো।
ঠিক আছে আজ হামি চলি। বেটার কাছে জানিয়ে দিবেন
বিরু
ও পানু চাচাকে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে।
সেদিন
রাতে বিরু তার বৌ এর সাথে অনেকক্ষণ এ বিষয়ে আলোচনা করে। তবে এদের ছেলের প্রতি যতই
প্রবল ভালবাসা বা টান থাক, এরা একটা জিনিষ খুব আঁচ করতে পারে যে পানু যদি সত্যি
সত্যি একবার চাচাজীর কথা মত গুজরাত যায় এই বয়সে, ওর চোখের সামনে একটা বিশাল জগত
খুলে যাবে। আর সেইসঙ্গে ওদেরও এই একঘেয়ে কষ্টকর দিনযাপন হয়ত একটু বদলাবে। ওরা
পানুকে ডেকে জিজ্ঞাসা করে – কি রে তোর কেমন লাগবে অতদূরে গিয়ে থাকতে? অজানা অচেনা
জায়গায় নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারবি তো?
পানু
একটুও দেরী না করে জবার দেয় – পারব, খুব পারব। তোমরা ভেবো না একদম। তাছাড়া চাচাজীর
সঙ্গে থেকে থেকে হিন্দী বলাটা মোটামুটি রপ্ত হয়ে গ্যাছে আমার।
বিরু
আর তার বউ এ ওর মুখের দিকে তাকায়।
পরবর্তী
ঘটনাগুলো চাচাজী আর পানুর মনের ইচ্ছা মতন তর তর করে এগিয়ে চলল। পানু বাবা-মা ও
বোনকে ছেড়ে সুদূর সুরাটের উদ্দেশ্যে রওনা হ’ল। বিরুও ছেলের সঙ্গে গিয়ে ওখানকার
জায়গা, কাজ, মানুষজন সব দেখে এল। চাচাজীর দোস্ত – পানুর নতুন মালিককেও তার মন্দ
লাগল না। বাড়ি এসে বউকে তার বর্ণনা দিয়ে শুধু বলল – চিন্তা কোরোনা, ছেলের আরও
উন্নতি হ’ল গো এবার। কি বিশাল কারবার, কত বড় শহর। আদব কায়দাই আলাদা। ছেলে মানুষ
হয়ে যাবে।
বিরুর
দিকে নিঃশব্দ এক চাহনি মেলে দিয়ে দুটো হাত জোড় করে শুধু মাথায় ঠেকালো পানুর মা। মায়ের
মন তো! মাঝে মাঝেই বাবা-মাকে ছেলে টাকা পাঠাতে থাকল যা প্রথমদিকে বিরুর কাছে প্রায়
অবিশ্বাস্য লাগত। সেদিনকার ছেলে, হেলাফেলার মধ্যে এই বস্তিতে বেড়ে ওঠা পানুর এই
কর্তব্যবোধ যে কখন গড়ে উঠল তা তারা বুঝে
উঠতে পারে না। ছেলের সংসারের প্রতি টান, তার এই নিয়মিত আর্থিক অনুদান তাদের
পরিবারে যে বেশ খানিকটা স্বচ্ছলতা এনে দিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মেয়েটা উঁচু
ক্লাসে উঠেছে, তার জন্য টিউশানের ব্যবস্থাও হ’ল। বিরুর এখন ছেলের দায়িত্বজ্ঞানের
ওপর এতটাই ভরসা যে মনে মনে সে অন্য অনেক কিছু ভাবা শুরু করে দিয়েছে – তারই একটার
নমুনা হ’ল খুব শীগগিরই তারা এই বস্তির বাস তুলে দিয়ে অন্য পাড়ায় একটা টালির ঘর ভাড়া
কররে মোটামুটি স্থির ক’রেও ফেলেছে। মাঝে
মাঝে বিরু চাচার সঙ্গে গিয়ে দেখা ক’রে আসে। ছেলের খবরাখবর দিতে যায়। চাচা বিরুর এই
কৃতজ্ঞতা বোধ দেখে খুশি হয়। চাচা বলে বিরুকে – দিখবেন এ বেটা আপনার বহ্ত বড়া
বনেগা। উস্মে কুছ কর্কে দিখানেকা হিম্মত হ্যাঁয়। হামার দোস্ত ভি ওকে বহ্ত
পসন্দ্ করে। বেটাকা হালচাল উনহিসে মুঝে পতা চল যাতা হ্যায়।
এ
পর্যন্ত পানুর জীবনের এই কাহিনী এক মনকাড়ানিয়া বাস্তবের সপ্নসুন্দর পরিণতি বলে
মেনে নিতে কোনও অসুবিধা হয় না। মাঝে পানু বার দু-তিনেক এসে বাড়ি ঘুরেও গ্যাছে।
নতুন বাড়িটা টালির চাল হলেও তার বেশ পছন্দ হয়েছে, সে কথা জানিয়েছে মাকে। সবকিছুই
যে এত দিনের ভিতর খুব মোলায়েম ভাবে কেটেছে বিরুদের তাও নয়। আর পাঁচটা সংসারের মত
তাদেরও ছোটখাট দুঃখ, দূর্দশা, বিপদ-আপদের
সম্মুখীন হতে হয়েছে। আবার কেটেও গ্যাছে সময়ের সাথে সাথে। সে জন্য পানুর
জীবনের জয়যাত্রা কোনমতে ব্যাহত হয় নি বা বিরু হতে দেয় নি।
কিন্তু
এবার যেটা ঘটল, তাকে বিরু যেন এক রূপকথা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেই পারে না। পানু কাজে
এতটাই পারদর্শী হয়ে উঠল দিনে দিনে যে এই লাইনে সে নিজেই এক প্রবাদ প্রতিম কারিগর
হয়ে উঠল তার অবিস্বাস্য দক্ষতার গুণে। চাচার দোস্ত - শেঠ বেছে নিল তাকে দুবাই এ
পাঠাবে ব’লে। আরও বড় কাজে ওকে লাগাবে বলে। পানু এ খবর পেয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলেছিল।
শেঠজীকে ব’লে সে সুরাট থেকে প্রথমেই চাচাকে ফোনে খবরটা জানায়। পরে অবশ্য বাবা-মা,
বোনকেও বলেছিল। মায়ের মনটা একটু বিষণ্ণ হয়ে গেছিল প্রথম চোটে, পরে অবশ্য প্রাণভরে
পানুকে আশীর্বাদ করেছিল। পানু মাকে ফোনেই বলেছিল – মা এবার তোমার বাইরের কাজ সব
বন্ধ করতে হবে। বয়স হচ্ছে শরীরটার দিকে নজর দিতে হবে। বোন শুনেই তো একেবারে থ। মা
কে খুশিতে ডগমগ হয়ে বলেছিল – আচ্ছা মা আমরা দাদার ওখানে বেড়াতে যাব তো?
সুখবর
পেয়ে চাচাকে মিঠাই খাওয়াতে বিরু চলল চাচার দোকানে। চাচার প্রতি বিরুর কৃতজ্ঞতার
কোনও শেষ নেই। সে চাচাকে বলে যে ছেলের এই উন্নতি আর সেই সুবাদে তাদের নিজেদের
জীবনেও এই পরিবর্তন এ কেবল রূপকথাতেই সম্ভব। চাচা যদি পানুকে এমনভাবে কাছে টেনে না
নিত, তাহলে কি এমনটা কোনদিনও ঘটত! চাচা
সেই একই রকম হেসে বিরুকে বলে – আল্লহ্ আপকা বেটাকা কিসমত্ কো সাহারা দিয়া। হামি
তো শুধু উস্কা অন্দর শে হীরে কো ঢুন্ড নিকালা।
খবর
এল পানুর পাস্পোর্ট তৈরী। দিন দশেকের মধ্যেই সে দুবাই রওনা হবে। দুবাই যাওয়ার আগে
ছেলে এক সপ্তাহের জন্য বাড়ি আসছে জেনে বাড়িতে খুশির ঢেউ বইতে শুরু করল। বিরু তার
নিজের ছেলের জন্যে নয় যেন এক রূপকথার নায়কের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল।