রাতভোর বৃষ্টি । শমিতার ঘুম ভেঙ্গে গেছে বার বার মেঘের
গর্জনে । এরকম বৃষ্টি বহুদিন কলকাতায় হয় নি। হটাত ভীষণ শীত করে উঠলো শমিতার। মন টা
হু হু করে উঠলো সুবাসের জন্য। বাইপাস এর ওপরে ১৬০০ স্কোয়ার ফুট এর এই সাজানো ফ্ল্যাট টা শুধু শমিতার মন খারাপে ভরে থাকে
বেশির ভাগ সময়। কত শখ করে কিনেছিল সে আর সুবাস।
শেষ বারের মতো যেদিন অফিস ট্যুর এ যাবার জন্য
রেডি হচ্ছিল ওই ত- ওইই ডাইনিং টেবিল এ সাজান ছিল নিয়ম মাফিক ব্রেড টোস্ট , ডিমের অমলেট আর
ফ্রুট জুস। ----
শমি শমি... কোথায় গেলে বলতো ? সবকিছু ঠিকঠাক
গুছিয়ে দিয়েছ ত?
ভীষণ
ব্যাস্ততায় বেরিয়ে যেতে গিয়েও ফিরে আসে সুবাস-- ' শমি আমার শমি । ভাল থাকবে - মন খারাপ করবে না । জাস্ট দুটো উইক, তার--পর এই বান্দা আবার হাজির তোমার কাছে । আবার
শমিতার গালের কাছে ঘন হল -- একবার,, তারপর বলল
যদি প্রয়োজন হয়্ ব্যাংকের পাসবুক, হেলথ ইন্সিওরেন্সের কার্ড সব ওই ড্রয়ার এ
রইল। চললাম শমি ।
সেই শেষ । আর আসেনি সুবাস। কিছুদিন পর তার দেহটা ফিরেছিল।
মুখটা চেনা যায় নি। শমিতার দাদা নামি ব্যারিস্টার । তারই বন্ধু পুলিশ কমিশনার এর
সাহায্যে অনেক খোঁজ খবর করার পর জানা গেল সেদিন অফিস ট্যুরে চেন্নাই তে যায় নি
সুবাস । সকালে বেরিয়ে অফিসে গিয়েছিল । সেদিন রাতে দার্জিলিং মেলে ট্রেনের টিকিট
বুক করা ছিল এন.জে.পি.
পর্যন্ত সুবাস
মুখারজির নামে। তথ্য বলছে পাহাড়ি রাস্তায় ওঠার পথে একটা শেয়ার এর গাড়ি -- আর একটা ট্রাক এর সাথে এক্সিডেন্ট হয় ।
ওই গাড়িতেই সুবাস ছিল । কোথায় যেতে চেয়েছিল
সুবাস? কেন চেন্নাই এ
অফিস ট্যুর না থাকা সত্তেও আদরের শমিকে না জানিয়ে অন্য পথে গিয়েছিল সুবাস?
এসব প্রশ্ন রয়ে গিয়েছিল অন্ধকারেই ।
আট বছর পর--- সিকিম এর এক গ্রাম --
নামচি-- তে বেড়াতে গিয়েছিল কলকাতার এক নামী কলেজের ছাত্রছাত্রী রা। হু হু শীতের রাত ।
সামনে আগুন জ্বালিয়ে তরুন তরুণী দের গল্প বলছিলেন এক মানুষ।,বয়স হয়েছে। চুলে
রুপোলী রেখা, কিন্তু দুচোখে তৃপ্তির স্বাদ । যেন জীবনে কোন দ্বিধা নেই। শোক নেই। শুধুই
শান্তির ছাপ মুখে ।
---------"তারপর সেই পড়ে যাওয়া গাড়ি থেকে অদ্ভুতভাবে
বেঁচে গিয়েছিল একজন । আসলে সে বাঁচতেই ছেয়েছিল যে। তাকিয়ে দেখল শেয়ার গাড়িটির
সামনের সিট এ বসা মানুষ টির মুখ থেঁতলে গেছে একেবারে । নিজেকে টেনে হিঁচড়ে তুলল
প্রাণপণে । হয়ত লোকজন এসে পড়বে একটু পরেই।
দ্রুত নিজের গায়ের শার্ট খুলে পড়িয়ে দিল
সামনের সিটের নাম না জানা মানুষটির গায়ে--- । পার্স, ক্রেডিট কার্ড, ভিজিটিং কার্ড সব ভরে দিলও থেঁতলে যাওয়া
মুখের পকেটে । ---------একটু হেসে জিজ্ঞাসু চোখ গুলির দিকে তাকিয়ে আবার বলতে
শুরু করলেন -- আসলে রোজকার এই জীবনটা আর চাইছিল না একটি সফল শহুরে উদাসী মানুষ ।
মেগা সিটির চোখ ধাঁধানো উজ্বলতা, ব্যাস্ত জীবন, উঁচু পদের মোহ, রূপসী স্ত্রীর নিবিড় সাহচর্য -- এগুলো তে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। ভীষণ একঘেয়ে
জীবন টা কে নিয়ে নিজের মত খেলতে ইচ্ছে করত তার। কিছু তেই সুর খুজে পাচ্ছিল
না। ঘোড়দৌড় থেকে সে মুক্তি চেয়েছিল । চেয়েছিল মুক্তির আকাশ । প্রেমে পড়েছিল
প্রকৃতির-- তাই সাহস করে তার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতেই---। দূরে তখন কাম্পফায়ারের আগুনের
পাশে গীটার বাজিয়ে গান ধরেছে এক সদ্য তরুণ-- " আমি আছি গতকালে ,
আমি আছি আগামিতে যেমন এখন আমি আছি-- বাতাসের জন্যে , হয়ত অরণ্যে,
গাছের শরীরে -- পাতায় পাতায়--
আমি আছি।।-----"