সকালে
ঘুম থেকে ওঠে বউকে খুঁজে পায়না মজিদ ।
ধলপ্রহরে ওর ঘরের
দরজা খোলা দেখে বিস্মিত হয় সে ।
তারপর পাড়ায় খবর চাউর হলে ছেলেরা খুঁজতে বের হয়
জয়তুনকে । বর্ষাকালে কালীধরা নদীর পানি থৈ থৈ করে । চণ্ডীবর্দি গ্রামে বন্যা হয় এ
সময় । জেলেপাড়ার উত্তরে দরগাতলা, তার কূলঘেঁষে প্রকাণ্ড বটগাছ । স্রোতজলের ধারা
এসে গোড়ায় পাক খায় তখন । পড়ন্ত বেলায় খবর আসে ।
-মজিদ
ভাই হে, আহ ।
অতিউৎসাহী
মজিদ হন্তদন্ত হয়ে দরগাতলায় গেলে সত্য প্রকাশিত হয় । বটগাছের গোড়া থেকে একটা শাড়ির
আঁচল ভাসে পানিতে ।
বুড়ো
ইলিমুদ্দির মৃত্যুর পর সংসারের ভার এসে পড়ে মজিদের উপর । ঘরে তখন নিদারুণ অভাব
ওদের । মৃত্যুকালে কি এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে পড়েছিল বাপ, রোগ নির্ণয় করতে পারেনি
পাড়ার আরজু ডাক্তারও । বাড়ীর পাশের সামান্য আবাদি জমিটুকু বিক্রি করে ইলিমুদ্দির
চিকিৎসা করেছে মজিদ । সেই ইলিমুদ্দি মারা গেল অবশেষে । মানুষ মারা গেলে ভবলীলা
সাঙ্গ হয় । কিন্তু ভবপারে পড়ে থাকা অন্যমানুষ গুলো ? উত্তরাধিকার সূত্রে বসতভিটা
ছাড়া ইলিমুদ্দির কাছে আর কিছু পায়নি মজিদ । এখন পেট বাঁচাতে পাড়ার অন্যদের সাথে
দিনমজুরীর কাজ করে সে । কিন্তু তাতে ফায়দা কি ? একেতো মজুরীর পরিমাণ সামান্য তার
উপর কাজ থাকেনা প্রায়ই । বেকার থাকলে একরকম উপোষ দিনাতিপাত করতে হয় মজিদদের । সে
সময় সস্তাদরে মোড়লের বাঁশঝাড় থেকে কিনে আনা কঞ্চি দিয়ে খাঁচা বানায় মজিদ । তাতেও
সংসারের অভাব মিটেনা তার । ফলে দারিদ্র্য ওর চিরকালের ।
হাতে
যখন একেবারেই কোন কাজ না থাকে মজিদ তখন বড়শিতে মাছ ধরে কালীধরা নদীতে । চণ্ডীবর্দি
গ্রামে মজিদের বাড়ীটা এ নদীর কূলঘেঁষে । পার্শ্ববর্তী গোঁড়াকান্দার নওশের আলীও
জালে মাছ ধরতে গেলে চোখাচোখি হয় দুজনের । নওশের বলে-
-একখান
বিড়ি দিবানি মতি পানিত ফুঁক দেই ?
পরমুহূর্তে
কোমরে গুঁজে রাখা প্যাকেট হতে একটা বিড়ি বের করে নওশেরের হাতে দিলে আগুন ধরায় সে ।
খোশমেজাজি নওশের বিড়ি ফোঁকে সময় ধরে । তারপর মজিদের সাথে খোশগল্পে মাতে অনেকক্ষণ ।
-আজ
কামে যাও নাই মালুম অয় ? মজিদ বলে-
-কাম
নাইগো মিয়া ভাই । নসু মাতবর মানা করছে কাইল ।
চৈত্র
মাসে কাজ থাকেনা মজিদ মিয়ার । এ দৃশ্য চণ্ডীবর্দির ঘরে ঘরে । যাদের সামান্য আবাদি
জমি আছে তারা বাহারি ফসল ফলায় । যাদের সে সুযোগ নেই তারা ঋণ করে কারও কাছে । এর
মধ্যে একদিন অসুখে পড়ে হরবলা বিবি । মা অসুস্থ হলে মনে মনে চিন্তিত হয় মজিদ । আরজু
ডাক্তার গঞ্জে নেওয়ার পরামর্শ দেয় তাকে । অর্থের বন্দোবস্ত না হলে নসু মাতব্বরের
কাছে ঋণ নিতে যেতে হয় মজিদকে । এ পাড়ায় নসু মাতব্বর পুরনো গেরস্থ । হালে বলদ আর
পাড়ায় আবাদি জমি দুটোই আছে তার । গরীব মানুষ বিপদে পড়লে সুদে ঋণ দেয় সে । মজিদ
মিয়া তাদেরই একজন । মাতব্বর বলে-
-মজিদনি,
টাহা চাও মুনে কয় ?
-হ
ভাই, মায়নি ব্যারামে পড়ছে কাইল ।
-শোধনি
দিবা হাঁচা ?
-নিয্যস
। টাহানি মারুম মালুম অয় ?
শেষমেশ
নসু মাতব্বরের কাছে দ্বিফসলী ঋণ পায় মজিদ । শর্ত অনুযায়ী আগামী বোরো মৌসুমে গতর
খেটে সুদ সমেত ঋণ শোধ দিতে হবে তাকে । তারপর একদিন হরবলা বিবিকে দেখা যায় উপজেলা
সদর হাসপাতালে । মায়ের চিকিৎসা করায় মজিদ । কিন্তু তাতেও সহসা রোগ ছাড়েনা হরবলা
বিবির । অসুস্থতা আরও বাড়লে বিছানা নেয় সে ।
বৈশাখের
গোড়ার দিকে আবার দিনমজুরীর কাজে ব্যস্ত হয় মজিদ । কালীধরা নদীর পশ্চিমে পুরনো নৌকা
মেরামতের অপেক্ষায় থাকে । আসছে বর্ষাকে কেন্দ্র করে নতুন নৌকা তৈরির চিন্তা করে
নসু মাতব্বর । জেলেপাড়ার নবীশেখের সহযোগিতায় মাতব্বরের নৌকা মেরামতের কাজ পায় সে ।
এ পাড়ায় অন্য কাজের তুলনায় নৌকা মেরামতে মজুরী বেশী, তবে পরিশ্রম করতে হয় অত্যধিক
। মজিদের দুঃখ নেই তাতে । পাড়ায় যথেষ্ট সামর্থ্যবান সে । রাতে বাড়ী ফেরার পথে
চণ্ডীবর্দি মসজিদের বড় হুযুরের কাছ থেকে পানিপড়া নিয়ে আসে মজিদ । তারপর বাড়ী ফিরে
রোগ সারানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে সে । হরবলা বিবি বলে-
-ব্যারামনি,
এইডা ছাড়বার নয়গো বাপ ।
ভাদ্রমাসে
বিয়ের ধূম পড়ে চণ্ডীবর্দি গ্রামে । বর্ষায় জেলে নৌকায় কাজ করে মোটা টাকার মালিক হয়
অনেকেই । উড়নচণ্ডী ছেলে গুলোর মধ্যে বিয়ের বাসনা জন্মে তখন । রাতে বিছানায় শোয়ে
মেয়ে মানুষের অভাববোধ করে তারা । এবার বর্ষার পুরো সময়টা নসু মাতব্বরের নৌকায়
কাটিয়েছে মজিদ । সে সুবাদে যৎসামান্য টাকা এসেছে তার হাতে । এরইমধ্যে একদিন পাশের
বাড়ীর হাস্না পান খেতে এসে খোশগল্প করে হরবলাবিবির সাথে ।
-মজিদ
ভাইনি কাঁচা টাহা পাইছে হুনি ?
-হাঁচা
মালুম অয় । সত্যিনি কয় পুত ?
-এইবার
ঘরে বউ আন চাচি ।
সেদিন
হাস্নার বলা কথাটা মনে ধরে হরবলা বিবির । মজিদের জন্য ঘরে বউ আনার সাধ হয় তার ।
বুড়ো মানুষটা অসুস্থ হলে খাওয়া দাওয়ার অসুবিধা হয় ছেলের । বউ এলে এ সমস্যার সমাধান
হবে অন্তত । তাছাড়া অসুস্থ হরবলা বিবিও কথা বলার মানুষ পাবে একজন । তারপর একদিন
ছেলে বাড়ী ফিরলে মনোবাসনা খোলে বলে হরবলা ।
-একখান
কতা কমু, গোস্যানি অয় বাপ ? মজিদ বলে-
-গোস্যা
কিয়ের, কও হুনি ?
-একখান
বিয়া কর শিগগির, বয়সনি বইয়্যা থাহে ?
হরবলা
বিবির বলা কথা মিছে নয় । দেখতে দেখতে যথেষ্ট বয়স হয়েছে মজিদের । সমবয়সী সবাই বিয়ে
করেছে ইতোমধ্যে । এখন ঘরে বউ দরকার তারও । মজিদ বলে-
-বিয়ানি,
মাইয়া দেহ তাইলে ।
উত্তরপাড়ার
হারু ঘটক বিয়ের কাজে পাকা লোক । মুখে আধপাকা দাঁড়ি আছে তার । হরবলা বিবি খবর দিলে
একদিন মজিদের বাড়ীতে দেখা যায় তাকে । হরবলা বলে-
-পুলার
বউনি খুঁজ্যা দিবা মিয়া ভাই ? হারু বলে-
-দিলে
ভরসা থও ভাবী, সরেস পাত্রী দিমু নিয্যস ।
তারপর
পাড়ায় পাড়ায় কনের সন্ধান করে হারু ঘটক । কিন্তু সহসা কনের খোঁজ মিলেনা কোথাও ।
পুনশ্চ, মজিদের কাছ থেকে মোটা টাকা হাতিয়ে নেয় সে । অবশেষে আশ্বিনের গোড়ার দিকে
ভাল পাত্রীর সন্ধান মিলে পার্শ্ববর্তী মজুপুর গ্রামে । কনে আফাজুদ্দির মেয়ে জয়তুন । দেখতে ভাল, স্বভাব চরিত্রও । হারু বলে-
-সরেস
মাইয়্যাগো ভাবী, পুলার কপাল কই ।
মজুপুর
গ্রামে আফাজুদ্দির বাড়ীটা শহরমুখী কাঁচা রস্তার কূলঘেঁষে । ঘরে স্ত্রী ছাড়াও দুই
কন্যা আছে তার । পেশায় ফেরিওয়ালা সে । পাড়ায় বাহারি পণ্য ফেরি করে দিনাতিপাত করতে
হয় তাকে । ফলে সংসারে অভাব মেটানোর সামর্থ্যের অভাব তার । এ অবস্থায় জয়তুনের বিয়ে
ঠিক হলে চিন্তিত হয় সে । পাত্রপক্ষের দাবিও যৎসামান্য নয় । হারু বলে-
-পুলা
সরেসগো মিয়া ভাই, দিলে ভরসা লও ।
অবশেষে
নিজের নামের বসতভিটার কাছের সামান্য জমিটুকুই বেচে দেয় আফাজুদ্দিন । তারপর একদিন
নিয়ম মেনে বিয়ে হয়ে যায় মজিদ আর জয়তুনের । নতুন সংসারে কদিন আত্মীয়ের আনাগোনা থাকে
খুব । অতিউৎসাহীরা বউ দেখতে এসে ধন্য ধন্য করে । তারপর ওরাও বিদায় নিলে সংসারধর্মে
ব্রতী হয় দুজনই । আফাজুদ্দির কাছ থেকে পাওয়া মোটা টাকায় বাড়ীতে টিনের দুচালা ঘর
তুলে মজিদ । বাকি টাকায় একটা নতুন রিকশা কিনে সে । ঘরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে খরচ
বৃদ্ধি পায় । পাড়ায় দিন মজুরীর কাজ করে দুবেলা অন্ন জোগাড় করার সামর্থ্য নেই
মজিদের । সেক্ষেত্রে প্রায়ই বেকার থাকতে হয় তাকে । অথচ নিজের একটা রিকশা থাকলে সে
সম্ভাবনা নেই তার । তাছাড়া স্বাধীন জীবন যাপন করতে পারবে সে । মজিদের প্রস্তাবে
বাঁধা দেয়না জয়তুন । স্বামীর সাথে দিনকে দিন সংসারে সচ্ছলতার স্বপ্ন দেখে সেও ।
বিয়ের
পর মজিদের সুখের সংসার দৃষ্টি এড়াইনা গেঁয়োদের । এ পাড়ার অনেকেই কানাকানি করে ওদের
নিয়ে । উত্তরপাড়ার আজিবরের বউ ময়না আর কলিমুদ্দির বউ হবিরন পান খাওয়ার উছিলায়
মজিদের বাড়ীতে এসে খোশগল্প করে । জয়তুন বড়ঘরের বারান্দায় বসে কাঁথা সেলায় দিনমান ।
হবিরন বলে-
-কি
সুখের সংসারগো বু তোমার ! ময়না বলে-
-হাঁচা
চাচি । বউ দেহ চাঁনরূপ ।
তারপর
এক এক করে দিন যায় । একদিন হরবলা বিবি অসুস্থ হয় আবারও । মা অসুস্থ হলে মজিদ জমানো
টাকা খরচ করে । কিন্তু অসুস্থতা ছাড়েনা সহসা । ফলশ্রুতিতে আবারও বিছানায় পড়ে হরবলা
বিবি ।
আজকাল
দিনের বেলা দেখা পাওয়া যায়না মজিদের । সুজাতপুর রিকশা চালাতে যায় সে,ফিরে রাত করে
। ও এলে অজুর পানি এগিয়ে দেয় জয়তুন । রাতে একই বিছানায় শোয়ে খোশগল্প করে দুজন ।
অভাবের সংসারেও চোখে স্বপ্ন জ্বলজ্বল করে দুজনের ।
দিনে
মজিদ বাড়ী না থাকলে একাকী সময় কাটায় জয়তুন । স্বামীর অবর্তমানে শাশুড়ির শুশ্রূষার
দায়িত্ব পালন করতে হয় । হরবলা বিবি অসুস্থতার ধরুন বিছানায় পড়লে সেবার জন্য কাতর
হয় । জয়তুনও কখনও অবহেলা করেনা তাকে । শাশুড়ি বলে-
-হামাক
দেইক্যগো মা, তোমারে মোর বেটি থুই ।
তারপর
মাস দুই পর হয়তো জয়তুনের কারণেই যমের দোয়ার থেকে ফিরে আসে হরবলা বিবি । ও সুস্থ
হলে পাড়ার মেয়েরা ধন্য ধন্য করে জয়তুনের । অসুস্থতার সময় কি না করেছে মেয়েটা ?
শাশুড়ির জন্য রাতের ঘুমও হারাম করেছে সে । কিন্তু কেন যেন কৃতজ্ঞতার বশবর্তী হয়েও
সত্যটা মানতে পারেনা হরবলা বিবি । পাশের বাড়ীর হবিরন জয়তুনকে নিয়ে কথা বললে হরবলা
বিবির সহজ জবাব-
-মাইনসের
বেটিগো বু মাইনসের বেটি । আপননি অয় হে ? পাশে থেকে প্রতিবাদ করে হাস্না-
-মিছা
কওকে চাচি, অমুন বউনি আছে গাঁয় ?
তবুও
সহসা সত্যিটা স্বীকার করেনা হরবলা বিবি । সম্ভব হলে পাড়ার অন্য মেয়েদের সাথে
বিদ্রোহ করে সে ।
এর
কদিন পরের ঘটনা । একদিন মজিদের বাড়ীতে মেয়েমানুষের কান্নার আওয়াজ শুনা যায় । সহসা
কান্নার কারণ খোঁজতে ব্যর্থ হয় অন্যরা । পরমুহূর্তে জয়তুনের মুখেই সত্য প্রকাশিত
হয় । আজ সকালে রিকশা নিয়ে গঞ্জে গেছিল মজিদ । সারাদিন রিকশা চালিয়েছে সে । বিকেলে
রাস্তা আটকে কে বা কারা রিকশাটা কেড়ে নিছে
ওর । কাউকে চিনতে পারেনি মজিদ । বুড়ি হরবলা বিবি বড়ঘরের বারান্দায় বসে সন্ধ্যার
শেষ অবধি আহাজারি করে-
-আয়গো
খোদা, হামাক কি সব্বনাশ অইলগো । হরবলা বিবি আহাজারি করলে ধমক দেয় মতি-
-চুপ
র মাগীর ছাও, দিলে সবুর দেস কই ।
শহরে
রিকশা হারিয়ে চিন্তিত হয় মজিদও । একমাত্র উপার্জনের বাহন হারানোর অর্থ আগামীতে
উপোষ থাকতে হবে সবাইকে । নসু মাতব্বর লোক মারফৎ রিকশাটা খোঁজার চেষ্টা করে
সুজাতপুর । সহসা সন্ধান দিতে পারেনা কেউ । নিরুপায় হলে কদিন ধার করে সংসার চালাতে
হয় মজিদকে । দিন দশেক পর সে সুযোগও থাকেনা তার ।
এরইমধ্যে
একদিন মজিদকে ডেকে পাঠায় নসু মাতব্বর । অতিউৎসাহী মজিদ মিয়া দেখা করতে গেলে পাওনা
টাকার তাগিদ দেয় সে । মজিদ বলে –
-টাহানি
কাহা ? হাতত খালী সুময় দেন । মাতব্বর বলে-
-ইতা
কেমুন কতা অইল মজিদ । অভাবনি একলা তোমার ?
অবশেষে
নসু মাতব্বরের কাছ থেকে কদিন সময় নেয় মজিদ । তারপর বাড়ীতে এসে ভাবনায় পড়ে সে ।
অভাবের সংসারে যেখানে তার দুমুঠো ভাত জোগানোর সামর্থ্য নেই, সেখানে নসু মাতব্বরের
ঋণ শোধের সাধ্য কোথায় ? কিন্তু যথা সময়ে দেনা পরিশোধ করতে না পারলে বিপদ হবে তার ।
নসু মাতব্বর কি আর যেসে লোক ? এ গাঁয়ের মোড়ল সে । হয়তো যেকোন উপায়ে পাওনা আদায় করে
নিবে সে । তারপর কি ভেবে একদিন নিতান্ত অপরাধীর মত জয়তুনের সামনে এসে দাঁড়ায় মজিদ । সে বলে-
-একখান
কতা কমু, গোস্যানি অয় বউ ? জয়তুন বলে-
-গোস্যা
কিয়ের, হাঁচা কও হুনি ?
-বাপের
বাড়ী যাবানি, কয়ডা টাহানি আনবার পাও ?
মজিদের
এমন প্রস্তাবে ভাবনায় পড়ে জয়তুন । অভাবের সংসারে আফাজুদ্দির সামর্থ্য যে মজিদের
চেয়ে কোন অংশেই ভাল নয়, এটা জয়তুনের চেয়ে ভাল কে জানে । জয়তুন বলে-
-টাহানি,
বাজাননি পাব দিতে ?
জয়তুনের
কথার সহসা জবাব দেয়না মজিদ । তারপর সত্যি একদিন টাকা চাইতে বাপের বাড়ী যেতে হয়
মেয়েকে । দীর্ঘকাল পর মেয়ের আগমনে পুলকিত হয় সে বাড়ীর সবাই । পরমুহূর্তে আসার কারণ
প্রকাশিত হলে রীতিমত ভাবনায় পড়ে আফাজুদ্দিন । ফেরার সময় মান অভিমানের এক পালা গান
হয় বাপ বেটিতে । আফাজুদ্দিন বলে-
-হামাক
মাপ দিস, সাধ্যনি আছে মোর ?
অবশেষে
শুন্য হাতেই ফিরে আসতে হয় জয়তুনকে । শ্বশুরবাড়ীর অপারগতায় বিমর্ষ হয় মজিদও ।
সংসারে নিদারুণ দুঃসময়ে শ্বশুরবাড়ীকে একমাত্র ভরসা ভেবেছিল সে । জয়তুন ফিরে এলে
শ্রাব্য অশ্রাব্য কথার তুবড়ি ছুটে হরবলার মুখে ।
-কেমুন
বাপ, ফকিরনি ? মুখে ঝাঁটা থুই ।
হরবলা
বিবি অভিসম্পাত করলে সহসা জবাব দেয়না জয়তুন । নিজের ঘরে বসে অশ্রু বিসর্জন দেয় সে
। তারপর একদিন পাওনা টাকা আদায় করতে এসে মজিদের পালের বলদটা নিয়ে যায় মাতব্বরের
ছেলেরা । এ বাড়ীর কেউ বাঁধা দেয়না তাতে ।
শ্রাবণ
মাসে বন্যা হয় চণ্ডীবর্দি । তখন পানিবন্দী হয়ে পড়ে এ পাড়ার সবাই । একদিন হারু ঘটক
কনের সন্ধান দিলে ছেলেকে দ্বিতীয় বিয়ে দিতে চায় হরবলা বিবি । মজিদ বলে-
-নিকানি,
বড় বউয়ের গোস্যানি অয় ?
জয়তুনের
প্রশ্নে কর্ণপাত করেনা হরবলা বিবি । সে বলে-
-গোস্যা
ছাড়ান দে । পেটের ভাত দিব কেডা ?
শেষমেশ
পাকা কথা দিতে হয় মজিদকে । জয়তুনের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেনা কেউ । জয়তুনও
যেচে বাঁধা দিতে আসেনা কখনও । ভালবাসাপাগল যে মেয়েটি শত দুর্দশাতেও মজিদের পাশে
থাকার চেষ্টা করেছে আজন্মকাল । আজ অস্তিত্বের সংগ্রামে কেন যেন কোন আগ্রহ নেই তার
। কে জানি, ও হয়তো যেনে গেছে জোর করে যায় হোক অস্তিত্বে আসন হয়না কখনও ।
এরপর
একদিন আবার সব নিয়ম মেনে দ্বিতীয় বিয়ের পিঁড়িতে বসে মজিদ । কনে আলফাডাঙার মুহুর আলীর
বেটি হালিমা । গায়ের রং কালো- তাতে কি, মেয়ে কাল বলেই হয়তো পণের অংকটাও বড় । মেয়ের
বিয়েতে মুহুর আলী নগদ টাকা দিয়েছে মজিদকে । সাথে নতুন রিকশা । মজিদের দ্বিতীয় বিয়ে
চাউর হলে কানাকানি করে গেঁয়োরা ।
-ইতা
কিতা অইল বু, মজিদেরনি পাষাণ পরাণ ?
নতুন
বউ বাড়ী এলে বরণ করতে হয় জয়তুনকেই । যে বিছানায় একদিন নিজেকে সঁপে দিয়েছিল সে,
সেখানে আসন ছাড়তে হয় তার । পরদিন সকালে আর খুঁজে পাওয়া যায়না তাকে । কে জানে,
শেষকালে কি দুঃখ ছিল জয়তুনের । এরপর অনেক বছর পরও দরগাতলায় দেখা যায় মজিদকে ।
বটগাছের গোড়ায় বসে উত্তাল নদীর স্রোত জলে দৃষ্টি আওড়ায় । লোকে বলে এখনও নদীতে
শাড়ির আচল ভাসে । সবাই দেখেনা, তবে কেউ কেউ দেখে-আচলে জরানো
সেই নিথর দেহ ।