অফিসে বিমল জানা নামে
এক চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী ছিল। সে খুব ভালো রান্না করতে পারতো এবং
মাঝেমধ্যে অফিসের ক্যান্টিনে ভালোমন্দ রান্না
করে আমাদের খাওয়াতোও। ছেলেটা খুব ভাল ছিল, কিন্তু তার পিছনে লেগে আমরা খুব মজা পেতাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, সে রোজ দুটো করে ডিমসিদ্ধ খাওয়া শুরু
করেছে। তখন আমার অল্প বয়েস, কথায়
কথায় কবিতা লিখে ফেলতাম। একটা কাগজে বড় বড় করে “জানার মাথায় গোবর পোরা, উঠবে
এবার সিং। বুদ্ধি কী আর বাড়ে জানা,
খেলে ডবল্ ডিম”?
লিখে ক্যান্টিনের দেওয়ালে সেঁটে দিলাম।
কিছুক্ষণ পরে ক্যান্টিনে চিৎকার চ্যাঁচামিচি শুনে গিয়ে দেখি, বিমল কবিতার কাগজটা দেওয়াল থেকে খুলে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর তার শ্রীমুখ দিয়ে অনর্গল খিস্তি ছুটছে।
এই বিমল তার বিয়েতে ছবি
তোলার জন্য বিশেষ ভাবে ধরলো। আমি একটা সেকেন্ড হ্যান্ড ক্যামেরা কিনে মাঝে মাঝে
ফটো তুলি বটে, কিন্তু
ফ্ল্যাশগান
না থাকায় রাতে ছবি তোলার সুযোগ ছিল না। নাছোড়-বান্দা বিমলকে এটা কিছুতেই বোঝাতে না
পেরে শেষে সহকর্মী সুজয়কে অনুরোধ করতে বুদ্ধি দিলাম। জায়গাটা ধ্যাড়ধেড়ে
গোবিন্দপুরে হওয়ায় সুজয় রাজী হলেও, একা যেতে কিছুতেই রাজী হ’ল না। শেষে সুজয়কে সঙ্গ দেবার জন্য
আমাকেও সঙ্গী হতে রাজী হতে হ’ল। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল সেই
ফ্ল্যাশগান নিয়েই। সুজয়ের ক্যামেরাটার ফ্ল্যাশগান নাকি মাঝেমধ্যেই কাজ করছে না।
শেষে সুজয় ও বিমলের বিশেষ অনুরোধে খুঁতখুঁতে ও সন্দেহবাতিক জয়দেব তার ফ্ল্যাশগানটা
দিতে রাজী হলে, সুজয়
তার ক্যামেরা নিতে বাড়ি চলে গেল।
বিকাল বেলা জয়দেবের
বাড়ি থেকে ফ্ল্যাশগানের সুদৃশ্য প্যাকেটটা নিয়ে সুজয়ের বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম। সুজয়
তৈরী হয়েই ছিল। যাবার আগে তার ক্যামেরায় ফ্লাশগানটা একবার লাগিয়ে দেখে নিতে গিয়ে
জানা গেল,
ফ্ল্যাশগানের
প্যকেটে তারটা নেই। সব ফ্ল্যাশগানেই দেখি একটা সরু তার ফ্ল্যাশের সাথেই
লাগানো থাকে, যেটা
ক্যামেরায় গুঁজতে হয়। এর আবার তারটা দুদিকেই খোলা যায়। খুঁতখুঁতে জয়দেবের
ফ্ল্যাশের তারটা সম্ভবত তার ক্যামেরার সাথেই অবস্থান করছে। অন্য উপায় না থাকায় বাধ্য হয়ে সুজয়ের ফ্ল্যাশ
নিয়েই যাওয়া স্থির হ’ল।
বিমল বিয়ে করতে যাবার আগে তার বাবা আশীর্বাদ করছেন, সুজয় দু’দুটো ফটো নিল,
কিন্তু একবারও
ফ্ল্যাশ কাজ করলো না। এরপর খুব কায়দা করে পালকিতে ওঠার আগে বিমল একবার মুখ ঘুরিয়ে
দাঁড়ালো,
সুজয়ও
তিন-তিনবার সার্টার টিপলো। কারণ তৃতীয়বারেই শুধু
আলো জ্বলেছিল। একটা বাচ্চাছেলে সুজয়কে জিজ্ঞাসা করলো, যে সে রঙ্গীণ ছবি তুলছে কী না। তাকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, তার বাবা রঙ্গীন ছবি তোলে। সুজয়কে
বললাম যে এখানে অন্তত একজন লোক আছে, যে ক্যামেরার ব্যবহার জানে। কাজেই সাবধান
হতে হবে। যাহোক, বর
পালকি চড়ে এগিয়ে চললো, হ্যাজাকের আলোয় আমরা সবাই তার পিছন পিছন
হেঁটে।
সরু মেঠো রাস্তা দিয়ে বিয়ে বাড়ি পৌঁছলে, আমাদের সবাইকে একটা খুব বড় বারান্দায় আপ্যায়ণ করে বসতে
দেওয়া হ’ল। সবাইকে চা ও গরম সিঙ্গারা দিয়ে যাওয়া হলেও, সুজয়কে পাত্রীর ভাইবোনের
আব্দার মেটাতে চা ফেলে ক্যামেরা কাঁধে যেতেই হ’ল। যাওয়ার আগে ও আমাকে সঙ্গী হিসাবে পেতে চেয়েছিল, কিন্তু
ফিরে গিয়ে অফিসে হাসির খোরাক হবার ভয়ে তাকে একাই যেতে বললাম।
বেশ কিছুক্ষণ পরে গম্ভীর মুখে ফিরে এসে সে জানালো, পাঁচটা ছবির মধ্যে দুবার মাত্র আলো জ্বলেছে। এভাবে চললে
তো এখনই ফিল্ম শেষ হয়ে যাবে, তাই
সে ফিল্মটা রিওয়াইন্ড করে নিয়েছে। এখানে এসে বিমলের ছবি তুলতে গিয়ে আবার দুটো ফটো
নষ্ট হ’ল। আবার রিওয়াইন্ড করতে গিয়ে ফ্লিমটা কিভাবে জড়িয়ে গেল।
ক্যামেরা খুলে দেখা গেল ফিল্মটা মুড়ে ভাঁজ হয়ে গেছে। ছবির অতীত ও ভবিষ্যৎ
সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্দেহ থাকলেও, বাধ্য হয়ে দাঁত দিয়ে
বেশ খানিকটা ফিল্ম ছিঁড়ে, নতুন
করে লাগানো হ’ল।
বিশাল ছাদে বিয়ের
জায়গাটায় আলোর অভাব হলেও, ফটো
তোলার পক্ষে আদর্শ। সুজয় বেশ কয়েকটা ছবিও তুললো, যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফ্ল্যাশ কাজ করে নি।
সে আমাকে দু’একটা ছবি তুলতে বলে বললো, “তুলে দেখ না, যদি তোর হাতে ভাগ্য ফিরে যায়”। আমি অফিসে মুরগী হবার ভয়ে ক্যামেরা বা সুজয়ের ভাগ্য ফেরাবার
ঝুঁকি
নিলাম না,
কারণ এই ছবি তোলা
নিয়ে আমরা আগে দুজনকে খোরাক করেছি।
এবার খই পোড়ানোর ছবি। বিমল তার নববধুর পিছনে
দাঁড়িয়ে,
সামনে হাত বাড়িয়ে, দু’জনে মিলে আগুনে কুলো করে খই ফেললো।
অনেকগুলো ছবির পরে ফ্ল্যাশ জ্বললো বটে, কিন্তু তার আগেই সব খই আগুনে পড়ে গিয়ে দুজনে ফাঁকা কুলো
হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
বাসরে আরও অনেকের মাঝে
বিখ্যাত ফটোগ্রাফার হিসাবে সুজয় ঘর আলো করে বসে আছে, পাশে তার সাঁকরেদ হিসাবে আমি। ঘন ঘন ছবি তোলার অনুরোধ
আসছে। আলো সমেত, আলো ছাড়া কয়েকটা ছবিও তোলা হয়েছে। সুজয় আবার আমাকে দু’-একটা ছবি তোলার জন্য অনুরোধ করলো। আমি
ঐ প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে, তাকে
হাত দিয়ে ফ্ল্যাশগানের লাইট জ্বেলে আপাতত মান বাঁচিয়ে অবস্থার সামাল দিতে পরামর্শ
দিলাম।
কোনমতে রাতটা কাটিয়ে
ভোর হতেই আমরা বিদায় নিলাম। সেদিনের সেই ফাঁকা কুলো হাতে বরকনের বিখ্যাত ছবিটা
নিয়ে মোট আটটা ছবি উঠেছিল। অফিসে সুজয়ের অবস্থার কথা আর নাই বললাম।