অমিত কুমার বিশ্বাস
তরুণ কবি-গল্পকার অমিত কুমার বিশ্বাসের গল্প সংকলন ‘রাত্রির হৃদয়েএখন নীল শুঁয়াপোকা’ হাতে
পেলাম । দশটি গল্প যায়গা পেয়েছে সংকলনটিতে । প্রকাশক ‘ধানসিড়ি’ প্রকাশন ।
` অমিত কবিতা লেখেন এবং ভালোই লেখেন । তাঁর
বেশ কিছু কবিতা পাঠের সুযোগ এই আলোচকের হয়েছে । অমিতের গল্পগুলিও কবিতারই মত ।
ইঙ্গিত ও চিত্রময়তা জুড়ে আছে আনেকটা যায়গা । কবির মত অমিত গল্পতেও পাঠকের অনুভুতি
প্রবণতাকেই গুরুত্ব দিয়েছেন । অমিত তাঁর সময়ের, তাঁর চারপাশের মধ্যবিত্ত আটপৌরে
জীবন, রেল লাইনের ধারের বস্তি আর আসেপাশের
মানুষের, বিশ্বাস যোগ্য কিছু খন্ড খন্ড ছবি লিখেছেন গল্পগুলিতে ।
সবে
চৌত্রিশে পা দেওয়া তরুণ গল্পকার বেড়ে উঠেছেন যে সময়কালে আমার মনে হয় সেই সেটা এক শূণ্যতার
সময়কাল । আমাদের আবেগ আর কোন আদর্শের আশ্রয় খোঁজে না, আশ্রয় পায়ও না । পণ্যায়নের
নিদারুণ পেষণে মূল্যবোধগুলি ক্রম নিরুদ্দেশ, আনাত্মীয় । প্রয়াত পূর্নেন্দু পত্রীর
কবিতার পংক্তি যেমন ছবিটা ধরা পড়ে – “স্বপ্নের দেওয়ালগুলি আগে সাদা ছিল / এখন
সেখানে ধুমশো সাপের মত ধ্বংসের অক্ষর”। অমিতের গল্পগুলিও কীটদ্রষ্ট সময়ের কথা।
রাত্রির হৃদয়ে নীল শুঁয়াপোকা এখন আর বর্ণময় প্রজাপতি হয়ে পাখনা মেলে না । এটাই
আলোচ্য গল্প সংকলনটি সম্পর্কে আমার পাঠপ্রতিক্রিয়ার সারাৎসার ।
‘আধপোড়া
বসন্তের কাব্য’ গল্পটিতে পাতি সিডির দোকান করে শম্পাকে নিয়ে বাঁচবার স্বপ্ন
দেখেছিল পল্টু । কিন্তু পল্টুর ‘স্বপ্নের সাদা দেওয়ালে ধুমশো সাপের মত ধ্বংশের
অক্ষর’ । শম্পার বাবা সুবোধবাবু লুকিয়ে নীল ছবি নিয়ে যান পল্টুর দেকান থেকে কিন্তু
তা বলে শম্পার সঙ্গে পল্টুর সম্পর্ক মেনে নেবেন কেন ? শম্পাও জাতপাত মানা পিতার
ভক্ত, পল্টুকে
ভালোবাসার কথা বলে আবার বাবার ঠিক করা ছেলের সঙ্গে বিয়েতেও অরাজি হওয়ার সাহস পায়
না , পল্টুর
আকাশে শুধু হেরে যাওয়ার হাহাকার । । ‘অমেরুদন্ডী’ গল্পের রেল লাইনের ধারের ঝুপড়ির
মিতুল কিন্তু ভ্যানচালক নোটনকে ঘিরে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে । ছোটবেলায় বাপ
ভেগে গেছে, পাঁড় মাতাল স্বামী চোলাই খেয়ে লাশ হয়েছে । তার শরীর খুবলে খেয়েছে
তোলাবাজ হুন্ডোরা । তবু জীবনের আশ্চর্য বোধে উজ্বল থেকে যায় মিতুল । মিতুলদের
কিংবা ‘ঘুমের মধ্যে ঘুম’ গল্পের দুখী ও কুট্টিদের কোন গল্প থাকে নয়া । থাকে শুধু
দৌড় আর ঠোক্কর । অমিত এদের দেখেছেন ।
সংকলনের শেষ
গল্প ‘রবীন্দ্রনাথ’এর নির্মিতিতে ‘ফ্যান্টাসি’র আবহ । বছরের পর বছর দৌড়েই যাওয়া
আমরা যেন একটা না পাওয়া আশ্রয় খুজছি, আর সেই আশ্রয়কে ভাঙার তামাম বন্দোবস্ত দেখেও
সেই শেষ আশ্রয়টিকেই প্রাণপণে আঁকড়ে থাকতে চাইছি । বিশ্বাসকেই আঁকড়ে থাকা ।
গল্পকার অমিত বিশ্বাস
ছোট গল্পের সনাতনী ফর্মুলার আশ্রয় নিয়ে তাঁর গল্পগুলির কাঠামো নির্মাণ করেন নি ।
তাঁর দেখা অস্থির সময়ের নানান চরিত্রের নিত্যদিনের যাপন, নিঃসঙ্গতা, বিষন্নতা, প্রেম-অপ্রেমের খন্ড খন্ড ছবি
সাজিয়েছেন । যেন তাঁরই গল্পের একটা পংক্তির মত “যেখানে প্রেমিক তার প্রেমিকাকে
ছোঁয়ার জন্য দৌড়চ্ছে কিন্তু পারছে না । বছরের পর বছর দৌড়েই যাচ্ছে, দৌড়েই
যাচ্ছে...”।
গল্পগুলি
পড়তে ভালো লাগে অমিতের লিখনশৈলীর গুনে । সাবলিল গদ্য-ভাষা কখনো বা গল্প আর কবিতার
ভেদটাই মুছে দেয় । তার ঝরঝরে ভাষা আর গল্পের সাবলিল গতি পাঠককে টানটান ভাবে গল্পের সঙ্গে লেপটে রাখে ।
পার্থপ্রতীম
সেনগুপ্তর শোভন প্রচ্ছদে মুদ্রন পারিপাট্যে প্রকাশকের যত্নের ছাপ পাওয়া যায় । ৬৪
পৃষ্ঠার বইটির দাম ৬০টাকা । এই আলোচকের নিশ্চিত বিশ্বাস বইটি পাঠক মহলে সমাদৃত হবে
।
- ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়