গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৮ জুন, ২০১৪

পুস্তক পর্যালোচনা



'রাত্রির হৃদয়ে এখন নীল শুঁয়াপোকা'

অমিত কুমার বিশ্বাস

তরুণ কবি-গল্পকার অমিত কুমার বিশ্বাসের গল্প সংকলন ‘রাত্রির হৃদয়েএখন নীল শুঁয়াপোকা’ হাতে পেলাম । দশটি গল্প যায়গা পেয়েছে সংকলনটিতে । প্রকাশক ‘ধানসিড়ি’ প্রকাশন ।

`       অমিত কবিতা লেখেন এবং ভালোই লেখেন । তাঁর বেশ কিছু কবিতা পাঠের সুযোগ এই আলোচকের হয়েছে । অমিতের গল্পগুলিও কবিতারই মত । ইঙ্গিত ও চিত্রময়তা জুড়ে আছে আনেকটা যায়গা । কবির মত অমিত গল্পতেও পাঠকের অনুভুতি প্রবণতাকেই গুরুত্ব দিয়েছেন । অমিত তাঁর সময়ের, তাঁর চারপাশের মধ্যবিত্ত আটপৌরে জীবন, রেল লাইনের ধারের বস্তি আর আসেপাশের  মানুষের, বিশ্বাস যোগ্য কিছু খন্ড খন্ড ছবি লিখেছেন গল্পগুলিতে ।

সবে চৌত্রিশে পা দেওয়া তরুণ গল্পকার বেড়ে উঠেছেন যে সময়কালে আমার মনে হয় সেই সেটা এক শূণ্যতার সময়কাল । আমাদের আবেগ আর কোন আদর্শের আশ্রয় খোঁজে না, আশ্রয় পায়ও না । পণ্যায়নের নিদারুণ পেষণে মূল্যবোধগুলি ক্রম নিরুদ্দেশ, আনাত্মীয় । প্রয়াত পূর্নেন্দু পত্রীর কবিতার পংক্তি যেমন ছবিটা ধরা পড়ে – “স্বপ্নের দেওয়ালগুলি আগে সাদা ছিল / এখন সেখানে ধুমশো সাপের মত ধ্বংসের অক্ষর”। অমিতের গল্পগুলিও কীটদ্রষ্ট সময়ের কথা। রাত্রির হৃদয়ে নীল শুঁয়াপোকা এখন আর বর্ণময় প্রজাপতি হয়ে পাখনা মেলে না । এটাই আলোচ্য গল্প সংকলনটি সম্পর্কে আমার পাঠপ্রতিক্রিয়ার সারাৎসার ।

‘আধপোড়া বসন্তের কাব্য’ গল্পটিতে পাতি সিডির দোকান করে শম্পাকে নিয়ে বাঁচবার স্বপ্ন দেখেছিল পল্টু । কিন্তু পল্টুর ‘স্বপ্নের সাদা দেওয়ালে ধুমশো সাপের মত ধ্বংশের অক্ষর’ । শম্পার বাবা সুবোধবাবু লুকিয়ে নীল ছবি নিয়ে যান পল্টুর দেকান থেকে কিন্তু তা বলে শম্পার সঙ্গে পল্টুর সম্পর্ক মেনে নেবেন কেন ? শম্পাও জাতপাত মানা পিতার ভক্ত, পল্টুকে ভালোবাসার কথা বলে আবার বাবার ঠিক করা ছেলের সঙ্গে বিয়েতেও অরাজি হওয়ার সাহস পায় না , পল্টুর আকাশে শুধু হেরে যাওয়ার হাহাকার । । ‘অমেরুদন্ডী’ গল্পের রেল লাইনের ধারের ঝুপড়ির মিতুল কিন্তু ভ্যানচালক নোটনকে ঘিরে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে । ছোটবেলায় বাপ ভেগে গেছে, পাঁড় মাতাল স্বামী চোলাই খেয়ে লাশ হয়েছে । তার শরীর খুবলে খেয়েছে তোলাবাজ হুন্ডোরা । তবু জীবনের আশ্চর্য বোধে উজ্বল থেকে যায় মিতুল । মিতুলদের কিংবা ‘ঘুমের মধ্যে ঘুম’ গল্পের দুখী ও কুট্টিদের কোন গল্প থাকে নয়া । থাকে শুধু দৌড় আর ঠোক্কর । অমিত এদের দেখেছেন ।

সংকলনের শেষ গল্প ‘রবীন্দ্রনাথ’এর নির্মিতিতে ‘ফ্যান্টাসি’র আবহ । বছরের পর বছর দৌড়েই যাওয়া আমরা যেন একটা না পাওয়া আশ্রয় খুজছি, আর সেই আশ্রয়কে ভাঙার তামাম বন্দোবস্ত দেখেও সেই শেষ আশ্রয়টিকেই প্রাণপণে আঁকড়ে থাকতে চাইছি । বিশ্বাসকেই আঁকড়ে থাকা ।

      গল্পকার অমিত বিশ্বাস ছোট গল্পের সনাতনী ফর্মুলার আশ্রয় নিয়ে তাঁর গল্পগুলির কাঠামো নির্মাণ করেন নি । তাঁর দেখা অস্থির সময়ের নানান চরিত্রের নিত্যদিনের যাপন, নিঃসঙ্গতা, বিষন্নতা, প্রেম-অপ্রেমের খন্ড খন্ড ছবি সাজিয়েছেন । যেন তাঁরই গল্পের একটা পংক্তির মত “যেখানে প্রেমিক তার প্রেমিকাকে ছোঁয়ার জন্য দৌড়চ্ছে কিন্তু পারছে না । বছরের পর বছর দৌড়েই যাচ্ছে, দৌড়েই যাচ্ছে...”।

গল্পগুলি পড়তে ভালো লাগে অমিতের লিখনশৈলীর গুনে । সাবলিল গদ্য-ভাষা কখনো বা গল্প আর কবিতার ভেদটাই মুছে দেয় । তার ঝরঝরে ভাষা আর গল্পের সাবলিল গতি  পাঠককে টানটান ভাবে গল্পের সঙ্গে লেপটে রাখে । 

পার্থপ্রতীম সেনগুপ্তর শোভন প্রচ্ছদে মুদ্রন পারিপাট্যে প্রকাশকের যত্নের ছাপ পাওয়া যায় । ৬৪ পৃষ্ঠার বইটির দাম ৬০টাকা । এই আলোচকের নিশ্চিত বিশ্বাস বইটি পাঠক মহলে সমাদৃত হবে ।

                                                                             -  ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়