গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ২৯ জুন, ২০১৪

শৌনক দত্ত

উতল হাওয়া...

রূপমানিয়া পরশু ফিরবে। লেখার টেবিল,ঘরদোর গুছিয়ে ঠাকুর ঘরের সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়েছি ধর্ম,ঈশ্বর দেবতায় আমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই অথচ রূপমানিয়া এই ঘরেই ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাতো রোজ পূজা আর্চায়।রূপমানিয়া থাকতে এই ঘরের দিকে এতগুলো বছরে আজকের মত কখনো দেখিনি আমি কখন ভেতরে ঢুকে প্রদীপ ও ধূপকাঠি জ্বেলে দিয়েছি খেয়ালই করিনি।বয়স কি কখনো কখনো বিশ্বাস বদলে দেয় ?

            তোমার বিশ্বাসই আজ আমার পাথেয় ছোট্টবেলা থেকে তোমায় দেখেছি ধর্ম,জাতপাত কে নস্যাত্ করে দিতে তোমার যে রক্ত আমার ভেতর তা ধর্ম নয় মানুষ চেনে তোমরা ও তো ভালবেসে বিয়ে করেছো ভালবাসা তো ভালবাসাই তাতে আবার ধর্ম কি ? বাবা,তুমিই বলো আমি কি অন্যায় করেছি রাহাত কে বিয়ে করে ? আমি জানি আমাকে কেউ না বুঝলেও তুমি ঠিক বুঝবে আমায়,কথাটা বলতে বলতে আমাকে জড়িয়ে ধরলো রুদালী চোখে কতদিনের জমে থাকা জল যেন বাঁধ ভেঙ্গেছে
এরই মধ্যে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। রুদালী আমাদের মেয়ে মাল্টিন্যাশানাল এক কোম্পানীর বড় চাকুরীজীবি রুদালী যেদিন পৃথিবীর আলো দেখলো সেদিন নারী দিবস আমরাও সেদিন ঠিক করেছিলাম আমাদের মেয়ে নারী নয় মানুষের মত বড় হয়ে উঠবে।তাই রুদালীর বেড়ে উঠায় আমার চেয়ে ওর মা র যত্ন ছিলো বেশি নিজের অপূর্ণতাকে সে যেন মেয়েকে দিয়ে পূর্ণ করতে চেয়েছে রুদালীর ডাকে ঘোর কেটে যায়,বাবা আমি হাসপাতাল যাবো চার.. হাসপাতাল যাওয়া নিয়ে রুদালীকে ফেরাবার নৈতিক অধিকার আমার নেই। তবু নিজেকে শক্ত করে বললাম- না,তুমি হাসপাতাল যাবে না বিস্ময়ে তাকালো রুদালী আমি এই দৃষ্টি চিনি,এই চাউনিতে হাজার প্রশ্নের বান চোখ নামিয়ে নিলো রুদালী -দূর থেকে দেখে চলে আসবো কথার পিঠে কথা সাজানোই আমার পেশা যদিও তবুও রুদালীর এই কথায় যেন আমি কথা হাতড়ে বেড়াই না বোধক মাথা নাড়ি রুদালীকে আর ভাবি খুব কাছের সম্পর্ক ও কখনো কখনো খোলা ফিতার মত দূর থেকে দূরে চলে যায়

            এত দূর থেকে রুদালী আজকের মর্নিং ফ্লাইটে এসেছে আসার পর থেকেই ঘরের এটা সেটা কাজ করছে,এখন সন্ধ্যার চা বানিয়ে নিয়ে এলো আমার আর ওর -বাবা -হুম - তোমার কি মনে হয় না মা ব্যাপারটাতে ওভার রিএক্ট করেছে ? এইসময়ে দাঁড়িয়ে এত প্রগতির কথা বলে মা যে আজো পেছন সারির মানুষ রয়ে গেছে আমি ভাবতে পারিনি,তুমি ভাবতে পেরেছো ? রুদালীর প্রশ্নের উত্তরে চায়ে চুমুক দেই আর ভাবি মেয়েটা এই দেড়মাসে যেন অনেক বড় হয়ে গেছে । আজ বড় অচেনা লাগচ্ছে ওকে

         আজকের সকালটা বড্ড অচেনা গতরাত ঘুমাতে পারিনি রুদালীর যুক্তিতর্কের ভিড়ে তলিয়ে যেতে যেতে মনে হয়েছে,বিশ্বাস আঁকড়ে বাঁচা মানুষ বিশ্বাসের ফাটল মেনে নিতে পারেনা রূপমানিয়াও পারেনি রূপমানিয়া কেন পারেনি আজ রুদালীর কাছে বড় এক প্রশ্ন। রূপমানিয়া কি আধুনিকা হয়েও মননে প্রাচীনপন্থি ?এইসব চেনা অচেনা অস্থিরতায় কখন রাত কেটে গেছে বুঝতেই পারিনি
খুব চিন্তায় ছিলাম রুদালীকে মুখের উপর বলতে পারিনি চলে যেতে।রূপমানিয়া হাসপাতাল থেকে ফিরে একপলক দেখলো রুদালীকে তারপর হাতের ইশারায় ডাকলো গত দুদিনের রুদালী যেন উধাও।ধীর পায়ে এগিয়ে এলো রুদালী। -কেন এসেছো?আমার এই অসুখ তোমার জন্য হয়নি রুদালী অপলক দাঁড়িয়ে থাকে আমি কি করবো বুঝে পাইনা সকালে একবার ভেবেছিলাম রুদালীকে বলি ফিরে যাও সেটা বলতে পারলেই হয়ত ভালো হতো রূপমানিয়া কি একটু একটু করে উত্তেজিত হয়ে উঠছে ? -মা,তুমি এখন কেমন আছো ? রূপমানিয়া কথার উত্তর দেয় না আমার দিকে পলকে তাকায় তাকিয়েই চোখ ফেরায় তারপর পা তুলে শুয়ে পড়ে রুদালীর চোখে আমার চোখ পড়ে যায়

         বাইরে আকাশ মেঘলা।গত কদিন ধরেই রোদের দেখা নেই মেঘ যেন কাটছেই না কিছুতেই রুদালীর চোখেও মেঘ। পলকে বেরিয়ে যায় আবার ফিরে আসে তারচেয়েও বেশি গতিতে - মা,বিধর্মীকে ভালবাসা কিংবা তাকে বিয়ে করাকে এত বড় করে দেখছো কেন তুমি আমি তোমাদের শিক্ষাতেই একজন মানুষকে জীবনে গ্রহন করেছি ধর্ম কে নয় এতে তুমি এত রিয়েক্ট করছো তবে কি তোমার শিক্ষা ভুল ছিলো মা ? চুপ করে থেকো না জবাব দাও রুদালী চিত্কার করে উঠে।তারপর ঘরময় নিঃস্তব্ধতা স্তব্ধতা কাটিয়ে খুব ধীরে রুদালী বেরিয়ে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়।দরজার কাছাকাছি যেতেই রূপমানিয়া উঠে বসে -আমার শিক্ষা,আমার বিশ্বাস ভুল ছিলো বড় ভুল শিক্ষা দিয়েছি তোমায় তুমি একদম ঠিক বলেছো।কিন্তু নিজের সত্ত্বা,নিজের পরিচয় বিসর্জন দিতে তোমাকে শেখাইনি কখনো রুদালী ঘাড় ঘুরিয়ে শুনছিলো এবার ঘুরে কিছুটা দৌঁড়ে আসে মা তোমার রুদালী চট্টোপাধ্যায় তাই আছে শিক্ষা বিকিয়ে রুদালী ইয়াসমিন হয়নি ভালবাসার জন্য ।

         পর্দার ফাঁকে ভেজা রোদ উঁকি দেয় অনেক দিনের পর।আমি জানি বোরখা কোন বিষয় নয় আর কোরান রূপমানিয়াও পড়েছে!কিন্তু আসল অভিমানটা ধরতে পারিনা তবে কি প্রগতির কোন কোণেই বাস করে জন্মগত বিশ্বাস,ধারনকৃত সংস্কার আর রীতির বুদবুদ?নাকি সারাজীবন যা ধারন করি তার সন্তরণ বয়সের সাথে সাথে টানতে থাকে গভীরে আর নিজের অজান্তে ডুব সাতাঁর গহীনে।