গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৮ জুন, ২০১৪

অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

   
                         ক্ষিতীশবাবুর বিবাহবিচ্ছেদ
                                     
            [মহামায়ার ভাবীজটি তৈরি করেই ভগবানবাবুর কী হোল কে জানে মায়ায় পড়ে গেলেন, না কি বেমালুম ভুলেই গেলেন, তাকে যথাসময়ে দ্বিতীয় ভুবনে আর পাঠানো হোল না। ফুটফুটে সুন্দর সেই ভাবীজটির কথা যখন তাঁর খেয়াল হোল, দোতলাটি তখন যে এক শতাব্দ এগিয়ে গেছে, তিনতলায় বসে সেটি আর ভগবানবাবুর মাথায় এল না। পুরনো মালমশলা বদলে নতুন মশলা না ঢুকিয়েই তিনি সেটিকে ডেসপ্যাচ  করে দিলেন। পাঠালেন আবার এমন প্রাপক-প্রাপিকার ঠিকানায় যাদের দোতলাবাসের সময় প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। ফলে ভাবীজটি ফুটল ঠিকই, কিন্তু মুখে কথা ফুটতে না ফুটতেই সে অনাথ হয়ে গেল। আবার একটু ডাগরডোগর হতেই ঘটনাচক্রে এবং প্রেমের চক্করে পড়ে ব্যাপারটা  দাঁড়াল এই যে বাইশ বছর বয়সেই ক্ষিতীশ আঠারো বছরের মহামায়ার নাথ হয়ে বসল।]  

            মহামায়া দেবীর বয়সের হিসেবটা যে বেজায় গোলমেলে সেটা বুঝতে বুঝতে ক্ষিতীশবাবুর জীবনটাই বয়ে যাবার জোগাড়! যতদিন চাকরিতে ছিলেন ততদিন খানিকটা আঁচ করলেও ঠিকঠাক টের পাননি। অবসরের পর চব্বিশ ঘণ্টা বাড়িতে থাকতে থাকতে এখন হাড়ে হাড়ে মালুম পাচ্ছেন। সন্দেহটা মাথায় আসতেই গৃহিণীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি ধরে ধরে ক্ষিতীশবাবু গোরু খোঁজা শুরু করলেন।
১। স্বামীর শরীরের কোন অংশে অসাবধানে পা ঠেকে গেলেই তিনি অবধারিতভাবে তাঁর পা ছোঁয়ার চেষ্টা করেন। ইদানীং কোমর ভেঙে নিচু হতে তাঁর অসুবিধে হয় বলে ক্ষিতীশবাবু সেই সব মুহূর্তে তড়িৎগতিতে নটরাজের ভঙ্গিমায় পর্যায়ক্রমে বাম ডান পা গৃহিণীর বুকের কাছে তুলে ধরেন। প্রথম প্রথম একটি পা তুলেই নিজের কর্তব্য সমাধান করতে চাইতেন তিনি। কিন্তু তাতে পতিদেবতার পায়ে গোদ হবে গৃহিণীর এই নিশ্চিত বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্তি-তর্কে পাল্লা দিতে না পেরে তিনি হার মেনেছেন। ক্ষিতীশবাবু স্মৃতি হাতড়ে দেখলেন এই অভ্যেসটা মহামায়া দেবীর নতুন কিছু নয়, ফুলশয্যার পরদিন সকালে উঠেই তিনি তাঁর বাইশ বছরের পুঁচকে পতির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিলেন। রাত্রে পতির পেটের ওপর পা তুলে ঘুমনোর অভ্যেসটি রপ্ত করলেও সকালে তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করার রেওয়াজটির কোন পরিবর্তন ঘটেনি। স্মৃতির ঝাঁপি আরো একবার খুললেন ক্ষিতীশবাবু; কিন্তু তাঁর পিতৃদেবের চরণ নিয়ে তাঁর মাতৃদেবীও এমনটি করতেন বলে তাঁর মনে পড়ল না। সেই মহিলা তো বিশ শতকের প্রথম দিকে জন্মে ওই শতকেরই শেষে দেহ রাখেন। সুতরাং তাঁর গৃহিণীর এই আচরণটি বিশ শতকীয় নয়, অধিকপক্ষে উনিশ শতকীয় আচরণ।

২। মহামায়া দেবী তাঁর স্বামীর নাম কখনো জিভে আনেন না। এটি অবশ্যি খুব পুরানো আচরণ নয়। ক্ষিতীশবাবুর বাবার নাম ঁআতঙ্কভঞ্জন পতিতুন্ডি, আর তাঁদের বাড়ির চারদিকে ছিল প্রচুর আতাগাছের ঝোপ। তাঁর মা ভালও বাসতেন খুব আতা খেতে। ছোটবেলায় ক্ষিতীশের একটি বিশেষ কর্তব্য ছিল বরণ-লাগা, অর্থাৎ যে আতার গুটিগুলি ফাঁকা ফাঁকা হয়েছে আর সেই ফাঁকা জায়গায় ঈষৎ গোলাপি ছোপ ধরেছে সেইগুলি খুঁজে পেতে বাড়ি নিয়ে আসা। চালের ভেতরে একদিন ঢুকিয়ে রাখলেই সেগুলি পেকে যেত। তো একদিন তাঁর ভাইপো অন্তু এসেছে তাদের বাড়িতে। মা তাকে আদর করে বললেন, - যা তো বাবা জন্তু, ঘরে দুটো পাকা ছাতা আছে, একটা তুই খা আর একটা আমাকে এনে দে।
অন্তু ভয় পেয়ে সেখান থেকে পালিয়ে এসে ক্ষিতীশকে ফিসফিস করে বলেছিল, - কি রে খেতো পিসির মাথাটা যে খারাপ হয়ে গেছে আমাকে কেউ বলেনি তো? আমাকে বলে কিনা ছাতা খেতে!
মহামায়া দেবী অবশ্যি সেরকম কিছু বলেন না। নেহাতই কাউকে স্বামীর নাম বলার প্রয়োজন হলে বলেন, - মূর্ধন্য - হ্রস্র-, - দীর্ঘ- তালব্য পতিতুন্ডি। সেটা কারুর বোধগম্য না হলে তাকে বর্ণ পরিচয়-দ্বিতীয় ভাগ পড়ার পরামর্শ দিয়েই বাক্যালাপ বন্ধ করে দেন। বিদ্যাসাগর উনিশ শতকের মানুষ, তাঁর বর্ণ পরিচয়ও ওই  শতকেই রচিত। বইটির প্রতি গৃহিণীর পক্ষপাত নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে তাঁর উনিশ শতকীয় সংশ্রব।
 
৩। ভূত-প্রেত, তন্ত্র-মন্ত্র, ঝাড়ফুঁক, বাণ-মারা, বাটি-চালা, বশীকরণ, নজর-লাগা ইত্যাদিতে মহামায়া দেবীর অটল বিশ্বাস। অন্য দিকে পোকামাকড়, মাকড়সা-টিকটিকি-আরশোলা, মায় কুকুর-বেড়াল এর প্রতি তাঁর ঘেন্না; এমনকি মানুষজনকেও বড্ডো দুর্‌-ছাই করেন তিনি। কাজের মেয়েদের ছাড়া তাঁর একটি দিনও চলে না, আবার সেই মেয়েদের ছোঁয়াছুঁয়ি যথাসম্ভব বাঁচিয়ে চলেন। নিজের পতিদেব ছাড়া একমাত্র ঠাকুরদেবতাদের সান্নিধ্যেই তিনি স্বচ্ছন্দ। যতদিন ক্ষিতীশবাবুর চাকরি ছিল ততদিন তাঁকে খুব বেশি সময় কাছে পেতেন না। তাই নিজের পাহাড়প্রমাণ অভিযোগের অতি সামান্যই পতিদেবের উদ্দেশ্যে ক্ষেপণ করতে পারতেন। এখন সেই আক্ষেপ তিনি প্রাণভরে মিটিয়ে নিচ্ছেন। এমনকি, ঠাকুরঘরে সামান্য যে ঘণ্টা পাঁচেক তিনি তাঁর অসংখ্য দেবদেবীর সেবায় কাটান, সেসময় তাঁর হাত দুটি সেবারত থাকলেও শ্রীমুখে যে মন্ত্রোচ্চারণ হয় সেগুলি তাঁর পতিদেবের উদ্দেশ্যেই নিবেদিত। প্র না বি কেরি সাহেবের মুন্সি বলেছিলেন যে উত্তম বীণা-যন্ত্রের সাধ্বী পত্নীর বিনা কারণে ঝঙ্কৃত হয়ে ওঠা স্বভাব। তো সেই মুন্সিজী, রামরাম বসু তো ঊনবিংশ শতাব্দীরই বাসিন্দা ছিলেন। সেকালের সাধ্বী পত্নীদের সঙ্গে মহামায়া দেবীর স্বভাব এতটাই মিলে যাচ্ছে যে ক্ষিতীশবাবু প্রায় নিঃসংশয় হয়ে গেলেন যে তাঁর জন্মলগ্ন ১৯৫৫ সালের পরিবর্তে ১৮৫৫ হওয়াটাই যুক্তিযুক্ত। তাছাড়া, একদিকে একদল কাজের মেয়ে অন্যদিকে এক দঙ্গল ঠাকুর নিয়ে বসবাস করার অভ্যেসটিও ওই সময়ের যখন পতিদেবতারা সারাটি দিন চাটুকার পরিবৃত হয়ে ধুতি ঘুড়ির মাঞ্জায় কিংবা বেড়ালের বিয়ের পরিকল্পনায় বিভোর থাকতেন এবং সন্ধেবেলায় সুরাসুর মগ্নতায় বাঈজির ঘুঙুরে মোহরবৃষ্টি করে সারারাত তার বুকের ওপর উপুড় হয়ে থাকতেন।

            গবেষণা শেষ করে ক্ষিতীশবাবু দৃঢ় সিদ্ধান্তে এলেন যে তাঁর গৃহিণীর ১৯৫৫ সালে মর্তে আগমন নেহাতই হিসেবের গরমিল। কী হিসেব, কার হিসেব সেটা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক বিধায়ে সেই ভাবনা শিকেয় তুলে তিনি ভবিষ্যতের কর্মপন্থা ঠিক করে ফেললেন। তাঁর নিজের জন্মসাল ১৯৫১, গৃহিণীর প্রকৃত জন্মসাল ১৮৫৫; কাজেই প্রকৃত প্রস্তাবে তিনি এতকাল তাঁর থেকে পাক্কা চুরানব্বই বয়সে বড় এক প্রাচীন মহিলার সঙ্গে ঘর করছেন! এতদিন যা হওয়ার হয়েছে। অবসরের পর তিনি এক প্রকৃত স্বাধীন মানুষ। একজন স্বাধীন মানুষের পক্ষে আর যাই হোক, চুরানব্বই বছরের বড় কোন মহিলার সঙ্গে ঘর করা শোভা পায় না। অতএব আর কালক্ষেপ না করে একটা সুষ্ঠু পদ্ধতিতে বিয়ে ভাঙার ব্যবস্থা করতে হবে। কোনরকম কেচ্ছা কেলেঙ্কারি নয় গৃহিণীকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে মিউচুয়্যাল ডিভোর্সে রাজি করাতে হবে। 

            ক্ষিতীশবাবু সুযোগের অপেক্ষায় থাকলেন। একদিন পরেই বৃহস্পতিবার মহামায়া দেবীর স্পেশাল দিন। রান্নার মেয়ে করুণার দিনটায় ঠাকুরঘরে স্পেশাল ডিউটি। সকালে এসেই তাকে আগে নিজেরজাত-বেজাতের ছোঁয়াজামাকাপড় ছেড়ে মহামায়া দেবীর সযত্নে রাখাপূত-পবিত্রপোশাক পরতে হবে। সাজবদলের পুরো প্রক্রিয়াটিই তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করবেন। তাঁর এই কঠিন পরীক্ষায় অতীতে বহু মেয়েই ফেল করেছে। এমনকি তাঁর খাস পরিচারিকা বকুলও যখন ডাহা ফেল হোল, ক্ষিতীশবাবু বুঝলেন কোন কুমারী মেয়ের পক্ষেই এটাতে পাশ করা সম্ভব নয়। পরীক্ষক মহিলা বলেই যে তারা পুরোপুরি লজ্জা বিসর্জন দিতে পারবে এমন নয়। অবশেষে তিনিই গৃহিণীকে পরামর্শ দিলেন করুণাকে ট্রাই করতে আর তিনি নিজে করুণাকে গোপনে একটা লোভনীয় অ্যামাউন্টের বিশেষ ভাতা এই কাজের দরুন অফার করলেন। ফল হোল চমকপ্রদ; করুণা সসম্মানে পরীক্ষায় উৎরে গেল। ক্ষিতীশবাবু বিশেষ বৃহস্পতি-কলরবের উপদ্রব থেকে রেহাই পেলেন। তখন থেকে এই ব্যবস্থাই চালু। করুণা সাজ বদল করে ঠাকুরের বাসন, জামাকাপড়, ঘট ইত্যাদি পরিষ্কার করে, ঠাকুরঘর ধুয়ে মুছে তকতকে করে এবং মহামায়া দেবী স্নান সেরে তাঁর ঠাকুরদের সাজাতে বসেন। এই পুরো সময়টাতে তাঁর অধার্মিক স্বামীটি যাতে কোন অনাচার না করতে পারেন সেজন্যে তাঁকে শোওয়ার ঘরে বন্দি থাকতে হয়। ক্ষিতীশবাবু অবশ্যি তাতে অখুশি নন। তিনি বেশ মৌজ করে সিগারেট টানতে টানতে (ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকারক) আনডিস্টার্বড্পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারেন।

            এই বৃহস্পতিবারে ক্ষিতীশবাবু হিসেব কষে নিজের খুশি বিসর্জন দিলেন। করুণা তার স্পেশাল ডিউটি সেরে রান্নাঘরে ঢুকেছে, মহামায়া দেবদেবীদের স্নান করিয়ে তাঁদের সাজাতে বসেছেন, ক্ষিতীশবাবু অমনি লক্ষ্মণরেখা পেরিয়ে ঠাকুরঘরের দরজার কাছে এসে সিগারেটের ধোঁয়া ঠাকুরঘরের হাওয়ায় ভাসিয়ে দিলেন। নাকে গন্ধ যেতেই মহামায়া আঁতকে উঠে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করে দিলেন, - যাঃ দিল এঁটো ধোঁয়ায় দিলো সব একাকার করে! ভীমরতিতে ধরল না কী? মনে নেই আজ বেস্পতিবার! কতবার বারণ করেছি এদিকে আসবে না যেন তক্কে তক্কে থাকে! এখন কী হবে?
রান্নাঘর থেকে করুণার প্রেসক্রিপশন ভেসে এল, - গঙ্গাজল ছিটিয়ে দাও কাকিমা, তাইলেই শুদ্ধু হয়ে যাবে।
ক্ষিতীশবাবু বললেন, - রান্না হোল করুণা? আমার খিদে পেয়েছে।
করুণা বলল, - এই তো সবে রান্নাঘরে ঢুকলাম কাকাবাবু
মহামায়া ঘরময় গঙ্গাজল ছিটোতে ছিটোতে বললেন, - খিদে না হাতি! আমার পেছনে লাগার বাহানা একটা দিন  একটু ভালো পুজো করি সেটাও সহ্য হয় না। ওই বলে না যারে দেখতে নারি তার চরণ ব্যাঁকা?
ক্ষিতীশবাবু বিনা মন্তব্যে গৃহিণীর প্রবচনের ব্যর্থ প্রয়োগটি উপভোগ করলেন। কারণ রুটিন ভাঙতে আজ তিনি  বদ্ধপরিকর। বললেন, - আমি ডায়াবেটিসের রুগি, ঠাকুর নিয়ে পড়ে থাকলে তো আমার চলবে না; সময়ে খাওয়াদাওয়া করতে হবে।
কে বারণ করেছে সময়ে খেতে? এই বকুল, তোর দাদুকে দই-চিড়ে মেখে দে তো। ঠাকুর যেন ওনার দু-চোখের বিষ! বয়স হচ্ছে, এসময় লোকে পুজো-আচ্চায় মন দেয়। তা না ওনার খালি বই মুখে নিয়ে পড়ে থাকা আর ঠাকুর-দেবতা নিয়ে ইয়ারকি মারা! সংসারে মঙ্গল হবে কি করে!
এই সময় আমি দই-চিড়ে গিলব? পাগল নাকি! তুমি সংসারের মঙ্গল নিয়ে থাকো। আমি আমার মতো থাকবো। কাল থেকেই অন্য ব্যবস্থা হবে।
কী ব্যবস্থা শুনি?
সে সব সন্ধেবেলায় ঠাণ্ডা মাথায় হবে। আপাতত তোমার যাগযজ্ঞ চলুক।      
কথা শেষ করে ক্ষিতীশবাবু নিজের গণ্ডির মধ্যে ফিরে এলেন।
            সন্ধের পর কাজের মেয়েরা বিদেয় হলে মহামায়া সারা দিনের ধকল কাটাতে বিছানায় টানটান হওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছেন, এমন সময় ক্ষিতীশবাবু এসে সকালের তুলে রাখাব্যবস্থাটি তাঁর সামনে নামালেন।
ভেবে দেখলাম, তোমার সঙ্গে এক সংসারে থাকা আর সম্ভব নয়।
মহামায়া ভুলেই গিয়েছিলেন সকালের প্রসঙ্গটা। স্বামীর কথা শুনেই তেলে-বেগুনে হয়ে গেলেন, -- তা যাও না যেখানে যাবে নতুন সংসার করতে।
এটা রাগের কথা নয়। ঠাণ্ডা হয়ে সব শোন আগে। তোমার ঠাকুর-ঠুকুরের দৌরাত্ম্য আর আমার সহ্য হচ্ছে  না। তুমি তো তাঁদের ত্যাগ করতে পারবে না। এর সহজ সমাধান হোল দুজনের আলাদা হয়ে যাওয়া।  
হও না আলাদা, কে বারণ কচ্ছে!
হও বললেই কি হয়? স্বামী-স্ত্রীর আলাদা হওয়া আর ভায়ে ভায়ে আলাদা হওয়া কি এক? ভাগাভাগির ব্যাপার তো আছেই। তা ছাড়াও আছে সইসাবুদের ব্যাপার। বিবাহবিচ্ছেদ কি সোজা কথা! তোমার ভরণপোষণের একটা ভালোমত ব্যবস্থা করাটাও জরুরি  
বিবাহবিচ্ছেদ  ? মানে ডিভোর্স? মানে আমাকে ছেড়ে দিয়ে আর একটা কাউকে বিয়ে করবে? কাকে করবে শুনি? কারুর সঙ্গে তোমার লটরপটর আছে বলে তো কখনো শুনিনি!
ছিঃ ছিঃ এই বয়সে নতুন করে কেউ বিয়ে করতে যায়! বিচ্ছেদ হলেই আবার একটা বিয়ে করতে হয় কে বলল?
কে আবার বলবে? আমি কি কিছু খবর রাখি না ভাবো? ওই যে গো মমতাশঙ্করের কে যেন হয় সেতার না কী যেন বাজায় তিনি করেননি বুড়ো বয়সে? তারপরে তোমার ওই যে কী যেন সেন যার বউটা গপ্পো  লেখে, একটা মেয়ে বোধয় সিনেমায় নেমেছে তিনি করেননি বুড়ো বয়সে আবার বিয়ে?
কী যে বলো না তুমি! ওঁদের সঙ্গে আমার তুলনা? সারা পৃথিবী ওঁদের চেনে। আজ এদেশে কাল ওদেশে ওঁদের ঘুরতে হয়; দেশি-বিদেশি বউ না থাকলে লোকে কি বলবে?
মহামায়া দেবী ভেবে দেখলেন তাঁর স্বামী কখনো বিদেশে যাননি। তিনি আশ্বস্ত হলেন। বললেন, -- ঠিকাছে, থাকো তুমি আলাদা।
গুড। আমার পেনশন তো জানো তিরিশ। দশ থাকবে ইলেকট্রিক আর ফোনের বিল, বাড়ির ট্যাক্স আর মেরামতির জন্যে। বাকি কুড়ির মধ্যে তোমার দশ, আমার দশ। বিচ্ছেদ নিচ্ছি বলে ভেবো না যে তোমার ঠাকুরের ভরণপোষণের দায় নেবো না। ওনাদের জন্যেও পাঁচ বরাদ্দ থাকবে আমার জমা টাকার সুদ থেকে। ঠাকুর বেচারারা তো চুপচাপ সেবা ভোগ করা ছাড়া নিজেরা কিছু করতে পারেন না। তাই তাঁদের অভিভাবিকা হিসাবে সেই টাকা তোমার হাতেই তুলে দেব।
ঠাকুরদেবতাদের নিয়ে একদম ইয়ারকি দেবে না বলে দিচ্ছি।
আরে ব্বাস! যে একেবারে মুজতবা-সুলভ শব্দ-প্রয়োগ! ক্ষিতীশবাবু নীরবে বাহবা দিলেন তাঁর উড-বি-এক্স ওয়াইফকে। মুখে বললেন, -- সরি সরি। আর হবে না। এবার মন দিয়ে শোন ভাগাভাগির ব্যাপার এখনো অনেক বাকি। তার আগে আর একটা দরকারি কথা। ব্যাংকে আমাদের জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট যেমন আছে তেমনই থাকবে। আমি সরকারকে জানাবো না আমাদের ডিভোর্সের কথা। কাজেই আমি মরলে তুমি বিধবা পেনশন ঠিকই পাবে।
অলক্ষুণে কথা একদম মুখে আনবে না। আমার মা-বাবা আমাকে এক মাস বয়সে ফেলে রেখে সগ্গে যাওয়ার সময় আশিব্বাদ করে গেছে আমি আজীবন সধবা থাকবো। 
বার্তাটি পুরানো। ক্ষিতীশবাবু অনেকবার শুনেছেন। সম্ভবত গৃহিণীর কোন দেবতাই তাঁকে বার্তাটি দিয়েছেন। তবুও যে তিনি ঈষৎ বিচলিত হলেন তার কারণ তাঁর সন্দেহ হোল গিন্নি বোধ হয় বিচ্ছেদটাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছেন না। স্বামী-বিচ্ছেদের পর তিনি সধবা থাকেন কি করে? বা, প্রাক্তন স্বামীর দেহ রাখার সঙ্গে তাঁর বিধবা হওয়ার যে কোন সম্পর্ক নেই এই বোধটি তাঁর জেগেছে বলে মনে হচ্ছে না। ব্যাপারে আর কথা বাড়ানো নিরর্থক বুঝে ক্ষিতীশবাবু প্রসঙ্গে ফিরলেন, -- কাজের মেয়েদের ভাগ-বাঁটোয়ারা আমি যেমন ভেবেছি বলছি, তোমার আপত্তি থাকলে পরিবর্তন করা যাবে। করুণা আর বকুলকে ছাড়া তোমার চলবে না। বাকি রইল জবা। তাহলে আমার ভাগে পড়ল। ঘরদোর আর জামাকাপড় পরিষ্কার করা ছাড়া অন্য কাজ আমার কিচ্ছু নেই। রান্নাটা আমি নিজেই করে নেব, দরকার হলে জবাও একটু সাহায্য করবে।
তুমি করবে রান্না! তাহলেই হয়েছে। ওসব ফন্দি ছাড়ো, রান্না একসাথেই হবে; করুণাই করবে। তোমার খাবারটা না হয় আলাদা করে তোমার ঘরে পৌঁছে দেবে। -- মহামায়া দেবী সুপ্রিম কোর্টের সুরে ফরমান জারি করলেন।

ক্ষিতীশবাবু বুঝে গেলেন বিষয়টায় এখন কথা বাড়ালে অনর্থ হতে পারে। মনটা খুঁতখুঁত করলেও এই ভেবে নিজেকে প্রবোধ দিলেন যে যৌথ রন্ধনে বিবাহ বন্ধনের দোষ লাগে না। সবশেষে তিনি এবার সর্বাধিক স্পর্শকাতর প্রসঙ্গটিতে চোখ বুজে লাফ দিলেন। খুবই উদাসীন ভঙ্গিতে বললেন, -- বাড়ি ভাগের বিষয়টা খুবই সোজা। নীচতলায় ঠাকুরদেবতারা বাস করেন। কাজেই নীচতলা তোমার আর দোতলায় আমার বইপত্তর থাকে, দোতলা আমার।
মহামায়া বললেন, -- সে তুমি দোতলা নাও। দিনের বেলায় সেখানে যা খুশি কর, কিন্তু রাত্রে তোমাকে নীচে এসে আমার ঘরে শুতে হবে। একলা আমি শুতে পারব না, আমার ভয় করবে।
যেখানে বাঘের ভয় সন্ধেটা সেখানেই হয়। ক্ষিতীশবাবু এই ভয়টাই পাচ্ছিলেন। এই অতি প্রাচীন মহিলাটির সঙ্গে যদি এক ঘরেই রাত পোহাতে হয় তাহলে বিচ্ছেদের আর কী মানে থাকে! তিনি চোখ বড় বড় করে বললেন, -- এটা তুমি কী বলছো মায়া ছিঃ! কাগজে সই করেই তো তুমি আমার স্ত্রী হয়েছিলে মনে আছে তো? সেই তুমি যখন আবার পাল্টা কাগজে সই করবে, তখন কি তুমি আর আমার স্ত্রী থাকবে? আমি তো তখন পরপুরুষ। সেই পরপুরুষের সঙ্গে একঘরে রাত কাটানোর কথা তোমার মাথায় আসে কি করে!
কথা শেষ করেই ক্ষিতীশবাবু লম্বা যুক্তিতর্কের জন্যে মনে মনে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁকে অবাক করে মহামায়া দেবী কেমন একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাঁর দিকে মিনিট খানেক পলকহীন তাকিয়ে থেকে হাত বাড়ালেন সামনে। বললেন, -- দাও তোমার কাগজ, কোথায় সই করতে হবে বলো।


            দোতলার ঘরের বিশাল বিছানায় মনের সুখে হা-ডু-ডু খেলতে খেলতে কখন যেন গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলেন ক্ষিতীশবাবু। হঠাৎ- বুকের ওপর একটা ভার অনুভব করে ঘুমটা ভেঙে গেল তাঁর। অন্ধকারে ঘুমের ঘোরে ভারী বস্তুটির ওপর হাত রাখতেই টের পেলেন উষ্ণ অশ্রুতে মাখামাখি এক নরম কপোল। তাঁদের বিয়ের দু-বছরের মাথায় কোন অনুজের আগমন-সম্ভাবনা বিনষ্ট করে মাত্র তিনটি বছর খুশির ফুল হয়ে ফুটেছিল যে তাঁদের যৌথ জীবনে, তার যাবতীয় স্মৃতি তাঁরা সপাটে মুছে ফেলেছেন তাঁদের জীবনের বহিরঙ্গে। এমনকি, দুজনে একান্তেও কখনো তার কথা উচ্চারণ করেন না। কেবল বিপন্নতার নিরুদ্ধ মুহূর্তে সে ছুটে আসে জনক-জননীর বুকে তার চিরকোমল হাতটি বুলিয়ে দিতে। যন্ত্রণাবিদ্ধ ক্ষিতীশবাবু পরম মমতায় সস্নেহ আঙুলে মুছে নিতে লাগলেন অশ্রুবিন্দুগুলি। দুই শতাব্দের মধ্যিখানে সময় জেগে রইল ধ্রুবনক্ষত্রের এক মায়াসেতু হয়ে।