গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৮ জুন, ২০১৪

বচন নকরেক

গাছ

গাছের মহাজন আসার কথা। সকাল থেকে আজ চায়ের স্টলে যায়নি কানিন গাছটা তাদের বিয়ের দিনে লাগানো হয়েছিল। বন্ধু স্টিফেন উপহার হিসেবে দুটো মেহগনি চারা এনেছিল। গ্রামের যুবকেরা খোল করতাল বাজিয়ে অনেক আনন্দ করে বরকনেকে দিয়ে বিয়ের স্মৃতি হিসেবে লাগিয়েছিল। খ্রিস্টিনা আর ধরাধামে নেই। বিশ বছর আগেই মরে গেছে আট বছরের ক্যাথি আর পাঁচ বছরের তিথিকে রেখে। এরপর অনেক কষ্টে ক্যাথি তিথি বড় হয়েছে বাবার কাছে। মা ছাড়া জীবন কতো কঠিন তা ক্যাথি তিথি ভালই বোঝে। বাবাই মা ভূমিকা নিয়েছে এতো বছর। কামাই করে এনে তাদের রান্না করে খাওয়ানো, গোছল করানো, পড়াশোনা করানো, স্কুলে পাঠানো -ব। সবাই পইপই করে কানিনকে বলেছিল তখন-–আবার বিয়ে কর। মেয়ে দুটির কথা ভেবে করেনি। এখন বয়সে নি:সঙ্গ থাকতে হয়। অসুখ হলে দেখার কেউ কাছে নেই।

শ্বশুর বাড়ি থেকে দুখান গাভী গরু পেয়েছিল কানিন। কারণ বিয়ের মাত্র তিন বছর পরেই আলাদা ঘর করে নতুন ভিটেয় উঠতে হয়েছিল তাকে। তখন ক্যথির বয়স দুবছর আর তিথি মায়ের গর্ভে। বিয়ের দিনে কানিনের হাতে লাগানো মেহগনি চারাটি গাভী দুটির পায়ে দলিত হতে হতে এক সময় মরে গিয়েছিল। কিন্তু খ্রিস্টিনার হাতে লাগানো চারাটি কেমন করে যেন বেঁচে যায়। ভোরে আকাশ ফর্সা হয়ে এলে গাভী দুটি প্রসাব করে দিত। ছর ছর করে মাটিতে পড়ার শব্দ শুনে খ্রিস্টিনা জেগে উঠতো। আর কানিনকে জাগিয়ে দিয়ে উঠোন ঝাাঁট দেয়া শুরু করে দিত। এরই মধ্যে ক্যাথিও বিছানায় বসে পড়ে হাই তুলতো। দগ্দগিয়ে বেড়ে বিয়ের স্মৃতি মেহগনি চারাটি কবে গাছ হয়ে গিয়েছিল খ্রিস্টিনার আদর খেয়ে খেয়ে। গাছের গোড়ায় গোবর, পচা আবর্জনা আর সকাল বিকেল জল ঢেলে দিতে দিতে রোজ খ্রিস্টিনা বলতো-গাছটা সাক্ষী, বেঁচবে না কিন্তু মনে রেখো।

মাস্টার বাড়ি আছেন?’ বাইরে থেকে গাছ মহাজন ডাক দেয়। অসুস্থ কানিন কিছুক্ষণ বিছানায় বসে দ্বিধা-দ্বন্বে ভোগে। পরে ভালমত ভেবে শেষে বলে দেয়, ‘আজ অসুখ বেশিতো আমার, পরে খবর দিমুনি।মহাজনধুস, বার বার বেঁচবা কইয়্যা খবর দেও আবার না কর।বলে বিরক্ত প্রকাশ করে চলে যায়। তাহলেও কী হবে এরকম বড় গাছ আর আশপাশে নেই। অনেক গাছমহাজন গাছটা কেনার জন্য খোঁজ খবর নেয় নারায়নের চা স্টলে। এখানেই কানিন মাস্টার রোজ চা খেতে আসে আর ভালমন্দ কথা বলে।

পাকিস্তান পিরিয়ডে ৭ম শ্রেনী পাশ কানিন ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি শিক্ষকতাও করতো। এক সময় সারা এলাকায় তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। পাঁচ সাত মাইল দূরে জঙ্গুলে রাস্তা দিয়ে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে গিয়ে ধর্ম প্রচারের কাজ করতো। তখন গভীর বনের ভিতর সরু জঙ্গল পথে অনেক অজানা বিপদ অপেক্ষা করতো। একবার কোন রকমে গাছে উঠে দাঁতাল বুনো শুকরের আক্রমন থেকে রক্ষা পেয়েছিল। এরকম অনেক বিপদ-সমস্যা আর অকালে স্ত্রী হারানোর মত দু: সয়ে বেঁেচ আছে কানিন। এদিকে বিয়ের পর ক্যাথি শহরে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে আছে। তাদেরই সাথে থেকে ক্যাথিও পড়াশুনা করছে সেখানেই। কাজের মেয়েকে নিয়ে ক্যাথি তিথি চলে গিয়েছিল বাড়ী ছেড়ে। ঘরে অনেক কাজ। মেয়ে দুটির পড়াশুনায় যাতে ব্যাঘাত না ঘটে এর জন্যে এক বিধবা মান্দাই মেয়ে সবিতাকে কাজ করাতে বাড়ী এনেছিল কানিন। এসময় নানা জন নানা কথা কানাঘুষা করতো। অনেকে সন্দেহ করে ক্যাথি তিথিকে নানা কথা শুনাতো। বলতো, ‘এতোদিন পর তোদের বাবা তোদের জন্য মা আনলো। আমরা তোমাদের মা মারা যাবার পরই বলেছিলাম আবার বিয়ে করতে।এরকম নানা কথা শুনাতো। একদিন তাই নিয়ে বাবার মুখোমুখি হয় ক্যাথি তিথি। বাবা বলেছিল, ‘এতোদিনেও তোরা আমাকে বুঝলি না। তোরাতো জানিস না মাতৃসূত্রীয় নিয়মের ঘোরপ্যাঁচ। আমি জামাই যাই নি। তোর মাকে বউ এনেছিলাম বলে কথা। নইলে বউ নিতে না চাওয়ার জন্য তোর মামারা আমাকে তাড়িয়েই দিতো। কিন্তু আমার বেলায় তা পারেনি। একেতো আমি শ্বশুর বাড়ী থেকে কোন জমাজমি নিইনি। মাত্র দুটি গাভী ছাড়া। তাও নাকি তোর মার জমানো পয়সায় কেনা ছিল সে সবতো তোদের পড়ানোর পেছনেও খরচ হয়েছে। আর টানা ১৫ বছর মিশনারি স্কুলে শিক্ষকতা করেছিলাম। এতগুলো জমাজমি করেছি সব আমার জমানো টাকা দিয়ে। তাই আমার বাড়িতে কারো মাতব্বরী খাটে না। আর লোকে নানা কথা বলে আমাদের ক্ষতি করার বৈ কিছু না। ঠিক আছে কাল থেকে সবিতা আর আসবে না। সব আমিই সামলাবো। তোমাদের কাজ পড়াশুনা করে যাওয়া

স্ত্রী মারা যাবার পর শ্বশুর বাড়ি থেকে কয়েকজন এসেছিল কানিনকে নতুন বউ দেয়ার ব্যাপারে কথা বলতে। কিন্তু এক পর্যায়ে কানিন ক্ষেপে যায়। লোকগুলোকে কড়া কথা শুনিয়ে দিয়ে কানিন বলেছিল, ‘বাদ দাও আমাকে দিয়ে এসব হবে না। আমার দুজন ছোট্ট মেয়ে আছে। তাছাড়া আমি মাস্টার আর খ্রিস্টান মানুষ।তারপরেও কানিনের বিয়ের ব্যাপার নিয়ে তার বাড়িতে অনেকে এসেছে গেছে। বিষয়ে তার ছিল দৃঢ় জবাব, ‘না। আমি আমার মেয়ে দুটিকে কষ্ট দিতে পারব না।

গাছের মত নি:সঙ্গ হয়ে থাকা কানিন বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ছনের চালে গুঁজে রাখা নিমের ডাল দিয়ে দাঁত মাজে। আসামে ছোট বনের কাছে একবার ঘুরে আসার কথা ভাবে। ৬৪তে একবার গিয়েছিল আসাম। আত্মীয়দের অনেকেই আসাম, ত্রিপুরা মেঘালয়ে আছেন। মরে যাবার আগে একবার ঘুরে আসা দরকার। এতদিন কোথাও যাওয়া হয়নি গাছটার জন্য। তার কেবলই মনে হত বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও গেলে কাঠ চোরেরা খ্রিস্টিনার স্মৃতি গাছটা কেটে নিয়ে যাবে। দুদিনের অসুখে স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে। মামা আদু- কথাও মনে পড়ছে তার। আদু মামা সেই যে সংগ্রামে চলে গেছে ত্রিপুরা আর ফিরেনি। লোকমুখে শুনেছে সেখানে সে আবার বিয়ে করেছে। পারলে তার সাথেও দেখা করবে আর না পারলে নাই। রোয়ার পাম্পের ওয়াসার পুরানো হয়ে গেছে পানি কম বের হয়। বাসী ঘামগন্ধ মাখা বালিসওয়ার, শার্ট-প্যান্ট বালতিতে রেখে আস্তে আস্তে রোয়ার পাম্প টানা শুরু করে কানিন। অল্পতেই হাপিয়ে ওঠে। বারান্দায় গিয়ে বেঞ্চে বসে জিরিয়ে নেয়। আবার এসে টানে। এভাবে বালতিতে জল ভরে গেলে হুইল সাবান দিয়ে কাপরগুলো কেঁচে রোদে শুকাতে দেয়। গাছ বেচা না বেচা নিয়ে সারারাত ভেবেছে সে। আর স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েছে, গাছ বেচবে সে। কিন্তু এত বছর অনেক অভাব থাকা সত্বেও গাছ বিক্রির স্থির সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি কানিন। কারণ গাছে হাত রাখলেই খ্রিস্টিনার কথা মনে পরে যেত তার দুধেল দুটি খয়েরি গাইয়ের কথাও মনে পরে যেত গাই দুটি বেচে ৬০ শতক জমি কিনেছিল সেই খ্রিস্টিনারই সন্মতিতে। অই জমিতে কাঁঠাল বাগান করেছিল। পরে ক্যাথি তিথি বড় ক্লাসে উঠলে খরচ বেড়ে যাওয়ায় বেচে দিতে হয়েছিল কাঠ হিসেবে। এখন জমিটা কলা বাগানের জন্য দেয়া আছে। আরো ১০ পাখি জমিও কলা চাষীদের কাছেই মেয়াদী দেয়া আছে। ঢাকা শহরে পড়ানো অনেক খরচ। তার উপর ক্যাথির বিয়ের সময়ও অনেক খরচ হয়। ঢাকায় পড়তে যেয়ে এডুয়ার্ডের সাথে পরিচয় হয় ক্যাথির। পরিচয় থেকে প্রেম্ এডুয়ার্ড অ্যামেরিকা এ্যাম্বাসিতে চাকুরী করে। ভাল মাইনে পায়। এখন ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে। ক্যাথিরও এরই মধ্যে একটি বড় এনজিওতে চাকুরী হয়ে গেছে। অই যে কাজের মেয়ের সাথে বাবাকে নিয়ে লোকমুখে গুজব শুনে রাগ করে চলে গিয়েছিল। অনেকদিন হয় বাবার খোঁজ খবর নেয় না।

যাদের জন্য এতো ত্যাগ স্বীকার, যাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ২য় স্ত্রী গ্রহণ করল না কানিন। তারাই যদি তাকে ভুল বোঝে তাহলে এভাবে পড়ে থেকে কী লাভ! তাছাড়া ইস্টি-গোষ্ঠী ইন্ডিয়াতে থাকে।
এলাকার গাছের বড় মহাজন আসার কথা। নিজস্ব তিনটা মিল আছে তার। গাছ বেচা নিয়ে ভাবতে ভাবতে নিধনের কথা মনে পড়ে গেল তার। সে কবেকার কথা। নিধনের ছেলে তুফানও পুরানো আম গাছটি বিক্রি করবে বলে এক মহাজনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। আর এদিকে তুফানের বাবা নিধনও বিলায়েত মহাজনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে একই গাছ দেখিয়ে। ব্যাপারটা জানাজানি হবার পর বাপ ছেলের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা দেখা গেল যে, কে আগে নিজের মহাজনকে দিয়ে গাছ কাটিয়ে বিদায় করতে পারে। শেষে এক সকালে তুফান তার মহাজনকে এনে গাছ কাটােেনা শুরু করলো। নিধন তার মহাজনকে ছেলের কাছে পাঠিয়ে দিল মানা করতে। কিন্তু নাছোড়বান্দা তুফান বাবার মহাজনকে বলে দিল এই বলে-বাবাকে বল, আমি তার বাবার গাছ কাটছি না আমি আমার বাবার গাছ কাটছি। কানিনের ঠোঁটে হাসির রেখা। পুরানো সেসব ঘটনা মনে করে। এমন সময় মহাজন টাকা লোকবল নিয়ে হাজির। কানিন মুখ ধোয়া শেষ করে গামছায় মুখ মুছতে মুছতে বারান্দায় এসে বসে আর বলে, ‘লেনদেনটা আগে হয়ে যাক তারপরে গাছে হাত দাও।এই বলে গাছের কাছে এগিয়ে যায়। হাত বুলিয়ে দেয়। তীব্র হাহাকারে বুকটা শুন্য হয়ে যায় তার। আবেগ সামলে নিয়ে বলে, ‘পঞ্চাশ হাজার এক টাকা গাছের দাম বলে দিয়েছি কিন্তু। এক পয়সাও কম হবে না। আগে লেনদেন শেষ কর।বলে গাছটা ঝাপটে ধরে হাত বুলিয়ে আদর করে।
ঠিক আছে মাস্টার আপনার কথা মতই টাকা এনেছি। এক পয়সাও কম দিব না।বলে মহাজন টাকা গুণার জন্য প্রস্তুত হয়।
 ‘দিদি, কি আঁকছো?’
ছবি।
কার ছবি?’
মা
কৈ মা, দেখি দেখি! এ্যাঁ, এখানে কৈ মা, দেখতে পাচ্ছি না তো।

একেঁছিলামতো, মনে হয় চলে গেছে।অল্প বয়সে মাকে হারানো দুবোন ক্যাথি তিথি এভাবে মাকে স্মরণ করতো। এসময় কানিন রান্না ঘর থেকে ধমক দেয়, ‘তোদের না কতবার মানা করেছি অযথা এটা ওটা একেঁ খাতা নষ্ট করিস না।ক্যাথি বলে, ‘না বাবা, ছবি আকিঁনিতো। এম্নি আকাঁ আকিঁ করে খেলছিলাম। এসে দেখে যাও বিশ্বাস না হয়।’ ‘ঠিক আছে।বলে কানিন রান্নায় ব্যস্ত হয়। সকাল সকাল খাইয়ে দাইয়ে মেয়ে দুটিকে স্কুলে পাঠাতে হবে। খালে পেতে রাখা বাইড়ে বেশ মাছ ধরা পড়েছে। তাই রেধে দিচ্ছে কানিন। সময় তিথির দেয়ালে টাঙ্গানো মা ছবিটার দিকে চোখ চলে যায়। মাকে মনে করে এখন কাঁদলেতো বাবা গাল দেবে আর দিদির পড়া হবে না এই ভেবে তিথি বাইরে উঠোনে চলে আসে। মা শেখানো গান গেয়ে খেলে, নাচে, দোলনায় দোলে। তবু তারই অজান্তে কখন দুচোখ জলে ভরে গেছে তার। ক্যাথি তা দেখে ফেলে। মা হারানো বোন দুটি পরস্পরকে ঝাপটে ধরে কেঁেদ ফেলে। কানিন জানলা তা দিয়ে দেখে তখন রান্না ঘর থেকে কড়াইয়ে মাছ রান্নার ছ্যাঁক ছ্যাঁক শব্দসহ খিদে ছড়ানো গন্ধ ভেসে আসছিল।
ঘুম থেকে উঠে বিছানায় বসে ছোট বেলার কথা, মার কথা বাবার কথা মনে করছিল তিথি। বাবার জন্য মনটা কেঁদে উঠছে ব্যাকুলভাবে। এদিকে সাত সকালে বাইরে হকারের চিৎকার-মাছ নিবেন মাছ, শব্জি টাটকা শব্জি কিংবা পুরান পেপার খাতা বই আর কাকের কা কা ডাকতো আছেই। এসময় ক্যাথি তিথিকে বলে, ‘এভাবে ঝিম মেরে আছো কেন? মুখ ধুয়ে পড়তে বস।
ভাল লাগছে না।
কেন?’
আমাদের ছোট বেলা, বাবাকে আর মা লাগানো গাছটাকে স্বপ্নে দেখেছি। বাবার জন্য আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে।
ক্যাথির মনটা তিথির কথা শুনে নরম হয়ে যায়। কাছে এসে বসে জিগায়, ‘কি রকম স্বপ্ন দেখলি, বল না?’

বাবাকে কাঠ ডাকাতরা বেঁধে জোর করে আমাদের সবার প্রিয় গাছটা কেটে ফেলছে। আর বাবা কেঁেদ কেঁেদ বলছে,আমাকে মেরে ফেল, তবু গাছটা কাটিস না। তবু তার কথা বনদস্যুরা শুনছে না। বাবার মুখটা খুব করুণ আর অসহায় দেখচ্ছিল তখন। বাবা দস্যুদের শুনিয়ে শুনিয়ে আরো বলছিল, গাছটা খ্রিস্টিনা- খ্রিস্টিনা লাগিয়েছিল গো, তাই তোরা কেটে ফেলছিস?’ এই বলে তিথি কেঁেদ ফেলল। ক্যাথি বলল, ‘ঠিক আছে, কালই আমরা বাড়ি যাব্যাধে আমরা পরের কথায় বিশ্বাস করে বাবাকে কষ্ট দিচ্ছি। বাবাতো এরকম না। এই ভুল বোঝাবুঝির অবসান দরকার। বাবা নিশ্চয় বড় রকম কষ্টে আছে। কাল নয় আজকেই চল না। যে বাবা আদর দিয়ে কোলেপিঠে করে মানুষ করল, মার অভাব বুঝতে না দিয়ে তাকেই আমরা এতো কষ্ট দিলাম।

গাছ কাটার আগে ডালপালাগুলো সাফ করা দরকার। দুজন শ্রমিক ইতোমধ্যে গাছে উঠে ডাল কাটা শুরু করে দিয়েছে। কানিন উঠোনের এক কোণে দাঁিড়য়ে অসহায় স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ডালগুলো প্রত্যেকটা যেন তার সন্তান, আর কতো পরিচিত ঝিরঝির বাতাসের ঝাকুনিতে হাত পা ছুড়ে হাসা শিশুর মত নতুন গজানো পাতাগুলো নেচে উঠতো। মন ভরে সেসব দেখে ফুরফুরে সকালটা কখন বিকাল হয়ে যেত কানিনের। ক্যাথি তিথিকে বুকে টেনে নিয়ে কানিন বলতো,
-অই দেখ তোদের মা, হাসছে। ক্যাথি তিথি বলতো,
-ওটা মা না, তবে মা লাগানো গাছ। কানিন বলতো,

-       অই হলই। খ্রিস্টিনার স্মৃতি আগলে এতোদিন বেঁেচ থাকা কানিনের কী যে কষ্ট হচ্ছিল তখন বুকের উপর উপচে পড়া থৈ থৈ শিল ব্যথা কঠিন পাথরে চাপা দিয়ে কানিন স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছিলো। বহুদিনের পরিচিত ডালগুলো যখন কুড়ালের আঘাতে বৃক্ষচ্যুত হয়ে পড়ছিল তখন তার মনে হচ্ছিল বুঝি তারা ভিষণ কান্নাকাটি করে খসে পড়ছে। আর যেন বলছে, ওরা আমাদের মেরে ফেলছেতো, বাঁচাও আমাদের। এতোবছর বলতে গেলে-গাছের সাথে ঘড় করা কানিন এই গাছের ভাষা বুঝতে পারছিল, গাছের প্রতিটা ডালের চিৎকার, কান্না-আর্তনাৎ শুনতে পাচ্ছিল। কিন্তু কঠিন বাস্তবতার শৃখলে বাঁধা যেন কানিনের হাত-পা তার ইচ্ছে করছিল কুড়ালঅলা মানুষগুলোকে মাটিতে নামিয়ে দেয় য়েক ঘা। কিন্তু তা হয়ে যাবে পাগলামো। এদিকে মহাজন পান চিবুতে চিবুতে বলে, ‘আপনে না অইলে এতো বছর কেউই এই গাছ রাখতে পারতো না, বেইচ্যা পালাইতো।এসময় হিরো স্প্যালেন্ডার চালিয়ে সেন্টো আসে। সেন্টো ভাড়ায় হোন্ডা চালায়।

এই গাছের জন্যেই মাস্টার এতো বছর বাইরে যাই নাই। এহন বেইচ্যা দিসে দেহি।এই বলতে বলতে সেন্টো কানিন মাস্টারের কাছে এসে দাঁড়ায়। কানিন মাস্টার নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ‘সেন্টো, কাল খুব ভোরে এই - টার দিকে আসিসতো সীমান্ত এলাকায় যেতে হবে।
ঠিক আছে।বলে সেন্টো চলে যায়। কানিন তীব্র কান্না লুকিয়ে ঘরগুলো ঘুরেফিরে দেখে দরোজায় হাত রাখে। স্টোর করে রাখা পুরানো আসবাবগুলো দেখে। সেখানে ক্যাথি তিথির খেলনাগুলো পড়ে আছে। খেলনায় হাতবুলায়, ধুলোবালি পরিস্কার করে। এদিকে খ্রিস্টিনার লাগানো গাছটা ডালপালা মুড়ানো হয়ে গেছে। ডালপালাবিহীন গাছটা বিবস্ত্র ধর্ষিতা নারীর মত মনে হচ্ছে--- –
ইন্ডিয়ায় চলে গেলে সে আবার ফিরবে কি ফিরবে না-আহা! তাহলেতো ক্যাথি তিথির খেলনাগুলো অযতেœ অবহেলায় পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে যাবে এরকম ভাবতেই বুকটা তীরবিদ্ধ পাখির মত ছটফট করে উঠে তার।
তবুও কাল সে যাবেই বোনের বাড়ি।