গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৮ জুন, ২০১৪

সোহেল রানা বীর

শাস্তি


মতলেবের চায়ের দোকানে বেশ কিছু দিন পর আসা। কি করে আসবে? আগের বাকী টাকাগুলো আজ দেবে কাল দেবে করে করে দুমাস পার করে দিয়েছে দুমাস ধরে কথা দেওয়ার পরও বকেয়া পরিশোধ না করায় তার কোন কিছু এসে যায়নি- এমনটিই ভাবনা তার। অন্য যে কেউ হলে টাকাগুলো হাতে নিয়ে তবেই মতলেবের সামনে দাঁড়াতো। কিন্তু নিজামউদ্দিনের সে উপায় আর কৈ! বিড়ির নেশাটা যেভাবে তাকে চেপে ধরেছে, তাতে মতলেবের দোকানে না গিয়ে তার আর রক্ষা নেই।

দিনে যার কয়েক প্যাকেট বিড়ি না খেলে প্রশান্তি আসে না, তার পেটে দুদিন ধরে একটি বিড়িও যায়নি- ভাবাই যায়না। পাশের বাড়ির ফরমান আর আশাদের কাছে বিড়ি চাওয়ার মাত্রাটা এতই প্রকট আকার ধারণ করেছিলো যে তারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, ‘না রে ভাই, আর বিড়ি দিতি পারবো না। মাংনা মাংনা আর কতো?’ এতে যে নিজামউদ্দিনকে যথেষ্ট অপমান করা হয়েছে সে কথা তার আর বুঝতে বাকী থাকলো না। পদমর্যাদার দিক দিয়ে ওরা কি খুব উপরে? এরকম কথা মতলেব বললেও কি নিজামউদ্দিন মানতো? ফরমান আশার কথায় নিজাম উদ্দিনের ভিতর দারুণভাবে ক্ষত সৃষ্টি হলো।না-, শালাদের কাছে আর কুনুদিন বিড়ি চাতি যাবো না।ক্ষোভের কথাগুলো  নিজেকেই শোনাল সে।

মতলেব সবেমাত্র দোকানের ঝাঁপ তুলে বসেছে। দূর থেকেই বিষয়টি লক্ষ করলো নিজামউদ্দিন। দু একজন ক্রেতা নগদ টাকায় কিছু জিনিস কিনলো- এটাও তার দৃষ্টি থেকে বাদ পড়লো না। সাত সকালে বাকীতে বিড়ি কিনতে গেলে খুব একটা ভালো যে দেখাই না তা তার ভালোই জানা। তাছাড়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে শুভযাত্রার ব্যাপার স্যাপার যে থাকে সে ব্যাপারেও তার যথেষ্ট জ্ঞান রয়েছে বলে তার বিশ্বাস। দূর থেকে একজন ক্রেতাকে নগদ টাকায় জিনিস কিনতে দেখে তার চোখে মুখে আশার আলো ফুটে উঠল। ছোটবেলার খেলার সঙ্গী মতলেব বকেয়া পরিশোধ না করার দায়ে নিশ্চয় একটি বিড়ি থেকে তাকে বঞ্চিত করবে নাÑ সে বিশ্বাস নিজামউদ্দিনের আছে।  তাছাড়া, মতলেবের যখন দোকান ছিলো না, তখন নিজামউদ্দিনের কাছ থেকে কত বিড়ি খেয়েছে সে, সে হিসেব কি মতলেবের জানা আছে? এসব ভেবে বিড়ি পাওয়ার আশার মাত্রাটা একটু বেড়ে গেল। টাকা পরিশোধ করার কথা একেবারেই ভুলে গেল সে। ভাবনার জোয়ারে ভাসতে ভাসতে এতক্ষণে দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো নিজামউদ্দিন। দোকানের সামনে বাঁশের চরাটে অনেকেই বসে আড়মোড়া ভাংছে। এক রকম  নিশ্চুপই  , চরাটের ওপর এসে বসলো।

একজন ক্রেতার সাথে লেনদেন চলার সময়ই আড়চোখে নিজামউদ্দিনকে এক ঝলক দেখে নিলো দোকানদার মতলেব। বকেয়া পরিশোধ না করার দায়টুকু একগাল হাসিতে ম্লান হওয়ার সম্ভবনা যে একেবারেই কম, তা জানা সত্ত্বেও অকৃত্রিম এক চিলতে হাসি মুখে মতলেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলো সে । এতক্ষণেও দোকানদারের দৃষ্টি আকর্ষণ না করতে পেরে মুখ খুললো , ‘মতলেব একটা বিড়ি দে দিন ! আজ দুদিন... কথা শেষ না করেই তাকে থামতে হলো। গ্রামের অন্য সবার মতো সেও নিজামউদ্দিনকে নিজু বলেই ডাকে।দেখ নিজু, আগের অনেকগুলো টাকা তোমার কাছে পাওয়া যাবে। দিবা করে করে দিচ্চো না। বন্দু মানুষ বুলে কিছু বুলতি পাচ্চিনে। অন্য কেউ হলি নোকজনের সামনেই কলার ধরে টাকা আদায় করে নিতাম।- কথাগুলো শোনার পর স্তব্ধ হয়ে গেল নিজামউদ্দিন। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সৃষ্টিকর্তা যেন এই মুহূর্তের জন্য তার ভাষা কেড়ে নিলেন। চলার ক্ষমতাও যেন হারিয়ে গেল। পা দুটি যেন মাটির ভিতর ঢুকে যাচ্ছে। মতলেবের কথাগুলো বারবার তার কানে বাজছে।কী বুললো মতলেব! এই কি বন্দুর নমুনা?’Ñ কথাগুলো ভাবতে গিয়েও যেন খেই হারিয়ে ফেলছে। কতদিন যে কথাটা মনে থাকবে তা একমাত্র নিজামউদ্দিন ছাড়া আর কেউ জানে না। অনড় নিজামউদ্দিন এতক্ষণে স্বাভাবিক হলো। অনেক কষ্টেআচ্চা শব্দটি মুখ থেকে বের করে দ্রুত দোকান থেকে চলে এলো।

রাগে অপমানে ক্ষুব্ধ নিজামউদ্দিন বাড়ি আসতে না আসতেই তার বউ জরিনা বেগম বলে বসলো, ‘আর ইট্টু পরে সমিতির স্যার কিস্তি নিতি আসপে। আগের কিস্তি এ্যাকবার দ্যাওনি! আজগে যে করেই হোক সমিতির টাকা কিন্তুক দিতি হবে, আগেততে বুলে রাকলাম। কথাগুলো জরিনা বেগমের স্বামীর রাগের মাত্রা যে বহুগুণে বাড়িয়ে দিলো তা কথা শেষ না হতেই বোঝা গেল। অকথ্য ভাষায় গালি দিয়ে বউকে বেধড়ক পেটাতে আরম্ভ করলো। মারের শব্দ শোনামাত্র এদিক-সেদিক থেকে অনেকেই ছুটে আসলো।কী দোষ বউডার!’- বলতে বলতে ওদিক থেকে ছুটে আসলো মালেকা বেগম। নিজামউদ্দিনের হাতের লাঠিটি কেড়ে নিল পাশের বাড়ির হেকমত। সুবাদে বড় ভাবী হওয়ায় মালেকা বেগমকে সব সময় সম্মানের চোখে দেখে নিজামউদ্দিন। আর সে জন্যই মালেকা বেগমের আগমনে ক্ষান্ত হলো সে। মালেকা বেগমের অনুপস্থিতিতে আরও কিছু লাঠির বাড়ি জরিনা বেগমের পিঠে যে পড়তো- এতে কোনো ভুল ছিলো না। অবলা জরিনা বেগমরা সব সময়ই নিজামউদ্দিনদের নির্যাতনের শিকার। নিজামউদ্দিনরা নিজেদের ব্যর্থতাকে দমিয়ে রাখতে জরিনাদের মতো পোষমানা-গৃহপালিত নারীদেরকে সব সময় হাতের মুঠোয় রেখে সেই মুঠো হাত ব্যবহার করে ওদেরই পিঠে। মুঠো হাতের সাথে মন মতো তৈরী করা বাঁশের লাঠিও ব্যবহৃত হয়। সবকিছু হজম করার জন্যই যেন জরিনারা পৃথিবীতে এসেছে! নিজামউদ্দিনের নির্যাতনের শিকার জরিনা বেগমের কাছে নতুন কোনো বিষয় নয়। এরকম মার প্রায়ই হজম করতে হয় নিজামউদ্দিনের বউকে। কতবার নিজামউদ্দিনের সংসার ছেড়ে বাবার বাড়ি চলে যেতে চেয়েছে, কিন্তু বাবা মরা জরিনা বেগম দুখিনী মা আর ছোট ভাইটার কথা ভেবে যেতে পারেনি। অভাবী মায়ের সংসারে নতুন করে বোঝা হতে চায়নি সে।

সকাল দশটা বাঁজতে না বাঁজতেই এনজিও কর্মী চলে এসেছেন। কুসুম আরার বাড়িতে কিস্তি তোলা হয়। সবার কিস্তি জমা হলেও জরিনা বেগমের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। জরিনা বেগমকে না পেয়ে নিরূপায় এনজিও কর্মী কুসুম আরাকে সঙ্গে নিয়ে নিজামউদ্দিনের বাড়িতে হাজির হলেন।

কালবৈশাখী তার প্রলয়নাচ দেখিয়ে পরক্ষণেই যখন শান্ত প্রকৃতি উপহার দেয়, মনেই হয় না একটু আগে সে তার ধংসলীলা দেখিয়েছে, ঠিক তেমনি শান্ত প্রকৃতির মতো নিজামউদ্দিন ঘরের মধ্যে চৌকির উপর ডানদিকে কাত হয়ে শুয়ে আছে। দেখে বোঝার উপায় নেই, এই মানুষটি একটু আগে তার স্ত্রীকে ইচ্ছে মতো প্রহার করেছে।

এনজিও কর্মীকে দেখামাত্র জরিনা বেগম সালাম দিলো।স্যার বসেন। - ভারী গলার কণ্ঠস্বর।না, বসবো না। আপনার স্বামীকে ডাক দেন, কথা বলবো। - ক্ষিপ্ত কণ্ঠে এনজিও কর্মী আবুল কালাম কথাগুলো বললেন। স্বামীকে ডাকতে গিয়ে বার কয়েক ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো জরিনা বেগম। রাগান্বিত হয়ে আবুল কালামকে উদ্দেশ্য করে তিক্ত কিছু কথাও শুনিয়ে দিলো জরিনা বেগমের স্বামী, ‘যা যা, তাকে বল্, কিস্তি দিতি পারবো না নে। এ্যাক মাসের মদ্যি যেন কুনু কিস্তি নিতি না আসে। আষাঢ়ে দিন যাক, তারপর কাজ-কাম করে টাকা হলি তকুন দেকা যাবে। উঠানে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনলেন আবুল কালাম। নিজামউদ্দিন তার সাথে দেখা না করায় কিছুটা অপমানিত বোধ করলেন তিনি।মূর্খ মানুষ মান-অপমান আর কি বুঝবে?’- এই ভেবে আবুল কালাম জরিনা বেগমের বাড়ি থেকে চলে এলেন। আসার আগে বলে আসলেন, ‘আগামী সপ্তায় ম্যানেজার স্যার আসবেন। যে করেই হোক, আপনার স্বামীকে টাকা জোগাড় করতে বলবেন, নইলে ঘরের টিন খুলে নিয়ে যাবো। কথাগুলো জরিনা বেগমের মনে কোনো রকমের ভাবনা তৈরী করতে পারলো বলে মনে হলো না।

হাঁড়িতে চাল নেই। সামান্য কিছু ময়দা আছে। তরকারী বলতেও কিছু নেই। জরিনা বেগমের অভাবী সংসারে মাঝে মধ্যে মালেকা বেগম এটা ওটা দিয়ে যায়। ইচ্ছে থাকলেও বেশি কিছু করতে পারে না। তারও তো সংসার আছে! তাছাড়া তার স্বামী খুব একটা সুবিধার না। নিজামউদ্দিনের পরিবারের জন্য যা করে, সেটা তাকে গোপনেই করতে হয়। আর জন্য তার প্রতি দারুণভাবে কৃতজ্ঞ নিজামউদ্দিন।

পরের দিন। রান্নার কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। টানা বর্ষায় কাজকর্ম একেবারেই বন্ধ। মোল্লাবাড়ির রফিক সাহেব আগেই জানিয়েছেন, ‘শোন নিজু, আপাতত আর কাজে আসার দরকার নেই। কাচ্ছে টাচ্ছে যাক, তারপর দেখা কর।

উপার্জনের একমাত্র উৎসটাও বন্ধ। কিন্তু এরকম তো হওয়ার কথা ছিলোনা। নিজামউদ্দিনও নিয়মিত চাষ করতো, গোলা ভরা ধান আসতো। অথচ... ভাবতেই বিমর্ষ হয়ে যায় তার চেহারা। স্মৃতির পাতায় সবকিছু ভেসে ওঠে-
সেবার প্রবল বর্ষণে নিজামউদ্দিনের বর্গা নেয়া জমির সব ফসল পানিতে ডুবে যায়। দিশেহারা নিজামউদ্দিন ভাগের ফসলের সমপরিমান টাকা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে থাকে। চাষ করার টাকাটাও যে উচ্চসুদে ঋণ নেয়া। ভবানীপুর গ্রামে ব্যবসা বিল্টু মোল্লারাই করে। সবাইকে তাদের কাছেই হাত পাততে হয়। নিজামউদ্দিনের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। ফসল না হওয়ায় ঋণের টাকা পরিশোধ করার জন্য সেবারই প্রথম এনজিও থেকে টাকা তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। নিয়ম মোতাবেক টাকা তোলার জন্য বউয়ের সাথে ছবিও ওঠে। অবশেষে টাকা হাতে হরিণাকুন্ডু থেকে বাড়ি ফেরে তারা।

বিল্টু মোল্লার টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে তাকে যে হিসেব দেখানো হয়, তাতে আসল টাকার চেয়ে সুদের অংকই বেশি। সংগত কারণে আসল টাকা আর পরিশোধ করা হলো না। সুদের টাকাগুলো পরিশোধ করে ফিরলো সে। বিল্টু মোল্লা আগে থেকেই হিসেব কষে রেখেছেÑ আসল টাকা পরিশোধ না করা পর্যন্ত হাজারে দুইশ টাকা হারে সুদ বাড়তেই থাকবে। নিজামউদ্দিনের মতো নিরুপায় মানুষদেরকে চুষে খাওয়ার উপায় তাদের ভালো করেই জানা।

দিন যাচ্ছে, সুদের টাকা বাড়ছে। অভাব নিজামউদ্দিনের সংসারে নিত্যসঙ্গী এখন। নিজের ধানি জমিটুকু আগেই খোয়াতে হয়েছে সুদের টাকা দিতে গিয়ে। এভাবে যে চলতে পারে না, কিছু একটা যে করা দরকারÑ চৌকির উপর শুয়ে শুয়ে নিরর্থক ভাবনাগুলো মাথার মধ্যে খেলা করছে। আসলেই কি কিছু করার মতো ক্ষমতা আছে তার? ইতোমধ্যে মালেকা বেগম টা রুটি আর আলু ভাজি দিয়ে গেছে। খাওয়ার জন্য কয়েকবার ডাকার পরও কোনো সাড়া মিললো না নিজমউদ্দিনের। এতবার ডাকাতে বেশ বিরক্ত হলো। এবার জরিনা বেগমকে স্পষ্ট জানিয়ে দিল, ‘মালা আর বিলকিসকে নিয়ে তুই খায়ে নে। আমার চিন্তা করা লাগবে না নে। কথাগুলো বলতে বলতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। অনেক দিন বাজারে যাওয়া হয়না। কী মনে করে ছেড়া জামাটা গায়ে দিয়েই বাজারের দিকে রওনা দিলো। বাজারে গিয়ে রবিউলের চায়ের দোকানে বসলো। পাশের গ্রামের ইজাল মুন্সির সাথে দেখা হওয়ায় বেশ পুলকিত হলো। নিয়মিত বাজারে আসলে আগে দেখা করে মুন্সির সাথে। দীর্ঘ দিনের বন্ধুত্ব। তাই বাজারে এলে মুন্সির সাথে ওঠা-বসা একটু বেশি হয়। এখন আর আগের মতো বাজারে না আসায় সম্পর্কটা যে একটু দূরে চলে গেছে, তাতে দ্বিমত নেই তার। ইজাল মুন্সি এক কাপ চা খাওয়ালো তাকে। সাথে একটি সিগারেটও। সিগারেট হাতে পেয়ে তাকে যে বেশ আনন্দিত মনে হলো তা তার মুখের দিকে তাকাতেই বোঝা গেল। যেন বহু আরাধ্য বস্তুটি হাতে পেয়ে পিপাসিত মনের তৃষ্ণা পূর্ণ হলো। অনেক দিন পর ইজাল মুন্সিকে কাছে পেয়ে মন খুলে কথা বলতে চাইলো কিন্তু তা আর সম্ভব হলো না। অভাবী সংসারের কিছু চিত্রও তুলে ধরতে চাইলো তার মন। কিন্তু সে সুযোগ আর পেল না। বিশেষ একটি কাজের কথা বলেআবার দেখা হবে বাক্যটি উচ্চারণ করেই বিদায় নিলো মুন্সি। ঘরমুখী মানুষগুলো একে একে বাজার থেকে চলে এলো। আরও কিছুক্ষণ বসে থাকলো নিজামউদ্দিন।চাচা যাবা না? রাত তো অনেক হয়ে গেল।- রবিউলের কথাগুলো ঠিকমতো কানে গিয়ে পৌঁছালো কি না তা বোঝা গেলো না বাজারের প্রায় সবগুলো দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। সারা দিনের কর্মব্যস্ত বাজারটিও যেন ক্লান্ত। দুএকটি হারিকেনের মৃদু আলো জ্বলছে বেশ দূরে। একটু পরে মৃদু আলোও নিভে গেল। অন্ধকারের রাজত্ব শুরু হয়ে গেছে। বাজারটি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। ঘুম ভাঙ্গাবার সাধ্য কি কারোর আছে? রবিউলও চলে গেলো। পাহারাদের বাঁশির আওযাজ ভেসে আসছে মাঝে মাঝে। ভাবনার নদীতে পূর্ণ মাত্রার জোঁয়ারে হাবুডুবু খাচ্ছে নিজামউদ্দিন। বিল্টু মোল্লা যে তাকে ঠকিয়েছে- সে কথাও বাদ যাচ্ছে না তার ভাবনা থেকে। নিশীথের সহযাত্রী হয়ে এতক্ষণে পা বাড়ালো। ওদিকে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিযে পড়েছে জরিনা বেগম।

ভোর বেলা নামাজ পড়ার জন্য ওজু করতে বাইরে বের হলো হেকমত আলী। নিজামউদ্দিনের রান্নাঘরের দিকে তাকাতেই চোখ আটকে গেলো তার। ঘরের সামনে গরু বাঁধা। গরু! গরু আসলো কোথা থেকে। এরকম ভাবনা আসার আগেই ওজু সেরে ফজরের নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদের দিকে পা বাড়ালো হেকমত আলী।

সকাল হতে না হতেই নিজামউদ্দিনের হঠাৎ পাওয়া গরুর সংবাদটি সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো। নিজামউদ্দিন আগেই বউকে জানিয়ে রেখেছে, গরুটি জরিনা বেগমের মামাতো বোনের। গতকাল বাজারে তার দোলাভায়ের সাথে দেখা হয়ে গেলে গরুটি রেখে যায় নিজামউদ্দিনের কাছে। গরুর বাচ্চা হওযার পর সেটি ফেরৎ দিতে হবে বলেও জানালো জরিনা বেগমের স্বামী।

নিজামউদ্দিনের হঠাৎ পাওয়া গরুর বিষয়টি কেউ সহজভাবে নিতে পারলো না। সূর্য উঠার আগেই বিল্টু মোল্লারা নিজামউদ্দিনের বাড়িতে হাজির। রান্নাঘরের সামনে বাঁধা গরুটি চিনতে বিন্দুমাত্র ভুল হলো না তাদের। বাঁধন খুলে গরুটি নিয়ে যেতে উদ্যত হলো বিল্টু মোল্লার ছোট ভাই। জরিনা বেগমের মেয়ে সাত বছর বয়সী মালা বধা দিতে গেলে নিজামউদ্দিন মেয়ের হাত ধরে টান দেয় । জরিনা বেগম ঘরের এক কোণে নির্বাক দাঁড়িয়ে গরুটির পিছু পানে চেয়ে থাকে। মোল্লাদের ভালো করেই চেনে নিজামউদ্দিন। শুধু বিল্টু মোল্লার উপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে গত রাতে বাজার থেকে আসার পথে বিল্টু মোল্লাদের পাড়ার দিকে যায় সে। শত চেষ্টা করেও গরুটি সরাতে পারে না অনভিজ্ঞ নিজামউদ্দিন।

বিকেল বেলা। অনেক মানুষ জুটেছে মোল্লাবাড়ির সামনে। খোলা জায়গায় গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। মাঝখানে হাত-পা বাঁধা নিজামউদ্দিন মাথা নিচু করে বসে আছে। পাশে চেয়ারে বসে আছেন চেয়ারম্যান সাহেব। চেয়ারম্যান সাহেব এখনো বিচার শুরু করেননি। তার আগেই এদিক-সেদিক থেকে লাঠির বাড়ি পড়ছে নিজামউদ্দিনের পিঠে। কেউ কেউ বলছে, ‘মার, শালারে মার!’