গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ২৯ জুন, ২০১৪

অনিন্দিতা সাধুখাঁ


মুক্তির আকাশ...
           
        বিকেলের রক্তিম আভায় নিজেকে আকণ্ঠ ভেজাতে বড্ড ভালো লাগে অনুর... সকাল থেকে দুরন্ত গতিতে ছুটতে থাকা ঘড়িটা এই সময় যেন একটু থমকে অনুর সাথে কিঞ্চিৎ গল্প সারে। অনুর মনের না বলা কথাগুলো শোনার একমাত্র সঙ্গী সে...তাই বিকেলটাতে এই ছোট্ট ব্যালকনিটা যেন অনুর জীবনে বেঁচে থাকার জিয়নকাঠি... রোজ এখানে বসে একটু নিজের সাথে কথা বলে সে।

আজকাল শুভ মানে অনুর স্বামী শুভেন্দুর অফিস থেকে ফিরতে আরো দেরী হয়। আর অনুর মেয়ে রাই স্কুল থেকে টিউশন পড়ে বাড়ি ফেরে সন্ধ্যেবেলা বর্তমান যুগের আধুনিকা মেয়ে রাই, বয়েসের তুলনায় বেশ অনেকটাই পরিণত এগিয়ে যাওয়ার ইঁদুর দৌড়ে সে বেশ গতিতেই ছুটছে আর শুভ, সামান্য কেরানী থেকে জীবন শুরু করে এখন সে ম্যানেজার... যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সকলেই দৌড়াচ্ছে আর অনু ?......... কেন সেও তো সকাল থেকে ছুটছে সাত সকালে ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘর তার ব্যস্ততার প্রধানতম জায়গা। শুভর চা, মেয়ের হরলিক্স তারপরই টিফিন তৈরি করা ... ঠিক সাতটা বাজলে সুজাতার মা এলেই কী কী রান্না হবে তা বলেই রাই কে তোলা , পড়তে পাঠানো , শুভর বাথরুমে টাওয়েল, পাজামা রেখে আসা -----স্নান সেরেই " অনু টাই তা কই?" , "পার্সটা ড্রয়ারে নেই কেন?" , "আর এক পাটি মোজাটা একটু দেখে দেবে প্লিজ " ----- সব হাতে হাতে দিতে অনু কী কম দৌড়ায় ?? ৯টায় শুভ বেড়িয়ে গেলে আর এক প্রস্ত দৌড় থাকে অনুর মেয়ে কে নিয়ে ১০ টার বাসে মেয়েকে চাপিয়ে দিয়ে অনুর ছুটি বাইরের স্কুল বাস যাওয়ার অনুর পর ক্ষণিকের অবসর... একটু জিরিয়ে বাজার-দোকান, ব্যাঙ্কের কাজ, মেয়ের স্কুলের খাতা পত্রে চোখ বোলাতে বোলাতে কখন যে আস্ত দুপুরটা নিস্তব্ধতাকে নিয়ে অনুর দরজায় কড়া নারে কিছুতেই বুঝতে পারেনা সে ... তারপর স্নান খাওয়া সেরে ক্লান্ত শরীর বিছানা টানে ... এই বিকেলটা তাই অনুর নিজেকে খুঁজে পাওয়ার একমাত্র সময়...

স্কুল জীবনে ১০০ মিটার দৌড় বা ৪০০ মিটারে , রিলে রেসে, অনু চিরকাল প্রথম।। ক্লাস ফাইভ থেকে ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত টানা প্রথম হয়ে এসেছে সে... নাহ রাইয়ের মত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে সে পড়েনি... পাড়ার পরিচিত এক বাংলা মিডিয়াম স্কুলে তার শৈশব কেটেছে ... পাড়ার গানের প্রতিযোগিতায় অনুর সমতুল্য কেউ ছিল না। দুই বোন আর এক ভাই এর মধ্যে অনু নিজের গুনেই বাবার ভালবাসার বেশিটাই নিজের দখলে রেখেছিল চিরকাল কারখানা থেকে ফিরে ঘরের সামনের বারান্দায় বসে অনুর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বাবা প্রায়ই বলত, " মা, নিজের পায়ের তলার মাটিটা শক্ত করতেই হবে, ওটা ছাড়া মুক্তির আকাশ অধরাই থেকে যাবে।" ঘন কালো রাত্রিতে বাবার স্নেহ পরশ, পরম আশীর্বাদের মাঝে অনু এক অদ্ভূত প্রশান্তি অনুভব করত। এম, পাশ করে টিউশনির ৩০০ টাকা বাবার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল... "বাবা , আমার মুক্তির আকাশ ! "

শুভর সাথে অনুর আলাপ মিতার জন্মদিনে শুভর ব্যক্তিত্বই অনুকে মুগ্ধ করে সবচেয়ে বেশি...অনুর মত তখন সে জীবনযুদ্ধের এক সৈনিক। একে অপরের অবলম্বন হয়ে জীবনযুদ্ধে সংগ্রাম করতে করতে কখন যে একে অপরের বেঁচে থাকার একমাত্র সংজ্ঞা হয়ে উঠেছিল তা অনু আজ বুঝতে পারে না স্কুলের চাকরির প্রথম খবরটা শুভকে দিয়ে অনু এক অনাবিল প্রশান্তি লাভ করেছিল। অনুর চাকরি তাদের সম্পর্কের পরিণতিকে কিছুটা নিশ্চয়তা দিয়েছিল। কিছু দিনের মধ্যেই শুভর চাকরির পর "আমি তুমির সুখি সংসার " এর স্বপ্ন দেখিয়েছিল এই দুই প্রেমিক-প্রেমিকাকে অল্প বেতন বলে মা আর দিদির বিয়েতে আপত্তি থাকলেও অনুর বাবার প্রানভরা আশীর্বাদকে সঙ্গি করে শুরু হয় অনুর বিবাহিত জীবন অধ্যায়

ভাড়া বাড়ি, একটা ছোট্ট ঘর, কমন বাথরুম, নির্দিষ্ট সময়ে কলের জল ধরে রাখা, সাত সকালে উঠে সংসার সামলে ট্রেনে বাসে ঝুলতে ঝুলতে স্কুল যাওয়া ------ যেন জীবনের নতুন জলছবি আঁকা নিত্য সংগ্রামের মাঝেও দুজনের ভালবাসার দৃঢ় বন্ধনে যেন জীবনতরী আপন ছন্দে ভাসতে থাকে জনসমুদ্রের মাঝে। কথায় বলে যৌবন কখন আসে আর কখন চলে যায় বোঝাই যায় না। অনুও বুঝল না। জীবনের সবচেয়ে মধুর সময় কেটে গেল সংগ্রামরত ভাবে সংসারের যাঁতাকলে নিজের সুখ, ইচ্ছে, প্রাপ্তির স্বপ্নগুলোকে পৃষ্ট করে আরো উন্নতির আশায় ছুটতে থাকল দুজনে। মাথা গোজার নিজের ভিটে, আরো একটু ভালো থাকার ইচ্ছে পূরণের আশায় ছুটতে থাকল দুজনে স্কুল ছাড়া টিউশন ধরল অনু। খাবার টেবিলে দুটো ক্লান্ত শরীর আর এক পৃথিবী স্বপ্ন ভরা চারটি চোখ ----দিন কাটতে থাকল। আগের মত ছুটির দিনে হঠাৎ হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে নিয়ে বেড়িয়ে পড়া, মাঝে মাঝে গঙ্গার ধারে দুজনের বসা, কোন বন্ধুর বাড়ি একটা সন্ধ্যে নির্ভেজাল আড্ডা মেরে কিছুটা মনের রসদ জোগাড় করা ------- নাহ এসব কিছুই আর নেই অনু-শুভর জীবনে। এমনকি এত সুন্দর অনুর গানের গলাও আর আনমনা হয়ে সুরে ভাসে না। মেয়ের জন্ম নাকি বাবার জীবনে শুভর বার্তাবহ। অনু হবার পর দ্বিতীয় কন্যা সন্তান শুনে তার মার মুখ কিছুটা ভার হলেও অনুর বাবা একথা বলেছিল। অনুর জীবনেও একরাশ আনন্দ নিয়ে ঘর আলো করে এল রাই।
বিবাহিত জীবনের এক যুগ কাটিয়ে দিল অনু অনেক পালাবদলের সাক্ষী সে বর্তমানে তার ঠিকানা মানিকতলায় পাঁচতলা উঁচু এক বড় সড় ফ্ল্যাটে যা আধুনিক আসবাবপত্রে সুসজ্জিত। আকাশটা অনেক কাছে এখন। রাই ক্লাস সিক্সে পড়ে শুভ ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। আর অনু ? সুগৃহিনী-- নিপুন গৃহিনী--- কেবলই সুগৃহিনী

শুভর পদোন্নতি ব্যস্ততা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাইকে মানুষ করার দায়িত্বকে প্রধান করে অনুকে চাকরি ছাড়তে হল। নিজের মুক্ত আকাশ ধরে রাখতে বাড়িতে বসে কিছু টিউশন--- নাহ তাতেও আপত্তি শুভর বলেছিল " কী দরকার ? আমি তো আছি সব প্রয়োজন মেটাতে, তুমি মেয়েকে দেখো এখন রাইয়ের বন্ধু, স্কুল, টিউটরিয়ল, কম্পিউটার আর নাচ নিয়ে বেশ ব্যস্ত নিজের একটা জগৎ পদোন্নতির সাথে সাথে শুভরও ব্যস্তময় জীবন পরিধি। আর অনুর ! এই চার দেওয়ালে আবদ্ধ ফ্ল্যাটে মাঝে মাঝে কেমন দম বন্ধ হয়ে আসে তার একাকীত্বের তীব্র যন্ত্রণা ক্ষতবিক্ষত করে নিরন্তর নিজস্ব জগৎ না থাকার বেদনা কুরে কুরে খায় তাকে গলা ছেড়ে গান গাইতে গেলেও সুর আসে না বাবার কথা, হারানো শৈশব, ফেলে আসা জীবন মনে করলেই চোখে জল আসে কেন ? তাহলে কি সে -সুখি? আজ সবই তো আছে তার জীবনের শুরুর সময় এসব সুখের স্বপ্নই তো সে দেখেছিল দুচোখে আর তাই সকাল থেকে রাত্রি নিপুন অভিনয়ে সে সকলকে বুঝিয়ে দেয় সে সুখী, তার সব আছে। শুধু নেই সেই মুক্তির আকাশ.........
টিং টং.........বেল বাজল ওই রাই এল বুঝি


অন্ধকারে চারিদিক ঘিরে এসেছে। অনু আবার মুখোশের আড়ালে নিজেকে ঢুকিয়ে নেয় এবার রাইয়ের গলায় নিশ্চুপ ঘরগুলো আবার প্রাণ ফিরে পাবে। আর অনুর প্রাণ ফিরে পাবে আগামীকালের পড়ন্ত গোধূলিতে, এই ব্যালকনির মাঝে.........