কালমৃগয়া
[১৯৬৯
সালে ক্লাস ফাইভের এক অর্বাচীন বালক মায়ের কাছে শোনা গল্পের আইডিয়া নিয়ে তার
স্কুলের ম্যাগাজিনের জন্য প্রথম কলম ধরে। অপরিণত মনের ততোধিক অপরিণত লেখা, কিন্তু তা প্রকাশিত হয়েছিল। এবং শিক্ষকেরা কিঞ্চিৎ
প্রশংসাও করেছিলেন। এখানে রইল সেই দুর্বল লেখনীপ্রচেষ্টার ক্ষীয়মাণ স্মৃতিনির্ভর
পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত অনুলিখনটি...]
জায়গাটার নামটা আর মনে নেই। বাকি সব কিছু মনে আছে কিন্তু ছবির মতো।
ভুলতে পারি নি।
অনেকদিন আগের কথা, প্রায়
বিশ বছর হবে। দক্ষিণবঙ্গের ঐ গণ্ডগ্রামটায় যেতে হয়েছিল কলকাতা পুলিশের নির্দেশে।
না, কোনও অপরাধ করে নয়, সরকারী
ডাক্তারের দায়িত্ব পালন করতে। গোসাবা থেকে প্রায় বাইশ মাইল বাসে যেতে হয়, ঘন্টা খানেকের রাস্তা। একটা থানা, একটা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, একটা বাজার আর প্রাথমিক স্কুলের নামে একটা ভাঙ্গা বাড়ী নিয়ে জনা
পঞ্চাশ ঘর বাসিন্দা এই প্রত্যন্ত গ্রামখানায়। কয়েকজন বর্ধিষ্ণু কৃষক অবশ্য আছেন, আর আছে কিছু পরিবার যাদের জীবিকা নির্বাহ হয় কলকাতা ও
শহরতলির কারখানায় কাজ করে। তাদের বাড়ীতেই শুধু বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে। বাকি সবই
স্থানীয় আদিবাসী উপজাতি। শিক্ষা অথবা বিদ্যুৎ— কিছুরই
আলোই সেখানে পৌঁছয় নি। শিকার, মৎস্য
ও অন্যান্য বনজ উৎপাদনই তাদের উপজীবিকা।
ওখানকার থানার দারোগা জনার্দন সাহা থাকেন গোসাবায়, রোজ যাতায়াত করেন । জীপ পাঠিয়েছিলেন আমাকে বাস-স্ট্যান্ড
থেকে নিয়ে যেতে। ড্রাইভার ছোকরা আদিবাসী, কিন্তু
টেনে টেনে বেশ বাংলা বলে। এবং কথা বলতে ভালোও বাসে। তার কাছ থেকেই পথে যেতে যেতে
শুনছিলাম তাদের গ্রামের কথা ।
তখন সেখানে একটাই চাঞ্চল্যকর খবর। আগের সপ্তাহে গ্রামের লাগোয়া
জলাজঙ্গলে পাওয়া গেছে একটা মৃতদেহ। জলজ গুল্মের মাঝে আটকে ছিল। মৃতদেহটা বেশ পুরনো, জলে ভিজে ফুলে ঢোল, পচে-গলে
চেনবার বিশেষ উপায় নেই। কিন্তু গ্রামের
কেউ কেউ সন্দেহ করেছে সেটা ওখানকারই বাসিন্দা মনুয়া নামে এক শবরের। মনুয়া প্রায়
মাস ছয়েক হল নিরুদ্দেশ। পরনের মেরুন রঙের পোশাকের অবশিষ্টাংশ থেকে গ্রামবাসীরা
আন্দাজ করছে সে হয়তো মনুয়া।
মনুয়া নিরুদ্দিষ্ট হতে তার পরিচিত জনাকয়েক পুলিশে একটা রিপোর্ট
দাখিল করেছিল এবং যেহেতু সেই কেসের তদবধি এখনও কোনও কিনারা হয় নি, তাই এই মৃতদেহটার একটা অটপ্সি করার প্রয়োজন হয়। কিন্তু
দেহটার অবস্থা এতোই খারাপ ছিল, যে
সেটা কলকাতা এমনকি গোসাবাতেও স্থানান্তরিত করা সম্ভব হয় নি। জনার্দন সাহা উদ্যোগী
হয়ে কলকাতার এক ফরেন্সিক ল্যাব মারফৎ এক বিশেষজ্ঞের ওখানে গিয়ে মতদান নেবার
ব্যবস্থা করেন। সেই সুত্রেই আমার এখানে আসা।
থানায় যখন পৌঁছলাম তখন বেলা দশটা। কাল আমার হাসপাতালে বেশ চাপ ছিল।
সন্ধ্যা পর্যন্ত ডিউটি করতে হয়েছে। তারপর রাতের ঘুম নষ্ট করে এসেছি। বেশ ক্লান্তি
লাগছিল। জনার্দন সাহা জানালেন, কাজ
তো বেশীক্ষণের নয়। নেহাতই ফর্মালিটি না করলেই নয়, তাই আমাকে কষ্ট দিতে হয়েছে। আমাকে স্বান্তনা দিতেই যেন বললেন, কিচ্ছু ভাববেন না স্যর, দুপুরের মধ্যেই কাজ হয়ে যাবে। পুলিশ গেস্ট হাউসে বুকিং করা আছে।
ওখানকার কুক ভবানীচরণ উড়িষ্যার লোক, খাসা
রাঁধে। আরামে লাঞ্চ আর ডিনার করুন স্যর। রাতটা কাটিয়ে সকালের বাসেই ড্যাং ড্যাং
করে ফিরে যেতে পারবেন।
কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, সত্যিই
আমার বিশেষ কিছু করার ছিল না। আমি জীবনে অনেক মড়া কেটেছি, কিন্তু এরকম বীভৎসভাবে বিকৃত দেহ কখনও দেখেছি বলে মনে
করতে পারলাম না। মানুষের দেহ বলে চেনার উপায় নেই বললেই চলে। অল্পসময়েই কোনও কিছুই
সনাক্তকরণ সম্ভব নয় বলে রিপোর্ট তৈরি করে দিলাম। জনার্দন সাহা আমাকে গেস্টহাউসে
নামিয়ে দিয়ে আমায়িক হেসে বললেন, সামান্য
কারণে আপনাকে এতখানি উত্যক্ত করে কি যে লজ্জা করছে। যাক, এখন রেস্ট করুন স্যর। সন্ধের সময় একটু দূরে একটা মেলা
বসেছে। জীপ পাঠিয়ে দেবো, দেখে আসবেন স্যর। এছাড়াও আর
কিছু দরকার পড়লে দারোয়ান মুরমু আছে, ওকে
দিয়ে থানায় খবর পাঠাবেন স্যর।
জনার্দনের আতিথেয়তার কোনও তুলনা নেই, কিন্তু তার প্রতি কথার আগে স্যর আর পরে স্যর শুনতে বেশ অস্বস্তি
হচ্ছিল। তবে হ্যাঁ, অতিথিভবনে ঢুকে সত্যিই যেন
শরীরের অর্ধেক ক্লান্তি কেটে গেল। জঙ্গলের মাঝে ছবির মতো গেস্টহাউস, নাম সন্ধ্যা-তারা। উঁচু উঁচু ছাদের পুরনো সাহেবি কায়দার
বাড়ী। ভিতরটা শামশীতল, শরীর মন জুড়িয়ে যায়। স্নান
সেরে লাঞ্চের টেবিলে এসে দেখি খাওয়ারও দিব্যি ব্যবস্থা। সরু চালের ভাত, সোনামুগের ডাল, আলুভাজা
ছাড়াও চার রকম মাছের পদ। শেষে চিনিপাতা সাদা দই আর মাখা সন্দেশ। দেখা গেল সূপকার
ভবানীচরণ বেশী কথা বলে না বটে কিন্তু তার হাত বলে। এতো ভালো ভাপা ইলিশ আগে কখনও
খেয়েছি বলে মনে পড়ে না। অনেক চেষ্টা করেও গুরুভোজন এড়ানো গেল না।
দুপুরের বাকিটা একটু বিছানায় গড়িয়ে নিয়ে বিকেলে যখন উঠলাম দেখি
গুরুভোজন দিব্যি নেমে গিয়ে শরীর বেশ ঝরঝরে লাগছে। ঘন্টা কয়েক আগের সেই বীভৎস
দৃশ্যের স্মৃতিও যেন ফিকে হয়ে এসেছে। বাইরে হেমন্তের দিন শেষে পড়ন্ত রোদের মরা
আলো। দেখলাম দুপুরের সেই আতপ আর নেই, হাওয়ায়
বেশ একটা তরতাজা শীতের আমেজ। একটা চাদর জড়িয়ে বাগানে এসে বসলাম।
এখনও জীপ এসে পৌঁছয় নি। মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে দেখতে পেলাম শুধু
সবুজের সমারোহ। শহুরে যান্ত্রিকতামুক্ত মন আপনা থেকেই কাব্যিক হয়ে পড়ে। আর একটু
হলেই একটা গানের কলি মুখে এসে গেছিল, হঠাৎ
দেখি কোথা থেকে একটা আট-ন' বছরের ফুটফুটে মেয়ে আমার
পাশটিতে এসে দাঁড়িয়েছে।
গেস্টহাউসে আরও যে অতিথি এসে থাকতে পারে প্রথমটা সেটা ধরতে পারি
নি। একটু চমকেই গিয়েছিলাম। মেয়েটাকে বললাম, তুমি
কোথা এসেছ খুকি ?
মেয়েটা কথা না বলে হাতটা পিছন দিকে ঘুরিয়ে যে দিকটা নির্দেশ করলো
তা সম্পূর্ণ উত্তরগোলার্ধের মাঝে যে কোনও জায়গাই হতে পারে। ভালো করে দেখলাম ওর
রংটা একটু চাপা,
কিন্তু মুখের গড়ন যেন পটে আঁকা।
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কি খুকি?
এবারেও কোনও উত্তর এলো না। মাথা নীচু করে মেয়েটা ততক্ষণে একমনে তার
ফ্রকের লাল ফিতেটা নিরীক্ষণ করছে। ভাবলাম কে জানে, কথা বলতে পারে তো? আমি
জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, তুমি কথা বলতে পারো তো? তোমার সাথে কে কে আছেন?
—তুমি
কি আমার বাবাকে দেখেছো?
ওকে প্রশ্ন করেছিলাম বটে কিন্তু যেন ধরেই নিয়েছিলাম উত্তর পাবো না।
তাই হঠাৎ যখন ও কথা বলল,— । ওই
বলল তো? নিশ্চই তাই, কিন্তু
যেন মনে হল অনেক দূর থেকে আওয়াজ ভেসে এলো!
ওর ম্লান মুখটা দেখে খুব খারাপ লাগছিল। বাবা বোধহয় ওকে না জানিয়ে
কোথাও গেছে,
বেচারা তাই বাবাকে খুঁজছে। ওর
প্রশ্ন শুনে আবার একটু ভালোও লাগলো, যাক
রাত্তিরে তাহলে আর একলা থাকতে হবে না। মনে হয় পুরো পরিবারই এসেছে। বেশ একসাথে
জমিয়ে খাওয়া দাওয়া আর আড্ডা মারা যাবে। কে কে এসেছে জেনে নিতে জিজ্ঞেস করলাম, আর কে কে আছে তোমার সাথে খুকি?
—আর
কেউ না, নমস্কার। এবার উত্তরটা এলো আমার পিছন দিক থেকে। এতো
কাছাকাছি আরও কেউ এসেছে কল্পনা করিনি। চকিতে ঘুরে দেখি, পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত এক সুদর্শন যুবক আমাকে দেখে হাত
জড়ো করে অভিবাদন জানাচ্ছে। আমার চেয়ে বয়স নিশ্চই কম, তাও তাড়াতাড়ি প্রতিনমস্কার জানিয়ে বললাম, নমস্কার। মাফ করবেন, আপনাকে
ঠিক খেয়াল করি নি। আপনিই কি ওর বাবা ?
ভদ্রলোক অনুমোদনসূচক মাথা নেড়ে বললেন, আমরা দু'জনই।
ওর মা তো অনেকদিন হল নেই। ও হবার বছর খানেক পরেই...
মনের মধ্যে একটা ধাক্কা লাগলো। এই ফুলের মতো বাচ্ছাটা মাতৃহারা!
হঠাৎ কি বলবো বুঝতে পারলাম না। ভদ্রলোকই বললেন, এখন
আমিই ওর বাবা আবার আমিই ওর মা। একসাথে বাপ-বেটি বেশ আছি, খাই দাই ঘুরে বেড়াই।
দেখলাম মেয়েকে পেয়ে ভদ্রলোক স্ত্রীবিয়োগের শোক প্রায় ভুলেই গেছেন।
অনেক কথা বলতে লাগলেন, সবই প্রায় নিজের কন্যার
সম্বন্ধে। বলতে বলতে ওনার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। কিন্তু মেয়েকে নিয়ে ওনার একটা
চাপা উৎকণ্ঠাও যেন অনুভব করছিলাম। তাঁর মেয়ে কি চায়, কি খেতে ভালোবাসে, কতো
গুণের এইসব বলতে বলতে জানালেন, মেয়ে
আমার এই বয়সেই এমন গিন্নি হয়ে উঠেছে কি বলি। এখন আমাকে রান্না করেও খাওয়ায়। তার
পরেই মাথা বাড়িয়ে আমার পিছন দিকে দেখে হঠাৎ বলে উঠলেন, ... আরে, দুলালী
কোথায় গেল?
দুলালী-ঈ-ঈ...?
ভদ্রলোক ব্যস্ত হয়ে ছুটলেন মেয়ের পিছনে। এতক্ষণ জানতে পারি নি, মেয়ের নাম তাহলে দুলালী। কথায় কথায় আমিও খেয়াল করি নি, পিছন ফিরে দুলালীকে আর দেখতে পেলাম না। নিশ্চই কোনও
গাছের আড়ালে,
নয়তো গেস্টহাউসের অন্যদিকে চলে
গেছে। ভদ্রলোকের উৎকণ্ঠা একটু অতিরিক্তই বোধ হল। অবশ্য মা-হারা কন্যার ওপর স্নেহটা
অতিরিক্ত হওয়া খুব অস্বাভাবিক নয়।
ওদিকে জীপ এসে গিয়েছিল। আমি আর ওনার জন্য অপেক্ষা না করে জীপে গিয়ে
উঠলাম। জীপ ছেড়ে দেবার পরে মনে পড়লো, এতো
কথার মাঝে ভদ্রলোকের পরিচয়টা তো নেওয়া হল না?
মেলা দেখে যখন ফিরলাম তখন রাত প্রায় ন'টা। 'সন্ধ্যা-তারা'য় বিজলী বাতি নেই, গোটা
কয়েক সেজ আর হ্যারিকেন জ্বলছে। ভূতের বাড়ীই মনে হতো, দোরের কাছেই ভবানীচরণকে পেয়ে গিয়ে ধড়ে প্রাণ এলো। একটা আলো নিয়ে
আমাকে আমার ঘরে পৌঁছে দিল। আমাকে খাইয়ে সে নিজের বাসায় ফিরে যাবে। ওকে জিজ্ঞেস
করলাম, ওনারা কোন ঘরে আছেন, ভবানীচরণ?
—কাদের
কতা বলচেন বাবু?
ভবানীচরণ হাতের হ্যারিকেনটা একটু
তুলে জিজ্ঞেস করলো।
—কেন, ওই যে বাবা আর মেয়ে, বিকেলে
দেখা হল? ওরা এখানেই উঠেছে নিশ্চই?
—এখানে
আপনি একাই আচেন বাবু। ভবানীচরণ আলোটা রেখে জানাল, আর তো কেউ নাই।
বলে কি রে? বিকেলে স্পষ্ট দেখলাম, কতো কথা হল- আর বলে কিনা কেউ নেই? অবশ্য কোথা থেকে এসেছেন সেটা জিজ্ঞেস করা হয় নি, কিন্তু ভদ্রলোককে দেখে স্থানীয় বাসিন্দা বলে তো মনে হয়
নি। আর এখানে ধারে কাছে বহিরাগতের বাসোপযোগী অন্য কোনও আস্তানা আছে বলেও তো মনে হয়
না।
ভবানীচরণ ফিরে যাচ্ছিল, ওকে
থামিয়ে বললাম,
সে কি হে? বিকেলে দেখলাম যে? ছোট্ট
একটা মেয়ে আর তার বাবা...'
এই পর্যন্ত বলেছি, হঠাৎ
দূর থেকে একটা আওয়াজ ভেসে এলো, দুলালী-ঈ-ঈ...!
সর্বনাশ, ভদ্রলোক কি এখনও তাঁর
মেয়েকে খুঁজে পান নি? আওয়াজটা বেশ দূরের, কিন্তু দেখলাম ভবানীচরণও শুনেছে। নীচু হয়ে তাড়াতাড়ি
আলোটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে শুকনো গলায় বলল, মনুয়া
খুঁজে বেড়াচ্ছে বাবু তাঁর দুলালীকে!
আমার সব কেমন গুলিয়ে গেল। দেখি ভবানীচরণও চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে
কি যেন বলছে। আমি তাকে একটু ঠেলা দিয়ে বললাম, কি
বলছ যা তা?
মনুয়া কে?
ডাক্তার হবার সুবাদে আমার ভূতের ভয়টা বেশ কম। এইরকম অন্ধকার রাতে
এতক্ষণ আমার একটু অস্বস্তি হচ্ছিল বটে, কিন্তু
ভয় পাই নি। এবার সত্যি কথা বলতে একটু গা ছম ছম করে উঠলো। সেই পচা-গলা লাশটার ছবি
চোখের সামনে ভেসে এলো। আজ দুপুরেই যার মৃতদেহ নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি, সে কি সত্যিই মনুয়া? ভবানীচরণ
কি সেই মনুয়ার কথাই বলছে?
—হ্যাঁ
বাবু মনুয়া মরে গেছে। কিন্তু এখনও সে তাঁর মেয়েকে খুঁজে ফেরে। মাঝেমধ্যি তার ডাক
শুনতে পাওয়া যায় বাবু...!
ভবানীচরণের ভয়ার্ত দৃষ্টি দূরে জঙ্গলের দিকে, হাতদুটো বুকের কাছে জড়ো করে থরথর করে কাঁপছে। অতিকষ্টে
চেঁচিয়ে দারোয়ানকে ডাকল, মুরমু তুই কোথায়?
প্রায় তক্ষুনি আর একটা আলো হাতে মুরমু এসে হাজির হল। চেনা লোক পেয়ে
ভবানীচরণ এবার একটু ধাতস্থ হল। তারপর আমাকে শোনালো এক মর্মান্তিক কাহিনী...
মনুয়া সুখে ছিল তার আদরিনী কন্যা দুলালীকে নিয়ে। মনুয়ার বউ মারা
গিয়েছিল অনেক দিন আগে। দুলালীই তার সব। দুপুরের খাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়তো মনুয়া।
পায়রা, বনমুর্গী, তিতির
বা হাঁস শিকার করে আনত। দিনান্তে তাই দিয়ে তাদের নৈশভোজ হতো। আর হতো সারাদিনের জমে
থাকা গল্প। দুঃখের সংসার, কিন্তু বাপ-বেটির মনে খুশীর
অভাব ছিল না।
সেদিন কোনও শিকার পায় নি মনুয়া। তাই রাতের আহারের সন্ধানে একটু
দেরী হয়ে গিয়েছিল। অমাবস্যার রাত ছিল বোধহয়, তায়
ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল। শূন্যহাতে ফেরার পথে গ্রামের কিনারে একটা আওয়াজ পেয়ে
সজাগ হয়েছিল সে। অন্ধকারেও তীর নিশানায় লাগাতে পারতো মনুয়া। কোনও অজানা শিকার ভেবে
অন্ধকারেই তীর ছোঁড়ে সে। একটা আর্তস্বর জানায় নিশানা তার ব্যর্থ হয় নি। কিন্তু
মনুয়ার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গিয়েছিল! দুলালী তার সন্ধানে জঙ্গলের এতো কাছে চলে
আসবে সে বেচারা কল্পনা করবে কি করে?
পরদিন গ্রামের প্রান্তে দুলালীর তীরবিদ্ধ দেহ পাওয়া গিয়েছিল।
কিন্তু মনুয়াকে আর দেখা যায় নি। শুধু তার ধনুকের দুটো টুকরো একটু দূরে পাওয়া যায়।
আর তারপর থেকেই অন্ধকার রাতে মাঝেমাঝে শুনতে পাওয়া যায় সেই করুণ
হাহাকার, দুলালী-ঈ-ঈ...!
মুরমুকে দিয়ে থানায় খবর পাঠিয়েছিলাম। সেই রাতেই গোসাবা থেকে আমাকে
কলকাতা ফেরার বাস ধরতে হল। রাতের ঘুম চুলোয় যাক, সন্ধ্যা-তারায় সে রাতে একলা থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হয় নি।