গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ২৯ জুন, ২০১৪

জয় চক্রবর্তী

ধোঁয়া

         “এত কালো ধোঁয়া যখন তবে নির্ঘাত কোন দুর্ভাগা হবে । যাক ! গেলি যখন বেঁচেই গেলি” । বাসটা চেতলা ব্রিজ পার হচ্ছিল । আজ সকাল থেকে যানজটটা একটু যেন বেশিই । কেওড়াতলা শ্মশানের চুল্লী থেকে নির্গত ধোঁয়ায় হরিদেববাবুর চোখদুটো কটকট করে ওঠে । হাই পাওয়ারের চশমাটা খুলে চোখদুটো কচলে জানলার পাশের সীটে কনুই রেখে যেভাবে তাকালেন, মনে হচ্ছিল নিজের সরকারি চাকরী আর নিশ্চিতভাবে পাওয়া জানলার ধারের সীট সম্পর্কে উনি জন্ম থেকেই অবগত ছিলেন । “লোকটা রোজ বাসের পাদানিতে ঝোলা বেসরকারি কোন সেলসম্যান হবে” । ভাবতে ভাবতে হরিদেববাবু গুনগুন করে কোন সুর ভাজার চেষ্টা করেন। পরক্ষনেই বাসের কনডাকটারের উদ্দেশ্যে ঠোঁট দিয়ে “ছিপ” করে একটা শব্দ তুলে বললেন, “কি হল ! এবার চালাও !” কোন উত্তর আশা না করেই হরিদেববাবু আবার দেবে যান নিজের সৌভাগ্য লিপির সঙ্গে বাকিদের অলিখিত ললাটলিখনের তুলনায় । বাসটা ব্রিজ থেকে নেমে রাসবিহারীর সিগন্যালের অপেক্ষায় ঠায় দাঁড়িয়ে । পাশের একটা গ্যাসের দোকানে বিশাল লাইন । অনেক মানুষ ভর্তুকি সিলিন্ডারের আশায় আধার কার্ড হাতে দাঁড়িয়ে আছে । এক তরুন সামনের এক মাঝবয়েসীকে বলল, “দাদা ! আমি আপনার পরেই আছি , লাইনটা একটু রাখবেন”। হরিদেববাবু জানলা দিয়ে দেখছিলেন --- শুনছিলেনও । আসলে চুল্লীর কালো ধোঁয়া তখনও অনার মনের হলঘরে ঘুরপাক খাচ্ছিল । উনি মনে মনে হাসলেন, “এত তাড়া কিসের ভাই ! একটা বেচুবাবুর চাকরী জোগাড় কর ! একটা বউ --- খান কয় ছেলেপুলে --- ওরা বড় হোক --- তারপর না হয় লাইনে দাঁড়িও” । একটা তাচ্ছিল্য আর প্রশান্তির স্রোত যেন মৈথুনের ভঙ্গিমায় খেলে গেলো হরিদেববাবুর চোখে মুখে । দশ টাকার নোটটা দুআঙ্গুলে খসখস করে বেশ সুলতানি ঢঙে বললেন, “কি হল ! টিকিটটা কর” !

         রাসবিহারী ছেড়ে কালীঘাট আসতেই বসা বা দাঁড়ানো অনেকের হাত বা অন্তত একটা আঙ্গুল কপাল আর বুক ছুঁয়ে নিল । হরিদেববাবু দুহাত জোড় করে মনে মনে বললেন, “ভাল রাখিস, মা” । হাজরা ক্রসিং-এ আবার নিথর জট । শহরটাকে যেন কেউ “স্ট্যাচু” বলে হঠাৎ থামিয়ে দিয়েছে । হরিদেববাবু জানলায় উঁকি দিয়ে দেখলেন --- সামনে যত দূর দেখা যায় শুধু গাড়ি, বাস, ট্যাক্সি --- নিস্পন্দ ! নাগরিক এই অচলাবস্থায় হরিদেববাবু মনে – চোখে এক তন্দ্রার হাতছানি অনুভব করতে থাকেন । কেওড়াতলার কালো ধোঁয়া, গ্যাসের লাইন, মা কালীর রোজকার অ্যাপয়নমেনট --- সব মিলিয়ে মিশিয়ে বেশ মিষ্টি এক আত্মস্থতার আবেশ ডুবিয়ে দিচ্ছিল হরিদেববাবুকে । আচমকা সশব্দে আবির্ভাব হল গাড়িটার । বাসের ঠিক পাশেই এসে দাঁড়াল কুচকুচে কালো লম্বা একটা মার্সিডিজ । ঘন কালো কাঁচে ঢাকা । মস্ত এক পানকৌড়ির মতো গ্রীবাভঙ্গি । কিন্তু যানজটের সাম্যবাদে নেহাতই বেমানান । বাসে অনেকেই অবাক চোখে গাড়িটা দেখছিল । পাওয়ার গ্লাস ধীরে ধীরে নামতেই হরিদেববাবুর চোখ পড়ে গাড়িটার পিছন সীটে বসা একমাত্র আরোহীর দিকে । পরনে ধুসর স্যুট --- আঙ্গুলে লম্বা সিগার । সানগ্লাসটা চোখ থেকে নামাতেই চমকে ওঠেন হরিদেববাবু ---বিষ্টু ! ছেলেবেলার পাঠশালার বন্ধু বিষ্টু ! হরিদেববাবু অজান্তেই চিৎকার করে ডেকে উঠতে চান --- “বিষ্টু ! আমি হরি ! বাসের জানলায়” ! ঠিক সেই মুহূর্তেই হাজরা মোড়ের সিগন্যাল সবুজ হয়ে যায় । সব গাড়ি স্টার্ট নেয় --- সব পাখী ওড়ার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত । হরিদেববাবুদের বাসটা স্টার্ট নিতে গিয়ে এত কালো ধোঁয়া ছাড়ে যে, বিষ্টুকে বোতাম টিপে কালো কাঁচ তুলে নিজের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যেতে হয় ।