প্রায় ঋষিতুল্য
জীবন মানে কি? কিছুটা সময়। পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
তবু এই জীবন নিয়ে কত কীই না হয়ে যাচ্ছে।
জীবনের ধর্ম নিয়ে কত না হই-হই কাণ্ড। জীবনের ধর্ম, নাকি
ধর্ম নিয়েই জীবন কাটাবে মানুষ, বুঝতে পারছে না কেউই। টিভিতে দেখাল গাড়ি গাড়ি ইট এল
দেশের নানা প্রান্ত থেকে। শোরগোল তুলে কিছু একটা নতুন করে গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে খুব।
যেমন বেশ কিছু বছর আগে এরকমই হই-হই করে কিছু একটা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। লাভ ক্ষতির হিসেব
করে লাভ কি? তবু এরকম হল কেন?
মানুষের প্রবৃত্তি। যদ্ধৃয়তে সঃধর্ম। মানুষকে বুঝে চলতে
হবে পরস্পরকে। হিংসা, ধ্বংস, এসব প্রবৃত্তিগুলোকে যতটা সম্ভব পাশ কাটিয়ে চলতে হবে।
সকলের মত আমিও পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনার আয়-ব্যয় মেলাতে মেলাতে চলছিলাম। কিন্তু তবু একদিন
এক ওষুধের দোকানে আমাকে শুনতে হল, ‘আপনি প্রিস্টকে চেনেন দিদি?’
‘প্রিস্ট কে?’
যা বলল, সবই বোঝা গেল। আমারই পরিচিত একটি ছেলে। ইদানীং
খুবই ধার্মিক বলে নাকি আমাদের এলাকাতে নামডাক হয়েছে তার। যদি সত্যিই ছেলেটা ধার্মিক
মনের হয়, তবে তো তার মন উদার হবে। এক ধরনের সার্বজনীন প্রেমও থাকবে। কী যেন নাম ছেলেটার?
হ্যাঁ, শিবের নামে নাম ওর। জল্পেশ। উত্তরবঙ্গের এক সতীতীর্থের শিব। বেশ কিছুদিন আগের
একটি দিনের কথা মনে পড়ল আমার।
আগেই বলে রাখি, এই গল্প আমার নয়। একটি ছোট ছেলের গল্প।
নাম তার জল্পেশ চৌধুরি। ওরা বৌদ্ধ। ওর বাবা বাঙালি বৌদ্ধ সমাজে বিশিষ্ট জ্ঞানী বলে
পরিচিত। লোকে তাঁকে জিনিয়াস বলে ডাকত একসময়ে। কাজকর্ম বিশেষ কিছু না করলেও লেখাপড়া
নিয়ে থাকতে ভালবাসেন তিনি। যা হোক, এবার তবে ওঁর ছেলের প্রসঙ্গে আসি। স্থানীয় বুদ্ধমন্দিরে
এক সন্ধ্যায় জল্পেশের সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল। মন্দিরের অডিটোরিয়ামে আমার সেসময়কার
সদ্য প্রকাশিত বইটা নিয়ে আলোচনা করছিলেন মন্দিরের সেক্রেটারি। যদিও বইটা তিনি পড়েননি।
ধরি মাছ না ছুঁই পানি করে বেরিয়েও গেলেন একটু পরেই। যদিও, বেরনোর আগে সকলকে বারবার
অনুরোধ করছিলেন বইটা কেনার জন্য। বুদ্ধ, ধর্ম, সঙ্ঘের হয়ে প্রচারের জন্য। যদিও আমার
বইটি ধর্মের বই নয় একেবারেই।
অনেকেই চলে গিয়েছেন সভা ছেড়ে। আমি বসে এক ধারে, চেয়ারে। বৌদ্ধ সমাজের
সঙ্গে আমার প্রধানতম যোগসূত্র যিনি, আমার স্বামী, একটু দূরেই বসে আছেন। ধর্ম, সমাজ
ইত্যাদি নিয়ে ভিক্ষুদের সঙ্গে গম্ভীর মুখে আলোচনা করছেন। আপাতত একাকী আমি। এই একাকিত্বই
আমার একমাত্র ভরসা, আমার সাহস।
হঠাৎ চমকে উঠে দেখি, আমার একেবারে পায়ের কাছে বসে আছে জল্পেশ। বললাম,
‘কী রে, একা কেন?’
‘তুমিও তো একা।‘
একটু অবাক হলাম। জল্পেশ আরও কাছ ঘেঁষে বসল। তারপর আমার
পা-দুটিতে হাত রাখল। ভাবলাম, প্রণাম করতে চায় বুঝি। সস্নেহে ওর মাথায় হাত রেখে বললাম,
‘থাক থাক, প্রণাম করতে হবে না। তোর মা কেমন আছে রে?’
জল্পেশ আরও কাছে এগিয়ে এল। ‘থাক না ওদের কথা। তোমার হাঁটুতে
মাথা রাখি একটু? তুমি কি না করবে?’
একটু যে অস্বস্তি হল না এমন নয়। তবে জল্পেশ খুবই ছোট একটি
ছেলে। আমার ছেলের চাইতে খুব বেশি হলে বছর দেড়েকের বড় হবে। ক্ষীণ হলেও একটা আত্মীয়তা
রয়েছে ওদের পরিবারের সঙ্গে। জানতে চাইলাম, ‘তোর কি মন খারাপ আজ? কেন রে?’
ততক্ষণে সে মাথা রেখেছে আমার হাঁটুতে। সে বলে, ‘আমার মাথায়
হাত বুলিয়ে দাও একটু।‘
‘শোন জল্পেশ। আমার দুটো হাঁটুতেই খুব ব্যাথা---বুঝলি,’
‘মিথ্যে কথা বলছ, হতেই পারে না। বিশ্বাস করি না তোমার কথা।
কোনোদিন তোমার বাড়িতে ঢুকতে দাওনি আমাকে, কতবার গেছি তোমাকে দেখতে।‘
মনে পড়ল, আমি বাড়ির ছাদ থেকে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, নীচে রাস্তায়
দাঁড়িয়ে জল্পেশ। সে খুব উৎসাহের সঙ্গে জানাচ্ছে, বাইপাসের ধারে একটা বাড়ির মালিকানা
পেয়েছে সে। উচ্চবিত্ত এক ভদ্রলোক আমেরিকায়, তাঁর ছেলের কাছে যাওয়ার আগে জল্পেশ’কে বাড়ির
রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়ে গেলেন। সেইসঙ্গে দিয়ে গেলেন পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি, বাড়িরই
সামনের খোলা উঠোনে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বলাই বাহুল্য, বুদ্ধ মন্দির। স্থানীয়
বুদ্ধমন্দিরের থেকে আলাদা হতে হবে অবশ্যই। কেমন হবে? না, ভদ্রলোক বলেছিলেন, আমাদের
ঢাকুরিয়ার বুদ্ধ মন্দিরের মত, উঁচু প্যাগোডা হবে। জাপানি-জাপানি দেখতে লাগে যেন!
জল্পেশ করিতকর্মা ছেলে যথেষ্টই। কিভাবে-কিভাবে একে-তাকে ধরাধরি করে
জাপানের সঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি সে যোগাযোগ করে ফেলল। বারকয়েক ঘুরেও এল জাপানে। ওই দেশের
এক বৌদ্ধধর্ম প্রচারক সংস্থা হয়ত তাকে ভারতীয় বৌদ্ধ-সন্তান ভেবেই খাতির করেছিল খুব।
সেই খাতির, তাও সে জাপান থেকে পাওয়ার কারণে হোক, কি নিজের ধার্মিক ভাবসাবের কারণে হোক,
জল্পেশ ভিক্ষু হয়ে গেল একদিন। সে আর চীবর ছাড়ার নাম নেয় না। মুণ্ডিত মস্তক, পরনে গেরুয়া
নিয়ে জল্পেশ তার পুরনো পাড়াতে ঘুরে বেড়াতে লাগল, পুরনো বাড়িতেই থাকতে লাগল, বাবা-মায়ের
সঙ্গেই। শোনা গেল, জাপান থেকে সে নাকি কলকাতার অখ্যাত এই পাড়াতে একটি বুদ্ধমন্দির প্রতিষ্ঠার
জন্য মোটা অঙ্কের টাকা পেয়েছে। সেই টাকার যথার্থ সদব্যবহার করে সুন্দর একটি মন্দির
বানাল একদিন জল্পেশ। সত্যিই জাপানি-জাপানি দেখতে সেই মন্দির। জাপান থেকে আনানো মহামূল্য
বুদ্ধমূর্তির প্রতিষ্ঠা হল। জাপান থেকে বরিষ্ঠ ভিক্ষুরা এসে মন্দিরের একদিন উদ্বোধন
করে গেলেন। কয়েকজন দেশী-ভিক্ষুও আমন্ত্রিত যে ছিলেন না, তা নয়। তবে সকলের নজর কেড়ে
নিয়েছিল সেদিন জল্পেশ। খবরের কাগজ, টেলিভিশনে যা বলার সে-ই একমাত্র বলছিল। জাপানি ভাষা
আয়ত্ত করতে না পারলেও, সে ভাঙা-ভাঙা জাপানিতে কথা চালাচ্ছিল জাপানি-ভিক্ষুদের সঙ্গে।
মিডিয়ার লোকজনের সামনে জাপানি-ভিক্ষুদের কথাগুলোকে দোভাষীর ভঙ্গিতে অনুবাদও করে দিচ্ছিল
সে। মুণ্ডিত মস্তকের গেরুয়া পরা জল্পেশ’কে নিয়ে এলাকাতে জল্পনা-কল্পনাও হচ্ছিল খুব।
জল্পেশ নাকি অনেক টাকা আত্মসাৎ করেছে জাপানি-সংস্থার অনুদানের সুযোগে। কেউ কেউ ফিসফিস
করে বলছিল, জাপান-কনসুলেটে লিখিত অভিযোগ করে আসা দরকার। কিন্তু সেসব আর বাস্তবায়িত
হয়নি।
সে যাই হোক, জাপানি-ভিক্ষুরা জল্পেশের মত তরুণ, বুদ্ধিদীপ্ত,
করিতকর্মা একজন ভারতীয় ভিক্ষুর সঙ্গে আলাপে মুগ্ধ হলেন। তারা ঘোষণা করে গেলেন, এই মন্দিরের
প্রধান-ভিক্ষু পদে আজ হতে জল্পেশ অভিষিক্ত হল। সেই থেকে জল্পেশ, এলাকার ‘হেড-প্রিস্ট’
বা ‘প্রিস্ট’ বলে নাম করতে শুরু করল।
সেই ভদ্রলোক বছর দুই বাদে আমেরিকা থেকে ফিরে এসে দেখলেন,
বাড়ির প্রায় পুরো জমিটা জুড়ে বিশাল এক মন্দির। উঁচু প্যাগোডা। সন্ধ্যায় গুরুগম্ভীর
ডঙ্কা বাজে। বিদঘুটে ভাষায় মন্ত্রপাঠ চলে। তার সাধের বসতবাড়িটা এখন সেই মন্দিরের ভিক্ষু-আবাস।
জল্পেশ সব্বাইকে বকা-ঝকা করে দিব্যি দিন কাটাচ্ছে। ভক্তিতে গদগদ হয়ে পড়লেন তিনি। পারলে
সেই মুহূর্তে তিনিও জল্পেশের মত মাথা মুড়িয়ে গেরুয়া পরে ফেলেন আর কি! অনেক কষ্টে নিজেকে
সামলে নিয়ে তিনি ঠিক করলেন, এমন পবিত্র এক তীর্থে পরিণত হয়েছে আজ তাঁর বাড়ি, এমন তিনি
স্বপ্নেও ভাবেননি। তিনি শুধু একটি মন্দির চেয়েছিলেন বাড়ির উঠোনে। পাড়ার শনি মন্দিরের
মত। কিন্তু এতসব কর্মকাণ্ড! সম্ভব হল জল্পেশের জন্য! তিনি খুব খুশি মনে দোতলাটা জল্পেশ’কে
লিখে দিলেন। বাকিটা মন্দিরের নামে দান করলেন রাতারাতি। তারপর আমেরিকায় চলে গেলেন চিরতরে।
যাওয়ার আগে বারবার বলছিলেন, ‘জল্পেশ সত্যিই জিনিয়াস। কে না জানে, জিনিয়াসের ছেলে জিনিয়াসই
হয়!’
সেই জিনিয়াস আর তার জিনিয়াস ছেলেকে একসঙ্গে আমি প্রথম দেখি, যখন
ছোট-জিনিয়াসের বয়েস মাত্র তিন কি চার। বাবার হাত ধরে হেঁটে আসছে। আমাদের বাড়ির সামনে
এসে বাবা দাঁড়াল। ছেলেও দাঁড়াল। আমরা তখন পুরনো বাড়িটাতে থাকতাম। লম্বা টানা বারান্দা।
আমি চেয়ার পেতে বসে ছিলাম। দেখছিলাম, ছটফটে একটি ছেলে বাবার হাত ধরে হাসিমুখে দেখছে
আমার দিকে।
‘নির্বাণদা কেমন আছেন?’
‘এই তো। ছেলেকে নিয়ে ফিরছি। ওকে কলকাতা দেখাতে নিয়ে গেছিলাম।‘
হাসি-হাসি মুখে বললেন জল্পেশের বাবা নির্বাণ চৌধুরি।
‘কি কেমন দেখলে কলকাতা?’ আমি বালকটিকে জিগ্যেস করি।
‘কলকাতা না, চোলে দেখেছি। চোলে।‘
‘চোলে?’
‘শোলে। প্যারাডাইসে চলছিল, দেখালাম ওকে। সেই থেকে বলছে, হেমা
কি সুন্দর, হেমা কি সুন্দর।‘
‘তুমি হেমার থেকেও সুন্দর।‘ আচমকা বলে উঠল ছেলেটা।
‘থাম পাকা বুড়ো! এবার বাড়ি যা।‘
সেই পাকাবুড়ো একদিন বড় হয়েছে, গেরুয়া ধরেছে। আরও পাকা হয়েছে।
সেই যে ভদ্রলোক আমেরিকা যাওয়ার আগে তাঁর বাড়ির দোতলাটা জল্পেশের নামে লিখে দিয়ে গেলেন,
ব্যস, পাকাবুড়ো জল্পেশ গেরুয়া-টেরুয়া ছেড়ে ফেলে আবার আগের মত যে কে-সেই হয়ে গেল। শুনেছি,
বিয়েও করেছে। তবে মন্দিরের তত্ত্বাবধায়কের পদটি এখনও তার নামেই আছে। দিনরাত মন্দিরের
কাজ নিয়েই মেতে থাকে। সরকারি, আধা-সরকারি, আর ব্যক্তিগত সব মোটা-মোটা ডোনেশনের উদ্দেশ্যে
হিল্লি-দিল্লি করে বেড়ায়, আর বছরে একবার করে যায় জাপান।
তার মত ভিআইপি পর্যায়ের মানুষকে আমাদের পুরনো মন্দিরের মেঝেতে
একলা বসে থাকতে দেখে অবাকই হয়েছিলাম আমি।
‘এখানে কি করতে বসে আছ? চলো তো, আমাদের মন্দিরে চলো।‘ জল্পেশ
বলে ওঠে।
‘না রে, এখন সময় নেই। পরে একদিন যাব।‘ আমি বলি।
‘তুমি তো এই মন্দিরেও আসো-টাসো না, অবশ্য এরা তোমার মর্যাদা দিতে
পারে না।‘
‘দ্যাখ জল্পেশ, আসল হল সময়। আমার সময় কই? লিখতে চাইলে মন্দিরে
গিয়ে সময় নষ্ট করা চলবে না।‘
‘চলো না, কিছু শিখতে পারবে ওখানে। চলো না।‘ জল্পেশ নাছোড়বান্দা।
‘এই এক মন্দির দেখেই আমার অনেক কিছু শেখা হয়ে গেল, আর কি শিখব
তোর মন্দিরে গিয়ে?’
‘চলো, চলো। জাপান যেতে পারবে। তোমার মত কোয়ালিফায়েড মহিলার খুব
দরকার আমাদের বাংলার বৌদ্ধ সমাজে। জাপানে চলো, ওরা তোমাকে লুফে নেবে। ওরা গুণীজনের
কদর করতে জানে।‘
‘না রে বাবা, আমার আর জাপান গিয়ে কাজ নেই। যা, পালা এখন। কাজ
আছে আমার।‘
‘কী এত কাজ তোমার? কারুর সঙ্গে একটু কথা বলতে পারো না, কোথাও
একটু দাঁড়াও না, কারুর দিকে তাকাও না পর্যন্ত ---’
‘থাম থাম, পাকা কোথাকার। বাচ্চা ছেলে বাচ্চার মত থাকবি। যা এখন।‘
‘আমি তোমার জন্য তোমাদের বাড়ির আশেপাশে সাইকেল নিয়ে ঘুরতাম তুমি
জানো?’
‘হায় ভগবান! আমি ভাবতাম, তুই আমার মেয়ের জন্যে ঘোরাঘুরি করছিস,
তাই আমার ছুঁতো ধরে আসছিস।‘
‘না না, ও তো ছোট। আমার বোনের চেয়েও অনেকটা ছোট। ও তো আমার বোন।‘
‘আর আমি যে তোর মাসি হই, ভুলে গেছিস না?’
জিনিয়াসের ছেলে সত্যিই জিনিয়াস হয়। তিন-চার বছর বয়েসে প্যারাডাইস
হলে ‘শোলে’ দেখে ফেরার পথে আলিয়া’য় বিরিয়ানি খাওয়ার অভ্যাস করার মধ্যে জিনিয়াস না হলেও,
যুগান্তকারী ব্যাপার তো রয়েছেই। ‘আমি আমার ছেলেকে সবরকম স্বাধীনতা দিয়ে দিয়েছি। স্বাধীন
চিন্তা আর কর্মের জন্য ওকে তৈরি করছি আমি। ভালো আর খারাপ দুটোর সামনেই আমি ওকে আনব,
তারপর দেখি, ও কোনটা বেছে নেয়। নিজের বিচারবুদ্ধিতে ওকে বুঝতে হবে, কি ভালো, কেন ভালো,
আর কোনটা খারাপ, কেনই বা খারাপ। একজন ঋষিকুমার যেমন নিজের থেকে ভালো-খারাপের পার্থক্য
বুঝতে পারে, আমার ছেলেও তাই। দেখবেন, বড় হয়ে ও খুব ধার্মিক হবে। দেশে বিদেশে ওর নাম
ছড়িয়ে পড়বে।‘ বলতে বলতে চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল নির্বাণ চৌধুরির।
জল্পেশের জন্মের পরেই
তার মা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। আজকাল যে প্রি-ন্যাটাল আর পোস্ট-ন্যাটাল ডিপ্রেশন নিয়ে হরেক
কথা উঠছে। দেশে-দেশে অনবরত গবেষণা চলছে, সেরকমই কোনও কারণে প্রায় শয্যাশায়ী হয়ে গেছিল
জল্পেশের মা চীরশ্রী।
নির্বাণ ছিল চিরশ্রীর চাইতে লম্বায় খানিক খাটো। আর চিরশ্রী ছিল
বয়েসে অনেকটাই ছোট তার থেকে। দেখতে বেশ সুশ্রী। চট্টগ্রামের অবস্থাপন্ন বৌদ্ধ পিতার
কন্যা। ওখানে নাকি ওদের পরিবারের বেজায় প্রতিপত্তি। নির্বাণ অদ্ভুত হীনমন্যতায় ভুগত।
তাই বোধহয়, সদ্যপরিণীতা পত্নীর কাছে তার মেয়েমহলে কতটা জনপ্রিয়তা, সেসব বোঝাতে চাইত।
যদিও অধিকাংশ কথাই ছিল তার অতিরঞ্জিত। নিজেকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে একজন রোমান্টিক প্রেমিক
হিসেবে দেখাতে চাইত। আর্থিক দিয়ে স্বনির্ভর ছিল না সে একেবারেই, টিউশনি ছিল বড় সম্বল।
একটা মফঃস্বলের স্কুলে অঙ্কের টিচার ছিল সে। এখানে-ওখানে এগারো-বারো ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদেরকে,
যদিও ছাত্রীই ছিল বেশি, অঙ্ক শিখিয়ে বাড়ি ফিরতে
তার রাতই হত। চীরশ্রী যদিও একা থাকত না। নির্বাণের ছোট বোনও থাকত তাদের বাড়িতে। ওর
স্বামী বাইরে কাজ করে। মাইনেপত্রও ভালোই।
চীরশ্রী যখন অন্তঃসত্ত্বা, খানিকটা দুধ আলাদা করে বরাদ্দ হল তার
জন্য। এমনিতে পড়াশোনা করা চটপটে মেয়ে হলেও এই বাড়িতে চীরশ্রীর আচরণ প্রায় গ্রামের লজ্জাশীলা
বধূর মত।
একদিন রাত করে বাড়ি ফিরে নির্বাণ তার স্ত্রীকে জিগ্যেস করেছিল, ‘তোমার
দুধটা খেয়েছ?’
‘কই দিলে না তো? দুবার রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়ালাম, তাও দিলে না।‘
‘কেন দুধটুকু একটু নিজে নিয়ে খেতে পারো না?’
‘না। আমি পারি না। তুমি জানো না, আমি কোনও কাজ করি না। সারাদিন
শুয়েবসে থাকি। আমার দুধ খাওয়ার কি দরকার।‘
‘কেন এমন কর? এত বেশি বয়সে বিয়ে করে আরও বেশি করে কাজকর্ম করা
উচিত। ডেলিভারি হবে কেমন করে? সিজার হবে শেষটায়।‘
তখন সাধারণ লোকে সিজার ব্যাপারটাকে বেশ ভয় করে চলত। কিন্তু চীরশ্রী
নির্বাণকে একটুও ভয় না পেয়ে বলল, ‘তোমার মত বুড়ো বরের বুড়ি ছাড়া আর কী জুটবে? বলেছিলে
কলেজে প্রফেসারি কর, তাই আমার বাবা বিয়ে দিয়েছিলেন, কেন মিথ্যে বলেছিলে বাবাকে? আমার
জন্ম ফরটি-থ্রিতে। তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হতেই পারে না।‘
এমন সময় নির্বাণের বোন এসে ঘরে ঢুকল। ছোট বোন। দাদা অন্ত প্রাণ।
তার সব ছেলেমেয়ের নাম রেখেছে এই দাদা। শ্রদ্ধা ভক্তিতে গদগদ হয়ে থাকা বোন নালিশের ভঙ্গিতে
তার দাদাকে জানাল, ‘বউদি আজ কি বলছে জানো দাদা? বাংলাদেশে থাকতে কত ব্রিলিয়ান্ট মুসলমান
ছেলে বউদিকে পছন্দ করত। কতজন প্রেম করতে চেয়েছে, বিয়ে করতে চেয়েছে, কিন্তু বউদি কাউকেই
পাত্তা দেয়নি, পরিবারের সম্মান রেখে চলেছে বরাবর। তাই তার ভাগ্যে বুড়ো বর! শুধু তাই
নয়, সঙ্গে যত রাজ্যের মেয়ের গপ্পো! সেসব যদি সত্যি হত, তবে তো অনেক আগেই বিয়ে হয়ে যেত।
ভাগ্যে আর বুড়ো বর জুটত না!’ বলতে বলতে কাঁদতে শুরু করে দিল সে।
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সে বলল, ‘আমার দাদা আমার কাছে
দেবতার মত। তাকে এরকম অপমান? আমাদের আরও দুই বোন আছে, আসুক একবার তারা! আমরা আর সহ্য
করব না।‘
বোনকে এভাবে কাঁদতে দেখে নির্বাণ চৌধুরিও কেঁদে ফেলল। ‘আরে, আমার
হাতে বিয়ের রেখা ছিলই না। কেন যে বিয়ে করলাম! কি যে করি। এই অপমান সহ্য করা যাচ্ছে
না। কিন্তু এখন যে বউ প্রেগন্যান্ট, এই অবস্থায় ডিভোর্স দিলে খোরপোষ দিতে হবে। কোথা
থেকে দেব, টাকা কই?’
‘দিতে হবে না। তোমার সঙ্গে থাকার চেয়ে যেদিকে দুচোখ যায়, চলে
যাওয়া ভালো। মুসলমান বিয়ে করা অনেক ভালো। বাচ্চার দায়িত্ব নেবে। আমাকে মাথায় করে রাখবে।
তোমার খোরপোষের পরোয়া আমি করি না।‘
‘কী? কী বললে? আমার সন্তান মুসলমানের ঘরে মানুষ হবে?’ চিৎকার
করে উঠল নির্বাণ চৌধুরি।
বেশি চিৎকার শুরু করল তার বোন। ‘দাদা, তুমি বলত? আমরা, তোমার
বোনেরা কি মরে গেছি? আমাদের এতগুলো ছেলেমেয়ের এমন সুন্দর-সুন্দর নাম যে দাদা রাখতে
পারে, তার জন্য বোনেরা এটুকু করতে পারে না?’ সে সটান তার বউদির দিকে ফিরে বলল, ‘যাও,
যেখানে খুশি চলে যাও। মুসলমানের ঘরে যাও। কিন্তু যাওয়ার আগে আমাদের বাড়ির বাচ্চা আমাদেরকে
দিয়ে যাও।‘ তারপর সে তার দাদার দিকে ফিরে বলল, ‘দাদা তুমি কোনও চিন্তা কোরো না, আমরা
বোনেরা সবাই মিলে তোমার বাচ্চাকে মানুষ করব।‘
আর্লি ডেলিভারি পেইন উঠল। মানসিক-উদ্বেগ অশান্তির কারণেই। পিতৃসম বয়স্ক
স্বামীর সঙ্গে সহবাস কিছুটা অতৃপ্তি এনে দিয়েছিল আগেই, যা শরীরে-মনে নানা প্রতিক্রিয়া
এনে থাকবে। তারপর সংসারের নিত্য অশান্তি লেগেই রয়েছে। শিরা-উপশিরাতে কত শত রাসায়নিক
বিক্রিয়া ঘটে চলেছে এরই কারণে। এসবই এই সময়কার বিজ্ঞানের গবেষণার বিষয়। নির্বাণ চৌধুরি
বিত্তহীন হলেও পণ্ডিত মানুষ। হাজার-হাজার কৃতি ছাত্রছাত্রীর গর্বে গর্বিত শিক্ষক। তারই
ছাত্র, মেডিক্যাল কলেজ হসপিটালের এক ডাক্তার, ব্যবস্থা করে দিল ডেলিভারির। শুধু বলেছিল,
‘আরও আগে ভর্তি করালে ভালো হত স্যার। আমাদের অবজারভেশনে রাখলে এই অবস্থাটা এড়ানো যেত।
প্রি-ন্যাটাল ডিপ্রেশনে ভুগছেন অনেকদিন ধরে।‘
নির্বাণ চৌধুরির বরাবরই যা কিছু প্রাকৃতিক আর সনাতনী, সেসবে আস্থা অগাধ।
সে ভেবেছিল, অনেক বছরের অভিজ্ঞ এক বৃদ্ধ ডাক্তারকে দেখানো হয়েছে চিরশ্রীকে। প্রায় বৃদ্ধ
সেই ডাক্তার বলেছিলেন, ‘কোনও সমস্যা হবে না, স্লিম ফিগারের অল্প বয়সী মেয়ে তোমার বউ।‘
কিন্তু কিসের থেকে ভণ্ডুল হয়ে গেলে সব।
কিন্তু সকলকে হতবাক করে দিয়ে, সত্যিই নর্মাল ডেলিভারি হল। বাচ্চা জন্মেই
চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে দিল। তবে মুশকিল বাঁধল দুধ খাওয়ানো নিয়ে। বাচ্চার মা সারাক্ষণ
উপুড় হয়ে শুয়ে রইল। কিছুতেই দুধ দিল না। সটান বলে দিল, ‘এটা আমার ছেলে নয়, ওর বাবার
ছেলে।‘
হাসপাতালে বহু মায়ের অঢেল দুধ থাকে। তিনটে দিন কাটল এর-ওর কাছে দুধ
খেয়ে। বেঁচে গেল। নাড়ি কাটা হল। তারপর মুচলেকা লিখে দিয়ে বাচ্চা কোলে বাড়ি ফিরল নির্বাণ।
তুলে দিল বোনের হাতে। এদিকে বোনের এখন ফিড করানোর উপায় নেই। কি আর করা। শেষে শায়র বানু
নামে এক মহিলাকে ফিড করানোর কাজে নিয়োগ করা হল। ওদের বাড়ির কাছাকাছিই থাকে। সে তার
বাচ্চার সঙ্গে একই সঙ্গে নির্বাণের ছেলেকে দুধ খাওয়াতে লাগল। চিরশ্রী ততদিনে পোস্ট-ন্যাটাল
ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছে। ভয়ানক অবস্থা। এখন প্রায় মৃগী রোগীর মত আচরণ তার। নির্বাণ সপ্তাহে
তিনদিন করে দেখে আসে তাকে। তাকে দেখতে পেলেই হাতের সামনে যা পায়, ছুঁড়ে মারে চিরশ্রী।
‘অনেকটা সময় দিতে হবে সুস্থতার জন্য। একমাত্র যদি স্নেহ-সম্পর্কের মধ্যে নিয়ে রাখা
যায় কিছুদিন, তবে তাড়াতাড়ি সেরে উঠতে পারেন উনি।‘ বলেছিলেন অভিজ্ঞ ডাক্তার। ‘শুধু ওষুধ
আর ভিটামিন খাওয়ালেই চলবে না। সেইসঙ্গে চাই নেচার। ন্যাচারাল সব কিছু। তবেই আগের অবস্থায়
ফেরানো সম্ভব। স্নেহ, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, আর সেইসঙ্গে যথার্থ সম্মান না পেলে মানুষ
কেমন করে বাঁচবে?’
খবর গেল বাংলাদেশে। চিরশ্রীর বাবার তীর্থ করতে কিছুদিনের মধ্যেই ভারতে
আসার ছিল। আসতে না আসতেই মেয়ে-নাতি সবসুদ্ধু নিয়ে তড়িঘড়ি চট্টগ্রামে তিনি ফেরত চলে
গেলেন। এরপর টানা সাড়ে তিন বছর পার হয়ে গেল। ছেলেবেলার চিটাগাং শহর, বাবামা, আত্মীয়-স্বজন,
বন্ধুবান্ধবদেরকে অনেকদিন বাদে দেখতে পেয়ে, তাদের সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে পেরে, ঘুরে
বেড়াতে পেরে, চিরশ্রীর মনে জমে ওঠা দুঃখকষ্টগুলো ঝরা পাতার মত উড়ে যেতে লাগল। ছ-মাসও
লাগল না তার সুস্থ হতে। এম-এ ক্লাসে ভর্তি হল সে। ভালো নম্বর নিয়ে পাশও করল। শিক্ষকতার
একটা চাকরিও পেল সে। বি-এড ক্লাসে ভর্তি হল। ততদিনে ছেলেকে সে অনেকটাই মেনে নিতে পেরেছে।
ছেলের নাম রাখা হল জল্পেশ’। রাখলেন তার মাতামহ। বলেছিলেন, শিবের কাছে প্রার্থনা করেছিলাম,
তাই নাতি পেয়েছি। তাঁর নামেই নাম হোক আমার নাতির।
চিরশ্রী দেখতে-দেখতে বি-এড পাশ করল। একদিন নির্বাণ তার ছেলের
দাবি নিয়ে এসে হাজির। চিরশ্রীর আপত্তি ছিল ছেলেকে দিয়ে দিতে। ছেলে যায় তো যাক, চাকরি
তো আছে তার। কিন্তু বাধ সাধলেন তার বাবা। বললেন, ‘মা, এই স্বামীই তোমার সব। তারই দান
এই ছেলে। তোমার সম্মান। ওকে বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত করার অধিকার তোমার নেই।‘
অগত্যা কিছুকাল পরেই আবার ফিরে আসতে হল ভারতে।
চিরশ্রী চৌধুরি এরপর আরও তিনটি ছেলেমেয়ের জননী হয়েছিল। ভোরবেলা
করে তাকে দেখা যেত, দুধের ক্যান হাতে করে বাড়ি ফিরতে। হনহন করে হেঁটে যেত সে। আবার
কখনো থমকে দাঁড়িয়ে পড়ত। কি যেন ভাবত একমনে। উন্মনা হয়ে যেত। মনে পড়ে, দীর্ঘ দিন পর্যন্ত
ওর বড় ছেলে জল্পেশকে দেখা গিয়েছে থেকে থেকে ডান হাতের বুড়ো চুষতে। ডাক্তারি মতে, শৈশবে
মাতৃদুগ্ধ না পাওয়ার সবচাইতে বড় সিম্পটম। তবে চিরশ্রী’র বাড়িতে দুধের যে এখন আকাল নেই,
সে ওর হাতের ক্যানের বহর দেখলে বোঝা যায়। তবে সে এখন কাউকে কিছুই বলে না। নিজের মত
থাকে। আশ্চর্য নীরব হয়ে গেছে।
আর তার জিনিয়াস-বর দিনদিন প্রতিভার বিকাশে দুর্দমনীয় হয়ে উঠছে।
চিরশ্রী একদিন উচ্ছ্বসিত হয়ে গল্প করছিল, ‘সেদিন জানো তো, বাদলদা আমাকে বাইকে করে পৌঁছে
দিয়ে গেল।‘
নির্বাণের তখন পঁচাত্তর চলছে। সে বলল, ‘দেখিস, বুড়ো বয়সে আবার
কার না কার বাইকে চেপে পালাস না আমাকে ছেড়ে। তোকে বিশ্বাস কি?’
‘ও মা, যার বউ এত সুন্দরী, সে আমার সঙ্গে যাবেই বা কেন?’
‘কেন যাবে না? তুই ডাকলেই যাবে। তারপর আস্তাকুড়ে জায়গা হবে তোর!
একবার পালিয়েছিস, তাতেও শিক্ষা হয়নি তোর না?’
চিরশ্রী বলে না কিছুই। চুপচাপ হয়ে যায়। সে জানে, থাকতে হবে এখানেই।
বড় ছেলে জল্পেশ ভাবে, বাংলাদেশের মানুষ না হলে মা এখানে কোনও না কোনও একটা চাকরি নিশ্চয়ই
পেত। ডিগ্রি-টিগ্রি সব ওখানকার। টিউশনি তার বাবাই করে বাঁচে না, তো মা আর কি করবে?
দিনরাত ঘরের কাজ আর সন্তান প্রতিপালন, চিরশ্রী ভুলেও বাংলাদেশের নাম উচ্চারণ করে না
আজকাল।
নির্বাণদা একদিন বলছিলেন, ‘কি করে যে আমার ছেলেকে দেশে ফেরাতে
পেরেছি, শুধু আমিই জানি। ওদেশে ছেলে তার বাবাকে দেখতে না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে শেষ হয়ে
যাচ্ছে। খাটে ঘুমোচ্ছে না, খালি মেঝেতে নেমে আসছে, আর কাঁদছে, আমি কি আর চুপ করে বসে
থাকতে পারি?’
‘ওইটুকু বয়েসেই সে এমন জেদী? খাট থেকে জোর করে নেমে আসত?’
‘হবে না? আমার ছেলে যে। ও যে একটা বিরাট প্রতিভা নিয়ে পৃথিবীতে
এসেছে। ওর মত আধ্যাত্মিক, ধার্মিক ছেলে এই যুগে বিরল। ওকে আমি নিজের হাতে তৈরি করছি।‘
জিনিয়াসের ছেলে জিনিয়াসই হয়। সকলের থেকে দশ কদম এগিয়ে। নির্বাণদার
মুখে এক সময়ে শুধুই মেয়েদের গল্প শুনতাম। তার অসংখ্য প্রেমিকা, বান্ধবীদের গল্প। কতটা
তার সত্যি, কতটা অতিরঞ্জিত, কে আজ আর বলতে পারে? কিন্তু তারই ছেলে জল্পেশকে দেখতাম
কোনও জনসমাগমে, কি বিয়েবাড়িতে, লজ্জায় অধোবদন হয়ে এককোণে দাঁড়িয়ে। তবে তার দাঁড়ানোর
ভঙ্গি ছিল খুবই স্মার্ট। বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেমেয়েদের মুখে লেগে থাকা যে লজ্জা খুবই সুন্দর।
অলঙ্কারের মত।
সেই জল্পেশ বড় হয়েছে। প্রিস্ট হয়েছে। বিয়ে-থাও করেছে। সেদিন আমাকে
বুদ্ধ-মন্দিরের সেই অনুষ্ঠানে দেখতে পেয়ে খুব স্মার্ট না হতে পারলেও, লজ্জা-টজ্জা সব
ঝেড়ে ফেলে সে অনেক কথাই বলেছিল।
‘কী যে সুন্দর ছিলে দেখতে তুমি! এখন এমন হয়ে গেছ কেন বল তো?’
‘আমি বেঁচে আছি তো, তাই পরিবর্তন হচ্ছে।‘ হেসে বলেছিলাম।
‘এই যে হাসলে, এর মধ্যে দিয়ে তোমার সৌন্দর্য সেই আগের মতই ফুটে
বেরোল। গায়ের রঙটা আগের মতই আছে। আর ---’
‘নে পালা এবার। অনেক হয়েছে।‘
ছেলেটা আবার আমার পা-দুটো জড়িয়ে ধরল। বেশ লম্বা আর ছিপছিপে গড়নের
একটি মেয়ে কখন জানি পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। জল্পেশ’কে বললাম, ‘কী রে? আলাপ করাবি না বউয়ের
সঙ্গে?’
‘না, এই জায়গাটা কাউকে আমি দেব না। এটা শুধু আমার। তুমি পরে না
হয় একদিন আমার বাড়ি এসে ওর সঙ্গে আলাপ করে যেও। বুঝতে পারো না, কবে থেকে তোমাকে এত
ভালোবেসে এসেছি, কত পিছে পিছে ঘুরেছি, চেয়েও দেখোনি। আর এরা এত সহজে তোমাকে পেয়ে যাবে?’
বলতে বলতে সে এবার আমারই শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকল লজ্জায়।
কি করব বুঝে উঠতে পারছি না। জল্পেশের বউয়ের দিকে তাকালাম। সে
হাসি-হাসি মুখে তাকিয়ে। তবে যথেষ্টই যে বিব্রত সে তার স্বামীর কারণে, তা স্পষ্ট হয়ে
উঠছে।
ওর বউয়ের সঙ্গে আলাপ করেছিলাম আমি। মিষ্টি একটি মেয়ে। ওরা দুজনে
অনেকবার করে ওদের বাড়িতে আসতে আমাকে অনুরোধ করেছিল। জল্পেশ বলছিল, ‘তুমি এলে, জানো,
সবচেয়ে খুশি হবে আমার মা। মা প্রায়ই তোমার কথা জিগ্যেস করে।‘
আর আমি ভাবছিলাম, সিনিয়র-জিনিয়াস আর জুনিয়র-জিনিয়াস, দুজনেই যে
একইরকম প্রেমিক তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া গেলেও, দুজনের প্রেমিক মনের কি অদ্ভুত পার্থক্য।
কিন্তু সংসার- জীবনেও কি জুনিয়র কি সিনিয়রকে অন্ধের মত অনুসরণ করবে? সারাদিন বউয়ের
সঙ্গে ঝগড়া করবে? ওর বউ তো আজকের যুগের মেয়ে, এতসব মেনে নিতে পারবে তো?
শৈশবে মাতৃস্নেহ পায়নি জল্পেশ। তার জন্যেই কি এত আধ্যাত্মিকতা,
প্রেমিক মন? মায়ের ডিপ্রেশনের একটা বড় অংশ যে ওর ভেতর চলে এসেছিল ছেলেবেলার থেকেই,
তা বুঝতে না পারলেও, কিছু একটার থেকে ভেঙে বেরিয়ে আসতে হবে, এই চিন্তাতেই কি অজান্তে
এমন জীবনদর্শন বেছে নিল সে?
‘তোমাকে না পেয়ে শেষে ওকে বেছে নিলাম। মায়ের মতই ওদেশের মেয়ে।‘
জল্পেশ বলেছিল।
‘খারাপ হয়নি তো বউ। পয়সাকড়ি নিসনি তো শ্বশুরের থেকে?’ আমি হেসে
বলেছিলাম।
‘না না। কি যে বল। আমার একটাই শর্ত ছিল, ওর বাবা-মাকে সব ছেড়ে
এদেশে চলে আসতে হবে। একসঙ্গে থাকতে হবে। নতুন মন্দিরের দোতলাটা এখন আমাদের খুবই কাজে
লাগছে। মেয়েকেও আর ডিপ্রেশনে ভুগতে হবে না। আশীর্বাদ কর, আমরা যেন সুস্থ থাকতে পারি
চিরদিন।‘
এমন প্রায় ঋষিতুল্য এক প্রেমিককে কি আর আশীর্বাদ করব! এ তো অনেকটা
অল্প বয়েসই জীবনের সার বোঝা বুঝে গিয়েছে। যা ওর বাবা এতটা বয়েসে, পাঁজা পাঁজা বই পড়েও
বুঝে উঠতে পারেনি। সেদিন খুবই ভালো লেগেছিল আমার। জল্পেশ যদি প্রিস্ট না হত, বৌদ্ধধর্মের
প্রচারে দেশ-বিদেশ ঘুরে না বেড়াত, তবে কি জল্পেশ সত্যি ‘এমন জল্পেশ’ হত? মনে হয় না।
পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনায় হয়ত ওকে খুঁজে পাওয়া যেত না। আমারও জানা হত না, চৌদ্দ আনার বাইরেকার
আরও কিছু কথা।