গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৮ নভেম্বর, ২০২০

সুদীপ দাস

 


কনক দ্যুতি

                                                            

গোধূলী বেলার আকাশের রঙ বরাবরই তীর্থকে মুগ্ধ করে। তন্ময় হয়ে তীর্থ আকাশের দিকেই চেয়েছিল।

-বসতে পারি?

নারী কন্ঠের শব্দে তীর্থের মগ্নতা কেটে যায়।মেয়েটি অনুমতির অপেক্ষায় থাকে না।তীর্থের পাশে বসে পরে।তীর্থ বিরক্ত হয়েই পাশে চেপে বসে।অন্যরকম একটি গন্ধ তীর্থের নাকে আসে।সে ধরে নেয় নাগেশ্বর চাপার গন্ধ হবে হয়তো।

-বিরক্ত হলেন?

মেয়েটি বলে।তীর্থ উত্তর দেয় না।সে উঠে পরার কথা ভাবে।

-জানেন,আমিও আপনার মত।আমার যখন খুব মন খারাপ হয়,আমিও আকাশ দেখি।

তীর্থ বেশ অবাক হয়।তার মনের কথা মেয়েটি আন্দাজ করে নিয়েছে।আজকের সারা দিনের ঘটনা প্রবাহ ওর মনের উপর খুব চাপ ফেলেছে।সে মেয়েটির প্রতি মনযোগি হয়।

-আমার নাম কনক দ্যুতি।বসবার কোন জায়গা পাচ্ছিলাম না।একমাত্র আপনিই একা একা বসে আছেন দেখে বসতে চাইলাম।কিছু মনে করেননি তো?

-না না।

তীর্থ হেসে উত্তর দেয়।

গল্পে গল্পে বেশ কিছুটা সময় চলে যায়। আঁধার নেমে এলে তীর্থ মেয়েটির কাছ হতে বিদায় নেয়।বাকৃবির ক্যাম্পাস হতে ফেরার সময় আবার তার মনটা খারাপ হয়ে যায়।সেই ছাত্র জীবন হতেই ওর মন খারাপ হলেই ব্রহ্মপুত্রের পারে একা একা বসার অভ্যাস।চাকুরি জীবনে এসেও অভ্যাসের কোন পরিবর্তন হয়।সেই পুরানো বোটানিক্যাল গার্ডেন,সেই নাগেশ্বর চাপা গাছ আর ব্রহ্মপুত্র নদী।বাসায় এসেই ব্যাগ গুছিয়ে ফেলে।খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ল্যাপটপ নিয়ে বসে।বসকে রিজাইন লেটার মেইল করে মোবাইল বন্ধ করে শুয়ে পরে।মাঝ রাত্রে তীর্থের ঘুম ভেঙ্গে যায়।নাকে সেই গন্ধ ধাক্কা দেয়।রুপার মুখটা মনে পরে।কতদিন দেখেনি রুপাকে।রুপার কথা ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে পরে তীর্থ।

 

ট্রেনে উঠে ময়মনসিংহ শহরকে মনে মনে বিদায় জানায়।ঢাকায় পৌঁছে ঝুটনের বাসায় উঠে।ঝুটনের অফিসেই ওর নতুন চাকুরি হয়েছে।অফিসের প্রথম দিনই ওর এই নতুন চাকুরি ভাল লেগে যায়।ঝুটনের বাসায় বেশ কিছুদিন থাকার পর সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের পাশে বাসা ভাড়া নেয়।

 

 

নাইট ক্লাব থেকে বেরিয়ে উজ্জলকে বিদায় জানায় কনক দ্যুতি। উজ্জল অবশ্য ওর গাড়িতে দ্যুতিকে বাসায় পৌঁছে দিতে চেয়েছিল।দ্যুতি রাজি হয় নি।আসলে গুলশানের নীরব রাস্তায় দ্যুতি হাঁটতে চেয়েছিল।রাস্তা ফাঁকা বলে মাঝ রাস্তা দিয়েই সে হাঁটতে শুরু করে।

 

মোবাইল বেজেই চলেছে।এমন বিশেষ মুহূর্তে কারই বা মোবাইল ধরতে ইচ্ছা করে।তবুও ধরে। উজ্জলের উত্তেজনা শিথিল হয়ে যায়।

-কি হলো ডার্লিং?

আদুরে গলায় প্রভা বলে।

-কনক দ্যুতির এক্সিডেন্ট হয়েছে।বাঁচবে না।

-খুব মন্দ খবর।তোমার দুধ দেওয়া গরু মারা যাচ্ছে।

প্রভা বলে।

উজ্জল প্রভার শরীর থেকে নেমে বাথরুমের দিকে যায়।

 

কনকের শরীর বেয়ে প্রচন্ড এক ব্যাথার ঝড় বয়ে যায়।তারপর সব অন্ধকার।কতক্ষণ রাস্তায় পড়েছিল কনক তা বলতে পারবে না।যখন উঠে বসে তখন প্রচুর মানুষের ভীড় ওকে ঘিরে।কনক উঠে দাঁড়ায়।আর খুব আশ্চর্য হয়ে যায়।মানুষগুলো ওকে নয়,মাটিতে পড়ে থাকা কিছু একটা দেখছে।সে সবার দৃষ্টি অনুসরণ করে মাটির দিকে চায়।ভীড়ের ভেতর হতে কনক বেরিয়ে আসে।ঠিক বুঝে উঠতে পারে না ওর নিজের অবস্থান।মাটিতে ওর দেহ পরে আছে।জীবিত না মৃত কনক বুঝতে পারে না।ও এখন অশরীরী এক আত্না।কোথায় যাবে?সে বাতাসে ভাসতে থাকে।

তীর্থ বেইলী রোডে দাঁড়িয়ে জামের শরবতে একটু একটু করে চুমুক দিচ্ছিল।আচমকা তাকিয়ে দেখে,ওর বয়সীই হবে,এমন একজন যুবক বেশ হ্যাংলার মত ওর খাওয়া দেখছে।তীর্থ বেশ বিরক্ত হয়।সে বাসার দিকে রওনা দেয়।

পরদিন আবার একই অবস্থা।তীর্থের এবার বেশ রাগ হয়।সে যুবকটির দিকে এগিয়ে যায়।
-দেখে তো বড় লোকের ঘরের ছেলেই মনে হচ্ছে।এমন হ্যাংলা কেন?
রাগত স্বরে তীর্থ বলে।
-আমার খুবই খেতে ইচ্ছে করছে।
যুবকটি উত্তর দেয়।
-দোকানে আছে তো কিনে খান।
-হবে না।
-কেন?
-আপনি ছাড়া এখানে কেউ আমাকে দেখতে পাচ্ছে না।
-কি বলেন?
-আমি আত্মা।গতমাসে রোড এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছি।
তীর্থের শীরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়।

শান্তিনগর বাজার হতে হাস কিনে ছিলে নেয় তীর্থ।কাব্যের খুব হাস খাবার আকাংখা।গত শীতে বন্ধুদের নিয়ে সিলেটের হাওড়ে যাবার পথে মারা যায় কাব্য।
-কাব্য,আপনার বাড়িতে কে কে আছেন?
-ছোট দুই বোন আর বাবা-মা।
-বাবা কি করেন?
-ব্যবসায়ী।
তীর্থের হাস রান্না শেষ হলে টেবিলে খাবার পরিবেশন করে।সে খেতে শুরু করে দেয়।কাব্য চুপচাপ বসে আছে।
-কই খাচ্ছেন না তো?
-আমি তো আত্মা
-তবে যে খেতে চাইলেন?
-আপনি একটি ধুপ শলাকা জ্বালিয়ে দিন।
তীর্থ খেতে খেতে উঠে পরে। ধূপ শলাকা জ্বালিয়ে খাবার টেবিলে বসে।এবার সে খেয়াল করে প্রতিটি খাবার পাত্রের ডুপ্লিকেট আর একটি করে তৈরি হয়ে যাচ্ছে।

-আপনার রান্না অনেক সুন্দর।কোথায় শিখলেন?
-বিশ্ববিদ্যালয়ে।রুমমেট ময়না ভাইয়ের কাছে।

অফিস থেকে ফেরার পথে প্রতিদিনই তীর্থ সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে প্রবেশ করে।কিছুক্ষণ চুপচাপ বারান্দায় বসে থাকে।মানুষ দেখে।দেব-দেবীর মূর্তি দেখে।কেন যে দেখে সে নিজেই বোঝে না।সে আস্তিক না নাস্তিক এরও কোন সঠিক উত্তর ওর কাছে নাই।মন্দিরে আসতে ভাল লাগে তাই আসে।আজ ওর পাশে কাব্য বসে আছে।চারপাশে মানুষ বলে কাব্যের সাথে কোন কথা বলছে না।কাব্য একাই বকে যাচ্ছে।বুয়েটে পড়াকালিন কাকে ভালোবাসতো এই সব আর কি।গেটের দিকে তাকিয়ে ছিল তীর্থ।দুই তরুণী উছ্ছল ভঙ্গিমায় মন্দিরে প্রবেশ করে।তীর্থের বুক কেঁপে উঠে।দুই জনের একজন রুপা।

তীর্থকে মন্দিরে পেয়ে যাবে এইটা রুপা কল্পনাও করেনি।ওর সাথে ওর পিসতুত বোন ।
-ছেলেটাকে চিনিস?
কংকা রুপাকে প্রশ্ন করে।
রুপা উত্তর করে না।সিদ্ধেশ্বরী মাকে প্রণাম করতে ব্যস্ত হয়ে যায়।কংকা খেয়াল করে রুপার ফর্সা গাল লাল হয়ে গিয়েছে।

 

রুপা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিষ্ট্রির ছাত্রী।হলে না থেকে পিসীর বাড়িতে থাকে।কংকাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তবে ও ম্যানেজম্যান্টে।বাসায় ফিরে দু’জনে পড়তে বসে।রুপার একটুকুও পড়তে ইচ্ছা করছে না। কতদিন পর তীর্থদাকে দেখল।কত লাজুক ছিল আগে।এখন দেখে অবশ্য তেমন মনে হলো না।আগে চোখাচোখি হলেই চোখ নামিয়ে নিত।এখন কেমন ভ্যাবলার মত তাকিয়ে ছিল ওর দিকে।

-কি রে পড়া বাদ দিয়ে দেয়ালে কি দেখছিস?মন্দিরের ওই লালটুকে?

কংকার প্রশ্নের কোন উত্তর দেয় না রুপা। রুপার গাল যে আবার লাল হয়ে গিয়েছে তা খেয়াল করে কংকা।

-রহস্যটা কি?মন্দিরেও লাল হলি,এখনও লাল।

-আমি তীর্থদার কাছে পড়তাম।এত লাজুক ছিল।পড়াতো কিন্তু চোখের দিকে চাইতো না।

কংকার প্রশ্নের উত্তরে রুপা বলে।

-মাষ্টরের প্রেমে পড়িসনি তো?

-কি যাতা বলছিস?

মুখে না বললেও রুপার অন্তর বলে প্রেমে রুপা পড়েছে।

-কোন ক্লাসে পড়াতো তোকে ?

-আমি তখন এইচ এসসিতে।আর তীর্থদা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে।

-আগুন।আগুন।

কংকা জোর গলায় বলে উঠে।

-কোথায়?

রুপা জানতে চায়।

-পড়ার টেবিলে।মাষ্টর আর ছাত্রীর মধ্যখানে।

-পড় তো।খালি ফাজলামি।

 

মৌচাকের পিছনের মার্কেটে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিল তীর্থ।রুপাকে দেখতে পায়।সাথে আগের মেয়েটি।তীর্থের পাশ দিয়ে চলেই যাচ্ছিল ওরা। তীর্থ ডাক দেয়।

-এই রুপা।

-আরে তীর্থ দাদা ?এখানে?

রুপা বলে।

-আমি তো মন্দিরের পাশের বাসাতে থাকি।তুমি কি হলে থাকো?

-না,আমিও এখানে থাকি।৭৬ নম্বর বাড়ি।ফ্ল্যাট নম্বর ১২।আমার পিসীর বাড়ি।

-উনাকে চিনলাম না।তোমার বান্ধবী?

-না,আমি রুপার বান্ধবী নই।রুপার পিসতুত বোন।

কংকা হেসে বলে।

-চা খাও তোমরা?

-না থাক দাদা।আজ তাড়া আছে।

রুপা বলে।

-আমার কোন তাড়া নেই।আমি চা খেতে পারি।

কংকা বলে।

-ঠিক আছে,দাদা চা বলেন।

রুপা বলে।

তীর্থ দুই কাপ চা এনে ওদের হাতে দেয়।

-আমার চা কই?

কাব্য প্রশ্ন করে।

-এখন আমি ধূপ শলাকা পাবো কোথায়?

তীর্থ বলে।

 

চায়ের ফাঁকে ফাঁকে ওরা গল্প করে একে ওপরের সাথে।

-তীর্থদা আপনি প্রতিদিনই মন্দিরে যান?

কংকা প্রশ্ন করে।

-হ্যাঁ।একা একা থাকি।রুমে অত আগে গিয়ে কি করবো?তাই মন্দিরে বসে সময় কাটাই।

-আপনি কি ভক্ত?

-মন্দিরে কি শুধু ভক্তরাই যায়?

কংকার প্রশ্নের উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন করে তীর্থ।

 

কাব্যের আজ পায়েস খাওয়ার শখ জেগেছে।তীর্থ কোনদিন পায়েস রান্না করেনি।মায়ের কাছে ফোনে পায়েস রান্নার পদ্ধতি জেনে নেয়।

-এইটা কি রান্না করলেন দাদা?

কাব্য প্রশ্ন করে।

-এইটা একটা নতুন ম্যানু।একে পায়েস না বলে ভাতেস বলা যায়।

তীর্থ বলে।

 

মাঝ রাত্রে তীর্থের ঘুম ভেঙ্গে যায়।ঘরময় নাগেশ্বর চাপা ফুলের ঘ্রাণ।সে আলো জ্বালে।আলো জ্বেলেই ভীষণ অবাক হয়ে যায়।কাব্যের পাশে কনক দ্যুতি।

-আপনিও কি মৃত?

তীর্থ প্রশ্ন করে।

-বলতে পারছি না।

দ্যুতি বলে।

-তাহলে আপনি আত্মা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কিভাবে?

-বলতে পারছি না।

দ্যুতি বলে।

-আপনারা সব আমাকে বেছে নিলেন কেন?

-একমাত্র আপনিই আমাদের দেখতে পান তাই।

দ্যুতি বলে।

 

তীর্থের ঘুম পুরোপুরি উবে যায়।ও ভাবে,এমন সমস্যায় পৃথিবীর আর কেউ পড়েছে কিনা কখনও।কনক দ্যুতি আর কাব্য দু’জনেই অনেক ধনী ঘরের সন্তান ছিল।কাব্যের তীব্র আকাংখা ছিল ওর প্রেমিকার হাতের রান্না খাওয়ার।ওর সেই আকাংখা অতৃপ্তই রয়ে গিয়েছে।অপর দিকে দ্যুতির মুখে যা শুনলো,সেটি খুব সুখকর  নয়।ধনীর ঘরের একমাত্র দুলালী ছিল সে।সব কিছুতেই হাত পাকিয়েছে।নাইট ক্লাব,বয়ফ্রেন্ডের পিছনে দেদারচ্ছে অর্থ খরচ- সব কিছুই।ও আত্মা হওয়ার পর জানতে পারে ওর বয়ফ্রেন্ড একজন প্রতারক।দ্যুতির এখনকার চাওয়া উজ্জলকে একটা শিক্ষা দেওয়া।

 

মন্দিরে ঢুকেই কংকাকে দেখতে পায় তীর্থ।

-তীর্থদা,অফিস শেষ?

-হ্যাঁ।রুপা আসেনি?

-কেন আমি আসলে কোন ক্ষতি আছে?

কংকা বেশ ভারী গলায় বলে।

-কি যে বল?এমনি জিজ্ঞাসা করলাম।

-যাই তীর্থদা।আমার মন্দিরের কাজ শেষ।আপনি কত নম্বর ফ্ল্যাটে থাকেন?

-এফ-সিক্স।

কংকা চলে যায়।তীর্থ ওর চলে যাওয়া দেখে।চলে যাওয়া বললে ভুল হবে।কংকার পিছন দিকটা দেখে।

-মেয়েদের  পেছন দিক দেখছেন।লজ্জা লাগে না?

দ্যুতির কথায় হকচকিয়ে যায় তীর্থ লজ্জাও পায়।তীর্থ আর কোন কথা বাড়ায় না।বাসার দিকে রওনা দেয়।

 

 

-আমাকে কবে সহযোগিতা করবেন?

কাব্য তীর্থকে বলে।

-চলেন আগামীকাল যাই মেঘার কাছে।

তীর্থ বলে।

 

মেঘাদের বাড়ি উত্তর বাড্ডায়।সে প্রতি মঙ্গলবার মেরুল বাড্ডার মন্দিরে আসে।কাব্যের কথা মত মন্দিরে আসে তীর্থ।কাব্য মেঘাকে চিনিয়ে দেয়।মেঘাকে দেখে খুব ভাল লাগে তীর্থের।কি স্নিগ্ধ চেহারা মেয়েটার!

-আপনার সাথে কথা ছিল?

তীর্থের কথায় পেছন ফিরে চায় মেঘা।

-আপনাকে  তো চিনলাম না।

মেঘা বলে।

-আমি কাব্যের খুব কাছের একজন।

তীর্থের কথা শুনে মেঘার চোখ ছলছল করে উঠে।

 

তীর্থের কাছে পুরো ঘটনা শুনে মেঘা আশ্চর্য হয়ে যায়।

-কাব্য কি এখনও আপনার সাথে?

মেঘা প্রশ্ন করে।

তীর্থ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে।

-আমরা লাষ্ট কোন সিনেমা একসাথে দেখেছি,তা কাব্যের কাছ থেকে জেনে জানান তো

মেঘা বলে।

তীর্থ কাব্যের দিকে তাকায়। কাব্য তীর্থকে সিনেমার নাম বলে।

-মনপুরা।

তীর্থ মেঘাকে জানায়।

 

তীর্থ সব আয়োজন করেই রেখেছিল।মেঘা এসেই রান্না ঘরে ঢুকে পড়ে।কাব্য যা যা বলেছিল একে একে সব রান্না করে মেঘা।তীর্থ সব খাবার টেবিলে সাজিয়ে দেয়।তারপর ধূপ শলাকা জ্বালিয়ে দেয়।মেঘা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করে সব কয়টি খাবার পাত্র দুইটি হয়ে যাচ্ছে।দ্বিতীয় পাত্রের খাবারগুলি ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যায়।

-তীর্থ দা,খুব তৃপ্তি করে খেলাম।আপনি অসম্ভব একজন ভাল মানুষ।মেঘাকে বলুন আমি মঙ্গল লোকে চলে যাচ্ছি।

তীর্থ কাব্যের কথা মেঘাকে জানায়।মেঘা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।তীর্থ বুঝে পায় না এখন ওর কি করণীয়।এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠে।তীর্থ দরজা খুলে দেয়।

-তীর্থদা,আজ বাড়িতে পূজো ছিল।তাই প্রসাদ নিয়ে এলাম।

তীর্থ দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়।কংকা ঘরে প্রবেশ করে মেঘাকে কান্নারত অবস্থায় দেখে।

-প্রসাদ কোথায় রাখবো?

কংকা বলে।

- রান্না ঘরে রেখে দাও।

যাবার সময় কংকা জানাতে চায় মেয়েটার কথা। তীর্থ জানায়-পরিচিত। কংকার মুখে মলিন ভাব তীর্থ লক্ষ্য করে।

-জটিলতা বাড়লো।

দ্যুতি তীর্থকে বলে।

 

সাতদিন পর রুপা আর কংকার সাথে তীর্থের দেখা হয়।রুপাকে ডাক দেয় তীর্থ।না শোনার ভান করে চলে যায় ওরা।

-কি হলো ওদের?

দ্যুতিকে প্রশ্ন করে তীর্থ।

-হয়তো মেঘার কান্নাভেজা মুখ দেখে কংকা ঘটনার ভুল ব্যাখ্যা করেছে রুপার কাছে।

তীর্থ আর কথা বাড়ায় না।শ্লথ গতিতে বাসার দিকে রওনা দেয়।সেদিন সারা রাত রুপার কথা ভাবে তীর্থ।

 

পরদিন সন্ধ্যায় কোন কিছু না ভেবেই কংকার বাড়িতে চলে যায়।রুপা দরজা খুলে দিয়ে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

-ভেতরে আসতে বলবে না?

রুপা সরে দাঁড়ায়।

সোফায় বসে ঘরের চারপাশ দেখে নেয় তীর্থ।

-কংকা নেই?

-কংকাকেই লাগবে?বাসায় কেউ নেই।সবাই পিসীকে নিয়ে ল্যাব এইডে  গিয়েছে।

-উনি কি অসুস্থ?

-না।রুটিন চেক আপ।

রুপা বলে।

-বলে ফেলেন।

দ্যুতি তীর্থকে বলে।

তীর্থ বড় করে একটি দম নেয়।

-রুপা,আমি তোমাকে  ভালোবাসি।

এক নিঃশ্বাসে তীর্থ বলে ফেলে।তীর্থের কথা শেষ হতে না হতেই দ্যুতি নাচতে শুরু করে দেয়।আর রুপা এক দৃষ্টিতে তীর্থের দিকে চেয়ে থাকে।যারা পরস্পরকে ভালোবেসেছে তারা সকলেই এই দৃষ্টি চেনে।কিন্তু মুখে রুপা জানায় যে সে এটা বিশ্বাস করে না।

-কেন?কেন তুমি বিশ্বাস করো না?

-আপনি তো ব্যাচেলার?তবে আপনার বাসায় মেয়ে যায় কেন?

রুপার কথায় তীর্থের মেঘার ঘটনা,কংকা যে ওর বাসায় গিয়েছিল,এ সবই মনে পড়ে।সে সব ঘটনা খুলে বলে।বলতে বলতে রুপার পাশে গিয়ে বসে।

-আপনি তো বিজ্ঞানের ছাত্র।আপনি আমাকে ভূত,আত্মা এসব বিশ্বাস করতে বলছেন?

-বিশ্বাস কর।সব সত্যি।এখনও আমার সাথে এক আত্মা আছে।

-আমি আপনার জন্যে চা করে নিয়ে আসি।

-তোমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছেনা?

কথা বলতে বলতে তীর্থ রুপার হাত চেপে ধরে। আর ঠিক সেই সময় দ্যুতি রুপার শরীরে প্রবেশ করে।কথা থেকে কি হয়ে যায়,রুপা আর তীর্থ দীর্ঘ এক চুম্বনে আবদ্ধ হয়। এরপর কেউ আর কোন কথা বলে না।তীর্থ দরজা খুলে বেরিয়ে যায়।

 

-রুপা মা দরজা খুলে বসে আছ যে?

রুপার পিসী  ঘরে ঢুকে জানতে চায়। ঠিক এই সময় দ্যুতি রুপার শরীর ছেড়ে চলে যায়।রুপা সম্বিত ফিরে পায়।

-কখন এলে পিসী?

পিসী আর কথা বাড়ায় না।বাথরুমের দিকে চলে যায়।পিসো চলে যায় তার ঘরে।কংকা রুপার কাছে এসে বসে।

-কেমন একটা গন্ধ এই ঘরে।

কংকা বলে।

-কিসের গন্ধ?

-এই ধর কোন একটা ফুলের।কেমন চাপা একটা গন্ধ।

-কই আমি তো পাচ্ছি না?

-আসার সময় দেখলাম তীর্থ দা বাসা থেকে বেরুচ্ছেন।এসেছিল?

প্রশ্ন করে তীব্র দৃষ্টিতে রুপার দিকে চেয়ে থাকে কংকা।রুপা কোন উত্তর করে না।ওর ঘরের দিকে চলে যায়।

 

তীর্থ ছাদে এসে বসে।আজ পূর্ণিমা।আর ওর কাছে জীবনের সব থেকে স্মরণীয় দিন।

-সবই তো হলো। এবার আমাকে সহায়তা করুন।

দ্যুতি বলে। তীর্থ স্মিত হেসে বলে ঠিক আছে।

 

পরদিন গুলশানের নাইট ক্লাবে তীর্থ যায়।দ্যুতি বলে দেয় উজ্জল আর প্রভাকে কোন স্থানে পাওয়া যাবে। তীর্থ সেখানে গিয়ে দু’জনকেই পেয়ে যায়।সে কোন ভাণিতা না করেই প্রভার হাত চেপে ধরে।বলে-কেন তুমি আমার ফোন ধরছো না?

-হাত ছাড়ুন?কে আপনি?

প্রভা রাগত স্বরে বলে।

-এই ম্যান,আপনি আমার গার্লফ্রেন্ডের হাত ধরেছেন কেন?মাতাল নাকি?

হিংস্র ভাবে উজ্জল বলে।

-না ভাই উজ্জল,আমি মাতাল নই।প্রভা আমার গার্লফ্রেন্ড।আপনার হতে যাবে কেন?

তীর্থ আমুদে গলায় তীর্থ বলে।

-কি আবোল-তাবোল বকছেন?আমি আপনাকে চিনিই না।

প্রভা বেশ নার্ভাস ভাবে বলে।

-ও সোনা,এ কি বলছো?তোমার বাম স্তনের নীচের ছোট্ট তিলে গত দুপুরেও তিন বার চুমু খেলাম।আর তুমি ভুলে গেলে?

তীর্থের কথা শুনে দ্যুতির হাসি আর থামে না।এই তথ্যগুলো দ্যুতিই তীর্থকে দিয়েছে।

-উনি তোমার তিলের কথা জানলো কি করে?

উজ্জল বলে।

-আমি কিভাবে বলবো?

প্রভা রাগত স্বরে বলে।

-তুমি মনে হয় টাকা পেলেই যার তার বিছানায় শুয়ে পর, না?

হিসহিসিয়ে উজ্জল বলে।তারপর হনহন করে ক্লাব হতে বেরিয়ে যায়।প্রভা তীর্থের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উজ্জলের  পিছু নেয়।

 

-রাতে রাস্তা কেমন নির্জন, না?

তীর্থ দ্যুতিকে বলে।

-আপনি খুব ভাল একজন মানুষ।কোন অহংবোধ নেই।আমি যদি আত্মা না হতাম তবে আপনাকেই ভালোবাসতাম।

দ্যুতি বলে।

-উপকারের বিনিময়ে প্রশংসা।

তীর্থ বলে।

-না সত্যি বলছি।

এ কথা বলেই দ্যুতি বাতাসে মিলিয়ে যায়।

-আপনাকে দেখতে পাচ্ছিনা কেন?

তীর্থ কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করে দ্যুতিকে । কিন্তু দ্যুতিকে আর পাওয়া যায় না।

 

 

ভবেশ বাবু স্ত্রীকে নিয়ে ল্যাব এইড স্পেশালাইজড হাসপাতালে আসেন।আজ তিন মাস ধরে একটি সংবাদের জন্যে প্রতিদিন প্রতিক্ষণ অপেক্ষা করে আছেন।যদি ঈশ্বরের কৃপা হয়।মেয়েটার জ্ঞান ফেরে।

-আপনার মেয়ে কোমা থেকে ফিরে এসেছে।

কর্তব্যরত নার্স ভবেশ বাবুকে জানায়। ভবেশ বাবু আনন্দে আত্মহারা হয়ে যান।

-আমরা কি ভেতরে যেতে পারি?

-কেন নয়?

-বাবা।

দ্যুতি মৃদ গলায় বলে।

-মা।মারে।

দ্যুতির হাত জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেন দ্যুতির বাবা। দ্যুতির মা বার বার রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে থাকেন।

 

এক মাস পর।দ্যুতি বাসার ছাদে বসে আছে।এমন সময় উজ্জল সুন্দর একটি ফুলের তোড়া নিয়ে আসে।

-দ্যুতি,মাই বেবি।

-তুমি এখানে কেন?

ঝাঁঝালো গলায় দ্যুতি বলে।

উজ্জল ফুলের তোড়া দ্যুতির হাতে দেয়।দ্যুতি তোড়া ছুঁড়ে ফেলে দেয়।

-বেবি,আমি কিন্তু কষ্ট পাচ্ছি।

উজ্জল বলে।

-তুমি প্রভার কাছে যাও।

এই কথা বলে দ্যুতি নীচে নেমে আসে।ড্রাইভারকে বলে গাড়ি বের করতে।

-কি মা,এই  শরীর নিয়ে তুই কোথায় যাচ্ছিস?

-সিদ্ধেশ্বরী।খুব কাছের একজনের কাছে।

-যাস না মা।ফোন করে আসতে বল।আর তা না হলে ড্রাইভার পাঠিয়ে দে।

দ্যুতির মা বলেন।

-ফোন নম্বর নেই।আর আমাকেই যেতে হবে।

বেরুতে বেরুতে দ্যুতি বলে।

 

 

আজ তীর্থ আর রুপার বাসর রাত।ব্যস্ততার মধ্যেও টিভির স্ক্রলে তীর্থের চোখ পরে।স্ক্রলে ভেসে বেড়াচ্ছে-বাংলা মোটরে প্রাইভেট কারের সাথে ট্রাকের সংঘর্ষ।ঘটনা স্থলেই কারের আরোহিনী আর ড্রাইভার মারা গিয়েছে।মৃতা ছিলেন বিশিষ্ট শিল্পপতির একমাত্র কন্যা।

 

তীর্থ ঘরে প্রবেশ করে।রুপার কাছে গিয়ে বসে।

-তারপর?

-কি তারপর?

রুপা জানতে চায়।

-ছাত্রী তো এখন আর ছাত্রী নেই।

তীর্থ বলে।

-আর কোন আত্মাও নেই।

রুপা হেসে বলে।

-তুমি কোন গন্ধ পাচ্ছো?

তীর্থ প্রশ্ন করে।

-তুমি সেন্ট স্প্রে করেছো,তারই গন্ধে ঘর মৌ মৌ করছে।

-আরে সেই গন্ধ নয়।

-তবে কিসের গন্ধ?

-নাগেশ্বর চাপার গন্ধ।

-ও ফুলই কোন দিন দেখিনি।তার গন্ধ কেমন, বুঝবো কিভাবে?

দ্যুতি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিল ।এবার সে রুপার শরীরে প্রবেশ করে।

 

রুহীগাঁও

১৬/১০/২০২০