গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৮ নভেম্বর, ২০২০

শম্পা চক্রবর্তী

 


দেবদাস, পারু এবং পারমিতা।

                                    

   

                           (১)

  দুপুরের খাওয়া সেরে বাঁধে জল আনতে যাওয়া পার্বতীর প্রতিদিনের কাজ। আজকেও তার ব্যতিক্রম ঘটে নি। পিতলের কলসী কাঁখে সে ঘাটের উপর এসে দাঁড়াল। দেখল কাছেই একটা কুল গাছের আড়ালে দেবদাস ছিপ হাতে মাছ ধরছে। খানিকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পার্বতী ঘাটের উপর কলসীটা যেই রাখতে গেল অমনি ঠং করে শব্দ হওয়ায় দেবদাসের নজর গেল তার প্রতি। দেখেই হাত নেড়ে ডাকল—"পারো, শুনে যাও"।

 

      পার্বতী পায়ে পায়ে কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো— " দেবদা, আমাকে কিছু বলবে?"

 

    "বোস"— এই বলে চুপ করে রইলো দেবদাস। পার্বতী আনতমুখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে হতাশমনে ঘাটের দিকে রওনা দিল। দেবদাস আবার ডাকলো—" শোন"।

 

       পার্বতী তার ডাক উপেক্ষা করতে পারলো না। মনের টানে ফিরে এলো।দেবদাস কিচ্ছুটি বলতে পারলো না। আসলে গভীর ভালোবাসা কখনো কখনো মুখের ভাষা কেড়ে নেয়। খানিক অপেক্ষা করে পার্বতী অগত্যা ঘাটের পথে এগোল এবং জল ভরে বাড়ির পথে রওনা দেবে ঠিক করলো। এমন সময় দেবদাস ছিপ গুটিয়ে ওর পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে বলল—" আমি এসেছি।"

 

      পার্বতী কাঁখ থেকে কলসী নামিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। দেবদাস দ্বিতীয়বার বললো—"আমি এসেছি, পারু !!

 —কেন? 

—তুমি আসতে বলেছিলে, মনে নেই?

—না।

— সে কি পারু !! সে রাত্রের কথা মনে পড়ে না?"

 

                             ‌(২)

    গ্ৰীষ্মকালের ম্লান জ্যোৎস্নোলোকিত রাত। বৈশাখী হাওয়ায় মেতেছে তালসোনাপুর গ্ৰাম। ঝোপে ঝোপে জোনাকির ভেসে চলা আর ঝিঁ ঝিঁ পোকাদের কলতান। দূরে কোথাও শিয়ালকুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে আকাশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে উড়ে চলেছে রাতজাগা পাখি।

 

        রাত একটার পর পার্বতী আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে ম্লান জ্যোৎস্নায় অভিসারে বের হোল। জনহীন পথে বিনা বাধায় সে মুখুজ্যেবাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। দেউড়ির বৃদ্ধ দারোয়ান কিষণ সিং এবং বাইরের উঠোনের কয়েকজন আধজাগা চাকরের চোখে ধুলো দিয়ে পার্বতী সোজা দোতলায় উঠে গেল। দেবদাসের ঘরের দরজা খোলা ছিল। পারো নির্দ্ধিধায় ঘরে ঢুকলো। দেবদাস অঘোরে ঘুমাচ্ছে। প্রদীপের আলোয় পারো তার প্রাণের দেবদাকে দেখলো। যুগযুগান্তের বাঁধন তাদের। প্রদীপের আলো উজ্জ্বল করে দিয়ে সে দেবদাসের পায়ের কাছে বসলো। তারপর ধীরে ধীরে ডাকলো—"দেবদা!"

কয়েকবার ডাকতে তবে ঘুম ভাঙলো তার।

চোখ রগড়ে অবাক দৃষ্টিতে সে দেখলো তার আবাল্য সহচরী এবং একমাত্র ভরসা পারু তার সামনে উপস্থিত।

    দরজা বন্ধ করে কথোপকথন ও জল্পনাকল্পনা চলল বহুক্ষণ। পরেরদিন সকালে ওদের কথা জানাজানি হলে ওরা কেউই লজ্জায় মুখ দেখাতে পারবে না— এই আশঙ্কায় ভীত হয়ে পড়লো দেবদাস। পারু তীব্র ও কঠিন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বললো—

" তুমি পুরুষ মানুষ।আজ না হয় কাল তোমার কলঙ্কের কথা সবাই ভুলবে। দুদিন পরে কেউ মনে রাখবে না কবে কোন রাত্রে হতভাগিনী পার্বতী তোমার পায়ের উপর মাথা রাখবার জন্য সমস্ত তুচ্ছ করে এসেছিল।"

    পার্বতী দেবদাসের পা দুটো সেইভাবেই চেপে ধরলো ডুবন্ত মানুষ অন্ধের মতো যেভাবে মাটি চেপে ধরে। দেবদাস বললো — "পারো, বাপমায়ের অবাধ্য হব?"

—"দোষ কি? হও।"

—"তুমি তাহলে কোথায় থাকবে?"

 পারু সদর্পে উত্তর দিয়েছিল —"তোমার পায়ে।"

     

          এরপর অনন্ত স্তব্ধতার মাঝে জেগে রইলো নিস্পাপ দুটি প্রাণ। একজন যুবক আর একজন তার পায়ের কাছে পড়ে থাকা বালিকা হৃদয়। দেয়াল ঘড়িতে রাত চারটের ঘন্টা পড়লে কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে দেবদাস নিঃশব্দে তাকে বাড়ি পৌঁছে দিল। এমন রাত কি পারু কখনো ভুলতে পারে !!!!                          

 

                                 (৩)

       বাঁধের কাছে দাঁড়িয়ে নানা বিষয় নিয়েই বাকবিতণ্ডা চলছিল ওদের দুজনের মধ্যে।পার্বতী নিজের রূপের অহংকার দেখিয়ে ঠোঁটের কোণে ক্রুর হাসি ফুটিয়ে বলল —

 

"যাও, শেষ সময়ে আমার নামে একটা কলঙ্ক রটিয়ে দাও গে; সে রাত্রে তোমার কাছে একাকী গিয়েছিলাম, এই কথা চারিদিকে রাষ্ট্র করে দাও গে। মনের মধ্যে অনেকখানি সান্ত্বনা পেতে পারবে।"

     

        গ্ৰাম্য দেবদাস সেদিন সত্যিই বোঝেনি যে পার্বতীর এই কথার মধ্যে কতটা অভিমান লুকিয়ে ছিল। কৈশোর থেকে সে শুধু বুঝতো ভালোবাসার অধিকার যার উপর আছে তাকে কেবল পীড়ন করা চলে। ভালোবাসলে, প্রাণে জড়ালে মেয়েদের যে ওরকম অভিমান হয় তা ছিল তার উপলব্ধির বাইরে।ফলে রেগে গিয়ে ছিপের বাঁট ঘুরিয়ে পার্বতীর মাথায় সজোরে এক আঘাত করলো। কপালের উপর বাম ভুরু পর্যন্ত চিরে ঝরঝর করে রক্ত ঝরতে লাগলো। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সে। মুহূর্তেই ছিপটাকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে জলে ছুঁড়ে ফেলে তৎক্ষণাৎ পারোর সেবায় নিয়োজিত হোল। নিজের জামা ছিঁড়ে জলে ভিজিয়ে ক্ষতে বাঁধন দিতে দিতে বললো—

"ভয় কি পারু !! এ আঘাত শীঘ্র সেরে যাবে—শুধু দাগ থাকবে।…….. শেষ বিদায়ের দিনে শুধু একটি মনে রাখবার মতো চিহ্ন রেখে গেলাম।"

     সেদিন পারোর চুলের উপর দেবদাস প্রথম চুম্বন করে বলেছিল—"ছিঃ!! তুই কি আমার পর পারু?..."

— "দেবদাদা, মাপ করো আমাকে।"

—"......... সত্যিই কি পারু আমাকে একেবারে ভুলে গেছিস? কবে তোর উপর রাগ করেছিলাম? কবে মাপ করিনি ?"

—" দেবদাদা-আ-আ-আ ……"

 

                              (৪)     

      ঘুমন্ত পারমিতার মুখ থেকে অস্ফূটে আ-আ-আ শব্দ বেরিয়ে এলো। ঘেমে নেয়ে একসা হয়ে ধড়ফড় করে উঠে বসল বিছানায়।এক নিঃশ্বাসে ঢকঢক করে জল খেলো। তারপর টিউব জ্বেলে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বাম ভুরুর নিচে হাত বুলিয়ে দেখলো মধ্যবয়সের নিটোল মুখে বিন্দুমাত্র কলঙ্কের দাগ নেই বরং চোখের কোল বেয়ে নেমে আসা জলের দাগ ছিল। চুলের মধ্যে হাত বুলিয়ে কত করে খুঁজলো তার জন্মজন্মান্তরের দেবদাকে।পর্দা সরিয়ে এ ঘর থেকে ও ঘর ছুটে বেড়ালো। কোথাও দেখতে‌ পেল না। তার হৃদপিন্ড থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত চুঁইয়ে পড়তে লাগলো। রাজলক্ষী এসে সান্ত্বনা দিয়ে বললো—" বড় প্রেম সবসময় কাছে টানে না, তা দূরেও ঠেলে দেয়।"

 

         রাজলক্ষী ও পারুর মধ্যে কোন বিভেদ খুঁজে পেল না পারমিতা। উভয়েই একই হাতে সৃষ্টি। উভয়েই বুকের পিলসুজে প্রেমের অনির্বাণ দীপ জ্বালিয়ে রেখেছে। আজন্ম। ওরই মতো। 

 

      বালিশের পাশে পড়ে থাকা বুকমার্ক দেওয়া শরৎচন্দ্রের "দেবদাস" বইটা পারমিতার নজরে এলো।গতকাল অষ্টম পরিচ্ছেদ পর্যন্ত পড়ে ভাবতে ভাবতে শেষরাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো । তারপর...

 

        অস্তলাগা ঊষার নরম আলো এসে পড়েছে পূবের ব্যালকনিতে। সেদিকেই হেঁটে গেল পারমিতা। রেলিঙে‌ ভর দিয়ে দাঁড়ালো । আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো— দেবদা, আগের জন্মে ভালোবেসে যত মেরেছ এ জন্মে তার চেয়ে কম কিছু মারতে বাকি রাখোনি। আমার লুকোনো সব ক্ষতের হদিশ একমাত্র তুমিই জানো। আমার অভিমানের গায়ে অদৃশ্য রক্তের ছোপ কিন্তু আজও লেগে আছে !! কি জানি হয়তো আরো কোনো নিষ্ঠুর অন্তিম বাকি রয়ে গেছে আমার জন্য!! 

     বেশ কিছুসময় অতিবাহিত হয় কিন্তু পারমিতার ঘোর কাটে না। দিগন্ত থেকে ভোরের আলো উঠে এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে ওকে। অদ্ভুত ভালোলাগার স্রোতে ভাসতে ভাসতে ও বিছানার কাছে এসে দাঁড়ায়। এস্.এম্.এস্. করবে বলে লালকালি দিয়ে ষষ্ঠ পরিচ্ছেদের ঐ অংশটুকু আদরে-যত্নে দাগিয়ে রাখে— 

 

 " আমার কলঙ্কের কথা বলচ? না, আমার কলঙ্ক নেই। তোমার কাছে গোপনে এসেছিলাম বলে যদি আমার নিন্দে হয়, সে নিন্দে আমার গায়ে লাগবে না।"

     অনেকদিন গোপন মানুষটার খবর নেওয়া হয়নি। দুপুরের অবসরে তাকে মেসেজ করলো আজকের পারো অর্থাৎ পারমিতা চ্যাটার্জী। উদ্ধৃতির নিচে জুড়ে দিলো — "বিশ্বাস করো তোমাকে ভালোবাসায় আমার কোন কলঙ্ক নেই। যত দূরেই থাকো না কেন আমাদের চলার অমোঘ পথটাকে যেন থামতে দিও না।"

 

    পারমিতার দামী অ্যানড্রয়েডের স্ক্রীনে ভেসে উঠল—" not sent " — "শেষবিদায়ের দিনে মনে রাখার মতো একটা চিহ্ন…….."