গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৮ নভেম্বর, ২০২০

সুদীপ ঘোষাল / দুটি গল্প

 


শরতে কাশের কারসাজি

 

কাশের কুঁড়ি রসদ মজুদ করছে ফোটা ফুলের সৌরভ বিতরণের ।  এরপরেই শুরু আনন্দে মাথা দোলানোর উৎসব । মননদীর গভীরে গাঁথা  তার আগমনী সংগীতের মালা  ।সে যেন  হাত নেড়ে বলছে, আসছে আসছে । দেবী কাশ রঙের সংকেতে তাঁর আগমনী বার্তা পাঠান যুগ যুগ ধরে ।

এবার শরতে কাশ ফুলের কারসাজি  । তার মাথা দোলানো দেখে আমি দুর্গা পুজোর ঢাকী  হয়ে যাই । আমার অন্তর নাচতে থাকে তালে তালে । মা তুই আসবি কবে আর, নতুন জামায় নাচে মন সবার ।

 

আমাদের শোভন কাকা কাশ ফুল দেখলেই কারণে অকারণে  গলা ছেড়ে গান গাইতেন । সেই মধুর সুরেই শোভন কাকা কাশ ফুলের শোভা বাড়িয়ে সকলের

মনের সংকীর্ণ বেড়া ভেঙ্গে দিতেন ।

 

আমরা সকলেই প্রিয়জন মরে গেলে দুঃখ পাই । কিন্তু নিজের মরণ বুঝতে পারলেও দুঃখ প্রকাশের সুযোগ পাই কি ? সেই শোভন কাকা গানে গানে কিন্তু নিজের মরণের আগেই পরিণতির কথা শোনাতেন । অঘোষিত উঁচু পর্বে নাম খোদাই হয়ে গিয়েছিলো তার । মৃৎশিল্পেও তার দক্ষতা ছিলো দেখার মতো । প্রতিমা তৈরির দায়িত্ব তার উপরেই দিয়ে নিশ্চিন্ত হতো পূজা কমিটি ।

 

শোভন কাকা এলেই আমাদের পুজোর গন্ধ গ্রাম জুড়ে গানের সুরের সঙ্গে ভেসে বেড়াতো । তিনি ছিলেন প্রাণজুড়ানো শান্ত পালক নরম আনন্দের ফেরিওয়ালা ।তিনি মাটি হাতে মায়ের সঙ্গে মন মাতানো মন্দাক্রান্তা গাইতেন ।তার চলন বলন দেখে ভালোবেসে তাকে শোভনানন্দ বলতেন তথাকথিত গুরুবৃন্দ । 

 

 

শিশিরবিন্দু

আমার বন্ধু তপন  বিয়ের পরে তারাপীঠে প্রণাম করে এলো দুজনে।তপনের স্ত্রী  বললেন, মায়ের কাছে ঘোরা তো বারোমাসের, কাছের ব্যাপার। চল, এবার দূরে কোথাও হনিমুনে যাই।

তপন বলল, ঠিক আছে সামনের মাসে পূর্ণিমাতে হনিমুন হবে আমাদের। স্ত্রী খুব খুশি। নতুন বৌয়ের আদর সেই সুবাদে পেল খুব। তপন খুঁজে খুঁজে সবকিছু ঠিক করে রেখেছে ।  কি ভাবে উপস্থাপিত করবে তার মতলব ,  তার প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছে সে। সোহাগ সমাদরে চলে এল বহু প্রতিক্ষিত মধুমাখা পূর্ণিমারাত।

রাতে তার বৌ বলল,তুমি যে বললে পূর্ণিমাতে আমাকে হনিমুনে নিয়ে যাবে। সারাদিন চলে গেল কই এখনও তার প্রস্তুতি দেখছি না।

 

তপন বলল।, আহা, রাত তো বাকি। তুমি সেজে নাও,অবশ্য না সাজলে তোমাকে বেশি ভাল লাগে।  বৌ গদগদ  হয়ে ফিটফাট হয়ে  নিল। তারপর তপন মজার ব্যাগ নিয়ে  ওর হাত ধরে বলল, চল তো একবার পূর্ণিমারাতের  সোনালি-  ছাদ থেকে ঘুরে আসি।

- কেন গো, ছাদে কি হবে?

- চলোই না, গিয়ে দেখবে কি হবে। 

তপনের জেতার জেদে বৌকে নিয়ে ছাদে উঠল। বৌ বলল, বলো কি বলবে।

তপন ভাল করে  ফুলেল শয্যা পাতল। তারপর দুজনে বসল তার উপরে আয়েস করে। বৌ বলল,বল তাড়াতাড়ি বল। কি যে কর, দেরী হয়ে যাবে তো।

তপন বলল, দেখ চাঁদের আলোর বন্যায় কেমন জগত মায়াবী হয়ে উঠেছে। তোমাকেও চাঁদের মত লাগছে। তুমিও আমার চাঁদ,আমার সোনামণি।

তারপর ব্যাগ থেকে  ডাবরের একটা মধু মানে হানির শিশি বের করে বৌয়ের ঠোঁটে মাখিয়ে দিল।আর বলল, এই হল হানি আর অই আকাশের মুন। তাহলে হানিমুন হল তো?  

বৌ ও কম যায় না। বলল,আমি জানতাম তুমি যাবে না কোথাও। কেবল দৌড়টা দেখলাম। 

তপন বলল, বাড়ির কাছে ঘাসের উপর  শিশিরবিন্দু  আমরা ঠিকমত দেখি না চোখ মেলে, আমাদের রবি ঠাকুর তো বলে গেছেন । 

একটু তাকিয়ে দেখ সোনা,  কাছের  জগত কত সুন্দর।তবে তার  থেকে অন্তর  জগতের সৌন্দর্য অনেক  বেশি সুন্দর।এস সেই অন্তর জগতে বিচরণ করি হানিমুনের রাতে। 

তপনের বৌয়ের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল।