গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৮ নভেম্বর, ২০২০

নীহার চক্রবর্তী

 


কাজলী মাসিমার নিরামিষ হোটেল


 কাজলী মাসিমার স্বামীর ছিল বড় কাপড়ের দোকান । দুজন কর্মচারী নিয়ে বেশ চলছিল তার ব্যবসা বেথুয়াডহরি বাজারে ।

তার দুই ছেলে নির্মল আর নিমেষ । মাসিমার নামে বাবা বাড়ি আর দোকান লিখে দেয় বলে তারা রাগ করে কৃষ্ণনগরে এসে বাসা বাঁধে তাদের পরিবার নিয়ে ।

 নির্মল কৃষ্ণনগরের এক হাইস্কুলের শিক্ষক । আর নিমেষ রানাঘাট পুরসভায় চাকরী করে ।

হঠাৎ মাসীমার স্বামী হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেলে খুব বিপদ এসে উপস্থিত হল । পয়সার সমস্যা তেমন ছিল না মাসিমার । কিন্তু বড় ব্যবসা তার পক্ষে দেখা সম্ভব ছিল না । ছেলেরাও কেউ এগিয়ে এলো না । নিজেদের বাসায় বাবার কাজ করলো কোনোরকমে । ছেলেদের ব্যবহারে হতভম্ব । স্বামীর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেললো খুব ।

 

এমন অবস্থায় কি করে ভাবতে-ভাবতে মাসিমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো ।

হোটেল খুললে কেমন হয় ? একেবারে নিরামিষ হোটেল । ভালোই চলবে মনে হয় ।

একথা ভেবে মাসিমা তার দোকানের দুই কর্মচারীকে একদিন ডেকে মনের কথা খুলে বলল ।

একজন উত্তর দিলো বিরস-বদনে, ’এ হয় না । কাপড়ের ব্যবসাই চলুক । আমরা দুজন মিলে দেখছি ।‘

মাসিমা রাজী নয় তার কথায় ।

উত্তর দিলো, ’আমার পক্ষে কাপড়ের দোকানে বসা সম্ভব না । আমি এখন বিধবা । নিরামিষটাই ভালো বুঝি ।‘

আর একজন রাগ করে বলে উঠলো, ’আমরা তাহলে এর মধ্যে নেই । আমাদের কাজেরও অভাব নেই বেথুয়াডহরিতে । চললাম ।‘

অতএব দুজন তাদের পথ দেখে নিলো । মাসিমা মনে-মনে হাসল ।

নিজেকে বলল,অন্যের হাতে ব্যবসা ছাড়ার মানুষ আমি নই । নিজেই যা পারি করবো ।

তবে মাসিমার একজন সঙ্গী দরকার খুব । মনে-মনে খুঁজতে থাকলো ।

 

হঠাৎ মাসিমার মনে পড়লো পাড়ার ছেলে কেষ্টর কথা । বাপ-মাহারা ছেলে । কাকার কাছে থাকে । কাকা পয়সা খরচ হবে বলে ছেলেটাকে ক্লাস এইটের পর আর পড়াল না । এখন সংসারের অনেক কাজ কেষ্টকেই করতে হয় মুখ বুজে ।

কিন্তু কেষ্টকে বললে হবে না । কাকাই ওর অভিভাবক । তাই তাকেই বলা দরকার ।

মাসিমার ভাবা সারা ; বলাও সারা ।

কেষ্টর কাকা-কাকি শুনে খুব খুশি হয়ে মাসিমাকে বলল, ’এ তো ভালো কথা । কেষ্ট এমনিতেই বসে থাকে । ওকে নিয়ে নিন আপনার সাথে । হোটেল ভালোই চলবে । ব্রাহ্মণ-বিধবা বলে কথা ।

শুনে খুব আনন্দ পেলো মাসিমা ।

পরে হাসিমুখে বলল, ’কেষ্ট কিন্তু আমার কাছেই থাকবে এখন থেকে । ফাঁকা বাড়ি । ভয় লাগবে আমার । কেষ্ট থাকলে

‘তাতেও সমস্যা নেই আমাদের । থাকুক না । ভালোই তো হবে ।‘

কেষ্টর কাকা-কাকিমা একসঙ্গে খুশির হাসি ছড়িয়ে বলে উঠলো ।  

মাসিমা তখন মনে-মনে হেসে বলল, একেবারে ঝেড়ে ফেলার তাল কেষ্টকে । বুঝি না বুঝি আমি ? তা হোক,দ্বাপরের কেষ্ট আমারই হয়ে গেলো তবে ।

 

তার এক সপ্তাহ পরে মাসিমা কাপড়ের দোকানের সবকিছু ঝেড়েঝুড়ে বেচে দিলো স্থানীয় এক বস্ত্র-ব্যবসায়ীকে । খুব একটা দাম পেলো না । তবু মাসিমা খুশি নিজের স্বপ্নের কথা ভেবে । সঙ্গে তখন তার কেষ্ট ।

তাই নিজেকে সে বলল, তোর আবার কষ্ট কীসের ? কেষ্ট আছে না সাথে ?

সে কথা মাসিমা কেষ্টকে বলতে ও অম্লান-হাসি ছড়িয়ে দিলো তার বুক-জুড়ে ।

তারপরেই মাসিমা কিছু বাসনকোসন কিনল । ঘরেও ছিল কিছু । হোটেলের বাসনের ব্যবস্থা হয়ে গেলো অনায়াসে ।

 

এরপর সাইনবোর্ড ।

এর ব্যবস্থা করলো কেষ্ট নিজেই । স্থানীয় সাইনবোর্ড নির্মাতা দুলাল সাহাকে বলে ও সাইনবোর্ড তৈরি করে ফেললো ।

তার আগে মাসিমা আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করে কেষ্টকে, ‘দোকানের নাম কী দেওয়া যায় রে ?’

একটু ভেবে কেষ্ট হাসি-হাসি মুখে একটু ভাবে বলল,’কাজলী মাসিমার নিরামিষ হোটেল দাও,মাসী । সুন্দর হবে ।‘

শুনে অভিভূত মাসিমা । সেই নামই জুড়ে বসলো সাইনবোর্ডে ।  

 

তার কয়েকদিন পর থেকে শুরু হয়ে গেলো মাসিমার স্বপ্নের হোটেল । নিজেই রান্না করে তেঁতে-পুড়ে । বারোটা বাজলেই কেষ্ট হোটেলের সামনে এসে চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে সবার মন আকর্ষণ করতে চায় ।

‘সম্পূর্ণ নিরামিষ খাবার এখানে পাবেন । একেবারে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সব । আসুন,আসুন ।‘

ওর কিশোর-কণ্ঠ নিরামিষ-প্রিয়রা অবহেলা করতে পারে না । তারা পেট পুরে খেয়ে মুখে তৃপ্তির হাসি নিয়ে বিদায় নেয় সেদিনের মতো ।

দুদিন পর অবশ্য মাসিমা আর এক মহিলা তার হোটেলে নেয় । তার কাজ তরকারী কেটে দেওয়া আর মশলা বেঁটে দেওয়া ।

কেষ্টর কাজ হোটেল সাফ করা আর জলের ব্যবস্থা করা । দিনের শেষে কিছু বাসন ধূতেও এগিয়ে আসে ও ।

 

মাসিমার ছেলেরা সব শুনে মার নামে ছিছিক্কার করতে থাকলো বাইরে থেকে । এলাকার কিছু মানুষ তাদের জানায় ।

সে খবর মাসিমা পায় অন্য মুখ থেকে । শুনে কিছু বলে না । মনে-মনে হেসেই যায় ।

দু’চোখ বুজে বিড়বিড় করে দুই ছেলেকে আশীর্বাদ করতে ভোলে না আমাদের কাজলী মাসিমা । আরও কাজে গতি পেলো ছেলেদের নিন্দা আর অবহেলায় ।

কেষ্ট সবসময় আনন্দে থাকে । আগের কষ্ট সব ভুলে যায় মাসিমার মুখের দিকে তাকিয়ে । মাসিমাও ওকে ঘিরে আনন্দভবন রচে মনের গভীরে । তার সব স্বপ্ন কেষ্টকে ঘিরে ।

 

একটা বছর হোটেল চলার পর কাজলী মাসিমা একদিন রাতে কেষ্টকে পাশে নিয়ে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে ভাবল, কেষ্টর একটা ভবিষ্যৎ করে যেতে হবে আমাকে । আমার কিছু হয়ে গেলে ও আবার আগের অন্ধকারে তলিয়ে যাবে ।

তার ভাবনার খবর কেষ্ট কিছুই জানে না । তাকে ঘিরেই ওর সুখে জাগরণ আর নিদ্রা ।

কিন্তু মাসিমা ওর ওটুকু সুখে সুখী নয় । 

তাই একদিন গোপনে রেজিস্ট্রি-অফিসে গিয়ে তার মনের কথা জানায় । শুনে অনেকেই অবাক ।

একজন বলে ওঠে, ’বলেন কী এসব ? আপনার দুই ছেলে আছে না ?’

মাসিমা অম্লান-হেসে উত্তর দেয়, ’তার জন্য ছেলেকে ছেলের মতো হয় গো । তাই আমার বাড়ি-দোকান কেষ্টর নামে দিয়ে যাবো ।‘

সবাই অবাক হলেও তাকে বুঝিয়ে পারলো না । অতএব দুদিন পরে কেষ্টকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে মাসিমা তার বাড়ি-দোকান ওর নামে লিখে দিলো । অপার-বিস্ময়ে কেষ্ট অপলকে চেয়ে থাকলো মাসিমার দিকে । দু’চোখ ভরে জল এলো ওর নিজের মায়ের কথা ভেবে । মাসিমা ওকে তার সুকুমারী-বুকে চেপে ধরে তখন ।

ঘরে ফিরে মাসিমা স্নেহমাখা হাসি হেসে ওর চুলে বিলি কাটতে-কাটতে বলতে থাকে, ’পাগল আমার বোঝে কম । এবার তুই দৌড়াবি জগত-জুড়ে । তবে কাউকে এখন জানাবি না । ঘরে কোথায় দলিল রেখেছি দেখে নিস । পরে আমার সেই ছেলেরা দেখতে চাইলে দেখাতে পারবি ।‘

 

তার মাস দুয়েক পর ।

মাসিমা এক রাতে দেহ রাখল ঘুমের মধ্যে । পাশে ঘুমিয়ে থাকা কেষ্ট কিছুই জানতে পারলো না । সকালে উঠে অনেক ডাকাডাকির পরেও মাসিমা সাড়া না দিলে কেষ্ট হাউহাউ করে কাঁদতে-কাঁদতে পাড়ায় ছুটল । ওর কাকা-কাকি সহ পাড়ার অনেকেই তাকে দেখতে এলো । সবাই জেনে গেলো,কাজলী মাসিমা আর ইহলোকে নেই ।

কেষ্ট আকাশ-ভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়লো । ওকে সান্ত্বনা দিতে থাকলো অনেকেই । ওর কাকা-কাকির আবার মন খারাপ হল । তবে তার কারণ অনেকের পক্ষে বোঝা দায় ।

যারা বুঝল শোকের মধ্যেও মুচকি হাসল ।

 

একদিন পরেই গতায়ু কাজলী মাসিমার দুই ছেলে ছুটে এলো বাড়িতে । সেও তিনবছর পর ।

কেষ্টর প্রহরায় তখন মাসিমার বাড়ি । ওদিকে হোটেল ।

ওকে দেখে চমকে উঠে দুই ভাই এক সুরে জিজ্ঞেস করলো,’তুই এখানে যে ?’

কেষ্ট কষ্ট-কষ্ট মুখে উত্তর দিলো,’আমার বাড়ি । আমার হোটেল । আমি দেখবো না ?’ 

ওর কথা শুনে দুই ভায়ের মাথায় যেন পুরো আকাশটাই ভেঙে পড়লো ।

‘মানে,মানে ?’

কেষ্ট একদিন আগেই দলিল রেখে দিয়ে আসে পাড়ার সর্বজনের জেঠু প্রমোদ দত্তর কাছে ।

দুই ভাইকে মানে বোঝাতে অপেক্ষা করতে বলে কেষ্ট তার কাছে ছুটল ।

মিনিট দশের মধ্যে কেষ্ট হাতে দলিল নিয়ে চলে এলো । সঙ্গে প্রমোদ দত্ত আর তার দুই ছেলে । এক ছেলে আবার কাজলী মাসিমাকে সাহায্য করে দলিল লিখতে ।  

কেষ্টর হাত থেকে ঝট করে দলিল কেড়ে নিয়ে বড় ছেলে নির্মল তন্নতন্ন করে পড়ে হতবাক হয়ে গেলো । তার তখন জ্ঞান হারানোর অবস্থা । ছোটো ভাই নিমেষ দাদাকে চেপে ধরল ।

শেষমেশ দুই ভাই প্রমোদ দত্ত আর তার দুই ছেলের মুখে সব শুনে মাথা হেঁট করে শেষবারের মতো বাবা-মার বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো ।

পথে যেতে-যেতে দুজনের বারবার কেষ্টর নাম মনে পড়তেই খুব কষ্ট হতে থাকলো ।

পাড়ার লোক দেখে মজা করে নিজেদের মধ্যে বলল,’সেটাই তো । স্বাভাবিক । ইশ রে !’

 

সেই হোটেল কিন্তু এখনও চলছে । কেষ্ট সাইনবোর্ডের একটা অক্ষর বদলায়নি ।নিরামিষ থেকে অনেকের চাহিদার কথা ভেবে আমিষ হয়নি । কাজলী মাসিমার স্বপ্নের নিরামিষ হোটেল বহালতবিয়তে এগিয়ে চলেছে ।

কেষ্টর কাকা মাঝেমধ্যে হোটেলে আসে । খাবারের গন্ধ শুঁকে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে চলে যায় । সেই কেষ্ট এখন বাড়ি আর দোকানের মালিক । ভাবতে তার বুকে ব্যথা বাজে খুব ।

কেষ্টর কাকির খোঁজ তেমন জানা যায় না । বাড়িতেই তো থাকে সে । নিশ্চয় নিজের দুই ছেলের মুখের দিকে তাকালে তারও খুব কষ্ট হয় ।

এ ব্যথা কি যে ব্যথা

বোঝে কি আনজনে ?

নাহ । সে কি হয় ?

মাসিমার ছেলেরা তো সেই থেকে বেপাত্তা । তাদের খোঁজ আর বেথুয়াডহরিতে আসে না । মুখেই আসে না কারো সেই নাম দুটো আর ।