গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২০

গোপেশ দে

 


ব্যাপারটা গোলমেলে



রাজা সেজে সিংহাসনে বসল আশিস।একে একে দেখতে লাগল প্রজারা আসতে শুরু করেছে নালিশ জানাতে।
'মহারাজ ! আমার বাড়িতে আজ  চোর ঢুকেছিল।'
'মহারাজ আমার বাড়িতে রোজ রাতে কে জেন ঢিল মারে ?'
'মহারাজ, আমার মেয়েকে জোর করে বিয়ে করতে চায় পাচু !'
মহারাজ চোখ বুজল।তারপর ডাকল সেপাইকে, 'সেপাই এদের বিপদ থেকে পরিত্রান করো।আজই মাঠে নেমে পড়ো।আমার রাজ্যে কোনো অনিয়ম দেখতে চাই না।'
'মন্ত্রী তুমি চিঠি দিয়েছো নাটোরের রাজাকে ? তাকে নিমন্ত্রণ পত্রটা দিয়েছো ?'
'না মহারাজ, সভাকবি নিমন্ত্রণ পত্রটা লিখছেন ছন্দ করে করে।'
'বাঃ বেশ! তা আমার শল্য চিকিৎসক কোথায়? আমার খিদে পায় না কেন? অরুচি অরুচি!
  ডাকো ডাকো কবরেজকে।'

এভাবেই দিন সাতেক ধরে সারারাত হ্যালুসিনেশনে থেকে কল্পিত একটা রাজকার্য সম্পন্ন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ভোররাতে ঘুমিয়ে পড়ে আশিস।ঘুম ভাঙে দুপুর বারোটা কি একটায়।তারপর স্নান খাওয়া সেরে ছাদে একা একা হাঁটে।বিকেলে এই পোড়োবাড়িতে চারপাশে হাঁটে আর চোখ জুড়িয়ে যায় তার।

রাত গভীর হলেই ইলিউশান তৈরী হয় চোখে।রাজার পোশাক পরে মাথায় মুকুট দিয়ে একটা সিংহাসনে বসে।চারপাশে মন্ত্রী, সেপাই, কোটাল, সভাকবি, একে একে কল্পিত প্রজারা আসে।একই গৎবাঁধা অভিযোগ
  প্রজাদের।একই রাজার আদেশ উপদেশ।এ যেন একটা মঞ্চনাটক।শুধু নিজেই দৃশ্যমান অভিনেতা।

মাঝরত্তিরে পরিতোষ এই বাড়ির আশেপাশে মাঝেমধ্যে ঘোরাফেরা করে মদ খেয়ে।বাড়িতে বিস্তর আশান্তি থাকায় রাতে মদ খেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে।গত এক বছর ধরে সে রাতে বাউন্ডুলে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।কিন্তু ক' দিন ধরে এই পোড়োবাড়ির দোতলার একটা রুমে লাইট জ্বলতে দেখে সারারাত।সেখান থেকে আশিসকে দেখতে পায় সে। কন্ঠও ভেসে আসে। পরিতোষ অবাক দৃষ্টিতে দোতলায় তাকিয়ে থাকে আর হি হি করে হাসে।

আশিস কলকাতার ছেলে । এখানে সে এসেছে কিছুদিন সময় কাটানোর জন্য।একটা পুরানো প্রাসাদ বাড়িতে থাকবে ঘুরবে ফিরবে এই অভিপ্রায়ে এখানে আসা। এডভেঞ্চারপ্রিয় ছেলে।ঘোরাঘুরি করাটাই তার শখ।এক পরিচিত বন্ধুর মাধ্যমে এই জায়গাটার খোঁজ পেয়ে এখানে আসা। একা একাই আছে সে এখানে।একা অজানা কোথাও থাকতে তার কোনদিন ভয় করে না। সে যত ভূতুরে বাড়িই হোক।এই সাহসটা তার ছোটবেলা থেকেই।
দিন দশেক আগে এখানে থাকার জন্য ট্রেনে চেপে একটা ছোট্ট ট্রলি আর কাঁধে ব্যাগ নিয়ে এখানে চলে আসে আশিস।লোকজন মারফত পোড়োবাড়ির ঠিকানা খুঁজে চলে আসে পোড়োবাড়ির কাছে। কথা হয় কেয়ারটেকার সুধাময় বাবুর সঙ্গে।পনের দিনে এক হাজার টাকা বন্দোবস্ত হয় ভদ্রলোকের সাথে।টাকাটা নগদ তখনই ধরিয়ে দেয় আশিস। সুধাময় তার থাকার ঘরটি দেখিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, 'বাবু একা থাকবেন।ভয় পাবেন নাতো ?'
আশিস ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলেছিল, 'ভয়।কেন এটা কি ভূতের বাড়ি ?'
সুধাময় বললেন, 'ঠিক ভূতের বাড়ি নয়।আবার বাড়িও।'
আশিস একগাল হেসে বলল, 'রাজবাড়ি নিয়ে সবাই এমন বলে।ভূতের বাড়ি।না থাকলেও বলে।আই ডন্ট বিলিভ গোস্ট।'
'তা ভালো।তবে একটা গোলমেলে ব্যাপার আছে।'
'সেটা কী ?' আশিস বলল।
সুধাময় প্রসঙ্গিটা এড়িয়ে গিয়ে অন্য কথা বললেন, 'তবে কেউ একা থাকতে আসে না এই বাড়ি।দু চারজন আপনার মতই এসেছিল একা।তবে...'
'তবে কী ?'
'না কিছু না।থাকুন।অসুবিধা মনে করলে বলবেন।'
'কোনো অসুবিধা নেই।আমি একাই পারব।আর আপনি থাকবেন কোথায় ?'
'আমি দিনের বেলায় প্রতিদিনই আসি।ঘুরে ফিরে যাই।কিন্তু রাতে আমি নিজের বাড়ি থাকি।অসুবিধা নেই।ঘরে লাইট ফ্যান সবই আছে।নতুন করে ওয়ারিং করা হয়েছে।'
'আচ্ছা ঠিক আছে।'আশিস খুব মনোযোগে শেষের কথাগুলো শুনল না।
'একটা কথা বলব দাদাবাবু ?'
'বলুন।'
'এটা অনেক পুরোনো রাজপ্রাসাদ তো।তাই বলছি।এই ঘরের পাশের ঘরটায় যাবেন না।'
'কেন ?'
'আসলে ওই ঘরে পুরানো রাজ- রাজরার কিছু নথি আছে।কাগজ পত্র আছে।ওগুলো ধরতে বারণ করে দিয়েছেন মালিক।'
'মালিক কে ?'
'মালিকের নাম চিন্তাহরণ দেওঘড়িয়া।ওঁরা বিহার থাকেন।আমার ওপর দায়িত্ব দেখাশোনার।'
আশিস তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলেছিল, 'ঠিক আছে।'
এরপর সুধাময় পনেরদিনের জন্য একজন রান্নার ঠাকুর ঠিক করে দিলেন।বাজার সদাই ঠাকুরই করে আনবে।খরচা পাতি যা লাগবে আশিস দেবে।

 


দিন দুই একা একা বেশ থাকার পরে এক রাতে আশিসের মাথায় একটা খেয়াল চাপল, পাশের ঘরটায় যাবে।ঘরটা তালাবদ্ধ নেই।যাওয়া যেতেই পারে।সুধাময় বাড়ন করেছেন তাতে কি ? তিনি তো আর দেখতে যাচ্ছেন না।
সেই রাতেই সে দরজার কাছে গিয়ে দরজায় প্রথমে হালকা ঠেলা দিল।কিন্তু খুলল না।তারপরে জোরে ঠেলা দিতেই খুলে গেল।ভিতরে ইঁদুর, ছুঁচো মরা গন্ধ পেতে লাগল।ঘরটা অন্ধকার সেটাই স্বাভাবিক।কিন্তু অসম্ভব রকমের ঠান্ডা রুমটা যেন এয়ার কন্ডিশন।সে তার নিজের রুমের টেবিলের ওপর থেকে লাইটটা নিল।লাইট জ্বালিয়ে অন্ধকার ঘরটিতে ঢুকে সুইসবোর্ড খুঁজতে লাগল।কিন্তু আশ্চর্য ! ঘরটাতে কোনো সুইস বোর্ড নেই।এই রুমে কোনো ওয়ারিং করা নেই কেন ?
 

ঘরে ঢোকা মাত্রই সে অনুভব করল ছমছম করছে যেন ঘরটা।টর্চের আলোয় দেখল ঘরের মধ্যে যাবতীয় কাগজ সরঞ্জাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা।বিশাল একটা টেবিল।টেবিলের ওপর বিস্তর পোকামাকড় মরে পড়ে আছে।রুমের এক কোণে একটা ট্রাঙ্কও দেখতে পেল সে।ট্রাঙ্কে তালা দেয়া।তালাটা সাইজে ছোট।তালাটা খোলা থাকলে ট্রাঙ্কের ভিতরটা দেখা যেত।হঠাৎ তার চোখে পড়ল একটা শাবল।কৌতুহল চাগাড় দিয়ে উঠল।শাবলটাকে কাজে লাগাতে হবে।শাবল দিয়ে তালা ভাঙা কোনো ব্যাপারই না।এই ভেবে শাবলটা হাতে নিয়ে এক ঝটকায় তালাটা ভেঙেও ফেলল।দ্রুত ট্রাঙ্কটা খুলল।দেখল একটা ডায়েরী, রাজা- বাদশার জড়ি দেয়া পোশাক, একটা মুকুট।পোশাক থেকে অদ্ভুত একটা গন্ধ বেরুচ্ছিল।ডায়েরীটা বেশ পুরনো বলেই মনে হচ্ছিল তার।
ট্রাঙ্কের যাবতীয় জিনিস নিয়ে সে রুম থেকে বেরিয়ে এল।ডায়েরীর লেখাগুলোয় একবার চোখ বোলাল কিন্তু মনোযোগে পড়ল না।সাধুভাষায় লেখা।কিছু কিছু লেখা অস্পষ্ট।
তারপর দিন থেকেই ঘটনা শুরু।রাত বাড়তেই শুরু হল ইলিউশান।
ডায়েরী পাওয়ার পরের দিন রাত থেকেই তার কেমন জানি একটা ঘোরের মধ্যে কাটল।ডায়েরী তাকে যেন বলল, 'এবার গল্প পড়ো বৎস...!'
সে গল্প পড়তে শুরু করল।পার্ট বাই পার্ট করে লেখা গল্প গুলো।
প্রথম পার্ট পড়া শেষ হতেই তার রাজা হতে ইচ্ছে জাগল।এরপর রাজার পোশাকটা পরল।একটাই চেয়ার ঘরটাতে।সেটাকে তখন সিংহাসনের মত লাগল দেখতে।
সিংহাসনে বসামাত্রই চোখের সামনে একটা ইলিউশান তৈরি হল। চোখের সামনে কল্পিত মন্ত্রী, সেপাই, কোটাল, সভাকবি, কবিরাজ প্রভৃতি মানুষ।শুধু রানী থাকে না।প্রজারাও একে একে আসে অভিযোগ জানাতে।সারারাত একটা ইলিউশানের মধ্যে দিয়ে কেটে গেল তার।তারপর নিজের সাথে বকবক করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল সে।
এই ভাবেই চলছে তার রাত্রিযাপন।
রাজা রাজা খেলা খেলে রাতগুলো তার কাটছে।ভোর রাতে চোখ ভেঙ্গে ঘুম আসে।ঘুম ভাঙে একেবারে দুপুর বারোটা একটায়।ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরে গিয়ে দেখে ঠাকুর সবকিছু রান্না করে দিয়ে গেছে।রাতের রাজা হওয়ার ইলিউশান তার মনেই পড়ে না।

 

 

এখানে আসার পর প্রতিদিন সন্ধে বেলা একটু বাইরে বের হয় আশিস।বাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই একটা চায়ের দোকান।ছাপড়া ঘর।সেখানে একার মত একা চা খায়।লোকজনও বিশেষ কথা বলে না তার সাথে সেও যেচে কারো সাথে কথা বলে না।
শুধু দোকানদার প্রথমদিন রহস্যময় ভঙ্গিতে বলেছিল, 'স্যার কি রাজবাড়ি উঠেছেন ?'
আশিস চায়ে চুমুক দিয়ে বলেছিল, 'হ্যাঁ।'
'বেশিদিন না থাকাই ভালো।'
'কেন ?'
'না মানে।কিছু না...'
'ভূত আছে নাকি বাড়িতে ?'
  আশিসের চোখে মুখে ছিল অবজ্ঞার সুর।
লোকটা চুপ মেরে গিয়েছিল।
আশিসও আর কথা বাড়ায়নি।

রাত ঘন হলেই ডায়রীটা যেন তাকে সম্মোহিতের মত টানে।পরবর্তী অধ্যায় একা একাই খুলে যায় যেন।আর সে পড়ে ফেলে এক নিমেষে।ডায়েরীর প্রতিটা অধ্যায়ের শেষ কথাটা একই রকম থাকে "... এইবার রাজা সাজো বৎস"।

সুধাময় ভাত খেয়ে দাওয়াই বসে আশিসের কথা একটু ভাবতে লাগলেন।আজ বিকেলের দিকটায় সুধাময় আশিসের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন।আশিসের ঘরে ঢুকেই তিনি রাজার পোশাক, মুকুট, ডায়েরী দেখে হতভম্ভ।খুব রাগী গলায় বলেছিলেন, 'পাশের ঘরটায় গিয়েছিলেন বাবু ?'
আশিস একটু ভড়কে গিয়েছিল, 'হ্যাঁ।ওই মনের কৌতুহল...'
'এত কৌতুহল ভালো নয়।এখনই রেখে আসুন ওগুলা।'
'ডায়েরী, রাজার পোশাক ওগুলো পেলেন কীভাবে? ওগুলো তো তালা দেয়া ছিল।'
'আসলে তালাটা ভেঙেছি।'আশিস লজ্জিত স্বরে বলল।
'ভেঙেছেন ? আমি রাগ করিনি ভেঙেছেন বলে।অন্য ব্যাপারে খুব চিন্তিত আমি।আপনি ওগুলো এখনই রেখে আসুন।'
'আচ্ছা রেখে আসবখন।চলুন বাইরে থেকে চা খেয়ে আসি।'
সুধাময় বললেন, 'বিপদ আনছেন কিন্তু বাবু।'
'কী বিপদ বিপদ বলছেন ?' আশিস একটু রেগে গিয়েছিল।
সুধাময় বললেন, 'যাই হোক ওগুলো আমি রেখে আসি ওই ঘরে।'
'আচ্ছা মশাই তো আপনি।আমি রেখে আসব বলেছি তো।আপনার মালিকের সম্পদ।সেতো আমি জানি।'
আশিসের এই গোঁয়ারপানা ভালো লাগল না সুধাময়ের।তিনি বিড়বিড় করতে করতে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে।রাস্তায় এসে আপন মনে বললেন, 'ত্যাঁড়া।বড্ড ত্যাঁড়া।বেঘোরে মরবে মরুক...!'

সুধাময়ের কেমন যেন এখন খটকা লাগছে মনের ভিতরটা।রাজবাড়িতে দু দুটো সুইসাইড কেস ঘটার পর একজন তান্ত্রিক এনেছিলেন বাড়িটায় অশুভ কিছু আছে কিনা জানার জন্য।তান্ত্রিক ডায়েরী, রাজার পোশাক, মুকুটের মধ্যে অশৈলী ব্যাপার আন্দাজ করেছিলেন।তিনি সেগুলো মন্ত্রবলে বন্ধন করে ট্রাঙ্কের মধ্যে তালা মেরে রাখতে বলেছিলেন। সেই থেকে এগুলো তালাবদ্ধ।
হঠাৎ দুটো কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠল।তার ভাবনায় ছেদ পড়ল।তার মনে হল, কুকুর দুটো বলছে,
  'বিপদ ঘোর বিপদ...'
সুধাময় ভাবলেন যা হবার হবে।শরীর ক্লান্ত তাঁর।বড্ড ঘুম পাচ্ছে।কাল সকালে একবারটি যাবেন জিনিসগুলো দেখতে।আশিস বলেছে সেগুলো রেখে দেবে ট্রাঙ্কের মধ্যে।

আশিস এইমাত্র রাতের খাবার খেয়ে বিছানার কাছের পেল্লাই জানালার কাছে ঘরের একমাত্র চেয়ারটি টেনে বসল।বাইরে ঝিরিঝিরি হাওয়া দিচ্ছে।আকাশে কুমড়োর ফালির মত চাঁদ।আলোটা মলিন।এই রাস্তায় রোডলাইট আছে কিন্তু সেটা জ্বলে না।অকেজো হয়ে আছে অনেকদিন ধরেই হয়ত।
হঠাৎ তাকে সম্মোহিতের মত ডায়েরী যেন ডাকল।সে সচকিত হয়ে তাকাল ডায়েরীর দিকে।ডায়েরীর পৃষ্ঠাগুলো এলোপাথাড়ি ওড়াওড়ি করছে।তাতে খচখচ শব্দ হচ্ছে।সে ডায়েরীর কাছে গেল।শেষের অধ্যায়টা বার করা।সবগুলো অধ্যায়ই পড়া হয়ে গেছে শুধু শেষ অধ্যায় ছাড়া।আজ পড়বে।
পড়ার জন্য মনটা উথাল-পাতাল করে উঠল।সে পড়তে শুরু করল,
ডায়েরীর শেষ কথাটা আজ অন্যরকম ---

"...অদ্য রাজার জীবনাবসান হইবে।আর কোনো বংশধর অবশিষ্ট রহিবে না।আজ আত্মহত্যা করো বৎস "


আশিস দেখল হুঁকের সাথে একটা দড়ি ঝুলছে দেয়ালের কোণে।সে রাজার পোশাক পরল, মাথায় দিল মুকুট।তারপর সিংহাসনে বসল।একটা ভৌতিক হাসিও দিল আজ আর বলল, 'আজ জীবনাবসান...রাজকার্য শুরু হোক আগে।হা হা হা...!'

মাঝরাতে জানালায় টকটক শব্দে ঘুম ভেঙে গেল সুধাময়ের।তিনি ধরফর করে উঠে বসলেন।
আবার শব্দ হল জানালায়।মাথার কাছেই ছোট্ট কাঠের জানালা।
'কে ?'
'আমি পরিতোষ।'
'ও পরি ! জ্বালাস না তো।ঘুমাতে দে।' তিনি জানেন পরিতোষ রাত বিরেতে মদ গিলে যেখানে সেখানে পড়ে থাকে।
'আরে দাদা ওদিকে ছেলেটা যে দড়ি ঝুলিয়েছে ফ্যানের সাথে।'
সুধাময়ের বুঝতে আর বাকী রইল না কী হতে চলছে।লুঙ্গি তিনি পরাই ছিলেন।শুধু একটা স্যান্ডো গেঞ্জি আর রাবারের চটি গলিয়ে পরিতোষকে নিয়ে ছুটলেন রাজবাড়ির দিকে।জোর পায়ে হেঁটে গেলে মিনিট পাঁচেক লাগে।তিনি হাঁটছেন আর বলছেন, 'বিপদ মহা বিপদ...থাপড়ানো দরকার হারামীটাকে।'
রাজবাড়ির মূল দরজা খোলাই থাকে।খোলা থাকলেও কেউ রাতে ভিতরে ঢুকে না।আর চোর ঢুকলেও বাইরে তেমন কিছুই পাবে না।সে জন্যই সুধাময় খুলে রাখেন।
সুধাময় দোতলার জানলার দিকে তাকালেন।যেখান দিয়ে আশিসের ফাঁসির দড়ি ফ্যানের সাথে ঝুলতে দেখেছিল পরিতোষ।কিন্তু জানালাটা বন্ধ এখন।
'সর্বনাশ ! আমার পা-টা কাঁপছে।আমি পড়ে গেলে আমায় ধরবি কিন্তু পরি...' সুধাময়ের ভিতরে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট।
'আজ্ঞে।'
মূলদরজা দিয়ে সুধাময় পরিতোষকে সাথে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে ভাবতে লাগলেন, আশিস যে ঘরে থাকে সেই ঘরের দরজা আবার ভিতর থেকে খিল দেয়া নয়তো ?
সুধাময় একটা ধাক্কা দিলেন দরজাটায়।কড়মড় করে দরজাটা খুলে গেল।তারমানে দরজাটায় খিল ছিল না।
একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন সুধাময়।
আশিস দড়ির দিকে তাকিয়ে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে।দড়িটা ফ্যানে ঝুলছে।
সুধাময় আশিসকে জাপটে ধরে ফেললেন পিছন থেকে।সঙ্গে সঙ্গে আশিস অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।

যখন আশিসের জ্ঞান ফিরল।তখন সে দেখল অন্য একটা ঘরে শুয়ে আছে।অন্য একটা বিছানা।সুধাময় বসে আছেন।পাশে পরিতোষও।
আশিস উঠে বসল, 'আমি এখানে যে।রাজবাড়িটা কোথায় ?'
সুধাময় ধমক দিয়ে উঠলেন, 'কী করতে যাচ্ছিলে মনে আছে ?'
আশিস বোকার মত চাইল, 'কী ?'
'আত্মহত্যা ?'
আশিস অবিশ্বাসের চোখে বলল, 'কী বলছেন আবোল-তাবোল ?'
'আবাল-তাবোল নয়।যাক গে তোমার কিছু মনে নেই হয়ত।যাই হোক।এখনি তুমি বাড়ি ফিরে যাবে।যেখানের ছেলে সেখানে যাবে।পরি ওকে স্টেশানে নিয়ে যা তো।আর ট্রেনে সোজা উঠিয়ে দিবি।তবেই আসবি।'
'কী বলছেন কিছুই তো বুঝতে পারছি না', আশিস ভয়ার্ত গলায় বলল।
'বুঝতে হবে না।আজ পরি না থাকলে একেবারে ওপরে চলে যেতে।যাই হোক।আর যেন এদিকে না দেখি।আর এলেও ওই রাজবাড়িতে আর না।সাহস ভালো কিন্তু বেশি কৌতুহল ভালো না।'

সেই রাতেই পরিতোষ আশিসকে ট্রেনে উঠিয়ে দিল।আশিস নিজেই যেতে পারত।কিন্তু সুধাময় আশিসের একা যাওয়াটাতে ঠিক ভরসা পাচ্ছিলেন না।স্টেশানে পরিতোষ মদ খাওয়ার জন্য আশিসের কাছ থেকে দু'শ টাকা নিয়েছে।

আশিস ট্রেনে বসে ভাবতে লাগল রাতে তার কী হয়েছিল আজ।সুধাময়ের ঘরে কেন ? আর আত্মহ্যত্যাই বা করতে যাবে কেন সে ? সুধাময় প্রায় হুমকি দিয়ে তাকে চলে যেতে বললেন।পরিতোষ তাকে বাঁচিয়েছে।কীভাবে ? ব্যাপারটা গোলমেলে।সে রাজবাড়ির কথাগুলো ভাবতে লাগল।আশ্চর্য ! সব স্মৃতি মনে পড়ছে কিন্তু রাতের স্মৃতি গুলো...!