গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৮ নভেম্বর, ২০২০

শান্তিময় কর


 যমালয় থেকে ফেরা                   


 

সেই কোন ছোটবেলা থেকে এরকমটা হয়ে আসছে । ঘুমিয়ে পড়লেই যত রাজ্যের স্বপ্ন এসে আমার সামনে ভিড় করে । এমন একটা রাত যায় না, যেদিন আমি স্বপ্ন না দেখি । অদ্ভুত অদ্ভুত কিম্ভুত কিমাকার সব স্বপ্ন । এক একটা স্বপ্নে আমিতো ভয়ে আতঙ্কে পাগলের মত হয়ে যাই । কিন্তু রেহাই নেই, স্বপ্নেরা সব আসবেই এবং এটা আমার জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে । এমনি একটা বীভৎস স্বপ্নের কথা বলতে চাই। মারাত্মক ঘটনা,এবং ঘটেছিল আমার ঘুমের মধ্যে ঐ স্বপ্নেই । এটাকে দুঃস্বপ্ন বলবো না অন্য কিছু, ভেবে পাই না । তবে এটুকু বলতে পারি, ঐ ভয়ংকর স্বপ্নের কথা ভাবলেও এখনও কেমন যেন সারা শরীরটা শিরশির করে ওঠে -- ভয়ে আতঙ্কে সিঁটিয়ে যাই । কদিন ধরেই প্রচণ্ড জ্বর, সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে বিছানায় পড়ে ছিলাম । জ্বর ও ব্যথার কাতরানির মধ্যে মাথায় মায়ের হাতের কোমল স্পর্শে কখন এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । আর তার পরেই সেই বীভৎস, ভয়ঙ্কর স্বপ্নটা । সবার যা হয়, স্বপ্ন দেখার সময় মনে হয় সমস্ত ঘটনা বাস্তবে ঘটছে । তাই স্বপ্নে যা যা ঘটে, সবই সত্য মনে হয় । আমার বেলাতেও তাই হয়েছিল । এখনও আমি চোখের সামনে সমস্ত ঘটনাটা দেখতে পাই । একা থাকতে পারি না --- মূর্তিমান বিভীষিকা যেন আমায় তাড়া করে ফেরে ।

স্বপ্নটা এইরকম --- দেখলাম অনেকগুলো লোক মাঝরাতে হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে " বল হরি হরিবোল " চিৎকার করতে করতে দড়ির খাটিয়ায় একটা মৃতদেহ কাঁধে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে শ্মশানে । ঐ চিৎকারে ধড়মড়িয়ে উঠতে গিয়ে মাথাটা কেমন যেন বনবনিয়ে ঘুরতে লাগলো । যাই হক, কোন রকমে নিজেকে সামলে নিলাম । লোকগুলো প্রবল উৎসাহে নেচে নেচে ‘বল হরি হরিবোল’ আর ‘রাম নাম সত্য হ্যায়’ বলতে বলতে একটু এগিয়ে পথের ধারে বুড়ো শিব মন্দিরের সামনে মৃতদেহের খাটিয়াটা নামালো । বোধ হয় শিব ঠাকুরের কাছ থেকে লোকটার জন্য শেষ আশীর্বাদটুকু পাইয়ে দেওয়ার জন্যই । আমি সামনে এগিয়ে গেলাম । মুখটুকু বাদ দিয়ে মৃতের পুরো দেহটা সাদা চাদরে ঢাকা । গ্রামের সবাইকেই চিনি, তাই ঐ লোকগুলোকে কোন প্রশ্ন না করে এগিয়ে গেলাম কে মারা গেছে স্বচক্ষে দেখার জন্য এবং মৃতের উদ্দেশে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর ইচ্ছায়।

 

কিন্তু  সামনে গিয়েই যা দেখলাম তাতে আমার সারা শরীরের রক্ত হিম হয়ে যাবার জোগাড় । মেরুদণ্ড দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে যেতে থাকলো । থরথর করে কাঁপতে লাগলো আমার পা দুটো । মনে হল শরীরটা অবশ ঠাণ্ডা হয়ে জমে যাচ্ছে । চোখে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে । এ কী দেখছি আমি ? কে ঐ মৃত লোকটা, কার মৃতদেহ ওটা ? আমি কি ভুল দেখছি ? আমি বিহ্বল আর অবাক বিস্ময়ে দেখছি সামনের খাটিয়ায় আমারই মৃতদেহ শোয়ানো আছে --- আমিই শুয়ে আছি মৃতদেহ হয়ে । এটা কি করে সম্ভব ? আমি তো জলজ্যান্ত দাঁড়িয়ে আছি । তবে ঐ লোকটা কি করে আমি হল বা আমি কি করে ঐ লোকটা হলাম ? আর তা ছাড়া আমার তো কোন যমজ ভাই নেই । অথচ ও আর আমি হুবহু একই লোক । ‘আমি ও’, ‘ও আমি’ ভাবতে ভাবতে মাথাটা আমার ঝিমঝিম টলমল করে উঠলো । মনে হল মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাচ্ছি । পড়েই যাচ্ছিলাম সত্যি সত্যি, হঠাৎ কে যেন আমাকে পিছন থেকে জাপটে ধরলো - “কি হল ঘণ্টা দা, এমন করছো কেন, কি হল তোমার ?" এই বলে ও আমাকে গাছতলায় শুইয়ে দিল । পাশ থেকে আর একজন কে যেন টিপ্পনী কাটল, “শালার কলজের জোর নেই তো ভড়ং করে মড়া দেখতে আসা কেন ? দে মাকড়াটাকে তুলে দে খাটে, এক সাথেই পার করে দিই”।

এই রকম ডায়ালগ বাজির মধ্যেই আমি আস্তে আস্তে জ্ঞান হারালাম --- কিন্তু অবচেতনে মানসচক্ষে সব কিছুই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম । মৃত ভেবে নিয়ে ওরা সবাই মিলে আমাকেও ঐ একই খাটিয়ায় তুলে দিয়ে দড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেললো । কিন্তু এ কী অবাক কাণ্ড রে বাবা ? একটু আগে যে লোকটা এই খাটিয়ায় শুয়েছিল, সে গেল কোথায় ? যেন কর্পূরের মত উবে গেল । আর আমি তো বেঁচে আছি, আমাকে এরা কাঁধে চাপিয়ে হরিবোল বলতে বলতে নিয়ে যাচ্ছে কেন ? আমি একবার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলতে চাইলাম, “আমি বেঁচে আছি”, কিন্তু গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বেরোল না, শুধু ফসফস করে কিছুটা হাওয়া বেরিয়ে গেল । হাত, পা, সারা বজ্র আঁটুনি, নড়াচড়ারও উপায় নাই । পালানোর কথা তো ভাবাই যায় না । নেহাৎ নিরুপায় অসহায়ের মত চুপচাপ পড়ে থাকলাম । ভাবলাম, যা হবার হক --- কী আর করতে পারি আমি । জন্মেছি যখন, মরতে তো হবেই একদিন । বেশী ভেবে কি লাভ ? তাছাড়া এই বেহেড মাতালগুলোর হাত থেকে তো নিস্তার নাই কোনমতেই । কিন্তু তবুও আমার দুচোখ দিয়ে ভরা শ্রাবণের ধারা বইতে লাগলো । এমন বেঘোরে জীবনটা যাবে ? আমি ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না এটা কি রকম উদ্ভট ব্যাপার ? একটু আগে যে এই খাটিয়ায় বিরাজমান ছিল, সে উধাও । সে আর আমি দুজনই এক, কোন তফাৎ নেই  । ওরা নেচে নেচে সুর করে হরিবোল গাইতে গাইতে শ্মশানের বুড়ো বটগাছ তলায় আমার খাটিয়াটাকে নামিয়ে দিয়েই যে যার বোতলের ছিপি খুলে বসে গেল গোল হয়ে একটু দূরে গাছতলায় । আমি হাত পা বাঁধা অসহায়ের মত পড়ে রইলাম একধারে একলা, একটু পরে নিজের অন্ত্যেষ্টির স্বাক্ষী হয়ে থাকার জন্য । আমার দিকে কেউ ফিরেও তাকাচ্ছিল না । আমি ভাবছিলাম আমার শেষ পরিণতিটা এই ছিল ! নানা ভাবনা আমার মাথায় ভিড় করে আসছিল । হঠাৎ দেখি সেই উধাও হয়ে যাওয়া লোকটা আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে ----

-কি ঘণ্টা দা, কেমন লাগছে ?

- আমি ঘণ্টা হলে তুমি কে ? আমি তুমি, তুমি আমি তো মিলে মিশে একাকার --কি করে হয় ?

- হ্যাঁ হয়, ঘণ্টা দা, হয় । এ রকমটাই হবার ছিল । বিদায় বন্ধু, বিদায় -- তোমার স্বর্গের পথ সুগম হ’ক, হ্যাপি জার্নি ।    

- কি বলছো কি তুমি ?

-তা নয়তো ? আমি মরে মরা, তুমি না মরেও মরা । ওপারে তোমার সাথে দেখা হবে।

- আচ্ছা, তুমি আমায় মুক্তি দিতে পারো না ?

- মুক্তি কোথায় হে দাদা ? মুক্তি নাই । সব শালার তোমার আমার মতই বেঘোরে প্রাণ যাবে ।

 

কথোপকথন শেষ হয় না । তার মধ্যেই মুর্দাফরাস মাতালগুলো হৈহৈ রই রই করতে করতে এসে আমার দড়িদড়া খুলে আমাকে চ্যাংদোলা করে চিতায় তুলে ফেলে পেট্রল ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দিল । আমি হাউমাউ করে চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে কেঁদে উঠলাম ----- বাঁচাও, বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও ।

আর ঠিক তখনই সেই মুহূর্তে আমার ঘুমটা ভেঙ্গে গেল । শুনতে পেলাম মা চিৎকার করে বলছেন, “খোকা, ওরকম করছিস কেন, কী হল তোর” ? " এই বলে মা আমার চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিতে সম্বিত ফিরে পেলাম । মনে হল যমলোক থেকে ফিরে যেন নবজীবন প্রাপ্তি হল আমার ।

 
               ********************************************************