গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ২৬ জুলাই, ২০২০

নীহার চক্রবর্তী

কোজাগরী


জমিদারতন্ত্র উঠে যাওয়ার সাথে-সাথে পূর্ব বাংলা থেকে কোলকাতায় ছুটে এলো জমিদার নীলমণি রায় । সঙ্গে তার স্ত্রী মীনাক্ষী আর কিছু বই ।
কিন্তু কোলকাতায় তার কেউ নেই । একটা বিশ্বস্ত বাসা খুঁজতে থাকলো সে । পেলো অবশেষে এক বিধবা বুড়ীর বেশ পুরনো বাড়ি । বুড়ী সেখানে তার বিকলাঙ্গ ছেলেকে নিয়ে বাস করে অনেকবছর ধরে ।

নীলমণি রায় বাসা পেয়ে খুব খুশি । খুশি তার স্ত্রী মীনাক্ষী ।
তবে দুজন অগোচরে থাকতেই পছন্দ করে । তা নিয়ে অবশ্য বুড়ীর মনে কোন প্রশ্ন ওঠেনি । নতুন মানুষ বলেই বুঝি এমন তার মনে হয় ।
তাই বেশ দিন কাটতে থাকলো সেখানে দুজনের । বুড়ীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও বেড়ে গেলো খুব । তার পঙ্গু ছেলেটাও বেশ আদর পেলো দুজনের কাছে ।
কিন্তু মাস দুয়েক পরে বুড়ী একদিন খুব আগ্রহের সঙ্গে নীলমণি রায়ের পূর্ব ঠিকানা তন্নতন্ন করে জানতে চাইলো ।

খুব আমতা-আমতা করতে থাকলো তখন নীলমণি রায় । বুড়ী দেখে বেশ অবাক ।
তাকে বিস্ময়ের সুরে বলল,'এত দ্বিধা কীসের ? বলেই ফেলো না । আমাদের সম্পর্ক তো এখন বেশ গভীর । আমাকে তোমাদের আত্মীয় ভাবতেই পারো ।
মীনাক্ষী তখন তার স্বামীকে বলল,'বলেই ফেলো না গো । সম্মান যা যাওয়ার গেছে আমাদের । আর কি থাকে তারপর ।'

সাথে-সাথে মাথা নিচু হয়ে গেলো নীলমণি রায়ের ।
প্রায় মাটিতে মিশে সে বলতে থাকলো তার গর্বের পূর্ব-কাহিনী । শুনে বুড়ী শুনে চমকে-চমকে উঠতে থাকলো । তার মুখের ভাব দেখে ভয় পেয়ে গেলো খুব মীনাক্ষী । সন্তর্পণে গায়ে হাত দিয়ে সে জমিদারকে থামতে বলল তখন ।
কিন্তু বলেই গেলো নীলমণি রায় । বলার শেষে ছলছল চোখে তাকাল বুড়ীর দিকে ।
কিন্তু বুড়ী তাতে মোটেও গলল না ।
বরং সে সরোষে তাকে বলে বসলো,'তোদের মতো বজ্জাতদের জন্য আমার স্বামী একদিন পূর্ব-বাংলা ছেড়ে চলে এসেছে এখানে । শোক সামলাতে না পেরে একবছরের মধ্যে মারা যায় সে । তাই তুই কাল দিনের আলো ফোটবার আগেই আমার বাড়ি থেকে বিদায় নিবি ।'
মীনাক্ষী তার পায়ে পড়ে হাপুস-নয়নে কাঁদতে শুরু করলো ।
চোখের জল ফেলতে ফেলতে তাকে বলল,'সে কি আমরা ? আমরা তো নই,বুড়ী-মা ।'
বুড়ী খেঁকিয়ে বলে উঠলো,'জাতের পাপ তোদের বইতেই হবে । আমার একই কথা । কাল থেকে আমি আর আমার ছেলে আগের মতোই সুখে থাকতে চাই ।'
সত্যিই হল তাই ।
পরেরদিন ভোরের আলো ফোটার আগে জমিদার নীলমণি রায় বুড়ীকে না বলেই মীনাক্ষীকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো চিরতরে ।
তারপর অনেকদিন চুপ । বুড়ী আর জমিদার আর তার স্ত্রীর কথা মনেই আনে না । মনে হলে সে ঘৃণায় মন থেকে উড়িয়ে দেয় তাদের ।
কিন্তু মাস খানেক পরে বুড়ী খবর পেলো,এক জমিদার সস্ত্রীক পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে কোলকাতা থেকে বেরোতে গিয়ে ।

বুড়ীর সহসা মনে পড়লো দুজনের সেই করুণ মুখ ।
যে তাকে খবর দেয়,তাকে বেশ কৌতূহলের সঙ্গে জিজ্ঞেস করে,’নাম জানা গেছে জমিদারের ?’
সেনীলমণি রায়বলতেই বুড়ী মাথায় হাত দিয়ে বসলো । সঙ্গে-সঙ্গে চোখ-ভরা জল নিয়ে তাকে বলল,’সে কী করেছে,শুনি ?’
সে বেশ রাগের সঙ্গে উত্তর দিলো,’জমিদারদের চেন না বুঝি ? নিজে হাতে মানুষ মারে না । মারায় । ওই শয়তান অমন কাজ করে পালিয়ে এসেছিলো কোলকাতায় । কোথায় উঠেছিলো কে জানে । পুলিশ ধরেছে জমিদার আর তার বৌকে ।
শুনে বুড়ীর খুশি হওয়ার কথা ছিল । কিন্তু সে ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেললো ।
কাঁদতে-কাঁদতে তাকে বলল,’আমার কাছেই উঠেছিলো দুজন । তোমরা কেউ জানো না । দুই বেচারা ভয়ে লুকিয়ে থাকতো । জমিদার জেনে আমি কেন যে বার করে দিলাম । আমার যে মহাপাপ হল ।

সে শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লো ।
চোখ বড়-বড় করে বলে উঠলো,’কী বল তুমি ? তুমি জায়গা দিয়েছিলে ? ভাবা যায় ?’
সাথে-সাথে বুড়ীর পঙ্গু ছেলেটা বলে উঠলো,’বেশ করেছি আমরা জায়গা দিয়ে । আমি চলতে জানলে খুঁজে আনতাম এখুনি ।
ছেলের দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির এক চিলতে হেসে আবার চোখ-ভরা জল নিয়ে তাকে বলল,’আমি তো মানুষ বলেই ওদের জায়গা দিয়েছিলাম । কিন্তু পরে জমিদার জেনে আগের রাগ সামলাতে পারলাম না । কিন্তু মানুষ তো ওরা । কেন যে তখন ভুলে গেলাম আমি ।

তাকে তখন সে সান্ত্বনার সুরে বলল,’বুঝলাম এবার । আমি কাউকে বলবো না তোমার বাড়ির ব্যাপারে । কেন তোমাকে বিপদে ফেলবো বল ।
না,তুই বলে দিস । আমি পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই দুজনকে একবারের জন্য আমার শুকনো বুকে জায়গা দিয়ে ।
তার কথায় যারপরনাই বিস্মিত হয়ে সে চলে গেলো । বুড়ী তারপরে আগের মতো কাঁদতে থাকলো । তার ছেলেটা খুব কষ্টে তার কাছে এলো । ও মাকে জড়িয়ে ধরল ।
বুড়ী একনাগাড়ে কেমন এক সুর করে তার অতীত আর বর্তমানের মালা গাঁথতে থাকলো চোখের সব অশ্রু-বিন্ধু দিয়ে ।
তারপরে আর কিন্তু সেই জমিদার নীলমণি রায় আর তার স্ত্রী মীনাক্ষীর আর কোন খবর মিলল না ।
যে খবর দিয়েছিলো,সে একদিন বুড়ীর কাছে এসে একমুখ হেসে বলল,’তোমার স্নেহ-আদরে বুঝি তারা বিপদ থেকে মুক্ত হয়ে গেছে । তুমি আর দুশ্চিন্তা করো না ওদের নিয়ে । ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্য ।

বুড়ী তার দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে অপলক তাকিয়ে এক-আকাশ হেসে তাকে স্বস্তির হাসি হেসে,’আমি তো তারপর থেকে আমি তো আমার দুই বাছার মঙ্গল কামনা করে গেছি । আমার ইষ্টদেবতাকে ডেকেছি কত । তাই বুঝি ওরা বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছে ।
সেদিন সন্ধের দিকে অবাক করে দিয়ে জমিদার নীলমণি রায় তার স্ত্রী মীনাক্ষী বুড়ীর বাড়িতে ফিরে এলো । দুজনকে একসাথে দেখে বুড়ী তো আনন্দে আত্মহারা । আনন্দে তার চোখে জলও চলে এলো । বুড়ীর পঙ্গু ছেলে দুজনকে দেখেই মাটি ঘেঁষটাতে ঘেঁষটাতে এগিয়ে এলো । ওর সারা মুখে তখন পরম শান্তির হাসি ।
দুজন বুড়ীকে প্রণাম করলো মুখে অনাবিল হাসি নিয়ে ।
বুড়ী দুজনকে পাসে বসিয়ে চোখেমুখে খুশির ঝিলিক তুলে বলল,’আমি যে এখানে পুড়ে মরি তোদের জন্য । কোথায় গিয়েছিলি রে ?’
জমিদার নীলমণি রায় তখন অমায়িক-হেসে বলে,’তোমার কিছহু জানতে হবে না । আমি ফিরে এলাম শুধু সব জমিদারের হয়ে তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে । ক্ষমা করবে তো আমাকে ?’
বুড়ী তার কথা শুনে খিলখিল করে হেসে বলে ওঠে,’ওসব বাদ দে তো । তখন কি বলেছি এখনো ধরে রেখেছিস ? মানুষ হয়ে মানুষের কাছে এসেছিস তোরা । আর তোদের ছাড়ছি না ।

মুহূর্তে বুড়ীর দুচোখে জল এলো । ফেলে আসা দিনের কথা বলে সে সুর করে কাঁদতে থাকলো । নীলমণি রায়ের স্ত্রী মীনাক্ষীও তাকে দেখে কেঁদে উঠলো ।
তখন নীলমণি রায় আর বুড়ীর পঙ্গু ছেলে সচেষ্ট হয়ে উঠলো দুজনের কান্না থামাতে ।
কান্না থেমে গেলো কিছুসময়ের মধ্যে । বুড়ীর কথারও ইতি ঘটলো । সন্ধের ঘরের নিম-অন্ধকার ভরে উঠলো চারজনের অযুত হাসির আলোর কত না ছটায় ।