ছোবল
লুসাই পাহাড় উত্তুন লামিয়ারে যার গই কর্ণফুলী…; গানটার
রেকর্ডিং শেষ করেই মারুফ সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের চট্টগ্রাম শাখায়
সিনিয়র এডিটর হিসেবে কর্মরত আছেন দীর্ঘদিন যাবৎ। আগামীকাল তাঁর আত্মজা হিমিকে পাত্রপক্ষ
দেখতে আসবে। কথা একরকম হয়েই আছে। ছবি দেখে পছন্দ করেছে এখন এসে শুধু পাকা কথা বলা বাকি।
কিন্তু পরক্ষণেই তাঁর মনে পড়ল কত কাজ এখনো বাকি, একটু আগে বের
না হতে পারলে সবকাজ গুছিয়ে শেষ করা যাবে না। শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে এটা ওটা বাদ পড়ে
গেছে। তখন টুনি কি আর ছেড়ে কথা বলবে? টুনি মারুফ সাহেবের সহধর্মীনি। ভাল নাম নাসরীন
বেগম। যে বয়সে তাকে সংসারে বৌ করে নিয়ে এসেছিল তখন তার খেলার বয়সও পাড় হয়নি; তাই আদর
করে বৌকে ডাকত টুনি। বয়সের সাথে সাথে সংসারও বড় হল কিন্তু আদরের নামটি এখনো ছোটই রয়ে
গেছে। এই ত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনে টুনি অনেক কিছু শিখেছে। যে টুনি বিয়ের পর মা’র
কাছে যাওয়ার জন্য আর পুতুলের বিয়েতে কেঁদে বুক ভাসাত এখন সে এক হাতে সংসার সামলায়।
একা হাতে মানুষ করেছে হিমি আর নিলয়কে। নিলয় মারুফ আর টুনি দম্পতির চেরাগবাতি। এখন ঢাকায়
থাকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এপ্লাইড ফিজিক্সে অনার্স করছে। পড়ালেখায় খুব ভাল, তাই তো
সবাইকে অবাক করে দিয়ে বুয়েটের মায়া ত্যাগ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। অবশ্য
টুনি নিজে খুব একটা পড়ালেখা না জানলেও ছেলেমেয়ে দু’টোকে চুল পরিমাণ ছাড় দেয়নি। তার
গুণেই তো ছেলেমেয়ে দুটো আজকে নক্ষত্রের মত জ্বলজ্বল করছে। সত্যিই সংসার সুখের হয় রমণীর
গুণে। দেখতে দেখতেই যেন পাকা গৃহিণী হয়ে গেল সেই ছোট্ট টুনি! এইসব ভাবতে ভাবতেই অফিসের
বাইরে পা বাড়ায় মারুফ সাহেব।
বাসায় ঢুকেই শুনতে পেল হিমির রুম থেকে ভেসে আসছে নজরুল সঙ্গীতের মধুময়
সুর। মেয়েটা যেন তার মনের কথা পড়তে পারে। বেছে বেছে সেই গানটাই গাইছে; “যারে হাত দিয়ে
মালা দিতে পার নাই, কেন মনে রাখ তারে, ভুলে যাও তারে ভুলে যাও, একেবারে__”; চুপি চুপি
মেয়ের ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে মারুফ সাহেব। গানের মধ্যেই যেন ডুবে গেল; হঠাৎ মেয়ের
দিকে তাকিয়ে থাকতে খুব কষ্ট হল তাঁর; এই সুখ তো আর বেশী দিন কপালে সইবে না। মেয়ে বড়
হয়েছে আজ না হয় কাল অন্যের ঘরে চলে যাবে। ভাবতে ভাবতেই চোখের কোণে জল চলে আসল তাঁর।
হিমি গানের ফাঁকে পলক ফেরাতেই দেখল বাবা তার রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। সলজ্জ চোখে বাবার
দিকে তাকিয়ে বলল, “বাবা কখন আসলে তুমি! আস ভিতরে আস; ওখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন?”
মারুফ সাহেব কোন রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে মেয়ের দিকে এগিয়ে গেল। হিমির
সামনে দাঁড়িয়ে হিমির হাত ধরে বলল, “দেখছিলাম আমার মেয়েটা কতটুকু বড় হল; আর ক’দিন পর
তো আরেকজনের সংসার সামলাতে হবে; তাই না!”
হিমি কোন কথা না বলে, বাবার বুকে মাথা লুকায়। মারুফ সাহেবও মেয়েকে বুকে
জড়িয়ে কপালে চুমু খেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। চোখদুটো আবারো জলে ছলছল করে উঠতেই নিজেকে
সামলাতে না পেরে দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে চলে গেল মারুফ সাহেব। হিমিও আবেগতাড়িত চোখে বাবার
চলে যাওয়া দেখল।
পরদিন জুম্মার নামাজ থেকে এসেই মারুফ সাহেব অতিথি আপ্যায়নের জন্য প্রস্তুতি
শুরু করে দিলেন। ছেলের মামা বলেছে বিকেল পাঁচটার মধ্যেই এসে পড়বেন। কথা আর কাজে যেন
কোন ব্যাতিক্রম ছিল না, পাঁচটার প্রায় দশমিনিট আগেই সোহেল সাহেব মানে পাত্রের মামা
তাঁর বোন রাহেলা বেগম, দুলাভাই ওসমান সাহেব আর পাত্র নাহিয়ান নূরকে নিয়ে হিমিদের দরজার
কড়া নাড়ল। সাথে সাথেই যেন এক উৎসবে মজে গেল পুরো বাড়ি। হিমির মামা, মামীও আগে থেকেই
চলে এসেছিল। মারুফ সাহেব সবাইকে ড্রয়িং রুমে বসাল। সোহেল সাহেব হাতে করে নিয়ে আসা মিষ্টির
প্যাকেটগুলো মারুফ সাহেবের হাতে দিয়ে যেন বাঁচলেন। সবাই হাসি মুখে নিজেদের পরিচয় পর্ব
শেষ করে ফেললেন। হিমির মামা মনির সাহেব যেন একাই একশ; নানান রকম গল্প কথায় সবাইকে মাতিয়ে
রাখলেন হিমির আগমনের আগ পর্যন্ত।
হিমি ট্রে হাতে ড্রয়িং রুমে ঢুকে একনজর সবাই দেখে নিল, মুখে মিষ্টি
একটা হাসি রাখতে ভুল করেনি মোটেও। একটা হলুদ কালারের পাঞ্জাবী সালোয়ারে পরীর মত লাগছে
হিমিকে। সবার দিকে একপলক তাকালেও নূরের ভাগটা যেন একটু বেশীই ছিল। কি ছেলেরে বাবা!
মেয়ে দেখতে এসে মাথা নিচু করে বসে আছে! তবে যতটুকু দেখেছে তাতে বেশ লাগল নূরকে; তারমানে
প্রথম দর্শনে অনেকটাই বাজিমাত করতে পেরেছে নূর। নামের মতই একটা শুভ্রতা আছে নূরের চেহারায়।
চাপ দাড়িতে বেশ মানিয়েছে ওকে। হিমি হাতে রাখা ট্রেটা সেন্টার টেবিলে রেখে সবাইকে হাতের
ইশারায় সালাম দিয়ে মা’র পাশে গিয়ে বসল।
সময়টা যে কিভাবে চলে গেল কেউই বুঝল না; কথায় আছে না সুখের সময় খুব তাড়াতাড়ি
চলে যায় আর দুঃখের সময় খুব ধীরে ঠিক তাই হয়েছে আজকে। কথায় কথায় যাওয়ার সময় হয়ে এলো।
এর মধ্যেই অবশ্য নূর আর হিমি সুযোগ পেয়েছিল আলাদা ভাবে কথা বলার; নিজেদের জানবার। এতেই
একরকম দুজনেই দুজনার প্রতি প্রবল আকর্ষন অনুভূত করল। তাই হয়ত যাওয়ার সময় দুজনেরই মনটা
খারাপ হয়েছিল কিছুটা। নূর আর হিমির সম্মতিতে সবাই খুব খুশি হয়েই মাসখানেকের মধ্যেই
বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে ফেলল শুধু শর্ত একটাই বিয়ের পর হিমিকে নূরের সাথে ঢাকায় চলে
যেতে হবে; নূর একটা সফটওয়্যার ফার্মে চাকরী করে। মারুফ সাহেব প্রথমে একটু ইতস্তত করলেও
হিমির সাথে কথা বলে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেল। সেদিনই নূরের বাবা হিমির হাতে আংটি পড়িয়ে
গেল। ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটে গেল যে হিমির মনে হল কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে অন্যের হয়ে
গেল, ক্ষণিকের ব্যবধানেই যেন এবাড়ির সবাই তার পর হয়ে গেছে। তারপরও নূরের কথা ভেবে খুব
একটা খারাপ লাগছিল না ওর। আর যাই হোক ছেলেটা বেশ ভাল। সবই ঠিক ছিল শুধু নিলয়ের না থাকাটা
ছাড়া। ছেলেটা ইদানিং খুব অদ্ভুত আচরণ করা শুরু করেছে। পরিবারের সাথে কেমন যেন একটা
দেয়াল তৈরী করে ফেলেছে। মারুফ সাহেবের কলিগ আসলাম সাহেব বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছেলেরা নাকি একটু আধটু ওরকম উদাসীন হয়ে থাকে জগত সংসারের প্রতি; মারুফ সাহেবও সরল মনে
বিশ্বাস করে মাথা নাড়েন। তবে হিমির বিয়ের পর যেহেতু ঢাকায় যাবে সেই ভেবে একটু স্বস্তি
বোধ করছিলেন। নিলয়ের সাথে অন্তত কেউ তো আপন থাকবে অচেনা শহরে। বিপদে আপদে কাছে তো পাবে
বোনকে।
দেখতে দেখতেই অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়ে এলো। আর দুইদিন পরেই নূর আর হিমির
বিয়ে। এই একমাসে দুজনে চুটিয়ে প্রেম করেছে। অবশ্য এটা প্রেম বলা যায় কিনা কে জানে;
দিনের মধ্যে আট থেকে নয় ঘন্টায় ফোনের মধ্যেই ডুবে থাকত হিমি আর নূর। এভাবে যে মনের
মত কাউকে পেয়ে যাবে কখনো কল্পনাও করেনি হিমি। হিমির ছিল খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষী; আকাশ ছোঁয়ার
স্বপ্ন দেখত সে! বিয়ে করা, সংসার করা এসবের কোন মূল্যই ছিলনা তার কাছে; বাবাকে ছেড়ে
যাবে সেটাও কি ভেবেছিল কখনো কল্পনাতে! কিন্তু কি হতে কি হয়ে গেল সে নিজেও জানে না,
দুই মাস আগেও যে ছেলেকে সে চিনত না তার সাথেই কিনা হাসি মুখে ঘর করার স্বপ্ন দেখছে
দিন রাত! সে যাই হোক আল্লাহ্ যাই করেন নিশ্চয় মঙ্গলের জন্যই করেন। এর মাঝেই বাড়িতে
আত্মীয় স্বজনের ভিড়। বিয়ে বাড়ির আমেজ এখন থেকেই শুরু হয়ে গেছে। সবাই আছে শুধু নিলয়
এখনো এসে পৌছাল না। এ নিয়ে মারুফ সাহেব ভীষণ ক্ষেপে আছে ছেলের উপর। একমাত্র বোনের বিয়ে
বলে কথা, কত কাজ পড়ে আছে এখনো। ছোট ভাই হয়ে কোন দায়িত্ব নেই! হিমি বাবাকে যতই ভাইয়ের
পক্ষে সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করছে ততই যেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠছে মারুফ সাহেব। অবশেষে
গায়ে হলুদের কিছু সময় আগে নিলয় এসে পৌছাল। একি বেশভূষা হয়েছে ছেলের! কেউ যেন চিনতে
পারছে না নিলয় কে; উষ্কখুষ্ক চুল, গাল ভর্তি দাড়ি আর পরণে নোংরা জিন্স আর খাদির হলুদ
থেকে খানিকটা ধূসর হয়ে যাওয়া পাঞ্জাবী। চোখ দুটো লাল যেন কয়েক রাত ঘুমোয়নি। তাকে দেখে
হিমি এক দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, “এই তোর আসার সময় হল! আর দুই দিন পর আসলে তো আমাকে
দেখতেই পেতিনা এই ঘরে।”
কেমন এক অদ্ভুত হাসি দিয়ে নিলয় হিমির গালে হলুদ লাগিয়ে দিল। এরপর কোন
কথা না বলেই আবার নিজের রুমে চলে গেল। গায়ে হলুদের রাতে বেশ মজা করল সবাই। নূরদের পরিবারের
কিছু মেহমানও এসেছিল গায়ে হলুদের রাতে। বেশ ধুমধাম করেই হল হলুদ অনুষ্ঠান; শুধু নিলয়ই
নিজের রুমে ছিল একা একা; বিষয়টি যে কেউ লক্ষ্য করেনি তা নয়। কিন্তু বিয়ে বাড়িতে এ নিয়ে
কেউ আর নতুন কোন ঝামেলা বাঁধাতে চায়নি। প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত নানা আয়োজনে শেষ হয় হলুদের
যত আয়োজন। মধ্যরাতে সবাই যে যার যার মত ঘুমিয়ে পড়ল। সকাল হতে না হতেই সবাই আবার ব্যস্ত
হয়ে পড়ল। হিমি ঘুম থেকে উঠেই সাজতে বসে গেল; সাথে খুব কাছে বান্ধবী অনামিকা আর শিমলা।
বাড়ির ছেলেরা সেই ভোররাত থেকে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে খাবারের আয়োজনে। কাছেই একটা কমিউনিটি
সেন্টারে ভোজের আয়োজন। আজকে নিলয়কে বেশ চনমনে দেখা যাচ্ছে। নিজ থেকেই কাজে হাত লাগাচ্ছে
দেখে মারুফ সাহেবের মন একটু খুশি হল। কিছুক্ষণ পর পর গিয়ে রান্না বান্নার তদারকি করতেও
ভুলছে না নিলয়। কমিউনিটি সেন্টার আর বাসায় যাতায়াত করতে করতে বেশ কাহিল হয়ে গেল নিলয়।
এগারটার কিছুক্ষণ পরই বরপক্ষ চলে আসল বাসায়। সবাই না অতি নিকট আত্মীয় যারা তারা আর
সাথে বিয়ে পড়ানোর কাজী। এর মধ্যেই হিমি নববধূর সাজে সজ্জিত, নূরও বেশ সুন্দর একখানা
পাঞ্জাবী চাপিয়ে এসেছে বিয়ে করতে। সবাইকে হালকা নাস্তা আর মিষ্টি পরিবেশন করল নিলয়
নিজ হাতেই। নূরের সাথেও এই প্রথম দেখা নিলয়ের। দেখতে দেখতে বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল।
কাজী হাতের ঘড়ি দেখে কন্যাকে নিয়ে আসার আদেশ দিলেন। অনামিকা আর শিমলা একটা পর্দার আড়াল
করে হিমিকে নিয়ে এলো। হিমি এসে নূরের বাম পাশে বসলে খানিকটা জায়গা দুজনের মাঝখানে ছিল।
কাজী সাহেব তার কাজ শুরু করে দিল। নূর আর হিমি যতটুকু ক্ষীণ সম্ভব স্বরে তিনবার কবুল
বলে নিজেদের আপন করে নিল। বিয়ের রেজিস্ট্রি বুকে স্বাক্ষর শেষে সবাই দুই হাত তুলে মোনাজাত
করল; নবদম্পতির সুখের জন্য সবাই সৃষ্টিকর্তার রহমত প্রার্থনা করল।
দুপুরের বিবাহভোজের পরপরই কন্যাবিদায়ের ক্ষণে এই আবেগঘন পরিবেশের জন্ম
দিল নিলয়। হিমিকে জড়িয়ে ধরে তার সে কি কান্না! একেবারে বাচ্চার মত হাউমাউ করে কাঁদতে
শুরু করল সবার সামনে। মারুফ সাহেব আর নাসরীন বেগম নিজেদের যতটুকু সামলে নিয়েছিলেন নিলয়ের
কান্নায় যেন সব বাঁধ ভেঙে দিল। সবার চোখে জল নিয়ে আসল নিলয়ের এমন ভগ্নীপ্রীতি। বেশ
খানিকক্ষণ এই পর্ব চলার পর কন্যাবিদায় দিলেন মারুফ সাহেব আর নাসরীন বেগম।
শ্বশুরবাড়িতে এই ক’দিনে বেশ মানিয়ে নিয়েছে হিমি। শ্বশুর শাশুড়ির যেন
প্রাণ ভোমরা হয়ে গেছে এই কয়েকদিনেই; তাইতো ঢাকায় যাওয়ার দিন শাশুড়ির কান্নার আওয়াজ
যেন নাসরীন বেগমের কন্যাবিদায়ের কান্নার চেয়েও বেশী প্রখর শোনা গেল কারো কারো কাছে।
ঢাকায় গিয়েই নিজের সংসার গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল হিমি। সারাদিন ঘরকন্যার কাজ সামলানোর
পর সন্ধ্যায় নূরের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা যেন তার নিত্যদিনের রুটিনে পরিণত হয়েছে।
তারপরও ভাল লাগে; এই অপেক্ষার মধ্যে একটা পূর্ণতার আভা আছে; ভাল লাগা আছে; ভালোবাসা
আছে। তাই রোজ সন্ধ্যায় শাড়ি পড়ে বসে থাকে কখন নূর এসে তার অপেক্ষাকে সার্থক করবে। আর
নূর আসার পর ভালোবাসায় হারিয়ে যাওয়া তো আছেই। নূরের সারাদিনের ক্লান্তি যেন নিমেষেই
দূর হয়ে যায় হিমির ভালোবাসার ছোঁয়ায়। লোকে বলে হৃদয় ভাঙ্গার নাকি কোন শব্দ হয় না, কিন্তু
হৃদয়ে ভালোবাসার যে এত বড় পাহাড় কিভাবে তৈরী হয় তা কি কেউ কখনো টের পায়? ভালোবাসার
পাহাড়ও যে নিঃশব্দেই গড়ে উঠে হৃদয়ে। পৃথিবীর সবচেয়ে দামী পাহাড়, হীরেরও নয়, সোনারও
নয় ভালোবাসার পাহাড়! নূরের জন্যও হিমির হৃদয়ে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে ভালোবাসার সুবিশাল
পাহাড়। নূরেরও হয়ত তাই। এই ভালোবাসার স্বাক্ষর রাখতেই হয়ত ঢাকায় আসার ছ’মাসের মধ্যেই
হিমি নূরকে এক সোনালী সন্ধ্যায় জানাল নূর বাবা হতে চলেছে। এই খবরে নূরের খুশির সীমা
বাঁধ ভাঙল। হিমিকে জড়িয়ে ধরে জানান দিল তার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। তাদের ভালোবাসা যে
আজই পূর্ণতা পেল।
পরদিন সকালেই হিমি নিলয়কে ফোন দিয়ে বাসায় আসতে বলল। একই শহরে থাকলেও
নিলয় খুব একটা আসে না হিমির বাসায়। প্রথম প্রথম হিমি খুব রাগ করত। কিন্তু নিলয় বাসায়
আসলেই হিমির কাছে টাকা চেয়ে বসে তাও একবারে কম না তিন চার হাজার টাকা। বাসায় আসলে বেশিক্ষন
থাকতেও চায় না। দিন দিন কেমন যেন রুক্ষতা চলে এসেছে নিলয়ের চোখে মুখে। হিমির তো আর
নিজের কাছে টাকা খুব একটা থাকে না। দিতে হলে তো নূরের কাছেই হাত পাততে হয়। নূর যে কিছু
বলেছে হিমিকে তা নয় তারপরেও ইদানিং হিমি নিজ থেকেই খুব একটা বাসায় আসতে বলে না নিলয়কে।
আজ হয়ত কিছু বলছে না কিন্তু সময় পরিবর্তন হতে তো আর সময় লাগে না। তাই ভাইকে খুব একটা
কাছে ঘেঁষতে না দেওয়াই উত্তম মনে করেছে হিমি। কিন্তু আজ তো খুশির দিন, এই দিনে ভাইকে
কাছে না পেলে হয়! তাই সকাল সকাল হিমি নিলয়কে আসতে বলল। প্রথমে একটু ঘায়ঘূই করলেও পরে
আসতে রাজি হয়েছে। নূরও আজ অফিস যায়নি বিকেলে হিমিকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে। নিলয়
দুপুরে এসে পৌছাল বাসায়। আজকেও সেই একই বেশভূষা। হিমি বেশ কয়েকবার বলেছে অভ্যাস বদলাতে
কার কথা কে শুনে! কোনরকমে দুপুরের খাবার খেয়ে যাওয়ার জন্য ছটফট করতে লাগল। নিলয় যে
মামা হতে চলেছে সে খবর দিল নূর, হিমি লজ্জায় ভাইকে বলতে পারেনি। তবে এতে নিলয়ের মুখে
আনন্দের কোন বিচ্ছুরণ দেখা গেল বলে মনে হল না হিমির। শুধু একটা শুষ্ক হাসি দিয়ে বলল,
“কনগ্রেচুলেশন!”, বলেই যাওয়ার জন্য সদর দরজার দিকে পা বাড়াল। আজ হিমি নিজ থেকেই ভাইয়ের
পকেটে কয়েকটা টাকা গুজে দিয়ে বলল, “এখন থেকে নিয়ম দিয়ে চলে গেল।
নতুন অতিথির আগমনের খুশি যেন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। চট্টগ্রাম থেকে মারুফ
সাহেব টুনিকে নিয়ে মেয়ের বাড়িতে আসল। ক’দিন থেকেই নাসরীন বেগমকে রেখে আবার একা ফিরলেন
চট্টগ্রামে। দেখতে দেখতে অতিথির আগমনের সময়ও সন্নিকটে চলে আসল। এখন খুব সাবধানে চলা
ফেরা করে হিমি। যেকোন সময় লেবার পেইনের যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে তাকে। নূর বেশ কয়েকবার
বলেছে যদি ভয় লাগে তাহলে সিজার করবে। কিন্তু হিমি নিজের সিদ্ধান্তে অটল প্রসব বেদনা
না সইলে মাতৃত্বের স্বাদ যে অপূর্ণ থেকে যাবে। যত কষ্টই হোক নরমাল ডেলিভারি করবে সে।
হঠাৎ এক সন্ধ্যায় হিমির বুঝতে পারল তার লেবার পেইন শুরু হয়ে গেছে। নাসরীন বেগম দেরী
না করে নূরকে ফোন দিলে কলিগের গাড়ি নিয়ে দশমিনিটেই এসে হাসপাতালে নিয়ে গেল হিমিকে।
পুরো রাস্তা নূর হিমির হাত ধরে ছিল এক অজানা আশংকা ঘিরে রেখেছিল তাকে। হিমিকে যথা সম্ভব
সাহস দেওয়ার চেষ্টা করছিল নূর। ঢাকা শহরের জ্যামের কাছে মানুষ যে কত অসহায় নূর সেদিন
বুঝতে পেরেছিল, হিমি অসহায় দৃষ্টিতে চেয়েছিল নূরের দিকে আর প্রসব বেদনার চিৎকার তার
সহ্য সীমাকে অতিক্রম করছিল বারবার। এসি গাড়িতেও দরদর করে ঘামছিল প্রতিটি মানুষ। নাসরীন
বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত রাখার চেষ্টা করছিল। হাসপাতেলের গেইটে পৌছাতেই একবার
মনে হল সব শেষ। হিমি একবারে নিথর হয়ে পড়েছে, চিৎকার করার শক্তিটুকুওমনে হয় তার ছিল
না। গাড়ি থেকে নামিয়ে তড়িঘড়ি করে স্ট্রেচারে উঠানো হল হিমিকে। সবাই ছুটছে; নূর ছুটছে;
নাসরীন বেগম ছুটছে আর তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটছে ঘড়ির কাঁটা। হঠাৎ এক গগনবিদারী
চিৎকারে সব কিছু যেন মুহুর্তেই স্তব্দ হয়ে গেল হাসপাতালের করিডোরে। স্ট্রেচারেই ঝাপসা
চোখে হিমি দেখছে সামনের রুমে বড় করে লেখা অপারেশন থিয়েটার। কিন্তু লাভ কি! সবই তো শেষ।
ঝাপসা চোখেই দেখতে পাচ্ছে নূরের পাগলের উন্মাদনা। ডাক্তারদের ছোটাছুটি। হঠাৎই মনে হল
এতদিন যে আদরের ভার বয়ে বেড়িয়েছে নিমেষেই যেন শূন্য হয়ে গেল। বুঝতে পারল তার জরায়ুর
বন্ধন ছিন্ন করে কি যেন একটা বের হয়ে গেল দু’পার ফাঁক গলে। এরপর আর কিছুই মনে নেই,
ধীরে ধীরে জগতের অন্ধকার গ্রাস করল হিমিকে। মনে হতে লাগল যোজন যোজন মাইল দূরে ছুটে
যাচ্ছে তার প্রাণ বায়ু। সবই যেন অসার। অমানিশা অমাবস্যায় যেন ছেয়ে গেছে পৃথিবীর আনাচ
কানাচ।
যখন একটু একটু আলো চোখের মধ্যে লাগল বুঝতে পারল, না সে মরেনি বেঁচে
আছে; কেউ একজন জোরে জোরে চিৎকার করে তার নাম ধরে ডাকছে। কেউ একজন গালে চড় দিয়ে দিয়ে
বলছে চোখ খুলতে। হিমি ধীরে ধীরে চোখ খুলল। কিন্তু চোখে যেন রাজ্যের প্রশ্ন, উৎকণ্ঠা।
হিমি লক্ষ্য করল তার চোখ খোলা দেখে সবার মুখে হাসি ফুটেছে। ডাক্তার বললেন এই তো সাবাশ,
এবার আপনি আপনার হাত পা নাড়াতে পারেন কিনা চেষ্টা করুন। হিমি অনায়াসেই সব করতে পারছে।
এরই মধ্যে চোখ বুলিয়ে নিল চারপাশে। হয়ত বুঝতে পেরেই ডাক্তার বলল আপনার ফুটফুটে একটা
মেয়ে হয়েছে। ভাল আছে। এতক্ষণে হিমি যেন একটু শান্তি পেল শুনে। তারপরও চোখদুটো তার রাজকন্যাকেই
যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে বারবার। তখন একজন এসে একটা মোটা কাঁথায় মোড়ানো একটা পুতুলকে হিমির
পাশে রেখে বলল, “এই তো আপনার মেয়ে! একদম আপনার মত দেখতে।”; খুশিতে হিমির চোখ দিয়ে জল
গড়িয়ে পড়ল। আজ তার সকল ত্যাগ সার্থক হল। এতক্ষণ যে নূর পাশে দাঁড়িয়ে ছিল খেয়ালই করেনি
হিমি। নূরকে দেখে কেমন যেন লজ্জা পেল, নূর হিমির কপালে চুমু দিয়ে বলল, “কনগ্রেচুলেশন
নিউ মম!”
নিলয়টা ইদানিং খুব বিগড়ে যাচ্ছে। কোন খোঁজখবর পাওয়া যায় না আজকাল, কোথায়
থাকছে, কি করছে কিছুই না। নূর এক বন্ধুর ভাইয়ের মাধ্যমে জানতে পারল গত দুই সেমিষ্টারের
পরীক্ষায় দেয়নি নিলয়; খারাপ বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে নেশা করে রাদিন হোস্টেলেই নাকি পড়ে
থাকে। অথচ বাড়ির কেউ জানেই না তার এই কীর্তির কথা। হিমিকে বলার পর খুব কষ্ট পেল, বাবার
জন্য খুব খারাপ লাগল হিমির; কত স্বপ্ন নিয়ে ছেলেকে ঢাকায় পাঠিয়েছিল। কত মেধাবী ছাত্র
ছিল নিলয়, এক সময় পড়ালেখা ছাড়া কিছুই বুঝত না যে ছেলে সে ছেলেকে এখন ফোন করেও পাওয়া
যায় না; পাওয়া গেলেও কথা শেষ না করেই কল কেটে দেয়। নূহির জন্মের পর মাত্র একবার এসেছিল
দেখতে তাও খালি হাতে। খুব কষ্ট পেয়েছিল হিমি। মামা বলে কথা। অন্তত ছোট্ট একটা খেলনা
তো নিয়ে আসতেই পারত। রাগের মাথায় একটু বকা দিতেই সেই যে হনহন করে বের হয়ে গেল এর পর
গত চার পাঁচ মাসে আর আসেনি বোনের বাসায়। বাবাকে নিলয়ের বিষয়টা বলবে বলে চিন্তা করে
রেখেছে হিমি, কিন্তু অযথা তাদের টেনশন হবে ভেবে এখনো বলা হয়নি।
আজ হিমি আর নূরের দ্বিতীয় বিবাহ বার্ষিকী; বেশ কয়েকদিন ধরেই দুজনে প্ল্যান
করছিল কিভাবে দিনটাকে সেলিব্রেট করা যায়! গতবছর নূহি পেটে থাকায় আর হিমির মা’ও বাসায়
থাকায় সেভাবে কোনকিছুই করা হয়নি ওদের। তাই এবার খুব আনন্দ করে কাটাবে বলে ঠিক করল দুজন।
ঠিক করল দুপুরে হিমি নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াবে নূরের সব পছন্দের ডিশ, তারপর বিকেলে
ঘুরতে যাবে কোথাও, ফেরার পথে ডিনারটা কোন এক চাইনিজ রেস্তোরায় সেরে আসবে। এই তো ম্পলের
মধ্যে গর্জিয়াস একটা প্ল্যান। যেমন ভাবনা তেমন কাজ; সকাল থেকেই হিমি ব্যস্ত হয়ে পড়ল
দুপুরের খাবারের মেনু তৈরীতে আর নূরের দায়িত্ব মেয়েকে সামলানো। মেয়ে অবশ্য বেশ বাপ
ভক্ত হয়েছে ঠিক যেমনটা হিমি ছিল মারুফ সাহেবের ন্যাওটা। বাপের কোলে থাকলে টু শব্দটিও
করে না। ইচ্ছে করেই নিলয়কে বলল না হিমি। যদি মনে থাকে তবে তারই চলে আসা উচিৎ। এটাকে
অবশ্য অভিমানও বলা যেতে পারে। দুপুরের খাবার বেশ মজা করেই খেল দুজন। আর ছোট্ট নূহি
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। লাঞ্চের পর নূহি যখন ঘুমের রাজ্যে ঢলে পড়ল তখন নূর এই
বিশেষ দিনে হিমিকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে এতটুকুও কার্পণ্য করল না। নিজেরাও একটু জিরিয়ে
নিয়ে বের হয়ে পড়ল ঘুরতে, বাসার কাছেই শিশুমেলা; হিমি বলল শিশুমেলায় গেলে নূহিরও ভাল
লাগবে। নূরও রাজি হয়ে গেল হিমির প্রস্তাবে। পুরো বিকেলটা মেয়েকে নিয়ে বেশ আনন্দেই কাটাল
হিমি আর নূর। সন্ধ্যার পরে কয়েকটা শপিংমল ঘুরে নূহির জন্য কয়েকটা জামা-কাপড় কিনে আটটার
দিকে এলাকার সবচেয়ে নামী চাইনিজ রেস্তোরা চিং-জ্যাং থেকে হিমির পছন্দের মেনুতেই ডিনার
করল। হিমির মনে হতে লাগল এত মজা, এত আনন্দ একদিনে এর আগে কখনো করেনি জীবনে। মনে মনে
নূরকে যে কত ধন্যবাদ দিল তার ইয়ত্তা নেই। আর চাইনিজের আলোআঁধারিতে হিমির ক্রমাগ্রত
দুষ্ট-মিষ্টি খুনসুটি তো আছেই। নূরকেও তখন বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল, নীলচে বেগুনী আলোয়।
নূহির তখন খানিকটা তন্দ্রা ভাব হওয়ায়, একটু যেন তড়িঘড়ি করেই শেষ করতে হল এই মধুময় রাতের
ডিনার; অনেক খাবার তখনো বাকি ছিল তাই নূর ওয়েটারকে বলে খাবারগুলো পার্সেল করে নিল।
রাস্তায় নেমে বাসার উদ্দেশ্যে একটা রিক্সায় চেপে বসল নূর আর হিমি। নূহি বাবার কোলে
আরামে ঘুমাচ্ছে। বেশ শক্ত করে ধরে বসেছে নূর যাতে রিক্সার ঝাঁকিতে মেয়ের ঘুম ভেঙে না
যায়! জীবন যে কত অদ্ভুত সেটা কল্পনাই করা যায় না; প্রতি মুহুর্তে নতুন কিছু উপহার দেয় জীবন।
সেটা হোক ভাল কিংবা মন্দ! নূর বা হিমি কেউ কি ভেবেছিল এত সুন্দর একটা সন্ধ্যা তাদের
জীবনে আসবে! কিন্তু সুন্দরটাই বা অসুন্দর হতে কতক্ষণ লাগে; বিধাতা নিয়তিতে কি লিখে
রেখেছেন সেটা কেই বা জানে? নূর আর হিমির জীবনে ঠিক তাই ঘটল সেই সোনালী সন্ধ্যার পর
আগত রাতে। রিক্সা কিছুদূর যাওয়ার পর অনেকটা অন্ধকারচ্ছন নির্জন রাস্তা দিয়ে যাওয়ার
সময় বাইকে থাকা ছিনতাইকারী প্রবল জোরে হিমির হাতে থাকা ব্যাগ টান দেয়। আর এতেই সম্পূর্ণভাবে
নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হিমি চলন্ত রিক্সা থেকে সজোরে আছড়ে পড়ে রাস্তার পাশে থাকা ল্যাম্প
পোস্টে। মাথায় প্রচন্ড আঘাতে মেষেই নিথর হয়ে যায় হিমির তাজা প্রাণ। কিছু বুঝে ওঠার
আগেই সব শেষ! নূর বিষ্ফোরিত চোখে চিৎকার দিয়ে বলে “হিমি__!”; বাবার চিৎকারে ঘুম ভেঙে
কেঁদে উঠে নূহি। রিক্সাওয়ালাটা অসহায়ের মত এদিক ওদিক তাকাতে থাকে। নির্জন রাস্তায় মুহুর্তেই
যেন শত লোকের ভিড় হয়ে গেল। সবার মুখে এক হাহাকার! চাইনিজের পার্সেল করা প্যাকেটগুলো
ছড়িয়ে আছে হিমির মাথার কাছে, রক্ত গঙ্গা বয়ে গেল রাস্তার পাশে ছোট্ট জীর্ণ নালায়। নূহির
কান্না যেন তীব্র থেকে তীব্রতর হল! এ যে মা হারানোর আর্তনাদ! নূর পাগলপ্রায়! কিছু সময়
যেতে না যেতেই পুলিশের সাইরেন! সাংবাদিকের ক্লিক ক্লিক! কি হচ্ছে এসব! শূন্য! সব শূন্য!
পরদিন নিলয়ের ঘুম ভাঙল বিকেল চারটায় বন্ধু ফারুকের মেসে! রাতে হোস্টেলে
ফেরা হয়নি তার; এটা অনেকটা তার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফোন হাতে নিয়ে
দেখে প্রায় এক’শর উপরে মিসড কল! বাবা, মা, দুলাভাই, বন্ধু রাজন, দীপ, সজল অনেকেরই নাম
লেখা মিসড কলের লিস্টে। নেশাগ্রস্ত লাল চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না যেন নিলয়; এত
মানুষ তার কেন খোঁজ করেছে! মা বাবার কিছু হয়নি তো! কাঁপা হাতে ঢুলতে ঢুলতে দীপকে কল
দেয় নিলয়। দীপ প্রথমবারেই কল রিসিভ করে। খুব অসহায় ভাবে জিজ্ঞেস করল, “তুই কই নিলয়?”
এরপর একে একে বলে গেল গতরাতে ঘটে যাওয়া সব কথা। জানতে পারে নিলয়ের দুলাভাই, হিমির লাশ
নিয়ে চট্টগ্রামের গেছে দুপুরের আগে। লাশ! হিমির লাশ! ব শুনে হঠাৎই যেন নেশা কেটে গেল
নিলয়ের। তার মনে পড়ল গতরাতে সেই রাস্তায়, হয়ত সেই বাইকের পিছন সিটে বসেছিল সে! তাহলে
কি! নাহ এ হতে পারে না! চিৎকার করে কান্না করে নিলয়; নিজেই নিজের নখ দিয়ে আহত করতে
থাকে হাত পা বুক। ফারুক তখনো বেঘোরে ঘুমিয়ে আছে মেঝেতে। নিলয় অসার পায়ে উঠে দাঁড়াল।
কাউকে কিছু না বলে থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করল। তাতে কি? হিমি তো আর ফিরে আসবে না; নূহি
তো আজীবন মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিতই রয়ে যাবে। নূর তো আর ফিরে পাবেনা হিমির সাথে কাটানো
সেই সোনালী সন্ধ্যাগুলো। আর নেশার রাজত্বে এভাবেই প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে হাজারো সোনালী
বিকেল, সন্ধ্যা, রাত__;