অজয় নদের বন্যায় ভেসে
যাচ্ছে সবকিছু। জমির ধান, চালাঘর, জালা ও মাটির কলস, ছাগল, গরু, ভেড়া, হাঁস আর একটা
কিশোরী। কালোদার কাঁধে একটা কালো ছাগল, হাতটা ফাঁকা। এক গলা জলে দাঁড়িয়ে কালোদা স্রোতের
দিকে এগিয়ে এসে কিশোরীর চুল ধরে আটকালো কোনোরকমে। টানতে টানতে নিয়ে এল গ্রামে। তারপর
নতুন পুকুরের উঁচু পাড়ে তেঁতুলগাছে বাঁধলো বাঁশ। বাঁশ আর ত্রিপল সহযোগে তৈরি করল গাছের
উপর ঘর। কালোদা একা মানুষ। অকৃতদার, পরোপকারী মানুষ। কিশোরীকে জিজ্ঞাসা
করল, কি রে তোর নাম কি? কোথায় তোর বাড়ি।
--- আমার বাড়ি কোপা
--- তোর মা বাবা কোথায়?
---- মা, বাবা রান্নাঘরের
চালায় বসে ছিল। তারপর জল বাড়লে ভাসতে ভাসতে চলে গেল নদের গর্ভে।
---- বলিস কি। আহা রে।
বেশ আমি আছি তোর বাপের মতন। ভয় করিস না। আমি তোকে দেখব।
- কিশোরীর সাহস বাড়ল।
কান্না থামিয়ে বলল, আমার খিদে পেয়েছে ।
কালোদা মুড়ি আর গুড় দিল।
কিশোরী খেয়ে শান্ত হয়ে বসল। আবার তার চোখে জল। তার মনে পড়ছে বাড়ির কথা। মা, বাবার কথা।
কালোদা কিশোরীকে গাছের
ঘরে রেখে চলে গেল বামুন পাড়ায়। একটা পানসি নৌকা জোগাড় করেছে কালোদা। ভাদু জেলের নৌকো।
ভাদু জেলে কালোদার বন্ধু। তাই তাকে বিশ্বাস করে। কালোদা নৌকো নিয়ে ভেসে যাওয়া ছাগল
আর হাঁসগুলো ধরে নৌকায় রাখছে। মালিক পেলে দিয়ে দেবে। তা না হলে নিজের কাজে লাগবে। বন্যায়
মাটির বাড়ি সব ভেঙ্গে পড়েছে। একটাও চালাঘর অবশিষ্ট নাই। বাবুদের দালানে বা স্কুলবাড়িতে
সবাই আশ্রয় নিয়েছে। খিচুড়ি আর পেঁপের তরকারি রান্না হয়েছে। সকলেই খাচ্ছে । কালোদা
খেয়ে নিল। কিশোরীর জন্য বাটিতে নিয়ে রাখল। মনে মনে কিশোরী নামটাই ঠিক করল
মেয়েটার । মেয়েটা এখন থেকে তার নিজের মেয়ে। কালোদার মনটা কন্যাপ্রাপ্তির আনন্দে নেচে
উঠল বর্ষার ময়ূরের মত। সে ভাবে,
বাড়ি গিয়ে মেয়েকে খিচুড়ি
দেবে। বাড়ি আর নেই। তেঁতুল গাছে ঘর বেঁধেছি অস্থায়ী ভাবে। সেইখানেই রাতে ঘুমোবো বাপ
আর মেয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে।তা না হলে ঘুমের ঘোরে পড়ে গেলে বিপদ হবে।
কালোদা স্রোতে ভেসে যাওয়া
অনেক মানুষকেও উদ্ধার করেছে। গ্রামের নয়নের মণি এই কালোদা। সকলের বিপদে আপদে
ঝাঁপিয়ে পড়ে এই মানুষটি।
তারপর তিনদিন পরে মানুষকে
নিঃস্ব করে বন্যার জল কমে গেল। ডি ভি সি জল ছাড়ে যখন ঠিক তখনই বন্যার জল নিচু গ্রামগুলির
ফসল নষ্ট করে বছর বছর। হত দরিদ্র এলাকায় এই গ্রামগুলি অবস্থিত। ফলে এখানকার লোক কাজের
সন্ধানে বাইরে চলে যায়। কেউ কেরালায় সোনার দোকানে কাজ করে আবার কেউ মুম্বাই হোটেলে
বাসন ধোওয়ার কাজ করে। গ্রামের জমিগুলো বাঁজা হয়ে পড়ে থাকে সারাবছর। তবু এখানে পৌষমাসে
পৌষলক্ষ্মীর পুজো হয়। যদি কোনোদিন লক্ষীর দয়া হয় তাহলে হয়ত ফসল ফলবে, বাঁজা জমি গর্ভবতী হবে।
কিশোরী এখন বড় হয়েছে।
প্রতিবেশিরা বলে এবার মেয়েটার বিয়ে দাও। ওর তো ভবিষ্যৎ জীবন আছে।কালোদা
সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। সে বলে, বিয়েতে তো অনেক টাকা লাগবে। কোথায় পাব গো? জানি না।
সকলে বললো, আমরা যতটা
পারব সাহায্য করব। কালোদা খুশি হয়ে বলে, তাই হবে। মুচকি হাসি কালোদার মুখে। তার অন্তর
কিন্তু অন্য কথা বলে। সে বাল্যবিবাহ সমর্থন করে না। নিজে সে নাম সই করতে পারে। নিজের
বেশিদূর লেখাপড়া না হলেও সে তার পালিত মেয়ে কিশোরীকে পড়াতে চায়। কিশোরী পড়াশুনায় খুব
ভাল। সে বলে, বাবা, বাবুরা আমাদের মূর্খ বানিয়ে রাখতে চায়। তাহলে তাদের শোষণের সুবিধা
হয়। বোকা মানুষের রক্ত খেয়ে ওরা নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। কালোদা অবাক হয়ে শোনে কিশোরীর
কথা। একটু একটু কথার মানেও বুঝতে পারে। সে বলে, কিশোরী, আমি তোকে লেখাপড়া শেখাব। তুই
বি ডি ও হবি, বড় অপিসার হবি। কালোদা বলে, আমি বিডি ও দেখেছি। বাবুরা ওদের পায়ে তেল
মাখায়।
আজ মহালয়া। কালোদা সকালে
ধুতি পড়ে বাবুদের বাড়ি চলে গেল। রেডিও, টি ভিতে মহালয়া শুনবে। বাবুদের বাড়ি
গিয়ে সকলকে ডেকে তুলল। তারপর সিঁড়িতে বসে শুনতে লাগল মহালয়া। বাবুরা উঁচু জাতের লোক।
কালোদা তাই জুতো খুলে বাইরে রাখে। দূরে সিঁড়িতে বসে। ধানের গোলার তলায় কাপ রাখা থাকে।
সেই কাপ কলে ধুয়ে বাবুদের বাড়ির চা খায়। বাবুগিন্নি খুব ভাল। কালোদাকে খুব ভালবাসেন
তিনি। চা দেন তার সঙ্গে ধুতির খুঁটে মুড়ি ঢেলে দেন দূর থেকে।
বাড়িতে, বাবুদের আজকে কেউ
নেই। কালেদাকে বাড়ির গিন্নির দেখাশোনার জন্য রেখে গেছেন। খুব বিশ্বাসী লোক কালোদা।
গিন্নিমা একটু প্রশ্রয় দেন কালোদাকে। তিনি বললেন, বোস খাটে বোস। আজ তো আমি একাই আছি।
বাইরের দরজা বন্ধ। কেউ দেখতে পাবে না। বোসো খাটে বোসো। কালোদা বলেন, কি বলছেন গিন্নিমা।
আমরা হলাম ছোট জাত। আপনাদের খাটে আমরা বসতে পারি না। গিন্নিমা বলেন, জানো আমার কষ্ট।
আমাকে মারধোর করে তোমার বাবু। তুমিএলে আমি একটু শান্তি পাই। আমি তোমাকে ভালোবাসি।
কিন্তু ভয়ে বলতে পারি না। তুমি আমার কথা শোনো। আমি তোমার কিশোরীর বিয়ের টাকা
দেব। তুমি আমাকে বাঁচাও। চল আজ আমরা দুজনে পালিয়ে যাই। কালোদা বলেন, আমি সব জানি। কিন্তু
আমি এত বড় বেইমানি করতে পারব না। বাবু আমাকে বিশ্বাস করে রেখে গেছেন। কি করে আমি তার
অমর্যাদা করি।
তারপর দুদিন পরে বাবু
বাড়ি এলেন তার কাজ সেরে। কালোদা বাবুকে বললেন, আমাকে পাঁচশো টাকা দেবেন। কোনোদিন আমি
টাকা চাই নি।খুব দরকার বলে চাইছি।
বাবু রাশভারি লোক। কিছুক্ষণ
চুপ করে থাকার পর বললেন, হুঁ, কি বলছিস।
---- আজ্ঞে, পাঁচশোটা
টাকা যদি দেন দয়া করে।
বাবু বললেন, অত টাকা
কি করবি রে কালো।
---- আজ্ঞে, বাইরে শহরে
যাব। মেয়েটার বিয়ে দোব।
----- গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে
যাবি। তা কি করে হয়?
---- হ্যাঁ এখানে থাকলে
আমি মেয়েটার বিয়ে দিতে পারব না। আমি আপনার টাকা শোধ করে দোব।
---- আমার বাড়িতে মেয়েটাকে
কাজে পাঠাস। বিয়ের ব্যবস্থা আমি করে দেব। দেখি না কেমন মেয়েটা। ও তো তোর নিজের মেয়ে
নয়। তোর আপত্তি থাকার কথা নয়।
---- না বাবু। আমি ওকে
স্কুলে পাঠাব। ওর খুব বুদ্ধি । মাষ্টার বলেছেন, ওর লেখাপড়া হবে। ওকে অনেকবড় করবো। দশজনের
একজন হবে।
---- বেশি পাকামো করিস
না কালো। যা বলছি শোন। কাল থেকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিবি। তা না হলে দীনু আর কিনু গিয়ে
নিয়ে আসবে তোর মেয়েকে। আরনাচ, গান যদি শেখে তাহলেও বড় হবে। আমার সামনে নাচবে। আমি সমস্ত
দায়ভার নোব। কিন্তু কোনেদিন বিয়ে করতে পারবে না। সংসারও হবে না। এটাই তো ভাল। কোনো
ঝুট ঝামেলা নেই। এই দীনু ওকে এখন দুশো টাকা দে তো।
--- না বাবু। ও টাকা
আমি নিতে পারব না। ও আমার মেয়ের মত। আমার প্রাণ থাকতে ওকে ছাড়তে পারব না।
---- তাই নাকি। আমার
মুখের উপর কথা। তুই তো দেখছি মাথায় উঠে নাচছিস। আজ রাতেই ওকে আমার শোবার ঘরে আনবি দীনু।
দরকার হলে মেরে লাশ বানিয়ে দিবি।
কালোদা কিছু না বলে বাড়ি
চলে গেলেন। ঠিক সেদিন রাতে কিশোরীকে বলল, বুঝলি আমরা শহরে পালিয়ে যাব। বাবুর বাড়িতে
মেয়েদের সম্মান নাই। তারা মানুষ নয় রে পশু। চল আমরা পালাই।কালোদা জানে দীনু আর কিনু
বাবুদের পোষা লাঠিয়াল। ওরা নির্দয়, গুন্ডা। রাতের বেলায় যখন পাড়ার লোকজন ঘুমিয়ে থাকবে
তখন কিশোরীকে ধরে নিয়ে গিয়ে বাবুর বিছানায় ফেলবে। এতদিন কালোদা সহ্য ক'রে ছিল একমাত্র
গিন্নিমার জন্য। অই বাড়িতে যেত ভালবাসার টানে। বাবুকে কালোদা ঘেন্না করে কিন্তু মনে মনে
কালোদা গিন্নমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছে। স্বপ্ন দেখতে দেখতে বিয়ে করার বয়সটাও চলে
গেছে।
ঠিক গভীর রাতে বাবুর
লাঠিয়াল আসার আগেই
কালোদা আর তার পালিত মেয়ে কিশোরী, ভালবাসার গ্রাম ছেড়ে চলে গেল চাঁপ পুকুরের পাড় দিয়ে
গড়গড়ে মাঠ পেরিয়ে ছোট লাইন স্টেশন।অন্ধকারে কাশফুল ফুটে আছে। সকাল হলেই ফুটে উঠবে দশদিক
আলো করে। কালোদা বলে, বুঝলি মা তোকে এই কাশফুলের মত ফুটে উঠতে হবে। দশজনের বুকে আলোর
রোশনাই ফোটাবি। তুই 'কোটিতে গুটি'র দলে হবি।
কালোদা কিশোরীকে বলে
কাশফুল শহরে দেখতে
পাবি না। কিশোরী কাশফুলের মায়ার শেকল ছিঁড়ে এগিয়ে গেল শিক্ষার আলোর টানে। তাকে বড় হতেই
হবে।
ট্রেন আসার পরে নতুন জীবনে প্রবেশ করতে চলেছে কাটোয়া শহরে,বাবা ও মেয়ে।
চার ঘন্টা পরে ওরা এক গ্রামে নামল। শহরে তারা গেল না। কালোদা বললো, গ্রামে মানুষ হয়েছি।
গ্রামই ভালো। এখানে আমি কালো হাজরা আর তুই হলি আমার মেয়ে শ্যামলী। আমাদের নতুন জন্ম
হল রে মা। এই বলে স্টেশনের পাশে একটা ত্রিপল খাটিয়ে রেলের জায়গায় ঘর তৈরি করল। ধীরে
ধীরেএই গ্রামের লোকদের সঙ্গে পরিচয় হল। শ্যামলী স্কুলে যায় আবার অবসর সময়ে আলে, খালে,
জমিতে মাছ ধরে। দুটো বাড়িতে কাজ করে বাচ্চা দেখাশোনার। কালোদা মুনিষ খাটে। এরপর ওদের
সঙ্গে দেখা
হয়ে গেল রাজুর । রাজু
এই গ্রামেরই সাহসী যুবক। সে বলল, আপনারা গ্রাম ছেড়ে যাবেন না। আমি আছি। আপনার বাবু
জোর করে ভয় দেখিয়ে অত্যাচার করে আপনাদের ভিটে ছাড়া করেছে । এখানে কেউ এরকম করলে তার
বিরুদ্ধে আমরা সমবেত হয়ে রুখে দাঁড়াব। কালোদা বলে, বড় ভয় গো। আবার পুরোনো কাগজ নাই
আমাদের , কোথায় যাব আমরা। রাজু বলে, ঠিক একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ও নিয়ে চিন্তা করবেন
না। কালোদা মন খারাপ করে উঠে যায়।
রাজু বামুন পাড়ার
ছেলে। পৈতে হয়েছে বৈশাখ মাসে। উপনয়নের পর উপবীত ধারণ করতে হয়। এই উপবীতের চলতি নাম
পৈতে। পৈতে কথাটি সমাজে বহুপ্রচলিত। বাহুতে গুরুদেব বেঁধে দিয়েছেন কবচ। রাজুদের বংশের গুরুদেব
বলেছেন, সমস্ত বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করবে এই কবচ আর পৈতে। সব কাজে
সফল হবে নিশ্চিতভাবে আর সারাজীবন রক্ষাকবচের মত আগলে রাখবে জীবন।
রাজু গরীব বামুনের ছেলে। দুবিঘে জমি, দুটো গরু আর গোটা দশেক ছাগল তাদের
সম্পত্তি। রাজুর পৈতেটা একটু দেরী করেই হয়েছে। তার ফলে গুরুদেবের আদেশ অনুযায়ী প্রায়শ্চিত্ত
করতে হয়েছে তার ফর্দমত। তার ফলে খরচ অনেকটা বেড়ে গেছে।
এখন তার বয়স উনিশ। বাবা মরে গেছেন অনেক আগেই। তার মা অই গুরুদেবের
কথামত সংসার চালান। পুজো, উপবাসে মেতে থাকেন মা। আর গুরুদেবের ফলাহার রাজু তাকিয়ে দেখে।
মা গুরুদেবের খাওয়ার শেষে তার উচ্ছিষ্ট খান। এটাই মায়ের গুরুর প্রসাদ।
গুরুদেব মাঝে মাঝে রাতে
রাজুদের বাড়িতে থাকেন। রাজু বোঝে সবকিছু কিন্তু চুপ করে থাকে। গুরুদেব মা কে বলেন,
আমার কথামত চললে তোমাদের ভাল হবে। এই ভাল হওয়ার লোভে রাজুর মা গুরুদেবের সব কথা মেনে
নেন। রাজুর মায়ের মিথ্যে রক্ষাকবচ হলেন গুরুদেব। এক অদৃশ্য দেওয়া নেওয়ার খেলা তিনি খেলেন
নিষ্ঠুর হৃদয়ে।
রাজু সকালবেলা মাঠে যায়।
সে বামুন হলেও লাঙল ধ'রে চাষ করে। ছোট থেকেই করে আসছে। বেশ গাঁট্টাগোঁট্টা চেহারা তার।
সকলে বেশ সমীহ করে চলে তাকে। পড়াশুনা বেশিদূর গড়ায় নি। বাবা মরে যাওয়ার পর থেকে
সংসারের দায়ীত্ব তার উপরেই ন্যস্ত। জমিতে কালোদার সঙ্গে দেখা হল একদিন। কালোদা বললো,ঠাকুরমশাই
তোমার হাতে লাঙ্গল দেখে ভালো লাগল গো। তোমরা যুবকরা যদি কাজ করো মাঠে, চাষের জমিতে
তাহলে এদেশের উন্নতি থামায় কে?
রাজু বললো, আমার ভাললাগে
গো। এই আকাশের তলে আমার ভাটিয়ালি ছড়িয়ে যাক আকাশে বাতাসে। কালোদা বলে আমার তাহলে কি
হবে। আমার মেয়ের কি হবে গো। কাগজপত্তর আমাদের নাই গো।
--- আবার আজেবাজে চিন্তা
করছ। দেখবে তোমার ভালো হবে।
---- না গো বুকে বড় কষ্ট
হচে গো। আমার কিছু ভাল লাগছে না।
--- জীবন যখন পেয়েছ,
বাসস্থানও পাবে কালোদা। মানুষকে ভরসা করো। ্যযাই এবার বাড়ি যাই কালোদা।
সকালে গরু ছাগল নিয়ে
মাঠে যায়। হাতে পাঁচন গলায় গামছা। লুঙ্গি পরে আলের উপর বসে থাকে। গরু ছাগল পালিয়ে গেলে
পশু ডাকিয়ে নিয়ে আসে ঘাসের বনে। পরের ফসল খেলে লোকে ছাড়বে না। এ নিয়ে অনেকবার ঝগড়া
হয়েছে রাজুর সঙ্গে জমির মালিকদের। একদিন রমেন মোড়ল লাঠি নিয়ে এসে বলল, তোর ছাগলে আমার
জমির ফসল খেয়েছে। খবরদার বলছি আমি কিন্তু ছাড়ব না। এই লাঠি মেরে মাথা ফাটিয়ে দোব। রাজু
বললো, বেশ কাকা আর হবে না এই ভুল। আমি নজর রাখব। সঙ্গে সঙ্গে মোড়ল নরম সুরে বলল, তোমরা
হলে গিয়ে বামুনের ছেলে। বলতে খারাপ লাগে। বুঝলে তোমার বাবাকে আমি দাদা বলে ডাকতাম।
রাজু বলল,মায়ের কাছে শুনেছি সব। তবে আপনার ফসলের ক্ষতি হলে তো রাগ হবেই। আমি এবার ভাল
করে লক্ষ্য রাখব। মোড়ল বললেন, বেশ বাবা বেশ। বেঁচে থাক।
রাজু ভাবে ফসলের মাঠে
গরু, ছাগল চড়ানো খুব কঠিন। কখন যে কার মাঠে নেমে যায় বোঝা মুস্কিল। সে ভাবল, কাল থেকে
অই পাকা রাস্তার ধার ঘেঁষে বারেন্দা গ্রামের কাছাকাছি জঙ্গলে যাবে গরু চড়াতে। ওখানে
ফসলের জমি নাই। নিশ্চিন্তে বসতে পারবে। মাকে বলে, জলখাবার সঙ্গে নিয়ে যাবে।
পরের দিন রাজুর মা সকাল
থেকে আলুভেজে দিল আখের গুড় দিল আর এক জামবাটি ভরতি করে মুড়ি দিল। রাজু গামছায়
বেঁধে গরু, ছাগলের দড়ি খুলে পাঁচন হাতে চলে গেল জঙ্গলে। সেখানে গিয়ে দেখল ঘাস আছে পাতা
আছে। আর ভিড় কম। পাশে ক্যানেলের পরিষ্কার জল। সেখানে মাছ ধরছে হাজরাদের একটা মেয়ে।
রাজু ভাবল, কি সুন্দর দেখতে মেয়েটা। উবু হয়ে মাছ ধরছে। মেয়েটা রাজুকে দেখতে পায় নি।
একটু পরে রাজু ডাকল, ও মেয়ে, তোর নাম শ্যামলী নয়? শ্যামলী বলল, হুঁ।
----- তুই রোজ এখানে
আসিস মাছ ধরতে?
--- হুঁ
--- আমাকে চিনিস তো।
কালোদা আমাকে চেনে।
---- হুঁ
আয় এখানে আয়। দুজনে মুড়ি
খাই। তোর মাছ নেব না। আয়। কোন ক্লাসে পড়িস।
--- এবার টুয়েলভ হবে।
তারপর কি হবে জানি না। বাবা খুব ভয়েভয়ে আছে। কবে যে ডিটেনশন ক্যাম্পে যেতে হবে?
--- ভয় নেই। গুজবে কান
দিবি না।তুই তো আমার থেকে পড়াশোনা করেছিস বেশি। তাহলে তু তো বুঝবি নাকি। আমি ওসব বুঝি
না বাপু। সবাই ভাল থাকুক বুঝলি, তবে ভাল লাগবে।
----না, সবাই বলছে আসামে
কি হয়েছে? কি হয়েছে ঠিক জানি না। বাবা শুধু পাগলের মত আজেবাজে বকছে।
--- ওসব আমিও বুঝি না
রে। সবাই না জেনে না শুনে কথা বলে বেশির ভাগ বুঝলি। আর আমি তো অশিক্ষিত । ওসব বুঝি
না।
শ্যামলী হাত, পা ভাল
করে ধুয়ে চলে এল রাজুর কাছে। রাজু গামছায় মুড়ি ঢেলে দিল। দুজনে গল্প করতে করতে খেল।
তারপর দুপুর হলে দুজনে চলে এল নিজের নিজের বাড়ি। এক টুকরো আকাশে ওরা সুখেই থাকে।
রাজু গোয়ালে গরু বেঁধে,
হাত পা ধুয়ে স্নান সেরে নিল। তারপর দরজার কাছে এসে দেখল দরজা বন্ধ। দরজায় একটা ফুটো
আছে। চোখ লাগিয়ে দেখল, গুরুদেব মা কে নিজের উলঙ্গ দেহ দিয়ে ঢেকে ফেলেছে। মাকে দেখা
যাচ্ছে না। তাহলে কি মাকে বশ করেছে কবচ পরিয়ে? আমাকেও দিয়েছে কবচ। রাজুর রাগ হল। কিন্তু কোন আওয়াজ না
করে চলে গেল গোয়ালে।
প্রায় কুড়ি মিনিট পরে
রাজুর মা রাজুকে দেখতে গোয়ালে এল। রাজুর মা বলল, আমি তোকে না দেখে একটু শুয়েছিলাম।
আজকে তোর দেরী হল কেন? রাজু বলল, মা আমার খিদে পেয়েছে। খেতে দাও। আমি এখানে বসে
খাব।
তারপর বর্ষা এল। নদী,
পুকুর, খাল, বিল সব কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেল। শুধু পূর্ণ হল না রাজুর মন। গুরুদেবের
প্রতি ঘৃণায় তার মন খারাপ ছিল। কিন্তু এখনও সেই ঘটনা ঘটে চলেছে। রাজু জানে, মানুষের
জীবনে কিছু ঘটনা মনের কোণে থেকে যায়। তার প্রতিকার হয় না কোনোদিন।
রাজু এবার চাষ করেছিল
সময়ে। কিন্তু বন্যায় ধানের চারা ডুবে থাকল দশদিন। সব পচে গেল। পচে গেল সমস্ত কৃষকের
আশা আকাঙ্খা সবকিছু। আর কদিন পরেই শরৎকালের দুর্গাপুজো। সবাই নতুন জামা, কাপড় কিনবে।
কিন্তু এই গ্রামের লোকগুলো খালি গায়ে গামছা কাঁধে ঘুরবে। রাজু শ্যামলীকে এইসব কথা বলে।
রাজু বলে, তোকে একটা শাড়ি দোব ভেবেছিলাম, কিন্তু কি করে দোব?
শ্যামলি বলে, দিতে হবে
না গো। তুমি শুধু এমনি করে আমাকে জড়িয়ে থেক।
রাজু আর শ্যামলী দুজনে
দুজনকে ভালবাসে। তারা বিয়ে করবে। কিন্তু বামুনের সঙ্গে হাজরা বা হাড়ি জাতের বিয়ে সমাজের
সেনাপতিরা মেনে নেবে না। ওরা ঠিক করল, পালিয়ে গিয়ে ওরা বিয়ে করবে পরে। ততদিনে
রাজু ভাবে, একটু গুছিয়ে নেব নিজেকে। টাকা, পয়সা জমিয়ে রাখব। তারপর বিয়ে,সংসার।
প্রায় দুবছর পরে রাজু
আর শ্যামলী ঠিক করল দুদিন পরে তারা শিবলুন স্টেশনে ট্রেন ধরবে। তারপর বহরমপুরে চলে
যাবে। ওখানে নিশ্চয় কাজ পেয়ে যাবে। তা না হলে কুলিগিরি করবে। ওদের ঠিক চলে যাবে।
রাজু আজ বাড়ি গিয়ে গুরুদেব
আর মা কে দেখতে পেল। গুরুদেবের দয়ায় মায়ের খাওয়া পরার অভাব নেই। মেয়ের বয়সী রাজুর মা।
গুরুদেব এই মেয়ের
বয়সী অসহায় বিধবার সঙ্গে যে খারাপ দৃষ্টি দিতে পারে, এই ধারণা গ্রামের সরল মানুষের
ছিল না। আর রাজুর দেখা সেদিনের ঘটনা একমাত্র শ্যামলী বিশ্বাস করে। আর কাকে বলবে সে।
এই ঘটনার সঙ্গে যে মা জড়িত। মা যদি লজ্জায় গলায় দড়ি দিয়ে বসে তাহলে রাজু তো মাতৃহারা
হবে। তাই নিজের পায়ে কোপ রাজু মারতে চায় না। নিজের মত করে পরবর্তী জীবন সে আনন্দে কাটাতে
চায়।
হঠাৎ একদিন গুরুদেব রাজুকে
কাছে বসালেন। বললেন, তুই নিজেকে খুব চালাক মনে করিস নয়? রাজুর মা
বললেন, কেন কি করেছে রাজু?
গুরুদেব বললেন, তোমার
ছেলে হাড়িদের মেয়ের সঙ্গে ঘোরে।মাখামাখি করে। ওদের পাড়ার অনেকে দেখেছে। আমাকে বলেছে।
রাজু বলল, হ্যাঁ, আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।
গুরুদেব বললেন, আমি হতে
দেব না। তুই বামুনদের ছেলে। সমাজ মানবি তো হতভাগা। রাজু বলল, আপনার মুখোশপরা সমাজ আমি
মানি না। আমি জাতপাত মানি না। এই বিয়ে হবেই। কোনো শক্তি এই বিয়ে আটকাতে পারবে না। প্রয়োজনে
প্রাণ দিয়ে দেব।
রাজুর মা চিৎকার করে
বললেন, কাকে কি
বলছিস তুই? এই বিয়ে
হলে আমার মরা মুখ দেখবি। আমি গলায় দড়ি দেব।
গুরুদেব বললেন, ছি ছি
রাজু। মায়ের কথা চিন্তা না করে তুই দেহের কথা চিন্তা করছিস। ছি ছি।
রাজু আজ রেললাইনের ধারে
ধারে কাশবনের ভিতর দিয়ে চলেছে কালাদার বাড়ি। নাকি শ্যামলীর কাছে। রাজু ভাবে একবার করে
ওর দেখা না পেলেখুব খারাপ লাগে। যাই একবার। শ্যামলি বলছিল, আজেবাজে মতলবে কিছু মাতাল
ওদের বাড়ির আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে। একদিন পুকুরে নাইবার সময় শ্যামলীর ভিজে আঁচল খুলে
ফেলেছিল এক মাতাল। কোনোরকমে লজ্জা নিবারণ করেছে সে। ছুটে পালিয়ে এসে চিৎকারকরে লোক
ডেকেছিল। তবেই বাঁচোয়া। রাজু ভাবল, আর দেরী নয়। খুব তাড়াতাড়ি তারা বিয়েটা সেরে নেবে।
আর একা একা থাকতে ভাল লাগে না। অন্য কোন গাঁয়ে...
রাজুর রাগ হয়। সে হঠাৎ
চেঁচিয়ে বলে, আমি আমার বাড়িতে থাকব। কোন শালার সাহস আছে দেখি। শালা গুরুদেবের আজই একটা
হেস্তনেস্ত করব। মা কে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে শালা। রাজুর চিৎকারে শ্যামলী বেড়িয়ে
আসে ঘর থেকে। বলে, আরে কার সঙ্গে কথা বলছ। রাজু বলে, আমি নিজেই নিজেকে বলছি। ওসব কিছু
না।
রাজু বলে, কালোদা কোথায়?
---সকাল থেকে কোথায় বেরিয়েছে
জানি না। বলছিল আজ কাজে যাবে না। রাজু শ্যামলীকে একলা পেয়ে ঘরের ভিতরে একটু আদর করল।
সুপুষ্ট উন্মুক্ত স্তনে ডলে দিল প্রেম। প্রবাহ নিচে নামতেই শ্যামলী হাত চেপে ধরল। বললো,
এখন না। বিয়ের পরে।
তারপর হঠাৎ একটা মেয়ে
শ্যামলীর বান্ধবী ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিল, কালোদা গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে বটতলায়। মেলা
লোক জড়ো হয়েছে। শ্যামলী কাঁদতে কাঁদতে ছুটে চলে গেল বটতলায়। তারপর গেল রাজু। তখন সব
শেষ। পুলিশ এক ঘন্টার পরে এল। বডি নিয়ে চলে গেল।
থানার অফিসার বললেন,
আত্মহত্যার কারণ জানা গেছে কি?
রাজু বললো, উনি মানসিকভাবে াঅসুস্থ
ছিলেন।
পুলিশ বলেন, আপনি কে।
---আজ্ঞে আমি গ্রামের
ছেলে। শ্যামলীকে এগিয়ে বলে, উনি হচ্ছেন কালোদার মেয়ে।
----ও, আই সি। আচ্ছা
আপনারা তিনঘণ্টা পরে ডেডবডি পাবেন। এখন আসতে পারেন।
তারপর দুজনে রাতের
বেলায় পাড়ার লোকজন নিয়ে থানায় গিয়ে কাটাছেঁড়া মরদেহ নিয়ে গেল শ্মশানে। সব মিটে গেলে
রাজু মনস্থির করল, আর দেরী নয়। বিয়েটা সেরে ফেলব তাড়াতাড়ি । তা না হলে শ্যামলীকে ছিঁড়ে খাবে শকুনের
দল।
রাজু বিয়ের কথা মাকে
জানাল। রাজুর মা বললেন, এ বিয়ে আমি মানতে পারব না। বংশের নাম ডোবাবি তুই।
রাজু মা কে বলল, মা হয়ে
তুমি ছেলেকে সাজা দেবে? ওর সঙ্গে বিয়ে না হলে আমি মরে যাব। আমি শ্যামলীকে ভালবাসি।
তুমি না মানলে আমরা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করব।
রাজু ছুটতে ছুটতে নতুন
পুকুরের পাড়ে গেল। রাজুর মা ও ছেলেকে ডাকছেন, রাজু ফিরে আয়। রাজু ফিরে আয়।
রাজু দূর থেকে দেখল শ্যামলী
ছুটতে ছুটতে শিবলুন স্টেশনে যাচ্ছে। এখন তাকে কোনো বাধা আটকাতে পারবে না।
আজ তাদের পালিয়ে বিয়ে
করার দিন। রাজু অবাক চোখে দেখে, শ্যামলী খোলামাঠে হৃদয় মেলে আনন্দে মেঘ হয়ে
ভাসছে।
রাজু ভাবল, এই আনন্দ
ম্লান হয়ে যেতে পারে না।সে ও হাওয়ায় উড়তে চায়।
রাজু অসহায় । সে ভেবে
পাচ্ছে না কি করবে? একদিকে শ্যামলী তার প্রাণের বাঁশি আর একদিকে মা, রাজুর
শ্রেষ্ঠ দেবী।
গুরুদেবের সমস্ত মিথ্যা
কথা রাজুর মনে পড়ছে। কবচ পরলে নিশ্চিতভাবে সকল কাজে সফল হওয়া যায়। পৈতে থাকলে সিদ্ধিলাভ
হয়। কই রাজুর জীবন তাহলে ব্যর্থতায় ভরা কেন? রাজু ভাবে, এইসবকিছু গুরুদেবের বানানো কথা। শাস্ত্র কখনও
জাতিগত ভেদাভেদ করে নি। পৃথিবীর কোন ধর্ম কোন মানুষকে ছোট করে নি।শুধুমাত্র গুরুদেবের
মত স্বার্থপর লোকেরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এইসব নিয়ম চালু রাখেন সমাজে। রাজু এই মুখোশ একা খুলতে পারবে
না। তবু
নিজের জীবনে তো নিজের ইচ্ছেমত থাকতে পারবে। সে মা কে বুঝিয়ে বলবে। মা
নিশ্চয়ই বুঝবে।
রাজু অনেক আশা নিয়ে পৈতে খুলে ফেলল। কবচ খুলে ফেলল। দুটো বিষফলের মত, কুসংস্কারের
বোঝা ছুঁড়ে ফেলে
দিল পুকুরের জলে। আর কখনও বিষফল দুটো রাজুর ভাবনার বাধা হতে পারবে না। রাজুর মনটা হাল্কা
হল।
তারপর দৃপ্ত পদক্ষেপে
হাঁটা শুরু করল মানুষের মনের কুসংস্কার মুছে ফেলার সংকল্প নিয়ে...