ফুলমতির একমাত্র ছেলের বয়স যখন তিন বছর তখন তার মাতাল স্বামী মারা
যায়। নোঙরবিহীন দারিদ্রের মধ্যে হাবুডুবু খেতে খেতে গ্রামের পূর্ব পরিচিত কালু মিস্ত্রির
কাছে পায় ফুলমতি পাড়ের সন্ধান। ভরা যৌবনা অপূর্ব সুন্দরী ফুলমতি আজ কালু মিস্ত্রিরির
বাঁধা লেবার। কালুর শান্ত সভ্য স্বভাব যেন বারবার নিঃশব্দ অভিব্যক্তিতে ফুলমতিকে বুঝিয়ে
দেয় - আমি তো আছি, ভয় কিসের? এদিকে কালুর সংসারে বৃদ্ধ ,বাবা-মা এবং দুটি সন্তান
। কালুর স্ত্রী-র ফুলমতিকে পছন্দ নয়। একদিন বলেই ফেলে, তোর তো ফুলমতি আছে, আর কী লাগে?
কালু সেদিন বৌকে খুব মেরেছিল। পরদিন টিফিন খাবার সময় ফুলমতিকে বলে- কাল বৌ-টারে খুব
মেরেছি। ফুসে ওঠে ফুলমতি। বলে তোদের পুরুষদের আর কী? আমিও কি আগে কম মার খাইছি! ফুলমতি
জিঞ্জেস করে,তা- কেন মারলি? ----এই তোরে নিয়ে খোঁটা। মাথাটা চটে গেল। আমি তো তোরে
হাজিরা ছাড়া কিছুই দিতে পারি না, তুইও আইজ পর্যন্ত কোনও দিন কোনও আবদার করিস নাই।
আমারে ছাইড়া অন্য কোথাও গেলে কত কি ------ ফুলমতি কালুর মুখ চেপে ধরে, মুহূর্তেই হাত
নামিয়ে নেয় -- পাছে কেউ দেখে ফেলে। এবার ফুলমতি বলে - আমারে ছুঁয়ে কথা দে, বৌরে
কোনও দিন মারবি নে। বৌ ঘরের লক্ষ্মী। ফুলমতিকে স্পর্শ করে কালু। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে
থাকে মূক বিহ্বল হয়ে ফুলমতির চোখে চোখ রেখে। এই ভয়াবহ প্রতীক্ষমাণ নিবিড়তার স্পর্শ
যেন অদৃশ্য বাধা-নিষেধের দেওয়াল ভেঙে তলিয়ে যেতে থাকে ধীর স্পন্দ এক ঘন স্রোতে ।
জেগে ওঠে সৃজন বারুদ। দ্বন্দ্বের প্রবলতায় নেমে আসে দীর্ঘশ্বাস। চুপি চুপি সময়টা
বেঁধে ফেলে দু-জনেই। পাপড়ি ফোটানো গোলাপের রং ছড়িয়ে স্তব্ধতা ভাঙে ফুলমতি। বলে,
আমি অন্য কোথাও গেলে কে আমারে এ-ভাবে ভালোবাসতো? দেখতে দেখতে সময়ের মান্যতা রেখে কেটে
যায় পনেরটা বছর।
একদিন কাজের জায়গায় এসে ফুলমতির ছেলে ডাকতে থাকে মা-মা। ব্যতিব্যস্ত
হয়ে এগিয়ে আসে ফুলমতি, পেছন পেছন কালু-ও। ভাদ্রের রোদের তালপাকা আঁচে তখন
ফুলমতির মুখটা থকথকে লাল। পরিশ্রান্ত ক্লান্ত ফুলমতির ঘামে ভেজা মুখের দিকে তাকিয়ে
ফুলমতির ছেলে বলে, মা- তোমাকে আর এত কষ্ট করতে হবে না। আমার চাকরিটা হয়ে গেছে। এখন
থেকে তুমি আরাম করবে বাড়িতে।এই বাস্তবটাকে অবাস্তব মনে হয় ফুলমতির। গোপনে কালুর দৃষ্টি
চুরি করে। ছলছল চোখে নিজেকে আড়াল করে কালু। ফুলমতির ঝাপসা চোখ বন্ধ হয়ে আসে। কানে
বাজে ছেলের নিশ্চিন্ত প্রতিশ্রুতি।