গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ২৬ জুলাই, ২০২০

বৈশাখী চক্রবর্তী

ঝাপসা দুর


ইশিতার বার্তা আলোর মত আসে। অনেক দিন পরে পরে কিন্তু আসে শরতের ভোরের আলোর মত। জীবনকে সবাই জিতে নিতে পারে না, কেউ কেউ পারে। ইশিতা পেরেছে। বন্ধু হলেও  তাই ও খুব সম্ভ্রমের জায়গায়।
          আজ বার্তা নয়, ফোন এলো। এলো খুব ভোরে, দিল্লী থেকে।দেবাঞ্জনদা খুব অসুস্থ। পারলে একবার দেখা করে আয়।তারপর হসপিটালের বেড নাম্বার। আর একটা ফোন নাম্বার সোহাগ মিত্রের। আর কিচ্ছু না। কোথায় যেন বেরিয়ে যাচ্ছে বলে কেটে দিল।
       আমার এক বন্ধু খুব অসুস্থ, একবার দেখা করে এলে ভাল হয়।
      কাল তো শুক্রবার, পরশু চলো। কোথায় আছেন?’
      ঠাকুরপুকুর —’
একটা জায়গার নাম,  কিন্তু যেন মৃত্যুরই সমার্থক। যেন শ্মশান । পুরোটা বলতেও হল না।
দাঁড়াও দেখছি।
          কেন যাবো? কী করে সামনে গিয়ে দাঁড়াবো? ঠিক কেমন আছে? কতটা খারাপ? বাড়ির লোকেরা, বিশেষত সোহাগ কী ভাববে? সারাটাদিন ভেবেছি , ভেবেছি তারপর আর্জি পেশ করেছি, আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আর্জি মঞ্জুর, তাতে ভাবনা আরো বাড়লো বই কমলো না। যদিবয়স শুধু ভাবতে শেখায়।
জীবন জুড়ে শুধু যদি। এতো অনিশ্চয়তা!

আমাকে দুর ডাকছে।
কোনো বৃদ্ধ বটের গুঁড়ি,
নেমে আসা অজস্র শাখামূল,
কোনো প্রাচীন শিলালিপি
এক ব্রাত্য বাতিস্তম্ভ
নির্মম ভগ্ন ইতিহাস
রেশম বোনা সুখ
আবছা কোনো মুখ
মনের ভিতর ভীষণ কষ্ট অস্থিরতা ভাবনা ভয়  সব একসঙ্গে এক অদ্ভূত অনুভূতি। গ্র্যান্ডফাদার ক্লকের পেন্ডুলামের মত  দুলছি, কখনো অতীতে কখনো বর্তমানের মাঝে।  স্কোয়াশ  বলের মত বার বার কষ্টের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসা। ফিরে আসা। আমি কি খুব বড় পাপী? নইলে এই ঘোর বর্ষণ পার করে আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের অতীতের সামনে দাঁড়াতে হবে কেন? তাও এমন নিরুপায় ভাবে? এমন ভাবে মৃত্যুমুখী প্রিয় মানুষটার সামনেই।

          আশ্বিণে প্রবল বৃষ্টি, এখন ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। হয়তো মাতৃপ্রতিমার শরীরে রঙ স্প্রে চলছে, হয়তো ড্রায়ার দিয়ে শুকানো হচ্ছে এ্যাক্রেলিক রঙ। হয়তো দো-মেটে প্রতিমা  গ্রিক ভাস্কর্যের মত দৃষ্টিহীন যুদ্ধ ভঙ্গিমা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষা করছে মানুষের হাতে দৃষ্টি পাবার। বছরের সেরা উৎসবের জন্য ভেতরে ভেতরে তিলে তিলে প্রস্তুত হয়ে উঠছে শহর। কিন্তু কলকাতার পথে, বেহালার বেহাল রাস্তায় তা বোঝার উপায় নেই। অন্য সময় হাঁ করে দেখতে থাকি চাকার আঘাতে জলের বকের ডানার মত ছিটকে নিজেকে মেলে দেওয়া। নানা রঙের ছাতা। নানা অস্বাচ্ছন্দ্য। মানুষের অসন্তুষ্ট মুখভঙ্গি। কলকাতার রাস্তার জমা জলে বকখালির সমুদ্র ঢেউ। বৃষ্টির থেকে মানুষের নিজেকে অকারণ বাঁচানোর চেষ্টা। তারই মাঝে এক দুজন আমাদের মত। ভালবেসে বৃষ্টি মাখা মানুষ। দেবাঞ্জনদা বলতোআমরা বৃষ্টিবহুল। আমি হাসতাম। বৃষ্টিবহুল, অব্যর্থ শব্দ। মানুষ মাত্রেই বোধহয় তাই।জানিস একটা মেয়ে,সে ক্রমাগত পাল্টে পাল্টে যায়! সারাদিন। কখনো মা, কখনো বোন, কখনো বন্ধু কখনোসখনো —’
তুমি নির্ঘাত  ঘোর প্রেমে পড়েছ তার।
বৃষ্টি যেমন মাটির প্রেমে পড়ে? নাকি আকাশ যেমন সমুদ্রের?’
এতো কাব্য জানিনা। তাকে বলে ফেল।
সোহাগের নাম আমি জানতাম। দেবাঞ্জনদার মুখেই শুনেছি। ছোট ছোট অনেক গল্প। কোএডূুকেশন স্কুলে পাশাপাশি  বসার গল্প। প্রথম ভাললাগার গল্প। ছড়ায় লেখা চিঠির গল্প। টিফিন ভাগ করে খাবার গল্প। তারপর প্রথম স্কুল বাসের আড়ালে ঠোঁটে ঠোঁট রাখার গল্প। তাই আমার বলা সহজ ছিল—‘এবার প্রপোজটা করে ফেল। সোহাগ যা সুন্দর ! তোমার সোহাগকে কেউ ছিনিয়ে নিলে? ’চুপ করে কী যেন ভাবতো। অনেক পরে অনেক ভেবে বলতো—‘বয়সের সঙ্গে সঙ্গে প্রেমের মানেও পাল্টে যায়। ভাব ভার প্রকাশ সব। তোর মোটা মাথা বুঝবি না।
         বুঝিনি। ইশিতা হয়তো বুঝেছিল। কী জানি?  একটা হাতে তৈরি করা রুমাল চেয়েছিল জন্মদিনে। বাইশে সেপ্টেম্বর। ভুলেই তো ছিলাম এতোদিন। একটা ফিনিক্সপাখি স্টিচকরা সাদা আদ্যি কাপড়ের নরম রুমাল। আর একটা উইলসন পেন। কালির কলমে লিখতে খুব ভালবাসতো যে।
       এক কলসি কাজল দীঘির জল ঢেলে দেওয়া সন্ধ্যাকাশ। একটা শ্বেত পাথরের কৃষ্ণ মন্দির। খুব মৃদু ঘন্টাধ্বনি। দুটো বিরাট পিলসুজের ওপর দুটো জ্বলন্ত প্রদীপ। একটা বাঁধানো পুকুর । পাড় বরাবর পাথরের রাস্তা। অজস্র কালচে সবুজ গাছ। পুকুরে চোখ বন্ধকরা পদ্ম। মন ভালো করা পরিবেশ। কিন্তু যেন ছেলে ভোলানো। চারিদিকে থমকে থাকা ব্যথা,কষ্ট ,কান্না আর মৃত্যু।

       নিচু ছাদের সাজানো কেবিন। বেডের পিছনটা পুরোটা কাঁচের দেওয়াল। বাগানের অনেকটা দেখা যায়। এসি চলছে। সাদা চাদরের ওপর আধশোয়া,ব্যাকরেস্ট দিয়ে পিঠ থেকে মাথা উঁচু করে রাখা। অক্সিজেন মাস্ক পরানো। ক্যাথিটার লাগানো। বেডের পায়ের কাছে একটা কার্ডের ওপর লেখা ডঃ দেবাঞ্জন মিত্র। ঠিক তার নিচে ডঃ বিমান  সান্যাল। মাথার কাছে একটি মেয়ে বসা। আলাপ হল। দেবাঞ্জনদার মেয়ে নীলাঞ্জনা।
        
আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামলো।ভিসিটর এখন কমেছে । প্রথম প্রথম অনেকে আসতো। নীলাঞ্জনা তার নতুন মেসোমশাইকে নিয়ে বাইরে গেল। বহুদিন পর দেবাঞ্জনদা। রোগ শরীরকে নিংড়ে নিয়েছে কিন্তু কেড়ে নিতে পারেনি হাসি আর অদ্ভূত সেই সুন্দর চোখ। চোখ দুটোয় খেলা করতো হাসি সুখ দুঃখ অভিমান সব। ডান হাতটা এগিয়ে এলো।এসেছিস। ইশিতা খবর দিল তো? সোহাগ ফোন করতে চেয়েছিল। আমিই নিষেধ করেছিলাম।
মিথ্যের তো কোনো জোর থাকেনা। তবু কোনোরকমে সমস্ত শক্তি জড়ো করে বললাম—‘ভালো হয়ে ওঠো।
আকাশের সব রঙ শেষ। প্রদীপের সব তেল। শুকনো বুকে সলতেটুকু জ্বলছি রে। এগারোটা কেমো। আর পারছি না।
অক্সিজেন মাস্কের জন্য কথা অস্পষ্ট। নার্স মেয়েটি এসে চ্যানেলে দুটো ইঞ্জেকশন পুশ করলো। ক্যাথিটার ব্যাগে ইউরিনের সঙ্গে হাল্কা ব্লাড।
তুমি তো দুর্বল ছিলে না!’
সত্যিই খুব মন করছিল রে তোকে দেখার। সোহাগের অপমানটা তুই ভুলে গিয়ে আসবি ভাবিনি।একটা ঠান্ডা হাত আমার হাতের পাতা দুটোর মাঝে। একটু একটু কাঁপছে। আমার গলাও। কেন যে মনে পড়ালে। সোহাগের একটা মাত্র বাক্য।আমার দেবকে আমি ভাগ করে নেব না কারো সঙ্গে। বন্ধু বেশে অবন্ধুত্বের কাজ করার সুযোগ আমি দেবো না তৃতীয় পক্ষকে।সরে আসতে গিয়ে বুঝেছিলাম ভালবাসি,ভীষণ ভালবাসি।
এবার পুজোটায় হয়তো থাকবো না।
এটা সেটা,রেখা নীল প্রদীপ অশোক সুদেষ্ণা ইশিতা সবার কথা হল একটু একটু । মৃত্যু অবধারিত, অসহায় তার প্রতীক্ষা করা, মিথ্যে লড়াই করা খুব কষ্টের। মনে মনে বললাম—‘আমি বুঝি।
এটা চিনতে পারিস? খুব কাছে কাছে রাখি। ভুলি নি। রুমাল উপহার দিলেই ভুলে যাওয়া যায় না।
আমার চোখ ঝাপসা, আড়ালটুকুও আড়াল মানলো না আর। শেষবার হাত ধরে মন থেকে ছুঁয়ে এলাম তাকে। নীলাঞ্জনা আর সোহাগের কাছ থেকে বিদায়। সোহাগের দু'হাত আকুল ভাবে চেপে ধরা। সব পিছনে ফেলে এলাম।
      গাড়ি ছুটছে। দুরত্ব বাড়ছে ক্রমশ। ভালবাসার ভার যে এতো দুঃসহ  বুঝিনি কোনদিন। হয়তো একটা বুকখালি করা কান্নার খুব দরকার।
দেবাঞ্জনবাবুর স্ত্রী সোহাগদেবী খুব ভাল মানুষ। এমন ভাবে কথা বলছিলেন যেন কত চেনা!’
আমি শুনছি কিন্তু শুনছি না। আমি দুরে,অনেক দুরে । কলেজের মূল বিল্ডিঙের চওড়া সিঁড়ির একদল ছেলেমেয়ের ভীড়ের মধ্যে।