গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ৭ জুলাই, ২০২০

শান্তিময় কর


এক্সপোর্ট ইমপোর্ট    


            উচ্চ বংশজাত বংশলোচন বংশ পরম্পরায় হংস ব্যবসায়ী। বংশলোচনের বাবা বংশী বদন সংসার বন্ধন ছিন্ন করে সেই কবেই সংসার ত্যাগী হয়ে কোন নিরুদ্দেশে চলে গেছে, অনেক চেষ্টা করেও বংশলোচন তার কোন সন্ধান পায়নি। অগত্যা সব আশা ত্যাগ করে সে জাত-ব্যবসায় মন লাগাবার চেষ্টা করে। সংসারে তার আপন বলতে মা আর এক ছোট ভাই। সংসার ছোট হলেও সেই সংসারকে টেনে নিয়ে চলাও প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে তার পক্ষে। বাপের আমলে হাঁসের অনেক কদর ছিল। হাঁস মাংস আর হাঁসের ডিম খুব বিক্রী হ’ত। আশ-পাশের পাঁচ সাতটা গ্রামে হাঁসের জমজমাট বাজার ছিল। কিন্তু যখন থেকে মানুষের মুরগী প্রীতি দেখা দিল, ধীরে ধীরে হাঁসের চাহিদা ক্রমান্বয়ে কমতে থাকায় বংশলোচনের আর্থিক অবস্থা ক্রমশঃ খারাপ হতে লাগলো। অনেক ভাবে চেষ্টা করেও কোন আশার আলো দেখতে পেলো না।

সব কিছু যখন ধ্বংসের মুখে, বংশলোচনের সাথে হঠাৎ একদিন কান্দীগ্রামের ফন্দীবাজ ছোকরা ফটিক নন্দীর দেখা হয়ে গেল, সাত সকালে, নদীর ধারে। সে তখন সাইকেলে চড়ে পাশের গ্রামে তার এক সাগরেদ মাইকেলের কাছে যাচ্ছিল নিজের ধান্দায়। বংশলোচনের সামনা সামনি হ’তে সে জিজ্ঞেস করে ‘কি ব্যাপার বংশ, হংস ব্যবসা কেমন চলছে তোমার’ ? ‘আর বলো না ভাই, সব উচ্ছন্নে গেছে। হাঁসের আর বাজার নাই। যেদিকে তাকাই, শুধুই আঁধার - বাঁচার পথ খুঁজে পাচ্ছি না। কি দারুন দিনই না ছিল, এখন আর নাই। বাপটাও কোথায় উবে গেল। দু’মুঠো খাবার জোগাড়  করারও সংস্থান নাই। এক এক সময় গলায় দড়ি দিয়ে মরে যেতে ইচ্ছে করে আমার’। ফটিক বলে, ‘মরেও কি শান্তি আছে ? আর মরতেই বা যাবে কোন দুঃখে ? তার চেয়ে এক কাজ   করো, এই ব্যবসা ছেড়ে আমার সাথে যোগ দাও - দু’পয়সা রোজগার হ’বে আবার ঝামেলাও কম’। বংশের প্রশ্ন, ‘কি ব্যবসা তোমার আর আমাকেই বা কি করতে হ’বে’ ? ফটিক বলে, ‘আমার ব্যবসায় সামান্য রিস্ক যে নেই, তা বলবো না। মূলধন লাগানোর কোন ব্যাপার নাই। শুধু বুদ্ধি লাগিয়ে গায়ে গতরে খাটা’।  ---   একটু বুঝিয়ে বলো কাজটা কী করতে হ’বে।
---   খাসা কাজ - ইমপোর্ট এক্সপোর্ট, মানে আমদানী রপ্তানীর ব্যবসা।
---   তুমি বললে মূলধনের কোন ব্যাপার নাই, কিন্তু আমি তো জানি, আমদানী
রপ্তানীর ব্যবসায় প্রচুর মূলধন লাগে।
---   আচ্ছা বাবা আচ্ছা, সে ভাবনা তোমার নয় - তুমি আমার দলে যোগ দাও,
তোমার কোন মূলধন লাগবে না। যা করার আমি করবো। দু’ পয়সা
কামাও, তোমার সংসারটা বাঁচুক। নিজেও আনন্দে থাকো।

            ফটিকের পরামর্শ বংশলোচনের মনঃপুত হওয়ায় এবং লোভনীয় মনে হওয়ায় আর কথা না বাড়িয়ে সে তার দলে যোগ দিতে সম্মত হ’ল। রাত্রে তার সাথে দেখা করতে বলে ফটিক সাইকেলে চেপে চলে গেল। তারপর থেকে কিভাবে কি হ’ল কেউ জানে না। তবে দেখা গেল বংশলোচন সর্বদাই ভীষণ ব্যস্ত। কালক্রমে সবাই লক্ষ্য করলো তার সেই আগের দশা আর নাই - তার অবস্থার উন্নতি হয়েছে, খাওয়া পরার ঠাট বদলেছে, শরীরে একটা চাকচিক্য ভাব দেখা দিয়েছে। অবস্থা যে বেশ পালটেছে, তা তাকে দেখে, তার চালচলন থেকে এবং এবং তার কথাবার্তার ভাবভঙ্গি দেখে বেশ অনুমান করা যাচ্ছে। তবে এটা পরিষ্কার যে ও ফটিকের সাথে ব্যবসায় নামার ফলেই তার এত উন্নতি, এত বাড়বাড়ন্ত। কী এমন ব্যবসা শুরু করলো সে যে এত তাড়াতাড়ি তার অবস্থার এমন পরিবর্তন ? এ ব্যপারে তাকে জিজ্ঞাসা করলে কিছু বলা তো দূরের কথা, সে মুখে একদম কুলুপ এঁটে রাখে। অনেক জেদাজেদি করলে বলে, “ঐ একটা    ছোটখাট ব্যবসা শুরু করেছি”। তার কথা কেউ বিশ্বাস করে, কেউ করে না। লোকের মনে সন্দেহ হয় ব্যাটা চুরি চামারি করে না তো ? লোকে কী ভাবলো আর কী বিশ্বাস করলো, তাতে তার কী এসে যায় ? তার তো দু’পয়সা ভালই আমদানি হচ্ছে এবং সংসারটাও একটু সুখের মুখ দেখতে পাচ্ছে।

             কিন্তু পরশ্রীকাতর হরিদাস পাতর বংশলোচনের ভবকিতে ভোলার পাত্তর নয়। এই হরিদাস লোকটি অসম্ভব ধুরন্ধর এবং পুরোমাত্রায় ধান্দাবাজ। সত্যি কথা ভুলেও বলে না। লোক ঠকিয়ে সংসার চালায় আর পরের ভাল দেখলে রাগে ফুঁসতে থাকে। কেউ উন্নতি করে দু’পয়সা রোজগার করলে, সমাজে প্রতিষ্ঠা পেলে হিংসায় জ্বলতে থাকে। এই হরিদাস পাতর মনে মনে দৃঢ় নিশ্চয়, বংশলোচনের ব্যবসা-ট্যবসা সব বাজে কথা - ও নিশ্চয়ই কোন কালা ধান্দায় নেমে পড়েছে। তা না’হলে এত শিগগির এত উন্নতি কারও কখন হয় ? সে মনে মনে প্রতীজ্ঞা করে, যে ভাবেই হ’ক তাকে আসল রহস্যটা উদ্ধার করতেই হবে। পরের দিন থেকেই সে অনুসন্ধানের কাজে লেগে যায়। চেষ্টা থাকলে কী না হয় ? তাই অবশেষে সে ঠিক জানতে পেরে যায় বংশলোচনের জীবিকার সন্ধান এবং উন্নতির রহস্য আর তা উদ্ঘাটন করতে পেরে নিজেই নিজেকে বাহবা দেয় “বাঃ রে আমি”।

            সত্যিই অদ্ভুত ব্যবসা বটে বংশলোচনের - ইমপোর্ট এক্সপোর্টই বটে। এক জনের বাড়ীতে ঢুকে মালপত্র চুরি করে নিয়ে আসা, মানে ইমপোর্ট আর সেই চোরাই মাল অন্য কাউকে বিক্রী করে দেওয়া, মানে এক্সপোর্ট। হ্যাঁ, এই রকমই তার ব্যবসা, রমরমিয়ে চলা আর তরতরিয়ে বেড়ে ওঠা। আবার এই ব্যবসা থেকে তার উপরি আয়ও ছিল। অভিনব ব্যপারটা। তার এই ব্যবসা আর অভিনবত্বের কিছু নমুনা পেশ না করলে গল্পটা আর গল্পই হবে না।

            এখানে একটু বলে রাখা দরকার যে এই বংশলোচন লোকটি স্বভাবগতভাবে অত্যন্ত রসিক ও পরিহাস প্রিয়। এমন এমন আজগুবি গল্প সে বলতে পারতো যে তা শুনে হাসতে হাসতে মানুষের পেট ছিঁড়ে যাবার জোগাড় হ’ত। যত রাগই হ’ক তার উপর, তেড়ে গিয়েও তাকে কেউ কিছু বলতে পারতো না - তার ঐ নিরীহ, গোবেচারা মুখটার দিকে তাকিয়ে সব রাগ গলে জল হয়ে যেত। তাই তার ঐ চুরির কথা ও অভিনব কায়দা কৌশলের কথা জানার পরও তারা হা-হা করে হাসতো। তাদের প্রতিক্রিয়া, “এই না হ’লে বংশ” ? তারা আবার অবসর সময়ে বংশকে ডেকে তার চুরির ঘটনা শুনতো আর খুব মজা পেত। আসলে ফটিক নন্দী নিখাদ চোর এবং ধরা পড়ে বহুবার সে জেলও খেটেছে। কিন্তু বংশলোচন চুরির সাথে রস মিশিয়ে মানুষের বিনোদনের খোরাক হয়ে উঠেছে এবং পরবর্তী কালে তার চুরির কাহিনী রূপকথায় পরিণত হয়ে গেছে।

            বংশলোচন প্রতি রাত্রে বেরোত চুরি করতে। ব্যাপারটা ঠিক কি রকম হ’ত - প্রথমে সে, ধরুন, যেত জেলে পাড়ায়। সেখান থেকে সে একটা জাল চুরি করতো। তারপর সেই জাল দিয়ে গ্রামের যে কোন পুকুর থেকে মাছ চুরি করে সেই মাছ পরদিন সকালে বাজারে বিক্রী করে পয়সা রোজগার করতো আবার জালটাকেও অন্য কাউকে কম পয়সায় বিক্রী করে দিত। এখন যার জাল চুরি গেছে, সে প্রথমেই বংশকে গিয়ে ধরতো কারণ সে ভালভাবেই জানতো যে এ কাজ সে ছাড়া আর কেউ করতে পারে না। প্রথমে বংশ অস্বীকার করলেও পরে বাধ্য হয়ে মেনে নিয়ে বলতো ---
--- যদি দশটা টাকা দাও, জালটা ফেরত পেয়ে যাবে।
--- আগে ফেরত দে, তারপর পয়সা পাবি।
--- তা হ’বে না। ফেলো কড়ি, মাখো তেল। এটা আমার ব্যবসার ওসুল।

            অগত্যা তাকে দশটা টাকা গচ্চা দিতেই হ’ত, না হ’লে সে আর জাল ফেরত পাবে না, ভাল করেই জানতো। বংশ বলতো, “কাল সকালে জাল ফেরত পেয়ে যাবে”। এবার মজাটা হল, ঐ জাল সে যাকে বিক্রী করেছে, রাত্রে তার বাড়ী থেকে আবার ওটা চুরি করে এনে আসল মালিককে ফিরিয়ে দিত। আবার ধরুন, কারও বাড়ী তৈরি হচ্ছে - মিস্ত্রী এসে নতুন সব দরজা জানালা তৈরি করেছে। বংশ তার মধ্যে একটা দরজা চুরি করে কাউকে এক দেড়শ টাকায় বিক্রী করে দিল আবার মালিকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পরের রাতে ঐ দরজা চুরি করে তাকে ফেরত দিল।

            এই ভাবেই চলছিল এবং বংশলোচন বেশ ভালই টাকা পয়সা রোজগার করছিল। কিন্তু একদিন মোক্ষম ঘটনাটা ঘটে গেল। হঠাৎ একদিন দেখা গেল গ্রামের হাইস্কুলেরে অফিস ঘরের দেওয়াল ঘড়িটা চুরি হয়ে গেছে। হেড মাষ্টার মশায় এটাকে সাধারণ চুরির ঘটনা মনে করে এ নিয়ে আর বেশী নাড়াচাড়া করেননি। সাত-আট দিন পর একদিন হেড মাষ্টার মশায় গ্রামে তাঁর এক বন্ধর বাড়ী বেড়াতে গেছেন। ড্রইং রুমে বসে বন্ধুর সাথে গল্প করতে করতে হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ল দেওয়ালে টাঙ্গানো ঘড়িটা। তিনি চিনতে পারেন ঘড়িটা তাঁর স্কুলের। কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হ’লেও তিনি বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেন সমস্ত জড়তা কাটিয়ে ---
--- এই ঘড়িটা কবে কিনেছো ? সাত আটদিন আগে আমার স্কুলের ঘড়িটা চুরি
হয়ে গেছে। এই ঘড়িটা হুবহু সেটার মত দেখতে।
---  আরে এটা স্কুলের ঘড়িটা নাকি ? আমি তো সাত আট দিন আগেই
বংশলোচনের কাছ থেকে পঞ্চাশ টাকায় এটা কিনেছি।

            এই বলে তিনি সবিস্তারে বংশলোচনের সব ঘটনা তাঁকে বললেন। পরের দিন হেড মাষ্টার মশায়ের বন্ধু স্কুলে গিয়ে ঘড়িটি যথাস্থানে টাঙ্গিয়ে দিয়ে এলেন। দু’ চারদিন পর হেড মাষ্টার মশায় বংশলোচনকে ডেকে পাঠালেন। তাঁর সাথে তাঁর বন্ধু ছাড়া আরও দুজন শিক্ষক সেখানে ছিলেন। বিনয়ের অবতার বংশলোচন হাতজোড় করে তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালো ---
---  স্যার, আমাকে ডেকেছেন ?
---  তুমি স্কুলের ঘড়িটা কেন চুরি করলে ?
---  কী যে বলেন স্যার, আমি কি এ কাজ করতে পারি ?
---  আচ্ছা, দেখাচ্ছি মজা। মনোজ, তোমাকে বংশলোচন পঞ্চাশ টাকায় ঘড়িটা
বিক্রী করেনি ?
---  হ্যাঁ, করেছেই তো।
---  দাঁড়াও, তোমার মজা দেখাচ্ছি। মনোজ, থানার বড় বাবুকে একটু ফোন
করতো।
---  আপনার পায়ে পড়ি স্যার, এমন কাজ করবেন না - ধনে প্রাণে মারা যাবো।
এবারের মত ক্ষমা করে দিন, আর কক্ষনো এমন কাজ করবো না।
---  তুমি চোর, তাই বলে স্কুলের ঘড়িটা চুরি করতে তোমার লজ্জা হল না ? এত
অমানুষ তুমি ?
---  ঘড়িটা চুরি করার কথা কখনও আমি ভাবিনি স্যার - ওটা চুরি করার কোন
মতলবই আমার ছিল না।
---  তবে চুরি করলে কেন ?
---  সেদিন রাত্রে আমি জেলে পাড়া থেকে একটা মাছ ধরার জাল চুরি করে
ইস্কুলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম বোস বাবুর পুকুরে মাছ চুরি করতে। ঐ সময়
ঢং ঢং করে ইস্কুলের ঘড়িটায় বারোটা বাজলো। আওয়াজটা কানে যেতেই
মনে হল, আরে বাঃ, ঘড়িটা চুরি করলে তো হয় ? যেই ভাবা অমনি কাজ।
ঐ আওয়াজটাই কাল হল স্যার। এবারের মত আমায় ক্ষমা করে দিন।
---  হয় তুমি জেলের ঘানি টানবে, না হয় কথা দাও যে আর কখনও চুরি
করবে না।
---  তা’হলে তো উপোষে মারা যাবো। কি করে স্যার চলবে আমার সংসার ?
---  গতর আছে, খেটে খাও।
---  কে আমায় কাজ দেবে স্যার ?
---  আমি দেবো। কাজ করবে তুমি ?
---  তাহ’লে তো বর্তে যাই।
---  ঠিক আছে কাল থেকে তুমি আমার স্কুলের মালির চাকরিটায় যোগ দাও।
রোজগার যদিও একটু কম, তবে তোমার খুব একটা অসুবিধা হবে বলে
মনে হয় না। যদি রাজী থাকো তো বলো।
---  হ্যাঁ স্যার, আমি রাজী। আমি এবার থেকে সৎভাবে বাঁচতে চাই।
---  ঠিক আছে, কাল থেকে তোমার চাকরি পাকা।

অতঃপর বংশলোচন তার আমদানি-রপ্তানির ব্যবসার পাট চুকিয়ে স্কুলের চাকরি নিয়ে সুখে সংসার করতে লাগলো। তার অভিনব চুরির কায়দা-কৌশল এখন রূপকথা। মনে করে সে নিজেও হাসে।