গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ৭ জুলাই, ২০২০

নীহার চক্রবর্তী


কান্না-ভেজা বসন্ত

চন্দ্রকান্তবাবুর বড়ছেলে রাধাকান্ত যেদিন কোলকাতায় কলেজে চাকরী করার সুবাদে তার স্ত্রী আর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে কোলকাতায় চলে গেলো, সেদিন তিনি তার বন্ধুদের বলেছিলেন,’’কিই বা করা যাবে । সত্যিই তো এত দূরের পথ বাড়ি থেকে যাতায়াত সম্ভব নাকি ?’’ বন্ধুরা সেদিন তার সঙ্গে সহমত হয়েছিল ।
চন্দ্রকান্তবাবুর মেজো ছেলে সূর্যকান্ত দমদমের একটা হাইস্কুলে চাকরী করতো । সে এতদিন বাড়ি থেকেই যাতায়াত করতো । সেও একদিন চন্দ্রকান্তবাবুকে বলল,’’বাবা,এভাবে আর বাড়ি থেকে যাতায়াত করা যায় না । আমার খুব কষ্ট হয় । তাই ভাবছি আমি দমদমেই চলে যাই ।‘’ সে কথা শুনে চন্দ্রকান্তবাবু কিছুটা দমে গেলেন । কিছুক্ষণ ছেলের দিকে চেয়ে থাকলেন । তারপর বললেন,’’বৌমাও তো যাবে । তাই না ?’’ সূর্যকান্ত বলল,’’সে ছাড়া উপায় ?’’ অতএব সূর্যকান্ত চলল তার পরিবারকে নিএ দমদমে ।
সংসারে তারপর পড়ে থাকলো চন্দ্রকান্তবাবু,তার স্ত্রী আর ছোটো ছেলের স্ত্রী । ছোটো ছেলে শ্যামাকান্ত দিল্লীতে এক কোম্পানিতে কাজ করতো । সে হঠাৎ একদিন বাড়ি ফিরে চন্দ্রকান্তবাবুকে বলে বসলো,’’বাবা,আমি আর পারছি না । ওখানে আমার খাওয়া-দাওয়ার খুব কষ্ট । তোমার বৌমাকে না নিয়ে গেলে নয় ।‘’ ছেলের কথা শুনে চন্দ্রকান্তবাবু দমে গেলেন । তার স্ত্রীর দু’চোখ জলে ভরে গেলো । কিন্তু সে ছাড়া আর কোন উপায়ও নেই । তাই চন্দ্রকান্তবাবু অস্ফুট-স্বরে ছোটো ছেলেকে বললেন,’’কি আর বলি আমি । ঠিকই তো । তোমরা তবে এসো ।‘’
চন্দ্রকান্তবাবু তার সংসারে স্ত্রীকে বড় একা হয়ে পড়লেন । অবশ্য একই বাড়িতে তার দুই ভাই তাদের পরিবার নিয়ে বাস করে । তাদের সঙ্গে সম্পর্কও বেশ ভালো । তবু ছেলেদের ছাড়া চন্দ্রকান্তবাবু আর তার স্ত্রী নিজেদের বড় নিঃস্ব বলে ভাবতে থাকলেন ।
এমন নিঃস্বতা যখন তাদের জীবনে চলছে,তখন তাদের একমাত্র মেয়ে চন্দ্রিমা তার চার বছরের ছেলেকে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে ফিরে এলো । চোখের জল ফেলতে ফেলতে বাবা-মাকে বলল,’’আমি আর ফিরছি না ওখানে । বড় নিষ্ঠুর ওরা । কেউ আমাকে ভালোবাসে না । তোমাদের জামাই দিনের পর দিন মদ খেয়ে বাড়ি ফেরে । আমার ওপর খুব অত্যাচার করে । জুয়ো খেলে । অন্য নারীতে আসক্ত । আমাকে ফিরতে বল না আর ।‘’ মেয়েকে কাছে পেয়ে চন্দ্রকান্তবাবু আর তার স্ত্রী সব কথা শোনার পরেও আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লো । চন্দ্রকান্তবাবু বললেন তাকে,’’কে বলেছে তোকে আর ওখানে যেতে ? এখানেই তুই এখানে থেকে যাবি । ভগবানের আশিসে এখনো তোর বাবার কম নেই । তবে আমাদের আইনি-লড়াই চলবে । সে তোর ফিরে যাওয়ার জন্য নয় । একেবারে সব ঘুচিয়ে দেওয়ার জন্য ।‘’
চন্দ্রকান্তবাবুর দুই ভাই কিন্তু চন্দ্রিমার ঘরে ফিরে যাওয়ার ওপরেই জোর দিতে থাকলো । মেজো ভাই নিশিকান্ত দাদাকে বোঝাল,’’সমাজ বলে কথা । মেয়েকে কি ঘরে রেখে দেওয়া যায় ? আমরা না হয় বুঝিয়ে-সুজিয়ে একটা ব্যবস্থা করে আসি ।‘’ কিন্তু চন্দ্রকান্তবাবু আর তার স্ত্রী তাতে একেবারেই রাজী নয় । চন্দ্রিমার মা বলল চোখ-ভরা জল নিয়ে,’’তা কেন ? মেয়ে কি আমাদের ফ্যালনা ? আমরা ওকে কাছে রাখতে পারি না ?’’ অতএব দুই ভাই মুখ বেঁকিয়ে ক্ষান্ত দিলো । ছোটো ভাই দেবকান্ত বলল চন্দ্রকান্তবাবুকে,’’তোমাদের মেয়ে । আমরা আর কি বলি ।‘’ কথাটা খুব কানে লাগলো চন্দ্রকান্তবাবু আর তার স্ত্রীর । কিন্তু মেয়েকে কাছে পাওয়ার আনন্দে তার কোন উত্তর দিলো না ।
চন্দ্রকান্তবাবুর বড়ছেলে আর মেজো ছেলে বাড়ি ফিরল একদিনের জন্য । বোন চন্দ্রিমার ব্যাপারে সব শুনে মুখ-ভার করে বড়ছেলে বলল,’’একটু মানিয়ে নিতেও হয় । সঞ্জীব তো এমন ছিল না । বেশী জেদ দেখালে সংসারে পুরুষ মানুষ বদলে যেতে কতক্ষণ ?’’ মেজো ছেলের মুখেও প্রায় একইরকম কথা । তা শুনে চন্দ্রকান্তবাবু আর তার স্ত্রী যেন আকাশ থেকে পড়ল । ভাবতে থাকলো চন্দ্রকান্তবাবু,এ যে আমার ভাইদের মতোই কথা । কীভাবে ভরসা করি এদের ? তাই চন্দ্রকান্তবাবু তার দুই ছেলেকে চোখ বিস্ফারিত করে বলে উঠলেন,’’তোমরা কালকেই কাজে যোগ দেবে । আসতে পারো ।‘’ দুই ছেলে বাবার কথা শুনে অবাক হতে-হতে একসময় তাদের শখের যাত্রা সাঙ্গ করে যে-যার আস্তানায় ফিরে গেলো ।
চন্দ্রকান্তবাবুর ছোটো ছেলের কাছেও বোন চন্দ্রিমার ব্যাপারে খবর গেলো । সে ফোনে বাবাকে জানালো,’’চন্দ্রিমাকে একদম ওই শয়তানটার বাড়িতে পাঠাবে না । আমাদের বাড়ির মেয়ে আমাদের কাছেই থাকবে । আমি একমাসের ছুটিতে শিগগির বাড়ি ফিরছি । সেই পর্যন্ত অপেক্ষা কর ।‘’ সে কথা শুনে মহাখুশি চন্দ্রকান্তবাবু আর তার স্ত্রী । বাড়িতে সবাইকে শুনিয়ে-শুনিয়ে বলতে থাকলো ছোটো ছেলের কথা । সবার মুখ-ভার । মুখে কোন কথা নেই । চন্দ্রকান্তবাবুর স্ত্রীর কানে গেলো মেজো ঠাকুরপোর স্ত্রী বলছে,’’দেখা যাবে । সেদিনের পুচকে বেশী বোঝে ।‘’ পরে স্ত্রীর মুখে শুনে হেসে মরে চন্দ্রকান্তবাবু ।
তার দুদিন পরে ছোটো ছেলের আবার ফোন চন্দ্রকান্তবাবুকে । সে বলে,’’এখানকার কাজ ছেড়ে দিচ্ছি । আমার পোষাচ্ছে না । সংসার চলা দায় এখানে । আমরা ফিরে আসছি । এবার থেকে তোমাদের আর কিছু ভাবতে হবে না । আমি গিয়ে যা করার করছি ।‘’ ছোটো ছেলের কথা শুনে চন্দ্রকান্তবাবু আর তার স্ত্রী যেন হাতে চাঁদ পেলো । সবাইকে বলল সে কথা । সবার মুখ একে-একে ফ্যাকাসে । এই ছেলেটা নাকি বড় বেয়াদব । এভাবেই অনেকে ওকে চেনে । কেউ কিছু বলল না । চুপ করে গেলো শুনে ।
আর যাকে নিয়ে এত কথা,সেই চন্দ্রিমা ? ও বাবা-মাকে ঘিরে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে । বরের সংসারকে ও মন থেকে প্রায় মুছেই ফেলেছে । ভাবতেই পারে না আর ওর আগে সংসার বলে কিছু ছিল । রাতে স্বপ্নে এলে জোর করে চোখ খুলে ফেলে বিছানায় বসে থাকে । শুধু একজনের কথাই ওর শুধু মনে হয় । সুদর্শন । এখনো বিয়ে করেনি । বাজারে ওর বড় ষ্টেশনারী দোকান । সেও জেনেছে চন্দ্রিমার অবস্থার কথা । কিন্তু শুনেই গেছে । মুখে কোন রা কাড়েনি ।
বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলা অবশেষে শুরু হল । চন্দ্রকান্তবাবুর ছোটো ছেলে শ্যামাকান্ত এর মুখ্য ভুমিকায় । কিন্তু সুদর্শনকেও কাছে পেলো ও । নামী আইনজীবীর ব্যবস্থা সেই করে দিয়েছে । এও বলেছে শ্যামাকান্তকে,’’অর্থের অভাব হবে না । এর শেষ দেখতে চাই আমি । এমন সংসারের মুখে আগুন ।‘’ চন্দ্রিমা সে কথা শুনে ফিরে গেছে ফেলে আসা সেসব দিনে । ফাগুন-হাওয়ার পথে একদিব দুজন খুব ছুটেছিল । কিন্তু রাশভারী বড়দা দুজনের পথে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিলো সেদিন । চাকরী ছাড়া বোনের পাত্র মানায় ? সব শুনে সুদর্শন বলেছিল সেদিন সখেদে,’’ঠিকই তো । মানায় ?’’
এদিকে বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলা প্রায় একবছর চলতে চলতে শোনা গেলো সুদর্শন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত । ওকে কোলকাতার এক নার্সিংহোমে ভর্তি ভর্তি করা হয়েছে । ভাই শ্যামাকান্তর মুখে সে কথা শুনে চন্দ্রিমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো । কী এক বিস্ময়ে ভায়ের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ । একেবারে নিরুত্তর ও । সারাটা দিন কারোর সঙ্গে কথা বলল না । একা-একা চোখের জল ফেলতা থাকলো । মা বোঝাল,’’সুস্থ হয়ে উঠবে ও । এমন করে কাঁদতে নেই । জানি ও তোকে খুব বোনের মতো ভালোবাসতো । ‘’ কিন্তু মা জানে না ওর হৃদয়ের পাগল-পারা স্বপ্ন । তাই ওর কান্না থামাতে পারলো না । বাবা চন্দ্রকান্তবাবু দেখল শুধু । কিছুই বুঝতে পারলো না । শ্যামাকান্ত বুঝেছিল । কিন্তু ও তখন নিরুপায় । ভালোই জানে সুদর্শনের দিন ফুরিয়ে এসেছে ।
সুদর্শন যেদিন মারা গেলো,সেদিন সকাল থেকে চন্দ্রিমা সেই আগের মতো কথা বলতে শুরু করলো । ওর মা খুব খুশী । বাবাও ওকে দেখে আনন্দিত । কিন্তু শ্যামাকান্ত সুদর্শনের মৃত্যুর খবর প্রকাশ করতেই চন্দ্রিমা কিছুক্ষণ থম মেরে থেকে বলে উঠলো,’’আমি স্বামীর ঘরে যাবো । এক্ষুনি তোমরা ব্যবস্থা কর ।‘’ শুনে চমকে উঠলো সবাই । কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো । সংজ্ঞা হারাল তারপর ।
চন্দ্রিমার কথায় বিবাহ-বিচ্ছেদ মামলা থমকে গেলো । ওর কথামতো সঞ্জীবের ঘরে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও হল । কিন্তু যেদিন ওকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হল,বাড়ির সবাই দেখল ও বিধবার সাদা থানে নিজেকে একেবারে মুড়ে ফেলেছে । মুখে অস্তমিত চন্দ্রিমা-হাসি । গাড়ি ফিরে গেলো দোর থেকে ।