গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ২৬ জুলাই, ২০২০

আফরোজা অদিতি

জিজীবিষা

সভা থেকে পথে বের হয়েছে অণুজীবটি; ধীরসি'র গতি। যেতে যেতে ওর মনে হলো এরকমভাবে চললে জীবনীশক্তি ক্ষয় হবে; এমনকি চিন্তশক্তিও ; ভাবতে ভাবতে বসে পড়লো ফুটপাতে অণুজীবটি; একটু পরে গা এলিয়ে দিলো ফুটপাতে! ওর ইচ্ছা করছে না কিছু; ভালো লাগে না আজকাল! ঝিমধরা একটা ভাব তাড়িয়ে বেড়ায় ওকে! শূন্যচোখে তাকিয়ে থাকে গভীর শূন্য একটি সময়ের দিকে! এমন সময় প্রায় শব্দহীন সেখানে নামলো আর একটি অণুজীব। ঐটুকু শব্দেই প্রথমটি তাকিয়ে দেখলো একটি লোক খুব লম্বা পা ফেলে জোরে জোরে হাঁটছে; হাঁটতে হাঁটতে মুখ না ঢেকে একটা হ্যাঁচ্চো দিলো সে; হ্যাঁচ্চো দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে পরেছে ঐ অণুজীবটি! প্রথম অণুজীবটি আড়মোড়া ভাঙলো; কাছে গেল ওটির। মোলায়েম সুরে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার নাম কি ভাই? এভাবে এখানে নামলে কেন?’২য় অণুজীব খুবই ক্ষুদ্র চোখে তাকিয়ে রইলো অনেকক্ষণ; তারপর বললো, ‘তুমি কে? কি নাম তোমার?’১ম টি খুব নিরীহ মুখে বললো, ‘আমি সব সময় প্রশ্ন করি তো তাই আমি প্রষ্টা। কিন' তুমি কে তাতো বললে না।২য় টি মুখ খুললো, ‘আমি ইটলি, আসছি ইটালি থেকে। ঐ যে মানুষটাকে দৌড়ে যেতে দেখলে ওর ভেতর ডে-ওয়ান থেকে ছিলাম আর বেটা ভীতুর ডিম আমাকে ফেলে গেল এখানে। এখানে না ফেললে ওটাকে শেষ করে দিতাম। ২য় টির পুরো অবয়বে ছড়িয়ে গেল হিংসাত্মক মৃত্যুকণা। হা-হা করে উঠলো ১ম জন।এমন করে না ভাই; আমরা করোনা গ্রোত্রের, মানে করো না; তাহলে কেন সবসময় মানুষের মধ্যে মৃত্যুর চাষ করতে যাই বলতো! কেন যাই? সবকিছু করা তো আমাদের শোভা পায় না; তুমিই বলো শোভা পায় কি?’ এরপর দুজনে চুপচাপ। হঠাৎ ওরা দেখতে পেলো কয়েকটা  ছায়া ভাসতে ভাসতে এদিকে থেকে ওদিকে যাচ্ছে। প্রষ্টা ওদের কথা শোনার জন্য উদগ্রিব হলো; শুনতে পেলো বলছে একজন, কী দুর্ভাগ্য আমাদের বলো, বেঁচে ওঠার জন্য ভেন্টিলেশনে ছিলাম অথচ ঐ ভেন্টিলেটরেই আগুন ধরে গেলো। অন্য এক কন্ঠ বললো, মৃত্যু লেখা থাকলে কিছুই করার থাকে না! পৃথিবীর জল-হাওয়া-খাওয়া-আমোদ-আহ্লাদের সময় যতোদিন আমাদের ঠিক করা থাকে জন্মের সময় ততোদিনই তো থাকবো আমরা। ওদের কথা শুনে মন খারাপ হয়ে গেল প্রষ্টার। ইটলি খুব খুশি হলো। বলল, ‘বেশ হয়েছে, ভালো হয়েছে।ইটলির খুশি দেখে প্রষ্টা বললো তুমি ওদের মৃত্যু দেখে খুশি হয়েছো। ইটলি হাসি থামিয়ে গোমড়ামুখে তাকিয়ে রইলো প্রষ্টার দিকে। ওদের মধ্যে
আর কথা হলো না। 


ভেসে আসা ছায়াগুলো মানবাত্মা। ওরা ভেন্টিলেশনে ছিল, ভেন্টিলেটর কার্যক্ষমতার থেকে বেশি কাজের চাপে বাস্ট করেছে, আগুন লেগে গিয়েছিল ফলে মারা গেছে ওরা। ওরা ভাসছে; ভাসছে দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত! নিজের আত্মীয়স্বজনকে একটু চোখে দেখার জন্য ভাসছে; নিজের কাছের মানুষদের দেখতে কার না ইচ্ছা করে; ওরা যখন অসুস' ছিল তখন তো ওদের আত্মীয়-স্বজনকে কাছে পায়নি। আসতে দেয়নি ওদের কাছে। ওরা ভাসতে ভাসতে যে যার গন্তব্যের দিকে যাত্রা করলো। শধু দুই ছায়ামানব বসে রইলো; ওরা ওদের আত্মীয়স্বজনদের দেখে এসেছে। একজন মুগ্দা, অন্যজন  বাসাবো। ওরা অবাক হলো দুই জায়গাতেই করোনাক্রান্ত রোগী বেশি। লকডাউন। ওদের তো আর লকডাউন মানামানি নাই। একদিন মেনেছিল ওরা,এখন সে বালাই চুকেবুকে গেছে। ওরা চুপচাপ! প্রষ্টা দেখলো অন্যদিক থেকে আরও কয়েকজন আত্মা আসছে। ওদেরকেও শোনার চেষ্টা করলো প্রষ্টা। ওদের মধ্যে একজন বলল, ‘ঈদের ছুটিতে আসার কথা ছিল কিন'  তার আগেই বন্ধ রেলপথ, সড়কপথ, আকাশপথ; টিকিট ফেরত দেয়ার কথা; কিছু করার ছিল না! অপেক্ষা করছিলাম এরমধ্যে করোনাক্রান্ত হয়ে এখানে!’ অন্য আত্মা বলল, ‘আহা! এই তো আমরা। আমরা শ্রমিক, নিজ দেশ থেকে ধনীদেশে আমরা কাজ করতে গিয়েছি, আমরা তো নিম্নশ্রেণীর লোক, মানুষ না; কী করার...’ একজনকে আসতে দেখে চুপ করে যায় সে।কি হলো চুপ করে গেলে, বলো।ইশারাতে না করলো প্রথম আত্মা। দ্বিতীয়জন তাকিয়ে দেখলো ভাসমান ছায়ামানবের দিকে। ওদের দেখে থেমে জ্ঞিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ভাসমান ছায়াটি; সেও  একটি আত্মা। অণুজীব প্রষ্টার মতো প্রশ্নবাণ ছুটিয়ে দিলো ১ম আত্মা , ‘কে তুমি? কোথা থেকে আসছো? এখানে কী জন্যে?’  খুব কাঁচুমাচু মুখে তৃতীয়জন বলল, ‘আমি এক হতভাগা দিন আনা দিন খাওয়া জন, যাকে বলে দিনমুজুর বা শ্রমিক; গাঁয়ের ভাষায় যাকে বলে কৃষাণ বা পাইট। এই করোনা সময়ে কোন সাহায্যি পাইনি, চায়েচিন্তে  যা পাইছিলাম তাই দিয়ে পরিবারকে খাইয়ি, নিজে খাইছি; তারপর সপ্তাহখানেক না খায়ি; কিচ্ছু জোগাড় করতি পারিনি, কাজ বন্ধ, যানবাহন বন্ধ, কোথাও যাতিও পারিনি, ওদিকে বউ-পোলাপানগুলানের না খায়ি থাকা সহ্যি করতি না পাইরে নিজের মরণ নিজেই ডাকছি, এখন ভাসতেছি!’ তৃতীয়জনের কথা শুনে ওদের ছায়াচোখে নামলো জলের ধারা।

ওরা ভাসতে ভাসতে চলে গেল অনেকটা দূরে। হঠাৎ দেখে ছোট একটি ছায়াশরীর; কাঁদছে। ওদের ছায়াপ্রাণে মায়া হলো; কাছে গিয়ে ৩য় বলল, ‘সোনামেয়ে কাঁদছো কেন? কী হয়েছে? কে মেরেছে? মা-বাবা ছেড়ে এসেছো বলে কাঁদছো?’ মেয়েটি তাঁর ছায়াচোখে অবাক তাকিয়ে কান্নাধরাকন্ঠে বলে,  না! আমি মা-বাবাকে ছেড়ে আসতে চাইনি! আমি খেলতে গিয়েছিলাম তারপর এখানে; কী করে যে এলাম বুঝতে পারিনি; তবে বাতাসে ভাসার আগে খুবই কষ্ট পাইছি। কষ্ট পেতে পেতে কত্ত ডাকছি মাকে-বাবাকে কিন' কেউ আমার ডাক শুনতে পায়নি! পরে মাইকিং শুনি, ‘আমাকে খুঁজছে সবাই। আমাকে যারা এখানে এনেছে তাদের দেখতে পাইনি তবে পাবো, তখন বুঝিনি তবে এখন বুঝতে পারবো, আমার মা-বাবা তো আমার কথা শুনতে পাবে না তাই আমিও আল্লাহ্র কাছে সব বলে দিবো।ছায়ামেয়ে চুপ করে। শব্দহীন কান্নার জল ঝরে কোলের ওপর। তিনজন আত্মাই সমস্বরে বলে, ‘ওরা পাষণ্ড, নরকের কীট। ওদের কেন করোনা ধরে না? করোনা ধরুক ওদের, ধরুক করোনা!’ ছায়ামেয়েটির পাশে বসে ওরা; কথা হারিয়ে যায় ওদের। হঠাৎ বৃষ্টি নামে। ঝড়বৃষ্টিতে তো ওদের কিছু যায় আসে না। ওরা বসে থাকে।সুপার ঘূর্ণিঝড়আসছে আসুক। ওদের ভাবনায় চলে উথালপাথাল; তিনজনেরই একই ভাবনা;  হোক ঝড় উল্টেপাল্টে যাক এই দুনিয়া, যতো কিছু অন্যায় আছে ধুয়ে যাক, উড়ে যাক; উড়ে যাক রোগবালাই! আবার আগের মতো স্বাভাবিক হোক এই ধরা, পৃথিবীর মানুষ ভালো থাক, ওদের মন ভালো হোক; পরিবার নিয়ে সুখে থাক সকলে।

ওরা বসে আছে। ছোট মেয়েটির কান্না থেমেছে। ছোট মেয়েটি বুঝতে পেরেছে কখনো আর ফিরতে পারবে না ওর মা-বাবার কাছে।


প্রষ্টার মন খারাপ। এই মানবমৃত্যু মিছিলের কারণ হতে চায় না ও। ইটলির এই মৃত্যু ভালো লাগছে তা ওর কথা-বার্তাতেই বুঝতে পেরেছে প্রষ্টা। প্রষ্টা কী করবে তাই ভাবছে। ও একা। ওর সঙ্গে কেউ নাই। না থাকার কারণও আছে; ও তো সৃষ্টিছাড়া এক অণুজীব! ওর চিন্তা অন্য সব অণুজীব থেকে পৃৃথক! ওদের যে সভা হয়েছে সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে আরও কিছুদিন এই বিশ্বে মানবের মাঝে থাকতে চায় ওরা; লক্ষ-লক্ষাধিক মানুষকে সরিয়ে দিয়েও শান্ত হতে পারছে না, সি'র হতে পারছে না! ওরা বলছে, মানবজাতি ক্ষতি করেছে এই প্রকৃতির, প্রকৃতি পুণর্বিন্যাস চায়; প্রকৃতির এই পূণর্বিন্যাসের দায়িত্ব পালন করছে ওরা! মানুষের মতো ওরাও এই প্রকৃতির অংশ; মানুষের অত্যাচারে সৃজিত সব দুর্যোগের মতো ওরাও মানবসৃজিত; মানুষের কাজে যে ক্ষতি হয়েছে প্রকৃতির তার ক্ষতিপূরণ কে দিবে? ক্ষতিপূরণ তো দিতে হবে মানবকেই। এইসব কথা বুঝতে পারে প্রষ্টা তবুও মন সায় দেয় না! প্রষ্টা অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে ইটলিকে কাছে ডাকে। বলে, ‘ইটলি চলো না আমরা একটা দল করি, দল করি ওদের নিয়ে, যারা এই মৃত্যুর পক্ষে নয়!’ ইটলি রাগ না করে মোলায়েম কন্ঠে বলল, ‘তুমি প্রষ্টা, এক সৃষ্টিছাড়া অণুজীব! আমরা কি আমাদের চরিত্রের বাইরে যেতে পারি, পারি না; যাওয়া উচিত নয় আমাদের! মানুষ-পশু-পাখি মারা তো আমাদের প্রধান ও একমাত্র চরিত্র! চরিত্রের এই দিকটা যদি না থাকে তাহলে আমরা তো আর মৃত্যুকণাবাহী অণুজীব থাকলাম না; আমরা তখন হয়ে যাবো এককণা চর্বিদলা! আমাদের উত্তরসুরী থাকবে না! না-না এই চরিত্র আমি বদলাতে পারবো না।ইটলির কথা শেষ হতেই দেখতে পেলো পাশের ফুটপাতে এক নারী হাঁটতে হাঁটতে এসে বসলো। পাশে রাখলো ব্যাগ। তাঁর গ্লাভস নাই, মাস্ক নাই; শাড়ির আঁচল অসাবধানে লুটিয়ে আছে ফুটপাতে। ওকে দেখেই হেসে উঠলো ইটলি, প্রষ্টাকে বলল, ‘আমার সময় নাই, তোমার কথা শোনার।প্রষ্টা কিছু বলার আগেই মেয়েটির আঁচলে গিয়ে বসলো; ঠিক তখনই মেয়েটি তাঁর আঁচল তুলে মুখ-হাত মুছে চোখের ওপর রাখলো আঁচলটা; চোখ কটকট করছে ওর! চোখ শাড়ির আঁচল দিয়ে অনেকক্ষণ ডললো, তারপর হাত দিয়ে চোখের পাতা তুলে শাড়িতে মুখে ভাপ দিয়ে চোখের ওপরে চাপ দিলো। সেই সুযোগে ইটলি আনন্দে এক থেকে চার হয়ে ঢুকে গেল ঐ মেয়েটির মধ্যে। হায় হায় করে উঠল প্রষ্টা। এটা কী করলে ইটলি; এতোবার বারণ করা সত্ত্বেও শুনলে না কথা।


মন খারাপ প্রষ্টার! মনে মনে ভাবলো আর সম্পর্ক রাখবে না অণুজীবদের সঙ্গে; একাই লড়বে মানবকুলের পক্ষে ওর স্বজাতির বিরুদ্ধে। একটা দল গঠন করবে ও; ওখানে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ও হবে প্রশিক্ষক! এই মানবমৃত্যু সঙ্গে স্বজাতির মৃত্যুও হচ্ছে! স্বজাতিরমৃত্যুও ভালো লাগছে না ওর। কিন' দল কীভাবে করবে! ওর কথা কেউ কানে তুলবে মনে হয় না। ইটলিকে দেখে বুঝেছে কেউ ওর কথাতে সায় দিয়ে স্বজাতির বিরুদ্ধে যাবে না। ও সব কিছু দেখে ভেবেছিল ওদের মতো মৃত্যুতে এতো আনন্দ কেউ পায় না; কিন' ওর ভাবনা ভুল প্রমানিত হয়েছে কারণ ও দেখতে পেয়েছে ওদের এই যাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকেই চলছে বিশ্বে মানবসৃষ্ট হানাহনি-মৃত্যু! রোড-অ্যাকসিডেন্টে মৃত্যু, মৃত্যু জায়গা দখল-ক্ষমতা দখল-পারিবারিক কলহ নিয়ে; প্রষ্টা আরো অবাক হয়েছে যখন দেখেছে শুধু টাকার জন্য বিক্রি করেছে মেয়েকে, মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে সন্তানকে মা-বাবা! অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে মানব; খুব অসহায় লাগছে প্রষ্টার! নিজেকেই দোষ দেয় প্রষ্টা; ওর মনে হয় ওরা এভাবে সংক্রমণ ঘটিয়েছে বলেই না অপরাধ বেড়েছে। প্রষ্টা এখান থেকে না অন্য কোথাও না গেলেও জানে কোথায় কী হচ্ছে! ওদের কারণে লকডাউন চলছে সবখানে। লকডাউন ভেঙে বাইরে আসার কারণে একদেশে গুলি করে মেরেই ফেলেছে লকডাউন-ভাঙনকারীকে; একটি জীবন্ত প্রাণকে মেরে ফেলা অন্যায়। আর একদেশে চিড়িয়াখানায় বন্ধ করে রেখেছে, কোথাও বা রাস্তা ঝাড়- দিতে বলেছে; এগুলো ঠিক আছে কিন' গুলি করা; নাহ্‌! প্রষ্টার মনে কষ্টের পাহাড় জমে।  প্রষ্টা নিরব! প্রষ্টা যে কোনো মানবশরীরে ঢোকেনি তা নয়; ঢুকেছে কিন' তাঁকে মৃত্যু যন্ত্রণা দেয়নি, তাঁকে বাঁচিয়ে নিজেও বেঁচেছে! একদিন কোনো না কোনো একটা পথ বের করে বেরিয়ে এসেছে। অবশ্য খুব কষ্ট হয়েছে বের হতে; একবার তো মরে যেতেই বসেছিল পরে কীভাবে কীভাবে বেঁচে গিয়েছে! এরপর থেকেই অনীহা; কিন্তু প্রশিক্ষক তো শুনতে চায় না! প্রষ্টার মনের কষ্ট-পাহাড় থেকে জল-প্রপাতের সৃষ্টি হয়! প্রষ্টার মনে হতাশা বাসা বাঁধতে শুরু করে! প্রষ্টার পাশ দিয়ে একটি পরিবার কথা বলতে বলতে  হেঁটে যাচ্ছে; প্রষ্টা শুনতে চায়, বুঝতে চায় কোথা থেকে এসেছে, কোথায় যাচ্ছে ওরা?  গ্রাম থেকে আসছে। গার্মেন্টস-এ কাজ করে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই। গার্মেন্টেস বন্ধ দিয়েছিল; ঠেলাঠেলি দাপাদাপি করে গিয়েছিল গ্রামে, খোলার পরে আবার সেই গাদাগাদি ঝাঁপাঝাপি গ্রাম থেকে আসা। এখন যানবাহনহীন সড়ক;ওরা হাঁটছে! ওদের সঙ্গের ছোটশিশুটা খিদের কষ্টে কাঁদছে! আহা! এতো ভোগান্তি মানুষের। কী করবে প্রষ্টা! কী করার আছে? বসে থাকে! মানুষ হলে হয়তো গালে হাত রেখে ভাবতো কিংবা গালে-চিবুকে আঙুলে ছোটোছেটো আঘাতে উদাস চোখে ভাবতো! প্রষ্টা অতোটা করতে না পারলেও ভাবছে, গভীরভাবে ভাবছে!


ইটলি যে নারীর দেহে ঢুকেছিল ওর নাম মাসুদা। ওর সঙ্গে চলা শুরু করে ইটলি। ইটলির ভালো লাগছে; বেশকিছুদিন পর একটি দেহ পেয়েছে খেয়েপরে বেঁচে থাকার জন্য! ইটলি গ্যাঁট হয়ে বসেছে; খুব আরামে দেহটা চষে বেড়ানোর প্রস্তুতি নিতে হবে তো! তাছাড়া ওর আয়ু তো প্রায় শেষের দিকে মানবদেহ আবাদ না করলে ও তো বাঁচবে না; ওকে বাঁচেেত হবে, আরো কিছুদিন বেঁচে থাকতে হবে; উত্তরসুরী রেখে যেতে হবে! মনের আনন্দে মাসুদার দেহের মধ্যে একটা ঘুম দেয় ইটলি।

ঐ নারী একটি বস্তিতে থাকে। বাড়িতে ঢুকতেই শুরু হয় ঐ স্বামীর চিৎকার! ‘হারামজাদী সেই কোন কালানে বাইর হইছিস আওনের নাম নাই। ঘর থেন বাইর হইলে আর ঘরে ফিরতি মন কয় না!’ স্বামীর চিৎকারে মাসুদা কোন কথা বলছে না; ও কথা বলতে পারছে না! নিজের কাছেই আশ্চর্য লাগছে, এমন লাগছে কেন ওর? স্বামীর কথা শুনতেও পাচ্ছে না মাসুদা! ওর কথা না বলাতে স্বামীর রাগ বাড়ছে সেই সঙ্গে বাড়ছে চিৎকার। মাসুদার স্বামী, রাজা কোন কাজ করে না; না ঘরের না বাইরের! ঘরে বসে সারাদিন ইয়ার-দোস্তদের নিয়ে তাস খেলে, জুয়া খেলে কাটিয়ে দেয়। সময়ে খাবার না পেলে চিৎকার-চেঁচামেচি করে, বউয়ের গায়ে হাত তোলে। মাসুদা কিছু বলে না; বলতে ইচ্ছা করে না। এটি ওর দ্বিতীয় বিয়ে; বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছিল প্রথমে।  দুই বছরের মাথায় এক মাসের মেয়ে আর ওকে ফেলে চলে গেল! ব্যাংকে দারোয়ানের চাকরি করতো। একদিন ব্যাংক-ডাকাতির সময় ডাকাতের ছুরির ঘায়ে মারা যায় মাসুদার স্বামী। মাসুদার দ্বিতীয় স্বামী, প্রথমজনের বন্ধু ছিল; সেই সুবাদে আসা-যাওয়া ছিল। ওর ছোট মেয়েটাকে খুব আদর করতো, বাজারঘাট করে দিতো। এরপর ঐ ব্যাংকে আয়ার চাকরি পেলো মাসুদা। ভালোই যাচ্ছিল দিন! ভূতে পেয়েছিল ওকে না হলে এই লোকের মোহে পড়ে বিয়ে করে ওকে! বিয়ের পর থেকেই শুরু হলো অত্যাচার! অত্যাচারে অত্যাচারে ক্লান্ত মাসুদা। এই অবস্থার জন্য মেয়েটাকে ওর নানির কাছে রেখে দিয়েছে; ওখানে টাকা পাঠায় মাসে মাসে। ঐ মেয়ের জন্যই সব সহ্য করে চলেছে মাসুদা!
মাসুদা মুখ বুঁজে কাজ করছে, স্বামীর কথার কোন জবাব দেয় না; ইচ্ছা করছে না কথার জবাব দিতে শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। ও তো ভালোই ছিল হঠাৎ গা ম্যাজম্যাজ করছে, নিজেই কপালে হাত দিয়ে গরম হয়েছে কিনা পরীক্ষা করলো। নাহ্ঠাণ্ডা্‌; স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মাসুদা। ও শুনেছে একটা ভাইরাস আসছে জ্বর থাকে, সর্দি,কাশি থাকে; যাক ওর এসব নাই; স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মাসুদা। কাজ করতে থাকে। ওর চুপ করে থাকা পছন্দ হচ্ছে না রাজার; শুয়েছিল উঠে বসে; আরো জোরে শুরু করে চেঁচামেচি। এবারে কথা বলে মাসুদা। বলে, ‘রাত দিন শুয়েবসে থাকো আর জুয়া-তাস খেল সংসারে কোথায় কী হচ্ছে সে খবর রাখো না, খালি চিল্লাও!’ ওর কথাতে আরো রেগে যায় রাজা। উঠে এসে স্ত্রীর পেছন থেকে জোরে ধাক্কা দেয় রাজা। মাসুদা ঢলে পড়ে যেতে নেয়; দুহাতে ধরে ঝাঁকাতে থাকে মাসুদাকে! মাসুদার মাথা ঘুরাচ্ছে। ওর মাথা ঘোরাতে দেখে খুশি ইটলি। মাসুদার দেহের জমিনে আনন্দে-খুশিতে লাফাতে ইচ্ছা করছে ইটলির। এমন সময় ঝাঁকুনি পায় ইটলি। কী হলো! ভূমিকম্প! আরো খুশি হলো। ভূমিকম্প হলে তো ভালো, খুশির খবর! ইটলি অপেক্ষা করে। নাহ্‌! এতো তেমন না! অনেক বেশি ঝাঁকুনিতে ভীত ইটলি বের হয়ে আসে চোখের জলের ভেতর দিয়ে; ওমা, মেঝেতে পড়ে আছে ওর আবাসস্থল-মাসুদার দেহ! চে খের কোণে জমে আছে জল! কিছুক্ষণ পর নিথর হয়ে গেল ঐ নারী!
ইটলির মন খারাপ হয়ে গেল। ইচ্ছা করলো ঐ পুরুষটাকে মেরে ফেলতে। এই রকম মানবকেই তো সরিয়ে দিতে হয় এই পৃথিবী থেকে। বিবস ইটলি; একবার রাজার দেহে ঢুকতে চাইলো ওকে মেরে ফেলার জন্য; পরক্ষণেই ভাবলো কী হবে ঐ হতচ্ছাড়া নচ্ছাড় হারামি  মানবকে মেরে! শুধু শুধু নিজের শরীরটাকে ক্লেদাক্ত করা! ওদের কাজ মানবকে মারা কিন' মানবের কাজ তো মানবের হিত করা, মানবের হিতে বেঁচে থাকা আর কাজ করা! রাজাকে দেখে গা গুলিয়ে ওঠে ইটলির; উল্টা-পাল্টা ডিগবাজী খেয়ে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে কী করবে তাই ভাবতে লাগলো; এখানে ওর ভালো লাগছ না! কিন' কোথায় যাবে? কোথায় যাওয়া যায়! অদ্ভুত এক পরিসি'তিতে পড়েছে ইটলি; এখানে থাকতে ভালো লাগছে না, আবার অন্য কোন মানবশরীর না পেলে কেমন করে বাঁচবে? কেমন করে জন্ম দিবে উত্তরসুরী? উত্তরসুরীর হাতে এই মানবমৃত্যুর ভার না দিয়ে ওর তো সুখ নেই; সুখে থাকতে পারছে না ইটলি। বিষণ্ন মনে বসে রইলো ইটলি!


রাজা- মাসুদার কাছে রাজার বোনের একটি মেয়ে বড়ো হয়েছে; বয়স বছর পনেরো! বিয়ে দিয়েছে। মাসুদাকে মা ডাকে! মেয়েটার আসার কথা; মেয়েটা এসেও পড়েছে। দরোজার কড়া নাড়ার শব্দ। রাজা দরোজা খুলে দেয়।মা কই? মা ঐখানে ঐরকম শুয়ে আছে কেন? মা মা, ওমা!’ ডাকতে ডাকতে মায়ের মাথার কাছে বসে আস্তে ধাক্কা দেয়। মাসুদা কথা বলে না। অনেকক্ষণ ডাকতে ডাকতে কথা বলছে না দেখে নাকের সামনে হাত দিয়ে চিৎকার করে ওঠে।ও মামা, মায়ে কী মইরা গেছে।মেয়ের কথা শুনে দৌড়ে আছে রাজা। সত্যি মারা গেছে মাসুদা। এখন কী করবে রাজা! ভেবে না পেয়ে মৃত মাসুদা আর জীবন্ত মায়াকে রেখে রাস্তায় পা রাখে। ইটলির মন আরো বিষণ্ন হয়। মায়ের বুকের ওপর কান্নাকাটি করছে মেয়ে। কিন' ইটলির একটা শরীর চাই, একটা শরীর। মেয়েটাকে মারার ইচ্ছা নাই, তবে আর কোন শরীর পেলে ছেড়ে দেবে ওকে। ও মেয়েটার শরীরে ঢুকে যায়!
ঈদের জামাত করা নিষিদ্ধ ছিল; মসজিদে যাওয়াও একরকম নিষিদ্ধ ছিল; কিন' সামাজিক দূরত্ব মেনে নামাজ আদায় করা যাবে! মসজিদেও এখন নামাজ আদায় হয়! ইটলি মন খুশি হয়ে যায়। মাকে নিয়ে টানা হেঁচড়া করে না মেয়ে। আশেপাশের লোকজন আসলে বাধা দেয় পুলিশ। পুলিশ নিয়ে যেতে চায় কিন'নিতে দেয় না মেয়ে; বলে, ‘মায়ের করোনা নাই।পুলিশ বিশ্বাস করতে চায় না। আবার মেয়েটির কান্নাকাটিতে পুলিশ কিছু বললো না! অনুমতি দিলো। ইটলির সৌভাগ্য; পুলিশের হাত পড়ে নাই! পুলিশের হাত পড়লে তো ওর আর বেঁচে ওঠা হতো না। পুলিশ প্রহরায় মাসুদার মরদেহ গোসল করানো হলো। যারা মরদেহ গোসল করালো তাদের মধ্যে বাসা বাঁধলো কয়েকটি অণুজীব; ওদের সঙ্গে নিয়ে এসেছিল ইটলি। ওদের সঙ্গে এনেছিল এবং বলেছিল ঐ মেয়েটির শরীরে যেন না যায়। ঈশ্বর ভরসা; দেখা যাক। মেয়েটি, অর্থাৎ মায়ার শরীরে আপাতত থাকবে ইটলি কারণ এতো সুন্দর মনের মেয়েকে মারতে ইচ্ছা করছে না ওর; তাছাড়া সন্তানসম্ভবা মেয়েটি! দুজনের জীবন নিতে ইচ্ছা করছে না ইটলির। ইটলি শ্যেনদৃষ্টিতে দেখে রাখছে কার দেহজমিনে চাষাবাদের জন্য ঢুকবে; এখন তো অনেকে সামাজিক দূরত্ব না মেনেই সান্ত্বনা দিচ্ছে মেয়েটিকে! সুযোগ বুঝে ঢুকে যাবে কোন একজনের দেহজমিনে।

মসজিদে জানাজার জন্য নেওয়া হলো মরদেহ! মেয়েটিও আছে সঙ্গে; খুব কাঁদছে। যখন কাঁদছে মেয়েটি ঠিক সেসময় মেয়েটির  কাছে এসে দাঁড়ায় রাজা! ওর হাত ধরে, চোখ মুছিয়ে দেয়। বলে, ‘কাঁদিস না, কাঁদিস না।এই সুযোগ হাতছাড়া করে না ইটলি! এমনিতে লোকটার ওপর রাগ জমেছিল, শোধ তো একটা নিতেই হবে! ইটলি সুরুত করে ঢুকে গেল ঐ লোকটির শরীরে! প্রথমদিকে ভেবেছিল ঢুকবে না; কিন' ইচ্ছার পরিবর্তন করে বাসা বাঁধলো রাজার দেহজমিনে; কিছুদিন জোর শাস্তি দিতে হবে! ইটলি জুতজাত হয়ে বসে গেল রাজার দেহজমিনে।  মায়ের জানাজা শেষে স্বামীর সঙ্গে শ্বশুর বাড়ি চলে গেল মেয়ে। প্রথম রাত্রি থাকলে তিন থেকে সাতদিন থাকতে হবে তাই; ওর থাকার উপায় নেই, শাশুড়ি অসুস' তাঁর দেখভাল করতে হয়, সংসার সামলাতে হয় ওকে!


প্রষ্টা সঙ্গী খুঁজে বেড়াচ্ছে কিন' পাচ্ছে না; যেসব অণুজীবের দেখা পাচ্ছে সেসব অণুজীব কিছুতেই রাজী হচ্ছে না প্রষ্টার সঙ্গে থাকতে; কেউ থাক বা না থাক একাই থাকবে, একাই চেষ্টা করবে প্রষ্টা। ও জানে কোন ভালো কিছু করতে গেলে কিছু কষ্ট সহ্য করতেই হবে! কখনও কখনও ভালো কাজের জন্য জীবন দিয়েছে অনেকে; এটা অবশ্য মানুষের মধ্যে বেশি হয়! যেমন হয়েছিল ১৯৭১-এ। পাকি-আর্মিরা অনেককে মেরে ফেলেছিল; নারী-পুরুষ-শিশু কাউকে রেহাই দেয়নি! তবুও জীবনবাজী রেখেছিল স্বাধীনতার জন্য। শুধু একাত্তর কেন? একাত্তরের আগেও মারা গেছে অনেকে; যখন ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল ভারতবর্ষ তখনও মারা গেছে েেদশের জন্য; মারা গেছে ক্ষুদিরাম, মারা গেছে প্রফুল্ল চাকী, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, কানাই লাল দত্তসহ আরও অনেক বিপ্লবী মহাপুরুষ! বিপ্লব ঘটাতে হলে মারা যেতেই হয় কাউকে না কাউকে। প্রষ্টার ইচ্ছা বিপ্লব ঘটাবে; অণুজীববিপ্লবী কমিটি একটা দাঁড় করাতে পারলে ভালো হতো! প্রষ্টা ভাবছে; কিন' কী ভাবে দাঁড় করাবে একটি বিপ্লবী কমিটি! এগিয়ে আসছে না কেউ; কেউ সঙ্গী হতে চাইছে না ওর!

কী জানি কেন প্রষ্টার মনে হয়, বিশ্বের মানবদের অনেকেরই মৃত্যু দেখতে ভালো লাগে, ভালো লাগে রক্ত দেখতে! ওরা অণুজীব-কীট, ওদের মধ্যে আছে, থাকবেই! প্রষ্টা তো দেখছে-শুনছে এই কোভিড মহামারী ছাড়াও থেমে নেই অন্যরকম মৃত্যু! মৃত্যু হচ্ছে লঞ্চ ডুবিতে, বাস দূর্ঘটনাতে রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে গলি থেকে রাজপথ! মরণকে আলিঙ্গন করছে অনেক মানব চিকিৎসা না পেয়ে! পারিবারিক কলহে মৃত্যু হচ্ছে কখনও স্ত্রী, কখনও স্বামী, কখনও বা সন্তান! ছিনতাই-রাহাজানি-নারীর সম্ভ্রমহানি করে ছিনিয়ে নিচ্ছে জীবন। শুধু তো এই নয় সীমান্তে সীমান্তে চলছে হানাহানি! মহামারী তো মানবকুলের দুঃসময় এর মধ্যে ওরা ডুবে আছে অপরাধ সাগরে! আর ওরা তো মৃত্যুসাগরের জলকণা; ওদের তো মৃত্যুর সঙ্গেই সখ্যতা! মৃত্যু ঘটানোই কাজ ওদের! তবুও চেষ্টা করবে প্রষ্টা! যেমন ভালো কাজের জন্য মানব-সমাজের অনেকেই মৃত্যুক আলিঙ্গন করলেও যুগে যুগে আসে মৃত্যুঞ্জয়ী মানব! তেমনি খুঁজে ফিরবে এই মৃত্যুসাগরের জলকণা সি'র করার আন্দোলনে শরীক হওয়ার জন্য মৃত্যুঞ্জয়ী অণুজীব! চেষ্টা অব্যাহত রাখবে; রাখতেই হবে; কারণ একদিন ভ্যাকসিন আবিষ্কার হবে; তখন তো ওদেরকে সি'র হতেই হবে! তাহলে আগে থাকতে কেন নয়? প্রষ্টা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ; বাঁচতে হবে, বাঁচাতেও হবে!