গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ৭ জুলাই, ২০২০

বর্ণালী রায় মিত্র


রূপম


শিশুটি যখন জন্মেছিলো তার রূপের দ্যুতি সবাইকে মুগ্ধ করেছিল। 
কাঁচা সোনার মত গাত্রবর্ণ, তীক্ষ্ণ নাসিকা, পদ্মের পাপড়ির মত টানা টানা চোখ, রেশমের মত নরম কালো কোঁকড়া চুল। 
জন্মের দিনকতক পরেই তার নাম রাখা হোলো রূপম। 
প্রথম পুত্রের ঘরে প্রথম সন্তান, কাজেই বাড়িতে আনন্দের জোয়ার এলো।.
কিন্তু ভাগ্যের লিখন নামক এক বিষম বস্তু যে থাকে, তাকে খন্ডাবে কে !!
জন্মের অনতিকাল পরেই পরীক্ষায় ধরা গেল অমন সুদর্শন শিশুটি জন্মান্ধ। 
তার টানা টানা ভ্রমরকালো চোখদুটি  দৃষ্টিহীন। কোনো আলোর রশ্মি সেখানে পৌঁছায় না। 
স্বভাবতই পরিবারে নেমে এলো শোকের কালো ছায়া। আনন্দের জোয়ার বদলে গেল বিষাদের চোরা স্রোতে। 
পরিবারটি আর্থিক দিক থেকে যথেষ্ট সম্পন্ন, কাজেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সেরা চক্ষু চিকিৎসকদের কাছে তাকে নেওয়া হতে লাগলো (সেই সময় চক্ষুদানের রীতি তেমন শুরু হয়নি) 

চিকিৎসকগণ রায় দিলেন, আশার আলো আছে, তার চোখের কর্নিয়া ত্রুটিযুক্ত।  
পরিবারের কেউ যদি কর্নিয়া দান করেন, তবেই তা প্রতিস্থাপন করে শিশুটির দৃষ্টিদান সম্ভব। 
জীবিত অবস্থায় যা দান করা যায় না, অপেক্ষা করতে হয় তাঁর শেষ নিঃশ্বাস অবধি। 
রূপমের ঠাকুরদা ঠাকুরমা মা বাবা  সকলেই তখনি আই ব্যাঙ্কে চক্ষু দানের অঙ্গীকার করে রাখলেন। ভবিষ্যতে তাঁদের যে কারুর নেত্র তাঁদের আদরের রূপমকে দেবে দৃষ্টি, নবজীবন। 

দৃষ্টিহীন মানুষের শ্রবণেন্দ্রিয় চিরদিনই খুব প্রখর ও জাগ্রত হয়। 
সংগীতের প্রতি তাঁদের এক আজন্ম প্রীতি সাধারণত পরিলক্ষিত হয়। 

রূপমের বয়েস যখন আড়াই তিন তখন থেকেই যে কোনো সঙ্গীতের প্রতি তার মনোযোগ ও আকর্ষণ লক্ষ্য করা যেতে লাগলো। 
কাছে হোক বা দূরে, কোনো গান বা সুর শোনা গেলেই সে নিবিষ্ট মনে কান পেতে রইতো। মাথা দুলিয়ে তার ভালোলাগা প্রকাশ করত। 

জানালার ধারে সে বসে থাকতো ঠাকুরমার কোলে। রেকর্ড প্লেয়ারে বাজানো হতো ভালো ভালো গান, সে মাথা দুলিয়ে, ছোট্ট হাত নাড়িয়ে সুরের রস গ্রহণ করত। 

খানিক কাকতালীয় ভাবেই সে পাড়ায় মাঝে মাঝেই আসতো এক অন্ধ বালক ভিক্ষুক, তার পিতার হাত ধরে। পিতার গলায় ঝোলানো থাকতো একটি ছোট হারমোনিয়াম, ছেলের গানের সাথে যেটি বাজাতেন তিনি। গান শুনে পথচলতি মানুষ ও গৃহস্থরা কিছু পয়সা দিতো বালকের হাতে ধরে থাকা ছোট থালায়। 
ভারি সুরেলা তার গানের গলা, সে গাইতো প্রধানত পল্লীগীতি, লোকগীতি যাতে মিশে থাকতো মাটির ঘ্রাণ। 

কোনো এক চৈত্রের সকালে সেই বালক এলো রূপমের পাড়ায়। 

সেদিন সে গাইছিলো ...

"কে কথা কয় রে দেখা দেয় না,
নড়ে চড়ে হাতের কাছে,
খুঁজলে জনম ভর মেলে না 

খুঁজি তারে আসমান জমিন 
আমারে চিনিনা আমি ...
এ বিষম ভ্রমের ভ্রমি ...
আমি কোনজন, সে কোনজনা ....."

রূপম সেই বালকের গান শুনে প্রবল ভাবে মাথা দোলাতে শুরু করে ও ঠাকুরমাকে বলে, ও কে গাইছে ? ওকে ডাকো, ওকে ডাকো ...
নাতির আবদারে ঠাকুরমা জানালা দিয়ে ডাকেন তাঁদেরকে। বালককে অনুরোধ করেন সম্পূর্ণ গানটি শোনাতে। 

গান শেষ হলে নিরুপমা দেবী জানতে চান বালকের নাম। সে জানায় নাম তার আনন্দ। বয়েস বারো তেরো হবে। 
নিরুপমা পিতা পুত্রকে ডেকে বারান্দায় বসান ও কিছু খাবার দেন তাঁদের। 

তাঁদের সামনে মোড়া পেতে বসে নিরুপমা আনন্দর পিতার সঙ্গে নানা কথা বলেন, নাতির দৃষ্টিহীনতা ও সঙ্গীতপ্রিয়তার কথা জানান। 

ইতিমধ্যে রূপম ঘর থেকে বলতে থাকে, ঠাম্মি ওই গানদাদাকে বলো, রোজ আসতে, আমায় গান শোনাতে।

নিরুপমা আনন্দর পিতাকে জানান নাতির আবদারের কথা।
আনন্দর বাবা পরেশ সামন্ত নিজে এক দৃষ্টিহীন বালকের জনক, তাই কোথায় যেন অন্তরের এক টান অনুভব করলেন রূপমের প্রতি। 
হেসে বলেন, আচ্ছা তাই হবে মা, চেষ্টা করব আসতে, তোমার রূপমকে গান শুনিয়ে যেতে।  

সপ্তাহে তিন চার দিন আনন্দ আসতে লাগলো সে পাড়ায়, রূপমকে শুনিয়ে যেত গান .......

একদিন সে গাইলো ...

"বাড়ির কাছে আরশী নগর 
সেথা পড়শী বাস করে 
আমি একদিন ও না দেখিলাম তারে 
গেরাম বেড়ে অগাধ পানি 
নাই কিনারা নাই তরণী পারে 
বাঞ্চা করি দেখব তারে 
আমি কেমনে সেথা যাইরে ..."

রূপম নিস্পন্দ হয়ে শোনে তার গান, 
গান শেষ হলে দুই হাতে তালি দিয়ে প্রকাশ করে তার ভালোলাগা।
আনন্দ চলে যাবার পর সে আপনমনে গুণগুনিয়ে চলে সেই গানের সুর। 

সঙ্গীতের প্রতি তার অনুরাগ ও গলায় সুরের নিপুণ দখল দেখে তার জন্য একজন সঙ্গীতশিক্ষক নিয়োগ করা হলো। 
প্রতি শনিবার ক'রে তিনি বাড়িতে এসে গান শেখাতে লাগলেন রূপমকে। সাড়ে তিন বছর বয়েসের বালকের সুরজ্ঞান বিস্মিত করত শিক্ষককে। 
রাগপ্রধান বাংলা গানেই তার আগ্রহ বেশি। 
বছর খানেক পর রূপমকে ভর্তি করা হলো দৃষ্টিহীনদের বিদ্যালয়ে।

স্থির করা হলো সে প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার বিকেলে বাড়ি আসবে, সোমবার ভোর বেলা তাকে আবার দিয়ে আসা হবে তার বিদ্যালয়ে। 
ব্রেইল পদ্ধতিতে চলতে লাগলো তার পড়াশোনা। সেই সাথে সঙ্গীতশিক্ষা। 

আনন্দ ও তার বাবাকে অনুরোধ করা হলো তাঁরা শনি ও রবিবার সকালে আসবে, আনন্দ গান শোনাবে রূপমকে।

নিরুপমা দেবী ওই দুদিন তাঁদের মধ্যাহ্ন আহারের ব্যবস্থা রাখতেন। 

এভাবে কেটে গেল আরো সাত বছর। 
রূপমের ঠাকুরদা হঠাৎই হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন এবং দিন ছয়েকের চিকিৎসার অন্তে চলে গেলেন। 

পূর্ব নির্ধারিত কথা অনুযায়ী তাঁর  চোখের কর্নিয়া প্রতিস্থাপিত করা হলো রূপমের চক্ষুতে। স্বভাবতই তার মা বাবা ও ঠাকুরমা খুবই উৎকণ্ঠিত রইলেন, অপারেশনের দিনটিতে। 

অস্ত্রপ্রচার সফল হলো। 
রূপম পেল দৃষ্টি।

দু চোখ ভ'রে সে দেখলো মানুষ দেখতে কেমন, চিনলো পরম আপনজন মা, বাবা ও ঠাকুরমাকে। 
পৃথিবীর সব রং, রূপ ধরা দিল তার চোখে। 

ঠাকুরদার জন্য তার দুচোখ জলে ভ'রে উঠলো। যাঁর কারণে সে নবজীবন পেল, তাঁকে চাক্ষুস দেখা তার আর হলো না। 

দৃষ্টি পাবার পরেই রূপম প্রবল ভাবে আগ্রহী হলো আনন্দদাদাকে দেখতে, যে শিশুকাল থেকে গান শুনিয়ে তার মন ভরিয়েছে। তার প্রিয় গানদাদা।

রূপমকে বাড়িতে নিয়ে আসার দিনকতক পরেই আনন্দ এলো তাঁর বাবার হাত ধরে। 

রূপম ভালোবেসে আলিঙ্গন করলো তাকে, বলল, গান শোনাও আনন্দদাদা, আজ আমি তোমার দিকে চেয়ে চেয়ে প্রাণভরে শুনব তোমার গান। 

আনন্দ তখন কৈশোর অতিক্রম করে নব্যযুবক, তার গানের গলা ও সুরবোধ আরো পরিপক্ক হয়েছে।

সেদিন সে গাইলো ...

"খাঁচার ভিতর অচিন পাখি 
কেমনে আসে যায় 
তারে ধরতে পারলে মন বেড়ি 
দিতাম পাখির পায়ে। 

আট কুঠুরি নয় দরজাটার 
মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাটা 
তার উপরে সদর কোঠা 
আয়না মহল টায় ....." 

গান শেষ হলে রূপম আবেগে আবার জড়িয়ে ধরে আনন্দকে।
বলে, কথা দাও গানদাদা, তুমি আমার কাছে থাকবে, কোত্থাও যাবে না আমায় ছেড়ে, কথা দাও আনন্দদাদা  কথা দাও......

এই অন্তরঙ্গ দৃশ্য দেখে মন আর্দ্র হয়ে  ওঠে নিরুপমা ও আনন্দর পিতা পরেশ সামন্তর। 

বছর খানেকের শিক্ষা ও অভ্যাসের পর রূপম সিনহা মূলস্রোতের লেখাপড়ার জগতে প্রবেশ করলো। 

সে তার মা বাবা, ঠাকুরমার কাছে প্রবল ভাবে বায়না করলো, আনন্দদাদাকে তাদের বাড়িতে স্থায়ী ভাবে রাখা হোক, সে যখন খুশি তার গান শুনতে পারবে এবং একজন সঙ্গীও পাবে। 
আনন্দদাদাকে লোকগীতির শিক্ষা দেওয়া হোক, এও তার বিশেষ ইচ্ছা। 

রূপমের অভিভাবকরা আনন্দর পিতা পরেশ সামন্তকে ডেকে জানালেন এই প্রস্তাব। 
পরেশ সামন্ত বললেন, আনন্দর গানের সূত্রে কিছু অর্থ উপার্জন হয়, তা যে বন্ধ হয়ে যাবে ! 
সংসারে তাঁর যে আর কেউ নেই। আনন্দর যখন পাঁচ বছর বয়েস তাঁর স্ত্রী, আনন্দর জন্মদাত্রী, গত হয়েছেন কলেরায় আক্রান্ত হয়ে। 

নিরুপমা দেবী পুত্র ও পুত্রবধূর সঙ্গে আলোচনা করে সামন্ত কে জানালেন তাঁর একার ব্যয় চালিয়ে নেবার মত অর্থ তাঁদের পরিবার থেকে দেওয়া হবে। 

পরের সপ্তাহে আনন্দকে রূপমের গৃহে রেখে তার পিতা চোখের জল মুছে বিদায় নিলেন। 
আনন্দও বাবাকে জড়িয়ে ধরে অশ্রুপাত করলো, কথা হলো তিনি প্রতি সপ্তাহে একবার আসবেনই পুত্রের কাছে। 

রূপমের ইচ্ছায় আনন্দকে সপ্তাহে একদিন নিয়ে যাওয়া হতো একজন লোকগীতির সঙ্গীতশিক্ষকের কাছে। 

মাসদুয়েক পরের কথা.....

কিছুদিন যাবৎ আনন্দকে খুব মনমরা দেখায়। 
সে কথা বলে কম, সারাক্ষণ কী যেন ভাবে উদাস হয়ে।
একদিন সে রূপমের হাত দুটি ধরে বলে, আমাকে যে এবার যেতে দিতে হবে ভাই, গ্রাম যে আমায় ডাকছে, পথ আমায় টানছে.....
যেদিন তোমার আমাকে বেশি প্রয়োজন ছিল আমি তোমার কাছে বারে বারে এসেছি, গান শুনিয়েছি। আজ তুমি দৃষ্টি পেয়েছো, অনেক বড় এক আলোকময় জগৎ এখন তোমার সামনে....আমায় এবার ছেড়ে দাও ভাই.........
বহু মানুষ আমার গানের জন্য পথ চেয়ে থাকে, আমায় তাঁদের কাছে যেতে দাও .....ঘরের চার দেওয়ালের মাঝে আমি যে হাঁপিয়ে উঠেছি গো !!
পথই যে আমার ঠিকানা.......

তবে আমি অবশ্যই আসবো, যেমন আসতাম আগে বাবার সাথে, মন খারাপ কোরো না ভাই.....আমায় যেতে দাও .....

আনন্দর গলায় এমন এক অস্থির আকুলতা ছিল, রূপম কিছু বলতে পারে না। মনের মধ্যে এক তীব্র কষ্ট অনুভূত হয় তার। 

কিন্তু সে এটুকু বোঝে আনন্দদাদাকে ধরে রাখা যাবেনা, রাখা উচিত ও নয়। পথে পথে গান গেয়ে বেড়ানোই তার বেঁচে থাকার নেশা। বাড়ির সকলেই উপলব্ধি করলেন আনন্দর অন্তরের এই তাগিদ ও যন্ত্রণা। তাঁরাও বাঁধা দিলেন না। 

দিনকতক পর বাবা এলে, যাবার জন্য তৈরি হয়ে নিলো আনন্দ। বড়োদের প্রণাম করলো। রূপম তাকে জড়িয়ে বসে রইলো খানিকক্ষণ। 
তার বুকের ভিতরটা তোলপাড় হচ্ছে বিচ্ছেদব্যথায়। 

আনন্দ বলে, ভাই রূপম, আজ যাবার বেলায় তুমি আমায় একখানা ভালো গান শোনাও ....

রূপমের চোখ ভ'রে আসছে জলে, সে গাইলো .....

"আমি ফুলকে যেদিন
ধরে বেঁধে আমার সাজি ভরেছি,
আমি সেদিন থেকে জেতা বাজি হেরেছি ......

আমি ঝড়কে যেদিন কেঁদে সেধে 
আমার মাঝি করেছি,
আমি সেদিন থেকে জেতা বাজি হেরেছি ...

মুক্ত ছিল ঝিনুকে 
আমি হাতে তুলে নিয়েছি,
বুঝিনি সেদিন বড় সাধে 
বুকে দুলিয়ে নিয়েছি 
এখন শূন্য ঝিনুক, ছিন্ন হৃদয় 
একি আলো জ্বেলেছি ...
আমি সেদিন থেকে জেতা বাজি হেরেছি ...

মিথ্যে ফাগুন সাজিয়ে..
আমি কোকিল বঁধুকে কাছে ডাকি 
তাই নিজের চোখে জল এনে 
সে আমায় দিয়েছে ফাঁকি ....

নাগের মাথায় যে মনি মানায় 
তাকে ছিঁড়ে এনেছি ..
মনি যে সবার সাজেনা 
মনিকে ম্লান দেখে জেনেছি ....." 

আনন্দর দু চোখ বেয়ে নেমে এলো জলের ধারা ......তার দৃষ্টি নেই, কিন্তু অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে সে যেন দেখতে পেল রূপমের ব্যথিত মুখচ্ছবি .....

গান দিয়ে একদিন শুরু হয়েছিল তাদের আলাপন, হৃদ্যতা.....বিদায় বেলায় গানই হয়ে রইলো মধুর সাক্ষী