গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ২৬ জুলাই, ২০২০

রুকসানা কাজল

সুরা গুন্ডা


গাউছিয়ার সোনার দোকানগুলো থেকে চান্দা তুলতে গিয়ে ধরা পড়েছিল সুরা গুন্ড। তা প্রায় সাত বছর আগের ঘটনা। মহামান্য আদালত সুরার বিচার করে আজ যাবজ্জীবন ঘোষণা করেছে। সুরা কেবল চান্দাবাজ নয়। পুরানো রেকর্ডগুলো ঘেঁটে দেখা গেছে সুরা এক দুর্ধর্ষ বোমাবাজ এবং সাংঘাতিক খুনি। দেশের শীর্ষস্থানীয় এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে বছর কয়েক আগে যে বোমাবাজি হয়েছিল এবং তাতে যে দুজন লোক মারা গেছিল তার নেতৃত্ব দিয়েছিল সন্ত্রাসী সুরা। সুরা গুন্ডার পুরো নাম কি ? টেবিলের ছড়ানো ছিটানো কাগজে নাম খুঁজে পায় কুরান। রইসউদ্দিন সোহরাওয়ার্দী। ক্লাশ এইট পাশ। এরপর ঝরে গেছে। সুরার নীচে তিন ভাই, দুভাই দোকানপাট ব্যবসা করে। ছোট ভাইটা ইঞ্জিনীয়ার। অস্ট্রেলিয়া প্রবাসি। ভাইটার খুব মন কাঁদে । দেশে ফিরে আসতে চায় । মাকে দেখবে। বাবার পাশে শুয়ে গ্রহ নক্ষত্রের নাম আর গল্প শুনবে। কিন্তু সুরার স্ট্রিক্ট নিষেধ আছে। দেশে আসতে পারে না কুট্টু। 

মেজো ভাইটা রুমালে চোখ মুছে কুরানকে জানায়, প্রথমবার আদালতে আনার পর ছোটভাইটাকে আদালতের গেটে দাঁড়ানো দেখে সুরা পুলিশের গাড়ি থেকে নামেনি। হাতে হ্যান্ডকাপ। কোমরে দড়ি। ছোটভাইটার মনে যদি কোন বিরূপ চিন্তার সৃষ্টি হয় সে জন্যে একজন পুলিশকে দিয়ে মেজো ভাইকে ডেকে ছোটভাইটাকে তৎক্ষণাৎ হোস্টেলে রেখে আসতে বলেছিল। পেপারওয়েটটা মুঠো করে ধরে মেজোভাইটা ভেজা চোখ তুলে বলেছিল, বড়ভাইজান ত বাবার মত। বিশেষ করে কুট্টুর কাছে। তাছাড়া কুট্টুর কান্না দেখেই ত ভাইজান এই লাইনে চলে আসে। কুরান জানতে চায়, সে কিরকম করে হয় ! বলুন ত শুনি । খুব গরীব হয়ে গেছিলাম আমরা। নিজেদের বাড়ি থাকলে কি হবে খাওয়ার কষ্ট পরার কষ্ট লেগেই থাকত। এসব কষ্ট আমরা সহ্য করতে পারতাম। কিন্তু কুট্টু খিদে সহ্য করতে পারত না। ঈদের আগের রাতে পাশের বাড়ির সেমাই রান্নার ঘ্রাণ পেয়ে খুব কেঁদেছিল কুট্টু। আম্মা কিছুতেই থামাতে পারছিল না। আব্বা কুট্টূকে কোলে নিয়ে বলেছিল, এখন ঘুমাও বাবু। সকাল হলেই দেখবে ফেরেশতারা অনেক সেমাই দিয়ে গেছে তোমার জন্যে। তুমি চামুচ চামুচ ভরে তখন সেমাই খেও। কুট্টু আব্বার বুকের উপর ওঠে খুশিতে দুলে দুলে বলেছিল, আব্বা আমি বাটি বাটি সেমাই খাবো। এত্ত এত্তবাটি বাটিখুব ভোরে অনেকগুলো মুরগীর ডাকে সুরার আব্বা আম্মা বাইরে বেরিয়ে দেখে, রান্নাঘরের বারান্দায় থরে থরে বাজার সাজানো। কি নেই সেখানে ! সেমাই, চিনি দুধ, বাদাম, কিশমিশ, পোলাঊয়ের চাল তেল, ঘি ! কুট্টুর জন্যে ছোট্ট পাজামা পাঞ্জাবী লেসের সাদা টুপি, বাটার জুতা। আমাদের সবার জন্যে জামাকাপড়। দুপুরে শোনা গেলো ঈদের নামাজ শেষ করে শহরের সবচে বড় রাজনৈতিক নেতার গাড়িতে করে ঢাকা চলে গেছে সুরা। তারপর ত এই ঘটনা । 

সুরা গুন্ডা। সুরা সন্ত্রাসী। সুরা খুনি। কুরান সুরার ভাইয়ের কাছে জানতে চেয়েছিল, আপনার আব্বা আম্মাসুরার আব্বা রান্নাঘর ছেয়ে উঠে যাওয়া বকুল গাছটার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ছেলেটা কুরবান হয়ে গেলো। কুরবান হয়ে গেলো আমার রাসু। কুরান সুরার উকিল। যারা জানে তারা ঘেন্না ঘেন্না চোখে বিপুল তাচ্ছিল্য নিয়ে ওর দিকে তাকায়। অনেকেই আড়ালে ফুট কাটে, সন্ত্রাসীর উকিল সন্ত্রাসী। সাধারন মানুষ জানে না কুরান কেবল মুখ দেখানো উকিল। সুরার আসল উকিল সেই রাজনৈতিক নেতা। তার হাত দিয়েই সব দরকারি কাগজ আর টাকা আসে কুরানের হাতে। এই নেতার ছুঃ মন্তরেই এতদিন বিচার না হয়ে ঝুলে ছিল মামলা। জেলে থেকে সুরা খাচ্ছিল, দাচ্ছিল ব্যায়াম করছিল। ছোট ভাইটাকে বিদেশে পাঠিয়ে আরো পড়াশুনা করতে বলেছিল। ভাইটার উপর কড়া নির্দেশ ছিল, আব্বাকে যেনো কেউ সুরা গুন্ডার আব্বা না বলে। মফস্বল শহরের চেনা জানা আত্মীয়রা যেন আব্বাকে ডাকে কুট্টু ইঞ্জিনীয়ারের আব্বা বলে । সেই যে ঈদের দিন সুরা তার শহর ছেড়ে এসেছিল। আর কখনো ফিরে আসেনি। বউকেও যেতে দেয়নি। বড় গেটওয়ালা দুতলা বাড়ি করেছে। ওর আব্বা আম্মাকে দেখাশুনার জন্যে এক ঘর গরীব আত্মীয়কে আলাদা ঘর তুলে থাকতে দিয়েছে। মেজো সেজো দু ভাইকে দোকানঘর ব্যবসার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। জেলে থেকেই নিজের ছেলের তিন বছর বয়েস হলে বউকে কড়া নির্দেশ দিয়েছিলো, ছেলেকে দাদাবাড়ি পাঠিয়ে দিতে। বউ আপত্তি করেছিল। কিন্তু বন্দি সুরার পাঞ্জা দেখে সাহস পায়নি। জেলে থাকলেও কিছুটা ক্ষমতা সুরার ছিল। তাছাড়া গুন্ডার বউ কি শান্তিতে থাকতে পারে ! সুরা বুঝত। জেনেও গেছিল অনেক কিছু। তবুও মামলার স্বার্থে প্রতি মাসে সুরার বউ আসে যায়। দরকারে সুরার সিগ্নেচার নিয়ে যায়। এবার দ্রুত বিচার আইনে, আদালতে সুরার মামলা উঠেছিল। ছুঁ মন্তরধারী রাজনৈতিক নেতার কারসাজি। শাস্তির ঘোষণাও হয়ে গেছে। সশ্রম যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। নিশ্চিত ফাঁসির রায় থেকে যাবজ্জীবন

সুরা খুব খুশী হয়। বেঁচে ত আছে। যদিও তার কালো টাকার অনেকখানি বেরিয়ে গেছে। তাতে চিন্তা নেই সুরার। রাজনৈতিক নেতার বৈধ ব্যবসায় ডাবল সোনার ডিম পাড়ছে ওর টাকা। রোজা শেষ হলেই ঈদ। সুরা ভেবে রেখেছে, যা হোক হেস্তনেস্ত ত একটা হয়ে গেলো। ঈদের পর বউকে ভালো করে বুঝিয়ে দিতে হবে টাকা পয়সা ব্যবসাদারীর সবকিছু। ছেলেটাকে কুট্টুর কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সুরার এক নানা, ওর মায়ের দিকের এক চাচা হাফ ডাক্তার ছিলেন। খুব ভাল মানুষ । শহরে প্রচুর সন্মান ছিল। সুরাদের অনেক সাহায্য করেছে। সুরা চায়, ছেলে ডাক্তার হোক। কুট্টু, সুরার ছেলে, অন্য ভাইদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দীক্ষার গুণে চিরদিনের জন্যে সুরার গুন্ডার নাম মুছে যাক। ওদিকে রায় হয়ে যাওয়ার পর, বার কাউন্সিলের সাদা ঘরে সুড়ুত সুড়ুত করে গ্রীণ টি খেতে খেতে ছুঁ মুন্তর নেতা জানায়, এবার হিসেবটা করে ফেল দেখি কুরান। একেবারে ঠিক হিসেব করবি। সব কিছু সুরার বউয়ের নামে চলে যাবে। সুরা নিজেই ওর বউকে দান করেছে। নে এই ফাইলে সব আছে। সুরার সিগ্নেচারসহ দানপত্র। সাবধান। লিক্করলি কিন্তুক তুই ফুটো হয়ে যাবিনি । কথাটা মনে রাখিস যাদু। রাজনৈতিক নেতার ব্যবসায় খাটানো সব সম্পত্তি, টাকা, সম্পদ চলে যায় সুরার বউয়ের নামে। আর সুরার বউ দ্বিতীয় পক্ষ হয়ে চলে যায় নেতার বিপত্নীক ভাইয়ের ঘরে। নেতার করা মানচিত্রে কেউ ডোবে কেউ ভাসে। সুরার দুই ভাই যৎসামান্য পেয়ে কিছুটা অখুশি। বেজার মন। তাই দেখে নেতা ভুরু কুঁচকে ধমক দিয়ে বলেছিল, সুরার বউ কিছু না দিলি কি করতি পারবিনি তোরা? বাল ফেলানোরও তো ধার নাই তোগের। যা পাইছিস তাই নিয়ি খাটি খা গে। স্যান্ডুইচ, ঝাল ঝাল চিকেন ফ্রাই, ডাউস পেট এক বোতল রাশান ভদকা আর দুই প্যাকেট বিরিয়ানি সাজিয়ে পুরান ডাক দেয় , এ কুরান খাতি আয়। তহন থে কি দেখতিছিস তুই ? মামলা ত মিটি গেছে। জলদি আয়। খিদেয় প্যাট পুড়ি যাতিছি আমার ! কুরান কয়েকটা সাদাকালো ছবি দেখায়। 

হাড় জিরজিরে সুরা। কম বয়েস। প্রথম নীলক্ষেতে হাত পাকিয়েছে ছিনতাই আর চান্দাবাজিতে। শীর্ণ অকাল বৃদ্ধ অসহায় মুখ আর অভাব জীর্ণ কিন্তু সুন্দরী সুরার বাবা মার পায়ের কাছে, মাথার পেছনে সুরাসহ কতগুলো অপুষ্ট আন্ডাবাচ্চা। বাবা ছিল বেসরকারি এক অফিসের সামান্য পিয়ন। মাসের কুড়িদিন ভাত জুটত না ওদের। মোটা ডাল, গম কিছু চাল সেদ্ধর এক অদ্ভুত ভাত খেয়ে থাকতে হত সবাইকে। অভাববিদ্ধ কূলকিনারাহীন অই জীবন থেকে কোন এক ঈদের আগের রাতে ছিটকে বেরিয়ে আসে সুরা। ওর জামার নীচে শতচ্ছিন্ন গেঞ্জি আর তার নীচে শত শত হা মুখ ক্ষুধা, কাগা গো ও কাগা ! আমি রাজি আছি। রাজনৈতিক নেতা সাগ্রহে জড়িয়ে ধরে সুরাকে। তারপর ভার্সিটি, নীলক্ষেত, গুলিস্তান, হাইকোর্ট, পুরানা পল্টন, রামপুরা। এক আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়ায় সুরা। সুরা ধরা পড়ে, নেতা ছাড়িয়ে আনে। এক অটুট আনোখা বন্ধন। সুরার কালো জামা, রক্তাক্ত হাত। নেতার সাদা জামা, কালো টাই। টাইয়ের নট এ লাল গোলাপ। ভদকার গ্লাসে চুমুক দিয়ে পুরান জানতে চায়, সুরাকে যখন সব জানায়ে দিলি তখন কি ও কান্দিছিল নাকি রে কুরান ? কানবি না। গরীবের ছেলে। ভদ্র পরিবার। বিদ্যা নাই বুদ্ধি নাই। ছেলো অই খ্যাপার মতন সাহস আর লক্ষ কোটি খিদেয় ভর্তি পেট। চান্দাবাজি করি যা পাইছে তাতো ভাগ হইছিল সমান ভাগে। এহন তো তাও গেলো। কত আশা করি ছেলো বেচারা। কুরান পুরান দুবন্ধুর ইচ্ছা করে বিচারের দেবীকে বলে, ও ম্যাডাম আন্ধা থাকি আর কি হবিনে কন। এখন চোখ খুলেও সবাই আন্ধা। আপনিও ঠুলি খুলি যুতজাত হয়ি বসে সবকিছু দেখেও আন্ধা সাজেন গো ম্যাডাম