গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৯

শুভাশিস দাশ

যন্ত্রণার ছেঁড়া শব্দ


এই ছিট ছেড়ে যেতে হবে এই কথা ভেবে  মনটা ব্যাথায় টন টন করে উঠলো  সামসুলের l  এখানেই  ঠাকুরদার কবর রয়েছে !তাঁর হাতের আম গাছটাতে এবার প্রচুর আম ধরেছে l
পাশের বাড়ীর ফুলিদের সেই পুরনো মন্দিরে কে যে বাতি দেবে ওরা গেলে !
আজ বাদে কাল এই চোদ্দ পুরুষের ভিটে ছেড়ে নিজের দেশ দেখতে যেতে হবে l
দেশ ?
নিজের মধ্যেই হেসে উঠলো সামসুল l
নিজের বাবার জায়গায় অন্য লোকের নাম বসিয়ে চৌধুরীহাট হাইস্কুল থেকেই সামসুল   মাধ্যমিক পাস করেছে l ব্যাস ওই পর্যন্ত l
বাকালিরছড়া ছিটে সামসুলরা বাস করে আসছে l ওদের সবকিছু বামনহাট অঞ্চলের সাথে l বোনটার বিয়ে হয়েছে লালমনিরহাটে l
বাবার ইচ্ছে ওপারে বোনের কাছাকাছি থাকার কিন্তু সামসুল তো এপারের স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেছে l এখনও চাকরির বয়স আছে l
বাড়ির সামনে বাঁশের মাচায় বসে দেখছে তার আশৈশব বেড়ে ওঠা এই বাকালির ছড়া কে l কত রাত ঘুমোতে পারেনি ওরা l মাঝে মাঝেই সমাজ বিরোধীরা এখানে হামলা করতো আর বি এস এফ এর সাথে গুলি বিনিময় হতো l
কিরে কী ভাববার নাগচিস  ? এল্যাও বুজি দ্যাখ কোটে যাবু ?ইন্ডিয়া না বাংলাদেশ !
ইন্ডিয়া গেইলে তোর বোনক দেখা হবার নয় l
সামসুল দেখে বাবার মনটা খুব ভেঙে গেছে আসলে বাপ তো !বেটির উপর দরদখানেক বেশিই !হামিদ মাস্টারের কথা শুনি তখন বোন টার বিয়া দিলো বাংলাদেশের ছেলের সাথে l
সামসুলের বাবা আবার বলতে শুরু করলেন -জানিস তো বাপ ইন্ডিয়া গেইলে হামার একটু অসুবিধা হবে !কত্ত দিনে কাগজপত্তর পামো তারপর পাসপোর্ট করি বাঙলাদেশ l
সামসুল  বললো -তুই খালি বোনকে নিয়া ভাবিস !মুই তোর কাও নং ?মোর ভবিষ্যৎ টা ভাবালু না ?
ওদের কথা বার্তার মাঝে চলে এলো ফুলির বাবা l বললো -কিরে শামসুল আর তো দুটা দিন !
সামসুলের   বাবা বলে উঠলো -তাই তো কবার ধরচং হামারা l এটে পরায় জীবনটা গেইল আর কত্তদিন বা বাচমো ?
না ভাইজান হামার না হয় দিন গেইচে কিন্তু সামসুল রা ?ওদের তো ভবিষ্যৎ হইবে ফুলির বাবা বললো l
সামসুলের বাবা বললো -তা তুই ফির বাংলাদেশ যাবু কে ?ওটে হাতে হিন্দুরা এই দ্যাশত আইসে !
আরে ভাইজান ফুলির মায়ের বাপের বাড়ি লালমনিরহাট অনেক জমিজমা l শ্বশুরের কাও নাই l মোর এটে কী আছে ?তাই ফুলির মায়ের  কথা চিন্তা করি এই সিদ্ধান্ত !
মোর বেটির এ্যানা খবর নিবার পাবু -সামসুলের বাবা বলে l
তোমাক সেটা কবার নাগবে ?
------------------------------
খুব ঘটা করে ছিটমহল বিনিময় হলো l 
সামসুলরা আজ সরকারি গাড়িতে দিনহাটা যাবে l সংসারের সবটুকু নিয়ে গাড়ি ভর্তি হয়েছে l সবাই গাড়িতে উঠে পড়েছে l কিন্তু বাবাকে দেখছে না l ব্যাপার কি !সামসুল এগিয়ে গেলো বাড়ীর পিছন দিকটায় l বাবা কাঁদছে তাঁর বাপের কবরের গোড়ায় বসে l শামসুল কাছে যেতেই ওকে জড়িয়ে ধরে কান্না  আরও বেড়ে গেলো l সামসুল অনেক বুঝিয়ে বাবাকে গাড়িতে তুলল l
গাড়ি ছুটছে বাকালিরছড়াকে পিছনে ফেলে বামনহাট অঞ্চলের রাস্তা ধরে l মা কেমন বোবা হয়ে গেছে l মুখে কোন শব্দ নেই l ফুলিরা আর একটা গাড়িতে কিন্তু অন্য পথ !ওরা বাংলদেশ যাবে l
সামসুলেরও মনটা ভেঙে গেলো l সেই জন্মের পর থেকে এই ছিটমহল কেই মাতৃভূমি রূপে দেখে আসছে l
মানুষের অনুভূতি আর বাস্তব তো এক হয় না l তাই কখনও কখনও মনটা হারিয়ে যায় l হৃদয়ের শব্দ গুলো কেমন যন্ত্রণার আগুনে পোড়ে !
গাড়ি এসে থামলো দিনহাটার অস্থায়ী ক্যাম্পে l সামসুল আগেই জেনেছিল আপাততঃ ওদের এই কৃষিমেলা সংলগ্ন ক্যাম্পে বাস করতে হবে l
কিন্তু একি !এতো মুরগীর খোপ !
এতে তিন চারজন মানুষ বাস করবে কী ভাবে !নিজের মনেই বলে উঠলো সামসুল l ছিটমহলের বাড়িটার চার ভাগের এক ভাগও নয় !ভাগ্যিস এখন সংসার হয়নি তাহলে বৌ নিয়ে বাপ মা য়ের সাথে কী ভাবে থাকতো !
কিন্তু উপায় নেই যে !দেশ দেশ করে এত আন্দোলন হলো তার ফল এই !আর কি !খোদা ভরসা !এই বলে গাড়ি থেকে নেমে সোজা ক্যাম্প অফিসে গেলো ঘরের খোঁজ নিতে l
কতদিন যে এখানে থাকতে হবে ?
------------------------------
ছিটমহলের মায়া এখনও কাটাতে পারেনি ওরা l সামসুল দিনহাটা শহরে দুএকজনকে ধরে ক টা টিউশন যোগাড় করেছে l উপায় কী ?সাপ্তাহিক বরাদ্দ সরকারি চাল ডালে দুবেলা ঠিকমত পেট ভরে কই !ছিটমহলে তাও জমি ছিল lবছরে  দুটো ফসল উঠতো অন্তত খাওয়া পরার কোন অভাব ছিলোনা l
এখনও ভোটার কার্ড পায়নি l তবে প্রশাসন আশ্বাস দিয়েছে অচিরেই সবার হবে l সামনে ভোট l তাই দিনহাটা থেকে সব দলের নেতারা আসছেন l এদেশে ভোট বড় বালাই l অনেক কষ্ট করে স্কুল সার্টিফিকেটে   বাবার ভুল নামটা সংশোধন করা গেছে l টিউশনি বাড়িতে ওরা জানেনা এঁরা ছিটের বাসিন্দা ছিলো l
মাঝে রাস্তায় দেখা হয়েছিল ছিটমহলের অন্যতম নেতা দীপু সেনের সঙ্গে l ওরা দীপু দা বলেই ডাকে l ভালো নাম দীপ্তিমান সেনগুপ্ত l বাপ কা বেটা l ওনার বাবাও ছিলেন বিচক্ষণ রাজনীতিক l
তিনি অবশ্য বলেছেন দিন ফিরবে !
সামসুল ভাবে কবে যে আর দিন ফিরবে l দেশ ছিলো না স্বচ্ছলতা ছিলো দেশ হলো এখন আধপেটা খেয়ে দিন কাটছে l আর শান্তি ?এখানেও তো লেগেই আছে l এই তো নির্বাচন কে ঘিরে কী হারে অস্ত্রের মহড়া চললো !
ছিটমহলে তো মাঝে মাঝে বাইরে থেকে সমাজবিরোধীদের হানা হতো আর এখানে ! হায় রে !
সামসুল ভাবতে ভাবতে এগোয় l দিনহাটা টা তাও নিজের মত মনে হয় l স্কুলে পড়ার সময় বেশ ক বার এসেছিল মামার সাথে l
দু চারজন বন্ধু আছে কিন্তু এখনও তাদের দেখা মেলেনি l
সামসুল চলে আসে টিউশনি বাড়ির কাছে ভাবে ...এই ভাবেই বোধহয় বাকী জীবনটা কেটে যাবে ......!