গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ২ মার্চ, ২০১৯

নীহার চক্রবর্তী

মন-ভাঙা-নাও


বছর পঞ্চাশের অকৃতদার রমেন দাসের খুব ইচ্ছা ছিল পুরী-ভ্রমণের । কিন্তু বিধবা মাকে ছেড়ে তার পক্ষে কখনো তা সম্ভব হয়নি । তা বলে তার ইচ্ছাও মরে যায়নি কখনো ।
সে সুযোগ এলো একদিন রমেন দাসের ।
সে কারো-কারো মুখে শোনে,এলাকার নবজ্যোতি-ক্লাব থেকে বাস ছাড়ছে পুরী-ভ্রমণের জন্য । ক্লাবের কিছু ছেলের সঙ্গে তার বেশ পরিচয় আছে । কেউ-কেউ তার কাছে টিউশনি পড়ে গেছে একসময় ।
তাই সে তার দুই খুব চেনা ছেলেকে ধরল । তারা তার কাছে পড়ে গেছে বেশ আগে । 
তাদের খুব আগ্রহের সঙ্গে বলল,'অনেকদিনের শখ রে আমার । এবার পূরণ করতে চাই । মাও আমাকে কদিনের জন্য ছেড়ে দেবে । আমার একটা আসন চাই কিন্তু ।'
তারা কথা দেয় তাকে । রমেন দাস শুনে স্বস্তির হাসি হাসে । চোখ বুজে ভাবতে থাকে সমুদ্রের সে কি ভীষণ গর্জন ।
তারপর মাঝেমাঝেই রমেন দাস তাদের কাছে জানতে চায় । 
তারা হেসে তাকে বলে,'চিন্তা করবেন না আপনি । হয়ে যাবে । আপনি তো একাই । কোন সমস্যা নেই ।'
কিন্তু না । 
এর কয়েকদিন পরে রমেন দাস শুনে অবাক হল,আগামী দিন বাস ছাড়ছে । মনমরা হল সে খুব । চুপচাপ বসে থাকলো নিজের ঘরে ।
কিন্তু পরেরদিন সকালে অন্য কাহিনী । ক্লাব থেকে দুজন অপরিচিত ছেলে তার কাছে ছুটে এলো ।
রমেন দাস অবাক হল তাদের দেখে ।
আরও অবাক হল সে যখন একজন তাকে বলল,'আমরা আগেই জানি আপনি যেতে চান আমাদের সাথে । আমাদের মনেও ছিল । কিন্তু আপনার চেনা দুজন ছেলে সেভাবে পরে আর আমাদের কিছু বলেনি । সরি । একটামাত্র আসন আছে এখনো । আপনি আমাদের সঙ্গে চলুন ।'
তার কথা শুনে মহাখুশি রমেন দাস । সে অনেক তৃপ্তির হাসি হেসে বলল,'আমি তো এক পায়ে খাঁড়া । আহা,আমি দেখবো না ? তা বললে বুঝি হয় ? ওদের কথা বাদ দাও । বাচ্চা ছেলে সব ।' তখুনি সে ভ্রমণের টাকা অনাবিল-হেসে মিটিয়ে দিলো ।
তারপর আর এক কাহিনী । সে কাহিনী অনেককে অবাক করে দিলো ।
পুরীতে বাস থেকে নেমেই রমেন দাস অমায়িক-হেসে বলল ট্যুর-ম্যানেজারকে ,'তোমাদের সমস্যায় ফেলতে চাই না আমি । বলেই যাই । আমি কিন্তু এখানে একা থাকবো । কোথায় থাকবো,সে কিন্তু বলবো না তোমাদের । তাই আমাকে খোঁজ করার চেষ্টাই কর না । সব দেখে মনের সুখে বাড়ি ফির সবাই ।' 
বলেই রমেন দাস মানুষের ভিড়ের মাঝে হারিয়ে গেলো । সেই তার দুই চেনা ছেলে পিছনে-পিছনে গিয়েও তার নাগাল পেলো না ।
চারদিন পর সেই বাস ফিরে এলো । অনেকেই বাস থেকে নেমে রমেন দাসের খোঁজ করতে থাকলো । 
কিন্তু অনেকেই বলল,'উনি তো এখনো ফেরেননি । ওনার মাও কিছু জানেন না । কি এক অদ্ভুত ব্যাপার । তোমাদের সঙ্গে এলো না কেন ?' 
শুনে বিস্ময়ের সীমা নেই কারো । উত্তরও দেওয়ার নেই কিছু । সেই দুই ছেলের চোখ ছলছল করে উঠলো তার কথা ভেবে । তবে কেউ তেমন বুঝতে পারলো না ।
তার দুদিন পরে রমেন দাস বাড়ি ফিরে এলো । বিধবা মা তাকে দেখে আনন্দে দিশাহারা । চোখের জল ফেলতে ফেলতে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরল সে । রমেন দাস নিজেও চোখের জল ফেললো খুব ।
সেদিন রাতেই কিন্তু রমেন দাস নিজের ঘরে গলায় দড়ি দিলো ।
একটা চিরকুটে সে লিখে গেলো দুটি বাক্য--
'
যা দেখে এলাম জন্ম-জন্মান্তরে ভুলবো না ।'
'
যা বুঝে গেলাম পরজন্মেও ভুলবো না ।'
ছেলের মৃতদেহের ওপর পড়ে বিধবা মা আকাশ-ভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়লো । দেখে অনেকের চোখ জলে ভরে গেলো । সব সান্ত্বনার ভাষাহারা তখন ।
আর সেই দুই ছেলে কেঁদে-কেঁদে আকুল তখন । কীসব বলে গেলো শোকের ঘোরের মধ্যে । 
তেমন কিন্তু কেউ কিছু বুঝতে পারলো না দুজনকে দেখে । শুধু অবাক-চোখে তাদের দেখে গেলো ।