গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ২ মার্চ, ২০১৯

পীযূষকান্তি দাস


চুনোমাছ



আজকেও যখন কানাইয়ের বাপ বাজার থেকে একগাদা চুনো-পুঁটি নিয়ে বাড়ি ফিরল তখন কানাই এর মা আন্নাকালি আর চুপ থাকতে পারল না রাগে চিৎকার করে উঠল মিনসে তুই ভেবেছিসটা কি? বাড়িতে কটা দাসী -বাঁদি পুষেছিস যে রোজ রোজ গুচ্ছের চুনো -পুঁটি আনছিস ? গিন্নির রুদ্রমূর্তি দেখে হরিপদ আদৌ ভড়কে গেল না বলল হা হা ! অত চটছ কেন গিন্নি ! দাসী বাঁদির কথা উঠছে কেন? চুনোমাছ বাছতে হবে তো ? সে আমিই বেছে দিচ্ছি তোমাকে নিয়ে কোন টেনশন করতে হবে না তুমি বরং পারলে আমায় এককাপ চা দাও তারপর দুটো সিঁড়ি বেয়ে উঠে বাজারের থলিটা রান্নাঘরের দাওয়ায় নামিয়ে পাশে পড়ে থাকা তালপাতার চাটাটার উপর যুত করে বসল
চায়ের কথা শুনে ঠাণ্ডা হওয়া তো দূরের কথা গিন্নি হলেন আরও খাপ্পা বলি সকাল থেকে কাপ হল শুনি? সকালে চা না হলে বাবুর পায়খানা হয় না মুখ ধুয়ে সাথে চা না থাকলে পেপার পড়ার মেজাজ আসে না বাজারে গিয়ে তো আবার সেই বিশুর চা চাইই চাই এখন এসে আবার চা ! হবে না হবে না বলি বাঁচা টাচার ইচ্ছে কি নাই ? সেদিন ডাক্তার বললে লিভারের অবস্থা ভালো না সুগারও বেশির দিকে চা একদম চলবে না ভাজা ভাজিও বন্ধ করতে বলল অথচ তুমি ! সে সব কি আদৌ কানে ঢুকেছে বলে গজগজ করতে করতে বাইরের দিকে কোথায় যেন চলে গেল চা চাইলে যে এত কথা শুনতে হবে হরিপদ বাপের জন্মেও ভাবে নি ! পকেট থেকে সদ্য কিনে আনা বিড়ির প্যাকেটটা বের করল তা থেকে একটা বের করে মুখে লাগিয়ে দেশলাই বের করে দেখে তাতে একটাও কাঠি নাই আস্তে আস্তে উঠে রান্না ঘরে গেল উনুন থেকে জ্বলন্ত কাঠের একটা টুকরা বের করে তার আগুনে বিড়িটা ধরাল দাওয়ায় নামানো থলি থেকে মাছের পলিথিনের প্যাকেটটা রান্নাঘরের এক কোনে রাখা চুপড়ি গুলোর থেকে একটা নিয়ে ধীরে ধীরে কলতলায় গেল কল তলায় চুপড়ি আর প্যাকেটটা রেখে দেখল পিড়েটা সেখানে নেই ওই তো পিড়েটা, ওইতো বারান্দায় দেখা যাচ্ছে পিড়েটা আনতে গেল পিড়েটা নিয়ে ঘুরে দেখে কি একটা বে আক্কেলে কাক প্যাকেট ধরে টানাটানি করছে হুউস হ্যাট হ্যাট বলে সেটাকে তাড়াল দেখল টানাটানিতে গোটা চারেক মৌরলা আর তার অত করে বেছে আনা বড় বড় সাইজের পুঁটি গুলোর মধ্যে সব চেয়ে বড়টা বাইরে পড়ে ভাগ্যিস ব্যাটা ওটা নিয়ে যায় নি ! পিড়ের উপর হাঁটু মুড়ে বসে আয়েশ করে বিড়িটা টানল তারপর মাছ কাটায় মন দিল
অর্ধেকর উপর কাটা হয়েছে এমন সময় কই হরিদা কি করছ বলে পালানের বাপ অনাদি মুখুজ্জে ঢুকল ঢুকেই দেখল হরিপদ মাছ কাটতে ব্যস্ত সেকি হরিদা তুমি মাছ কাটছ যে বড় ? বৌঠানের কি শরীল খারাপ নাকি ? এই সময়ে অনাদিকে বাড়ি ঢুকতে দেখে যারপর নাই বিরক্ত হলেও হরিপদ মুখে তা প্রকাশ করল না সে বললে অনাদি , আরে এসো এসো বসো বলে আপন পিড়েটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে নিজে চাতালের উপরেই থাপসে গেদে বসে পড়ল অনাদি পিড়েটা টেনে নিয়ে একটু তফাতে বসল তারপর পকেট থেকে বিড়ির প্যাকেটটা বের করে বলল নেবে নাকি একটা হরিদা ? হরিপদ বলল না না এইমাত্র খেয়েছি এখন আর না কদিন ধরে রাতের বেলা কাশিটা একটু বেড়েছে তোর বৌঠান দেখলে অশান্তি করবে আরে নাও না একটা আজ পর্যন্ত তো অনেক বিড়ি খেয়েছ কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি এর' বিড়ি তুমি কক্ষনও খাওনি গতপরশু রানাঘাটে গেছলাম আমাদের সুখির বাড়ি ইস্টিশানে নেইমে দেখি কি পকেটে বিড়ির প্যাকেট টাই নাই জামা পাল্টানোর সময় সেই যে সেটা বের করে টেবিলের উপর রেখেছিলাম বেরুবার সময় তাড়াহুড়োতে ফেইলে চলে গেছি অগত্যা পেলাটফরম থেকে বেইরে দোকান থেকে এক প্যাকেট কিনলাম তুমি তো জানো দাদা আমি কেমন খুঁতখুঁতে কিন্তু কি বলব দাদা তোমায় , প্যাকেট কেটে একটা বিড়ি ধইরে আমি ! তাইতো কাল বিকালে আসার সময় আমার নিজের লেগে দুপ্যাকেট আর তোমার জইন্য দু প্যাকেট এইনেছি আসতে কাল অনেক রাত হইগেল তাই আজ সকালেই এলাম দেখ খেয়ে আমার কথা মেইলে কিনা ! এই বলে অনাদি একটা নিজের মুখে লাগিয়ে আর একটা হরিপদর দিকে এগিয়ে দেয় হরিপদ আবাছা মাছগুলোকে পলিথিনের প্যাকেটে বাঁধল কাটা মাছগুলোর সাথে সেই প্যাকেটে বাঁধা মাছ সবকে চুপড়ি ঢাকা দিয়ে চৌবাচ্চার গায়ে লাগানো ট্যাপের জলে হাত ধুয়ে এদিক ওদিক দেখে বিড়িটা নিল কানের কাছে বিড়িটা নিয়ে গিয়ে দুআঙ্গুলে ঘুরিয়ে পরখ করে বলল আওয়াজ শুনে তো ভালোই মনে হচ্ছে রে দে দে চট করে বিড়িটা ধরিয়ে দে তার কথা শুনে অনাদি অপর পকেট হাতড়ে দেশলাই বের করল ফস করে একটা কাঠি জ্বালিয়ে নিজের বিড়িটা ধরাল আর হাত এগিয়ে সেই জ্বলন্ত কাঠিতেই হরিপদর বিড়িটাও ধরিয়ে দিয়ে দুজনে সুখটান দিতে লাগল তা তারা ততক্ষণ বরং মৌতাতে ব্যস্ত থাক আসুন এই ফাঁকে আমি অনাদির সাথে আপনাদের পরিচয় পর্বটা সাঙ্গ করে দিই হরিপদর বাড়ি যেই গলিতে সেই গলিতেই হরিপদর বাড়ি ছাড়িয়ে আরও গোটা পাঁচেক বাড়ির পর বাম দিকে তাকালে একটা একতলা বাড়ি দেখতে পাবেন বাড়িটার সামনে একফালি জমি রাজ্যের আগাছায় ভর্তি বাড়িটার রঙ যে এককালে হলুদ ছিল তা অনেক কষ্ট করে অনুমান করে নিতে হবে কেননা এখন তার দেওয়ালে শ্যাতলা পড়ে এমন বর্ণ ধারণ করেছে যে তার রঙ কি তা বলা সাধারণ মানুষ তো ছার কোন চিত্রকরের পক্ষেও বোঝা দুঃসাধ্য ! আসলে বাড়িটায় শেষ রঙের কাজ হয়েছিল তা নাই নাই করে কমপক্ষে বিশ বছর আগে সে বছর অনাদির বাবা ভবতোষ মুখার্জী মেটালবক্স থেকে রিটেয়ার্ড করে ভালোই টাকাপয়সা পেল আর সেই পয়সায় বাড়িটার রঙ করাল রিটেয়ার্ডের আগে অবশ্য আরও একটা কাজের কাজ তিনি করেছিলেন সাহেবদের ধরেটরে (নিন্দুকেরা বলে নাকি পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে )নিজের টেনেটুনে এইট পাশ ছেলেটাকে অ্যাপ্রেন্টিস হিসাবে নিজের কারখানায় ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন ট্রেনিংএর পর পর যখন অনাদি পার্মানেন্ট হল তখন তার সেকি ফাট ! প্যান্ট শার্ট কোট পরে বুটের আওয়াজ তুলে সারা পাড়াকে জানান দিয়ে আপিসে যেত এরকম চলল তা বছর পাঁচেক তারপর এল সেই উত্তাল করা দিন " দিতেই হবে দিতেই হবে" আওয়াজ সব কারখানার গেটে গেটে পিকেটিং নাভিশ্বাস উঠে গেল কারখানায় কারখানায় উৎপাদন হোক আর নাই হোক তাতে কি ! হয় শ্রমিকদের সব আবদার পূরণ করো নইলে কারখানার চাক্কা বনধ এক এক করে সব কারখানা হয় লকআউট নয় উঠে যেতে লাগল মেটালবক্সও তার মধ্য পড়ল পেটের ভাতই জোটে না তায় ঘর রঙ !
বিড়ি খাওয়া শেষ হলে অনাদি বললে কি দাদা মিলল তো আমার কথাখান ? বিড়িটা কেমন ? বিড়িটা যে ভালো তা হরিপদও সায় দিল তখন অনাদি গলাটা খাটো করে বলল হরিদা একটা কথা রাখবে ? বলি গোটা পঞ্চাশেক টাকা ধার হবে ? পালান বললে সামনের হপ্তায় ঠিক দিয়ে দেবে না না অনাদি আর টাকা হবে না আগের বারে এক সপ্তাহ বলে সেই যে তুমি একশটিটাকা নিয়ে গেলে তা কতবার বলে বলে কবে শোধ করেছিলে সে খেয়াল আছে? তুমি তো জানো আমারও পেনশনের ওই কটা টাকা কানাই এম . পাশ করে এখনও বেকার স্কুল সর্ভিস কমিশনের পরীক্ষা আবার কবে হবে তার ঠিক নাই যা হোক টিউশন কটা করে বলে হাত খরচের টাকা চায় না এইকথা শুনে অনাদি হরিপদর হাত দুটো ধরে বলল দাদা বড় আতান্তরে পড়ে গেছি নইলে আসতাম না গতকাল থেকে তোমার বউমার প্রেসারের ওসুধটা ফুইরে গেছে নইলে ......! ঔষধ ফুরিয়ে গেছে শুনে হরিপদ আর কিছু বলল না উঠে ঘরে গেল বাক্স খুলে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে এনে তার হাতে দিল টাকাটা পেয়ে অনাদি প্রায় গেটের কাছ পর্যন্ত চলে গেছিল তারপর হঠাৎ সেখান থেকে ফিরে পকেট থেকে হরিপদর জন্য আনা দুপ্যাকেট বিড়ি তার হাতে দিয়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল অনাদি বেরিয়ে যাওয়ার পর হরিপদ বাইরে পড়ে থাকা নড়বড়ে চেয়ারটায় বসে বসে ভাবতে লাগল ভাগ্যিস তার পেনশনটা ছিল
এর ঠিক বছর খানেক পরের কথা হঠাৎ বুকে ব্যথা আর হসপিটাল হসপিটাল করতে করতে পথেই সব শেষ! গতকাল ঘাটক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে আজ শ্রাদ্ধর পরে জলেভাত দেওয়ার অনুষ্ঠান অনাদি এল একটা প্যাকেট হাতে, তাতে কিছু চুনোমাছ আন্নাকালির হাতে সেটা দিয়ে বলল বৌঠান এটার ঝাল চচ্চড়ি জলে ভাত দেওয়ার সময় একটু দিও বড্ড ভালোবসত হরিদা