চুনোমাছ
আজকেও যখন কানাইয়ের বাপ বাজার থেকে একগাদা চুনো-পুঁটি নিয়ে বাড়ি ফিরল তখন কানাই এর মা আন্নাকালি আর চুপ থাকতে পারল না । রাগে চিৎকার করে উঠল মিনসে তুই ভেবেছিসটা কি? বাড়িতে কটা দাসী -বাঁদি পুষেছিস যে রোজ রোজ গুচ্ছের চুনো -পুঁটি আনছিস ? গিন্নির রুদ্রমূর্তি দেখে হরিপদ আদৌ ভড়কে গেল না । বলল আ হা হা ! অত চটছ কেন গিন্নি ! দাসী বাঁদির কথা উঠছে কেন? চুনোমাছ বাছতে হবে তো ? সে আমিই বেছে দিচ্ছি । তোমাকে ও নিয়ে কোন টেনশন করতে হবে না । তুমি বরং পারলে আমায় এককাপ চা দাও । তারপর দুটো সিঁড়ি বেয়ে উঠে বাজারের থলিটা রান্নাঘরের দাওয়ায় নামিয়ে পাশে পড়ে থাকা তালপাতার চাটাটার উপর যুত করে বসল ॥
চায়ের কথা শুনে ঠাণ্ডা হওয়া তো দূরের কথা গিন্নি হলেন আরও খাপ্পা । বলি সকাল থেকে ক কাপ হল শুনি? সকালে চা না হলে বাবুর পায়খানা হয় না। মুখ ধুয়ে সাথে চা না থাকলে পেপার পড়ার মেজাজ আসে না । বাজারে গিয়ে তো আবার সেই বিশুর চা চাইই চাই । এখন এসে আবার চা ! হবে না হবে না । বলি বাঁচা টাচার ইচ্ছে কি নাই ? সেদিন ডাক্তার বললে লিভারের অবস্থা ভালো না। সুগারও বেশির দিকে । চা একদম চলবে না । ভাজা ভাজিও বন্ধ করতে বলল। অথচ তুমি ! সে সব কি আদৌ কানে ঢুকেছে বলে গজগজ করতে করতে বাইরের দিকে কোথায় যেন চলে গেল । চা চাইলে যে এত কথা শুনতে হবে হরিপদ বাপের জন্মেও ভাবে নি ! পকেট থেকে সদ্য কিনে আনা বিড়ির প্যাকেটটা বের করল । তা থেকে একটা বের করে মুখে লাগিয়ে দেশলাই বের করে দেখে তাতে একটাও কাঠি নাই । আস্তে আস্তে উঠে রান্না ঘরে গেল । উনুন থেকে জ্বলন্ত কাঠের একটা টুকরা বের করে তার আগুনে বিড়িটা ধরাল। দাওয়ায় নামানো থলি থেকে মাছের পলিথিনের প্যাকেটটা ও রান্নাঘরের এক কোনে রাখা চুপড়ি গুলোর থেকে একটা নিয়ে ধীরে ধীরে কলতলায় গেল । কল তলায় চুপড়ি আর প্যাকেটটা রেখে দেখল পিড়েটা সেখানে নেই । ওই তো পিড়েটা, ওইতো বারান্দায় দেখা যাচ্ছে । পিড়েটা আনতে গেল । পিড়েটা নিয়ে ঘুরে দেখে কি একটা বে আক্কেলে কাক প্যাকেট ধরে টানাটানি করছে । হুউস হ্যাট হ্যাট বলে সেটাকে তাড়াল । দেখল টানাটানিতে গোটা চারেক মৌরলা আর তার অত করে বেছে আনা বড় বড় সাইজের পুঁটি গুলোর মধ্যে সব চেয়ে বড়টা বাইরে পড়ে । ভাগ্যিস ব্যাটা ওটা নিয়ে যায় নি ! পিড়ের উপর হাঁটু মুড়ে বসে আয়েশ করে বিড়িটা টানল । তারপর মাছ কাটায় মন দিল ।
অর্ধেকর উপর কাটা হয়েছে এমন সময় কই হরিদা কি করছ বলে পালানের বাপ অনাদি মুখুজ্জে ঢুকল । ঢুকেই দেখল হরিপদ মাছ কাটতে ব্যস্ত । সেকি হরিদা তুমি মাছ কাটছ যে বড় ? বৌঠানের কি শরীল খারাপ নাকি ? এই সময়ে অনাদিকে বাড়ি ঢুকতে দেখে যারপর নাই বিরক্ত হলেও হরিপদ মুখে তা প্রকাশ করল না । সে বললে ও অনাদি , আরে এসো এসো বসো বলে আপন পিড়েটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে নিজে চাতালের উপরেই থাপসে গেদে বসে পড়ল। অনাদি পিড়েটা টেনে নিয়ে একটু তফাতে বসল । তারপর পকেট থেকে বিড়ির প্যাকেটটা বের করে বলল নেবে নাকি একটা হরিদা ? হরিপদ বলল না না । এইমাত্র খেয়েছি । এখন আর না । কদিন ধরে রাতের বেলা কাশিটা একটু বেড়েছে । তোর বৌঠান দেখলে অশান্তি করবে । আরে নাও না একটা । আজ পর্যন্ত তো অনেক বিড়ি খেয়েছ । কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি এর'ম বিড়ি তুমি কক্ষনও খাওনি । গতপরশু রানাঘাটে গেছলাম আমাদের সুখির বাড়ি। ইস্টিশানে নেইমে দেখি কি পকেটে বিড়ির প্যাকেট টাই নাই । জামা পাল্টানোর সময় সেই যে সেটা বের করে টেবিলের উপর রেখেছিলাম বেরুবার সময় তাড়াহুড়োতে ফেইলে চলে গেছি । অগত্যা পেলাটফরম থেকে বেইরে দোকান থেকে এক প্যাকেট কিনলাম । তুমি তো জানো দাদা আমি কেমন খুঁতখুঁতে । কিন্তু কি বলব দাদা তোমায় , প্যাকেট কেটে একটা বিড়ি ধইরে আমি থ ! তাইতো কাল বিকালে আসার সময় আমার নিজের লেগে দুপ্যাকেট আর তোমার জইন্য দু প্যাকেট এইনেছি ।আসতে কাল অনেক রাত হইগেল । তাই আজ সকালেই এলাম। দেখ খেয়ে আমার কথা মেইলে কিনা ! এই বলে অনাদি একটা নিজের মুখে লাগিয়ে আর একটা হরিপদর দিকে এগিয়ে দেয় । হরিপদ আবাছা মাছগুলোকে পলিথিনের প্যাকেটে বাঁধল । কাটা মাছগুলোর সাথে সেই প্যাকেটে বাঁধা মাছ সবকে চুপড়ি ঢাকা দিয়ে চৌবাচ্চার গায়ে লাগানো ট্যাপের জলে হাত ধুয়ে এদিক ওদিক দেখে বিড়িটা নিল । কানের কাছে বিড়িটা নিয়ে গিয়ে দুআঙ্গুলে ঘুরিয়ে পরখ করে বলল আওয়াজ শুনে তো ভালোই মনে হচ্ছে রে । দে দে চট করে বিড়িটা ধরিয়ে দে । তার কথা শুনে অনাদি অপর পকেট হাতড়ে দেশলাই বের করল । ফস করে একটা কাঠি জ্বালিয়ে নিজের বিড়িটা ধরাল আর হাত এগিয়ে সেই জ্বলন্ত কাঠিতেই হরিপদর বিড়িটাও ধরিয়ে দিয়ে দুজনে সুখটান দিতে লাগল ॥ তা তারা ততক্ষণ বরং মৌতাতে ব্যস্ত থাক। আসুন এই ফাঁকে আমি অনাদির সাথে আপনাদের পরিচয় পর্বটা সাঙ্গ করে দিই ॥ হরিপদর বাড়ি যেই গলিতে সেই গলিতেই হরিপদর বাড়ি ছাড়িয়ে আরও গোটা পাঁচেক বাড়ির পর বাম দিকে তাকালে একটা একতলা বাড়ি দেখতে পাবেন । বাড়িটার সামনে একফালি জমি। রাজ্যের আগাছায় ভর্তি । বাড়িটার রঙ যে এককালে হলুদ ছিল তা অনেক কষ্ট করে অনুমান করে নিতে হবে । কেননা এখন তার দেওয়ালে শ্যাতলা পড়ে এমন বর্ণ ধারণ করেছে যে তার রঙ কি তা বলা সাধারণ মানুষ তো ছার কোন চিত্রকরের পক্ষেও বোঝা দুঃসাধ্য ! আসলে বাড়িটায় শেষ রঙের কাজ হয়েছিল তা নাই নাই করে কমপক্ষে বিশ বছর আগে ॥ সে বছর অনাদির বাবা ভবতোষ মুখার্জী মেটালবক্স থেকে রিটেয়ার্ড করে ভালোই টাকাপয়সা পেল আর সেই পয়সায় বাড়িটার রঙ করাল । রিটেয়ার্ডের আগে অবশ্য আরও একটা কাজের কাজ তিনি করেছিলেন । সাহেবদের ধরেটরে (নিন্দুকেরা বলে নাকি পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে )নিজের টেনেটুনে এইট পাশ ছেলেটাকে অ্যাপ্রেন্টিস হিসাবে নিজের কারখানায় ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন ॥ ট্রেনিংএর পর পর যখন অনাদি পার্মানেন্ট হল তখন তার সেকি ফাট ! প্যান্ট শার্ট কোট পরে বুটের আওয়াজ তুলে সারা পাড়াকে জানান দিয়ে আপিসে যেত ॥ এরকম চলল তা বছর পাঁচেক । তারপর এল সেই উত্তাল করা দিন । "
দিতেই হবে দিতেই হবে" আওয়াজ। সব কারখানার গেটে গেটে পিকেটিং । নাভিশ্বাস উঠে গেল কারখানায় কারখানায়। উৎপাদন হোক আর নাই হোক তাতে কি ! হয় শ্রমিকদের সব আবদার পূরণ করো নইলে কারখানার চাক্কা বনধ । এক এক করে সব কারখানা হয় লকআউট নয় উঠে যেতে লাগল । মেটালবক্সও তার মধ্য পড়ল । পেটের ভাতই জোটে না তায় ঘর রঙ !
বিড়ি খাওয়া শেষ হলে অনাদি বললে কি দাদা মিলল তো আমার কথাখান ? বিড়িটা কেমন ? বিড়িটা যে ভালো তা হরিপদও সায় দিল । তখন অনাদি গলাটা খাটো করে বলল হরিদা একটা কথা রাখবে ? বলি গোটা পঞ্চাশেক টাকা ধার হবে ? পালান বললে সামনের হপ্তায় ঠিক দিয়ে দেবে । না না অনাদি আর টাকা হবে না । আগের বারে এক সপ্তাহ বলে সেই যে তুমি একশটিটাকা নিয়ে গেলে তা কতবার বলে বলে কবে শোধ করেছিলে সে খেয়াল আছে? তুমি তো জানো আমারও পেনশনের ওই কটা টাকা । কানাই এম .এ পাশ করে এখনও বেকার । স্কুল সর্ভিস কমিশনের পরীক্ষা আবার কবে হবে তার ঠিক নাই । যা হোক টিউশন কটা করে বলে হাত খরচের টাকা চায় না । এইকথা শুনে অনাদি হরিপদর হাত দুটো ধরে বলল দাদা বড় আতান্তরে পড়ে গেছি । নইলে আসতাম না । গতকাল থেকে তোমার বউমার প্রেসারের ওসুধটা ফুইরে গেছে । নইলে ......! ঔষধ ফুরিয়ে গেছে শুনে হরিপদ আর কিছু বলল না । উঠে ঘরে গেল । বাক্স খুলে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে এনে তার হাতে দিল । টাকাটা পেয়ে অনাদি প্রায় গেটের কাছ পর্যন্ত চলে গেছিল তারপর হঠাৎ সেখান থেকে ফিরে পকেট থেকে হরিপদর জন্য আনা দুপ্যাকেট বিড়ি তার হাতে দিয়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল ॥ অনাদি বেরিয়ে যাওয়ার পর হরিপদ বাইরে পড়ে থাকা নড়বড়ে চেয়ারটায় বসে বসে ভাবতে লাগল ভাগ্যিস তার পেনশনটা ছিল ॥
এর ঠিক বছর খানেক পরের কথা ।হঠাৎ বুকে ব্যথা আর এ হসপিটাল ও হসপিটাল করতে করতে পথেই সব শেষ! গতকাল ঘাটক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে । আজ শ্রাদ্ধর পরে জলেভাত দেওয়ার অনুষ্ঠান ।অনাদি এল একটা প্যাকেট হাতে, তাতে কিছু চুনোমাছ । আন্নাকালির হাতে সেটা দিয়ে বলল বৌঠান এটার ঝাল চচ্চড়ি জলে ভাত দেওয়ার সময় একটু দিও । বড্ড ভালোবসত হরিদা ॥