গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ২ মার্চ, ২০১৯

শুভাশিস দাশ

প্রতিমার যাপিত জীবন


আর এই সংসার ভাল্লাগেনা !কী দেখে যে এই পোড়ার মুখোর সাথে বিয়ে দিলো !কামাই করবার মুরাদ নাই খালি বৌয়ের উপর চোটপাটগ্যাস শেষ হয়েছে পাঁচদিন ,উনুনের আঁচ ঠেলতে ঠেলতে কথা গুলো আপন মনেই বলতে থাকে প্রতিমা l
প্রতিমার মনে পড়ে সেই ছোটবেলার কথা l
গাড়লঝাড়ার সেই গ্রাম !বাপের বাড়ি l না ছিলো পাকা রাস্তা না ছিলো স্কুল lগরমকালে তাও ধুলো মাড়িয়ে স্কুলে যাওয়া যেতো কিন্তু বর্ষায় সে এক ভয়াবহ ব্যাপার !রাস্তা দিয়ে এক কোমর জল গড়িয়ে যেতো l আমাদের বুক সমান জল ভেঙে যেতে হতো দুই মাইল দূরের প্রাথমিক স্কুলে l
বাপের বাড়িতেও যে সুখ ছিলো তা নয় ,সমান্য চাষের জমি আর পাঁচ জন ভাই বোন !ওই দিন আনা দিন খাওয়া !
অভাবের সংসারে যা হয় আর কি !
তবু কষ্ট করে লেখাপড়া টা শিখেছিলাম না হলে আজ দুর্দশার অন্ত থাকতো না l
মিনসের যা রোজগার !চাল আনতে নুন আনার পয়সা শেষ হয়ে যায় তারউপর আবার দুরারোগ্য ব্যাধি l প্রতি তিন মাস অন্তর হায়দরাবাদ যেতে হয় !
ভাগ্যিস এখন স্বনির্ভর গোষ্টি হয়েছে l এই গ্রুপ গুলোই আমার মত মহিলাদের বাঁচিয়ে রেখেছে l প্রতিমা ভাবছিল আপন মনে l
কই ভাত হলো ?স্বামী অজয়ের কথায় ভাব কেটে গেলো l
তুমি চান করে এসো l
মানুষটা খুব একটা খারাপও নয় তবে নানা ব্যাধিতে মেজাজটা খিঁচে গেছে l
সেল্ফহেল্প গ্রুপের সেক্রেটারি প্রতিমা বর্মণ l ছোট আটিয়াবাড়ি অঞ্চলের এই প্রতিমাই বি পাশ l তাই ওকে সবাই একটু সমীহ করে l প্রতিমাও সাধ্যমত মানুষের কাজ করে দেয় l
আজ অঞ্চলে গ্রুপের সভা আছে l প্রতিমা সাইকেল নিয়ে বেড়িয়েছে l পথে বাতাসীর মা ডাক দিলো - বৌমা এত্তি এ্যানা আইশত !
সাইকেল থামিয়ে প্রতিমা বলে কে মামী কী কন ?
বাতাসীর মা বলে -আইজ বাতাসীক পড়াবার নন ?এল্যায় কোটে যাবার ধরছেন ?
ক্যা তোমরাগুলা জানেন না আইজ অঞ্চলে মিটিং আছে গ্রুপের !
বাতাসীর মা উত্তর দেয় -তা তো জানি তার জন্য তো তোমরা গুলা আচেন !
প্রতিমা বলে সন্ধ্যা বেলা পড়ামো l
এই বলে আবার সাইকেলে চেপে সে চলে যায় l
বাতাসীর মা ভাবে সেও যদি একটু পড়াশুনা জানত তাহলে বাতাসীকে নিজেই পড়াতে পারতো l অক্ষর না থাকলে সত্যি অন্ধ !ভাবতে ভাবতে গণেশের মা এসে দাঁড়ায় l বলে -এটে কে বাতাসীর মাও ?
ওই বৌমাকে ধরবার বাদে l উমার অঞ্চলের মিটিং আচে তাই পরের বেলা আসবে l
বৌ টা কিন্তুক খুব খাটাইয়া !সকালে উঠি ওই যে দৌড়াদৌড়ি একেবারে সন্ধ্যায় !তাও এলা একটু মনত অশান্তি স্বামীটাক নিয়া l
অঞ্চলে পৌঁছে দেখে কেউ আসেনি l প্রতিমা জানে কারো টাইম্ ঠিক নেই l পাশে পোস্ট অফিসের দরজা খোলা l প্রতিমা এগিয়ে গেলে পোস্ট ম্যান বিপিন বললো আরে বৌদি যে !তোমার অঞ্চল এখনও খোলেনি তুমি এখানে এসে বসো l
প্রতিমা জানে বিপিন একটু মেয়ে ঘেঁষা l তবে ভালমন্দ নিজের কাছে l
সে এগিয়ে গিয়ে পাশের চেয়ারে বসলো l
বেলা সাড়ে দশটা l
বিপিন বললো -তা বৌদি কেমন আছেন ?
দাদার অসুখ ভালো হয়েছে ?
না ভাই !বারবার বাইরে নিয়ে যেতে হচ্ছে আর কুলাতে পারিনা l প্রতি তিনমাস অন্তর কতগুলো কড়ে টাকা লাগে !
গায়ের চাদর টা ঠিক করতে গিয়ে প্রতিমা দেখল বিপিন একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে প্রতিমার বুকের দিকে l পুরুষ মানুষগুলোই বোধহয় এরকম !
বিপিন বলে কেন বৌদি আমিতো অনেকবার বলেছি টাকার দরকার হলে আমাকে বলো l
না ভাই শোধ দেবো কী করে ?
দুর্ !দেওর বলে ভাব যখন আর শোধের কথা চিন্তা করো ?
প্রতিমা জানে এর লক্ষ্যই  ওই দিকে l কাজেই নত হওয়া যাবেনা l
এর মধ্যে প্রতিমা দেখলো অঞ্চল অফিসের দরজা খুলেছে ,বিপিন কে বললো আসি ভাই দরকার হলে তোমাকে বলবো !
অঞ্চলের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী ভবানী বললো দিদি যে বড় সক্কালে এসেছো ?
মিটিং তো একটায় !
প্রতিমা বললো কেন আমার চিঠিতে তো সকাল এগারো টা লেখা !
কেন আপনি ম্যাসেজ পাননি ?কাল প্রধান সাহেব তো সকলের নন্বরে ম্যাসেজ করেছেন l
কী জানি হয়তো আমার কথা ভুলেই গেছিলো !
ঠিক আছে এসেই যখন পড়েছি তবে বসি একটু জিরিয়ে নিই ,বাড়িতে তো বসার সময় পাইনা l
এমন সময় প্রতিমার ফোন বেজে উঠলো
অজয়ের ফোন l ব্যাপার কি !বুকটা কেমন যেন একটু ধুক করে উঠলো !অজয় তো খুব একটা ফোন করেনা !
হ্যালো !কী হলো ?
অজয়ের গলায় কেমন ভারী সুর -শরীরটা খারাপ লাগছে তাই বাড়ি চলে এলাম l তোমাকে জানিয়ে রাখলাম l
প্রতিমা ঘড়ির দিকে দেখলো এখন সাড়ে এগারো টা মিটিং আরও দেড় ঘন্টা l এর মধ্যে ঘুরে আসা যাবে বাড়ি থেকে l অঞ্চল থেকে প্রতিমার বাড়ি বড়জোর পনের মিনিট !
প্রতিমা সাইকেল ছুটছে !মনটা অস্থির !
ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে যারপর নাই গালিগালাজ করলো প্রতিমা !একটা মানুষকে এত্ত কষ্ট দিতে পারে ঈশ্বর ?
বাড়ি পৌঁছে দেখে অজয় শুয়ে আছে l প্রতিমাকে দেখে বললো কবে যেন যেতে হবে ডাক্তার দেখাতে !
প্রতিমার আজ কেমন যেন মনটা খারাপ হয়ে গেলো !এত অসহায় মনে হলো নিজেকে !নিজের কপাল কেই দোষ দিলো প্রতিমা l
অথচ সৎপথে থাকার যে আনন্দই আলাদা l
প্রতিমা বললো দেখি আজ মিটিং যদি লোন মঞ্জুর হয় তবে সামনের সপ্তাহে যাবো l
প্রতিমা লক্ষ্য করলো অজয় কাঁদছে l
এই প্রথম বার দেখলো সে ভেঙে পড়েছে l
প্রতিমার মনে হলো পৃথিবীতে টাকা না থাকলে সবই অন্ধকার !