গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ২ মার্চ, ২০১৯

আফরোজা অদিতি

প্রতিচ্ছায়া


বাসায় পুলিশ দেখে খুব ভড়কে গেল রমিজা। ওর স্বামী হাসনাত রূমি বাড়ি নেই;বাড়ি থাকেও না খুব একটা। বগুড়াতে একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর আছে সেখানেই থাকে; পৈতৃক ভিটাতে দেয়া দোকানটিও হাসনাত রূমির বাবার; হাসনাত সাহেব শুধু পরিধি বাড়িয়েছেন। নিজে দেখাশোনা না করলে জ্ঞাতি-গুষ্টিদের দখলে চলে যাবে। বাবার এতদিনের পরিশ্রম বৃথা যাবে; তা হয় না। সেই কারণে সচরাচর আসতে পারেন না তিনি। 
ওদের দুই ছেলে; বড়টি বগুড়াতে বাবার সঙ্গে থাকে, ছোটটি ওর কাছে। বড়টি লেখাপড়ায় ভালো নয় আবার পড়তে বসতেই চাইতো না; পড়তে ভালো লাগে না তার! তাই ছেলেটিকে বাবার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে, বাবার কাজে সাহায্য করবে। ছোটটি এখানে এম.বিএ করছে। সারাদিন বই নিয়েই থাকে। বিশেষ কোথাও বের হয় না। ছেলেটির জ্বর; জলপট্টি দিচ্ছিল এর মধ্যে কাজের মেয়েটি এসে খবর দিলো পুলিশ এসেছে। পুলিশ! পুলিশ কেন তাইতো বুঝতে পারছে না রমিজা।
এই বাড়িটি ওর বাবার। চার তলা। নিচ তলার একাংশে ভাইয়ের দোকান, অন্যাংশে কুরিয়ার সার্ভিস আর কম্পিউটার- মোবাইল মেরামতের দোকান। দুই তলাতে বোন, তিন তলাতে ছোট ভাই আর চার তলাতে থাকে রমিজা নিজে;ওরা দুইজন মানুষ, তাই পাশের ফ্ল্যাটটি ভাড়া দিয়েছে। ভাড়াটিয়ারা বেড়াতে গিয়েছে। ছেলেটিতো জ্বরে কথাই বলতে পারছে না। পুলিশের সঙ্গে কথা; একা ভয় পাচ্ছে রমিজা কী বলতে কি বলে ফেলবে শেষে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই কাজের মেয়েটিকে পাঠায় ভাইকে ডাকতে; কিন' মেয়েটি ফিরে এলো একা; ভাই আসতে পারবে না! আসবে না শুনে কষ্ট পেলো রমিজা। এই ভাইকে কোলেপিঠে বড় করেছে, নিজে না খেয়ে ওকে খাইয়েছে। অসুস্থ হলে জেগে থেকেছে পাশে। শুধু ভাই নয় বোনের জন্যও করেছে। ভাইবোনদের মধ্যে বড় হওয়ায় ভাইবোন উভয়ের জন্যই মায়ের দায়িত্ব পালন করেছে। মন খুব খারাপ হয়ে গেল।
পাশের ঘরে পুলিশ বসে আছে। কী বলবে পুলিশের প্রশ্নের জবাবে ভেবে পাচ্ছে না রমিজা। রমিজা ঘরে ঢুকতেই .সি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।বিপুল কে?”
বিপুল আমার ছেলে।রমিজা বলে।
ডেকে দিন। ওর নামে চুরির অভিযোগ আছে।দারোগার কথায় আশ্চর্য হয় রমিজা।
চুরি করেছে! কবে কখন কোথায়? তো জ্বরের ঘোরে অচেতন; চারদিন ধরে বিছানাতে শুয়ে আছে।বিস্মিত কাতর কণ্ঠ রমিজার।
 দেখুন জ্বর কি জ্বর নয় তা দেখার বিষয় আমাদের নয়! ওর নামে ডায়েরি হয়েছে থানায়, আমরা এসেছি। এখন ওকে থানায় নিয়ে যাবো।
কে করেছে ডায়েরি? আর এই অবস'ায় থানায় নিয়ে যাবেন?”
কি করবো বলেন, শুধু ওকে নিয়ে যাবো না, আপনার বাড়ি সার্চ করবো। সার্চ ওয়ারেণ্ট আছে।
সার্চ ওয়ারেণ্ট এনেছেন, সার্চ করবেন কিন' বলেন তো কে অভিযোগ করেছে?” রমিজা বলে।  
এই বাড়ির তিন তলায় যিনি থাকেন। তার দোকান থেকে চুরি করেছে বিপুল।.সি বলে।
তিন তলায় তো আমার ভাই থাকে, অভিযোগ করেছে? আমার এম.বিএ পড়ুয়া ছেলে চুরি করবে তাও আবার ওর মামার দোকানে! তাছাড়া তো বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারছে না; জ্বরে বেহুঁশ, বেহাল অবস্থা ! আর কেনই বা চুরি করবে?”
 রমিজার কথা শুনে থানার দারোগা একটু চুপ করে থেকে বলে,“দেখুন কেন চুরি করবে সেটা তো আমার জানার কথা নয়। আমরা অভিযোগ পাই, ধরতে আসি।
পুলিশ বাড়ি সার্চ করে বাড়িতে কিছুই পেলো না; না পেলেও বিপুলকে নিয়ে চলে গেল ওরা। বিপুলকে দেখে পুলিশের মায়া হলো কিন' কিছুই করার নেই। ডিউটি! ডিউটির কাছে মানবিকতা হার মানে! মায়ের কাকুতি-মিনতিতে মন গলে না পুলিশী কাজের! পুলিশের সঙ্গে যেতে চেয়েছিল মা, কিন' যাওয়া যায় না! ওদের সঙ্গে যেতে না পারলেও রমিজা পরে চলে যায় থানায়। থানায় গিয়ে দেখে জ্বর বেড়ে বিপুল অচেতন! বিপুলের চেতনা ফেরানোর জন্যে চেষ্টা করেও যখন পারে না তখন .সি নিজেই হাসপাতালে পাঠায় ওকে। এই মানসিক প্রেসার নিতে পারে না বিপুল মারা যায় দুই দিন পর। ছেলের শোকে হাসনাত সাহেবও স্ট্রোক করে মৃত্যু মুখে পতিত হন।
বাবা আর ভাইয়ের শেষকৃত্য হওয়ার পর বড় ছেলে,শিমুল বগুড়ার দোকান আর ভিটেবাড়ির দেখভাল করার জন্য  সেখানে চলে যায়, মাকে নিয়ে যেতে চায় কিন্তু যেতে রাজী নয় মা! স্বামী-ছেলের স্মৃৃতিচিহ্ন ছড়িয়ে আছে ঘরের ভেতর বাহিরে; কী করে চলে যাওয়া যায়! কোন মা কি যেতে পারে? পারে না। রমিজারও যাওয়া হলো না। খুব দরকার না পরলে বাসা থেকে বের হয় না রমিজা। ভাইকে দেখলে রেগে যায়, চিৎকার করে। রমিজা বাসায় একাই থাকে; এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পাগল সাজিয়ে মানসিক হাসপাতালে রেখে আসে রমিজাকে। তারপর! তারপর আর কী! সোনায় সোহাগা; যা চেয়েছিল তাই হয়েছে, ফ্ল্যাট নিজের করে নিতে পেরেছে আজমল! ফ্ল্যাটের দলিল কোথায় রেখেছে সারা বাড়ি তোলপাড় করেও পেলো না যখন, তখন জাল দলিল করতে দিয়ে জাঁকিয়ে বসলো ভাই! ভাইয়ের একবারও মনে পড়লো না বোনের কথা! এই বোনটিই কোলে-পিঠে বড় করে তুলেছিল ওকে! বোন না থাকলে এই জীবনে কিছুই করতে পারতো না, সে কথা একবারও মনে করলো না এমনি অকৃতজ্ঞ সে!


মানসিক হাসপাতালের বাগানে হাঁটছে রমিজা। এখন ভালো। রিলিজ করে দিবে বলেছে। কিন্তু কোথায় যাবে? সেই তো ফ্ল্যাটবাড়ি, সেই তো ভাইয়ের মুখ, সেই তো একা থাকা! তার থেকে এখানে থাকতে ভালোই লাগছে ওর। কী হবে বাড়ি গিয়ে, সেই তো ভাইয়ের সঙ্গে লাগালাগি; ভাইয়ের জন্যই তো ছেলে আর স্বামীকে হারিয়ে তার ঠাঁই হয়েছে এই মানসিক হাসপাতালে! এখন ওখানে গেলে কী আর ঘটনার থেকে ভালো কিছু ঘটবে! এরপর হয়তো  খুন করবে ওকেই! বিশ্বাস নেই ভাইকে! রিলিজের দিন এলো ডাক্তার। ওর চিকিৎসক। চিকিৎসকের নাম বিপুল আবার দেখতে-  বিপুলের মতো! ওর চিকিৎসা-যত্নে একটু একটু করে সেরে উঠেছে রমিজা। বিপুলের মা-বাবা কেউ নেই; অনুকুল ঠাকুরের আশ্রমে থেকে লেখাপড়া করেছে, ডাক্তার হয়েছে! এখন নিজের বাড়িতে থাকে। রিলিজ করিয়ে নিজের বাসায় নিয়ে আসে রমিজাকে। একদিন বাসাতে রেখে দেয়। পরদিন আর যেতে চায় না রমিজা! বলে, “তোকে ছাড়া বাঁচবো না বিপুল; আমি যাবো না, যাবো না!” বলতে বলতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে রমিজা। বিপুল বুঝতে পারে, রমিজাকে সুস্থ মনে হলেও সে সুস' নয়! সন্তানের শোক কি সহজে ভুলতে পারে কোন মা। কোন মা- পারে না, রমিজাও পারেনি। এরপর যখনই যাওয়ার কথা ওঠে তখনই কান্না জড়ানো কণ্ঠে রমিজা বলে, “তোকে ছেড়ে তো যেতে পারি না। তাছাড়া কেন যাবো? না হলে তুই- চল!”
রমিজার কথা শুনে বিপুল বলে, “আমার এখানে তো কাজ আছে, কী করে যাই? তুমি যাও।বিপুলের কথা শোনার পর রমিজার অবস্থা আবার খারাপ হয়ে যায়। অসুখ যখন বেশি ছিল তখন চিকিৎসক হিসেবে কথা দিয়েছিল বিপুল কখনও ছেড়ে যাবে না রমিজাকে। সেই কথাই ধরে রেখেছে রমিজা, সবসময় তার হারাই-হারাই ভাব! বিপুলকে না দেখলে চিৎকার, চেঁচামেচি, কান্নাকাটি করে! বিপুল বাসায় রেখেই কয়েকদিন চিকিৎসা দেয় রমিজাকে; রমিজা ভালো হয়ে ওঠে কিন' বিপুলকে ছাড়তে চায় না। রমিজাকে এখানে রাখতে ওর কোন অসুবিধা নেই কিন্তু বিপুল শুনেছে এবং জেনেছে রমিজার ফ্ল্যাট দখল হয়ে গেছে; তার ভাই সেখানে থাকতে শুরু করেছে এবং জাল দলিল করার চেষ্টা করছে! রমিজা ওখানে না গেলে সব কিছু দখল হয়ে যাবে! আর একবার জাল-দলিল হয়ে গেলে কোট-কাচারি না করলে ফ্ল্যাট পাওয়া যাবে না! আর কোট-কাচারিতে খরচও অনেক, শ্রমও অনেক। তাছাড়া মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দখল পাওয়া যাবে না। কিন' এসব কথা বলা যাবে না রমিজাকে তা জানে বিপুল। অন্যপথে চেষ্টা করতে হবে!


ছুটি নিয়ে রমিজাকে নিয়ে ঢাকা আসে বিপুল; কিন্তু বাড়িতে ঢুকতে দেয় না ম্যানেজার। হাজারটা প্রশ্ন করে সে। অনেক চেষ্টা করেও যখন ঢুকতে পারে না তখন বিপুল বলে, “ ফ্ল্যাট তো রমিজা হাসনাতের নামে। সে কেন যেতে পারবে না, থাকতে পারবে না ফ্ল্যাটে! অদ্ভূত তো! আপনি চেক করুন, দেখুন ফ্ল্যাটটি কার নামে!” তখন ম্যানেজার খাতাপত্র ঘেঁটে বলে না নামে কোন ফ্ল্যাট মালিক নেই। বিপুল ওখানে আর থাকে না। চলে আসে রমিজাকে নিয়ে, হোটেলে ওঠে। এখানে কেন বাপ!” রমিজা প্রশ্ন করে।
এখানে কয়েকদিন থাকি না মা।বলে বিপুল। ওর খুব মা ডাকতে ইচ্ছা করে তাইমাবলে ডাকে রমিজাকে। দিন আর কোথাও বের হয় না বিপুল;চিন্তা করে কী ব্যবস্থা নিলে ফ্ল্যাটটি নিজেদের আয়ত্তে আনতে পারবে সে বিষয়ে। হোটেলে শুয়ে নিজের ফ্ল্যাটের কথা মনে পড়ে রমিজার; মনে পড়ে ছেলেদের কথা, স্বামীর কথা, আজমলের কথা। মা ছিল না, আজমলকে কোলেপিঠে বড় করেছে; ওকে বড় করার জন্য লেখাপড়া করতে পারেনি, যেতে পারেনি স্কুলে। কিন' কী ফল হয়েছে তাতে, আজমলকে তো মানুষ করতে পারেনি। যে ভাইয়ের জন্য সব ছেড়েছিল সেই ভাইয়ের জন্যই মারা গিয়েছে নিজের ছেলেটি। দুই চোখ বেয়ে জলের ধারা নামে রমিজার। বিপুল বুঝতে পারে কাঁদছে রমিজা। কিন' কাছে আসে না; একটু কাঁদার প্রয়োজন আছে। 
পরদিন বাইরে গেল বিপুল। শুধু দিন নয় পরপর কয়েকদিন বাইরে গেল সে। আশপাশ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলো কয়েকদিন; পরে আজমল বাড়ি থাকাকালীন রমিজাকে নিয়ে ফ্ল্যাটে আসে বিপুল। ওকে দেখে চমকে ওঠে আজমল। আজমলকে সালাম দেয় বিপুল,“আসসালামু আলাইকুম মামা।
সালামের জবাব না দিয়ে আজমল বলে, “তুমি কে?”
 আমি বিপুল
 বিপুল তো মরে গেছে। নিজ হাতে দাফন করেছি আমি।মিথ্যে বলে আজমল।
না, মরেনি বিপুল। এই তো আমি আপনার সামনে।
এতোদিন আসোনি কেন?” রাগি,রূঢ় কণ্ঠ মামার।
এতদিন আসিনি, কারণ মা অসুস' ছিল তাই! মা-কে তো পাগল বানিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়েছিলেন আপনি।শান্ত স্বরে কথা বলে বিপুল এবং মামাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মা-কে নিয়ে চারতলায় চলে যায়।কোথায় যাও, কোথায় যাওবলতে বলতে পেছনে যায় আজমল! ঘরে ঢুকে অবাক বিস্মিত রমিজা। বলে,“আমাদের কোন মালপত্র নাই কেন এখানে?”
আমাদের মালামাল কোথায় মামা?” রমিজার কথা শুনে বিপুল প্রশ্ন করে আজমলকে। 
এখানে তোমাদের মালামাল থাকবে কোথায়? আমার ফ্ল্যাটে তোমাদের মালামাল! হাসালে! তোমরা চলে যাও। তাছাড়া তুমি কে?” আজমল ধমকের সুরে বলে। রমিজার দুইচোখে জল। কান্না জড়িত কণ্ঠে বলে,“এবার কী হবে বিপুল? আমার এতোদিনের ব্যবহার করা মালপত্র কোথায়? আমার স্বামীর স্মৃতি, ছেলের স্মৃতি সব মুছে গেল বাপ!”
 মা একটু চুপ করো, আমি দেখছি।স্বান্তনা দেয় কিন' এই ভাবনার কোন স্বান্তনা হয় বা কতোটুকু স্বান্তনা পাবে মা তা জানে না বিপুল! ওখান থেকে উঠে আজমলের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় বিপুল। এবারে কঠোর কণ্ঠে বলে, “মামা, ঘর খালি করো।
ঘর খালি করবো, তুমি কে হে? যে তোমার কথায় ঘর খালি করবো!” হুমকি দেয় মামা।
আমি কে সেকি তুমি জান না মামা? না জানলে মায়ের কাছে জেনে নাও। এবং ঘর খালি করো না করলে আমিই খালি করে নিবো।
বাড়ি থেকে বের হও না হলে আবার পুলিশ ডাকবো।ধমক-ধামক দিচ্ছে ঠিকই কিন্তু আজমল ইতস্তত করে, এখনও দলিল হাতে পায়নি। 
ঠিক আছে ডাকুন। কই ডাকুন, চুপ করে রইলেন কেন? এখন আমি আছি মামা, মা একা নেই। কিছুই করতে পারবেন না।বিপুল শক্ত কন্ঠে বলতে পারলো কথা কারণ বিপুল জানতে পেরেছে জাল দলিল এখনও আজমলের হাতে আসেনি।
কথার ফঁকে কখন যে আজমলের ছেলেমেয়েরা চলে এসেছে জানতে পারেনি কেউ। রমিজার ঘরে এখন আজমলের ছেলেমেয়েরা থাকে। বিপুল ওদের কাছে ডেকে বলে, “তোমাদের জিনিসপত্র নিয়ে যাও তো ভাই।ছেলেমেয়ে দুটি বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এবারে বিপুল বলে, “ওদিকে তাকিয়ে কোন লাভ নেই! বই-খাতা সব নিয়ে যাও। নিয়ে যাও বিছানা-পত্তর আর অন্যান্য জিনিস; না পারলে আমি সাহায্য করবো। এসো।
ওদের জিনিসপত্র একপাশে নামিয়ে রেখে রমিজার জন্য নতুন খাট বিছিয়ে বিছানা করে শুইয়ে দেয় তাকে। কয়েকদিন কেটে যায়। বিপুলের ছুটি শেষ। কিন' এখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতি দেখে বুঝে গিয়েছে যে এখানে একা একা থাকতে পারবে না রমিজা! এরা থাকতে দিবে না। এদের লোভ অনেক অনেক বেশি। বিপুল মায়ের কথা ভেবে ঢাকাতে চাকরির চেষ্টা করে এবং পেয়েও যায়।

এদিকে আজমলের মন ভালো নেই! এতো ভালো ফ্ল্যাটটি বেদখল হয়ে গেল। এতো রক্তারক্তি, এতো কীর্তি-কাণ্ড সব বিফলে গেল। হা হতস্মি! আজমলের ভালো লাগে না। ভালো লাগে না খেতে-শুতে-ঘুমাতে-কাজ করতে; কিছুই ভালো লাগে না তার। সারাক্ষণের চিন্তা ফ্ল্যাট; কী ভাবে হস্তগত করবে ফ্ল্যাট এই চিন্তা তার!  ছেলেটা যতো নষ্টের গোড়া; ছেলেটি বিপুল নয়! বিপুল মারা গেছে; থানাতেই মারা গিয়েছিল। লাশটা চোখে দেখেনি তবে শুনেছে। মর্গ থেকে সোজা গ্রামের বাড়িতে বাবা আর ছেলেকে পাশাপাশি কবর দিয়েছে ওরা! এখন এই ছেলেটিকে কিভাবে সরানো যায় সেই চিন্তা করছে; আগের ফর্ম তো আর খাটবে না! কী করা যায়, কী করা যায়!
বিপুল খুব ভালো ব্যবহার করে আজমলের সঙ্গে। মামা মামা বলে কাছে যায়, হাতের কাজ আগ বাড়িয়ে করে দেয়। আজমলের ছেলেমেয়ের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে। একদিন কথার ফাঁকে আজমলকে বলে, “মামা, তুমি কেন বিপুলকে অন্যায়ভাবে মারলে? ওতো তোমাকে এতো ভালোবাসতো এতো ভালোবাসতো যে তোমার ছেলেমেয়েরাও তোমাকে এতোটা ভালোবাসে কিনা সন্দেহ আছে। খুব ভালো ছিল মামা।
ওর কথায় চমকে ওঠে আজমল। আজমলের হঠাৎ করেই বছর ত্রিশ আগের কথা মনে পড়ে যায়! হরতাল, মিটিং,মিছিলের শহর তখন ঢাকা। রমিজা ছিল সন্তান সম্ভবা; সে সময় ব্যথা উঠলে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয় আজমলকে। দূরপাল্লার গাড়ি বন্ধ থাকার জন্য হাসনাত রূমি বগুড়া থেকে আসতে পারেনি। সেই হরতাল-সেই দূরপাল্লার গাড়ি বন্ধ আজমলের জন্য সোনালি দিন এনে দিয়েছিল; অন্ততপক্ষে সেদিন আজমলের তাই মনে হয়েছিল! সেদিন এক আয়াকে ঠিক করেছিল বাচ্চাটাকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য; যদিও তার বিনিময়ে অনেক টাকা খরচ করতে হয়েছিল ওকে! সরিয়েও দিয়েছিল সাক্ষী তো নিজেই! ছোট্ট এক ফুটফুটে বাচ্চাকে দেখিয়ে নিয়ে ছেড়েছিল অন্য এক দম্পতির হাতে! কিন্ত আজ একি ফ্যাসাদ; ঘটনার কিছুই বুঝতে পারছে না আজমল! কিন' এতোদিনের পরিশ্রম হেরে যেতে পারে না আজমল তাই কণ্ঠে জোর এনে বলে,“অ্যাই তুমি বিপুল বলছো নিজেকে আবার তুমিই বলছো বিপুল মরে গিয়েছে! তাহলে তুমি কে?”  
বিপুল এই অপেক্ষাতেই ছিল। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে; সচেষ্ট হলো বিপুল। মায়ের ওপর অত্যাচার, বাবার মৃত্যু, ভাইয়ের মৃত্যু- সবকিছুর প্রতিশোধ নিতে চায় ! বিপুল নিজে জানে এই বাড়ির কেউ নয় তবুও রমিজাকে নিজের মায়ের থেকে বেশি মানে! রমিজাকে দেখার পর থেকে কেন যেন মনে হয়েছে যে মাকে দেখেনি সেই মা!
এখানে এসে অনেক কিছু জানতে পেরেছে; যা জানতে পারেনি রমিজা! জানতে দেয়নি তাকে। বড় ভাইয়ের বগুড়ার দোকানে হিরোইন,ইয়াবা রেখে ক্রশফায়ারে মেরে দিয়েছে বড় ভাইকে আজমল! বাবা, ভাই - ওদের সকলের মৃত্যুর প্রতিশোধ, রমিজার প্রতি হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতেই হবে ওকে, নিতেই হবে। যে নিজের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আজমলের কথা শুনে হা হা করে হেসে ওঠে। বলে, “আমি তো মরেই আছি মামা, এই আমি! যাকে তুমি দেখছো সে তো বিপুল নয় বিপুলের আত্মা, ওর প্রতিচ্ছায়া! বিপুল তো সেই-কবেই মরে গেছে মামা!” আবার হা হা করে হেসে উঠে বিপুল। ওর হাসির শব্দ শুনেআত্মা! প্রতিচ্ছায়া!”  বলে চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে আজমল।

আজমলের জ্ঞান ফিরিয়ে আনে বিপুল কিন্তু ওকে দেখলেই জ্ঞান হারায় আজমল! ওকে দেখলেই মানসিক চাপ বাড়ে আজমলের, বাড়তে বাড়তে মানসিক রোগগ্রস্থ হয়ে পড়ে আজমল। এমন প্রতিশোধ চায়নি বিপুল কিন্তু নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে করতে হয়েছে ওকে! না হলে যে তার মা ভালো থাকবে না! মাকে ভালো রাখতে আত্মার নাটক করতে হয়েছে! এর জন্য ওর মনে কোন গ্লানি নেই! নেই কোন অপরাধবোধ! 

আজমলকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে বিপুল।