বসন্ত এসে গ্যাছে
অফিস ছুটি হয় কাঁটায় কাঁটায় ঠিক চারটায় । সাহেব কোম্পানীর অফিস । সেই অফিসে পেটি ক্লার্ক আমি । দেখতে শুনতে লোকে বলে ভালোই । মহিলামহল আড়ালে আবডালে বলে কার্তিককুমার । আমি মনে মনে হাসি । কার্তিককুমার হেঁ হেঁ হেঁ ! দুপুরের টিফিনের পর প্রায়দিনই বারে বারে সামনে টাঙানো মস্ত বড় দেওয়াল ঘড়ির দিকে চাই আর ছটফট করি । শালা ঘড়ির কাঁটা যেন নড়তেই চায় না ! আমার মুখোমুখি পরের রোর টেবিলে বসেন অনিকবাবু ।আমার চেয়ে বছর পাঁচেক বড় । আমি ডাকি অনিকদা। আমার ছটফটানি তাঁর নজর এড়ায় না । বলেন এই যে পাল ! অত অস্থির কেন ? মন দিয়ে কাজটা করো । গত সপ্তাহে বড় সাহেব আমায় ডেকেছিলেন । জিজ্ঞেস করছিলেন কাজ কম্মো কেমন করছো । ইদানিং তোমার ফাইলে নাকি বেশ ভুলভাল থাকছে। ব্যাপারটা কি হে ? আমি বললাম তাই নাকি দাদা ! আর কি কিছু বললেন ? উনি বললেন না না । তবে .......। তবে কি দাদা আমি ব্যগ্র হয়ে প্রশ্ন করি । না না সেরকম কিছু নয় । তবে আমি বলি কি ভায়া এবার কাজে একটু মন দাও । অনিকদার কথা শুনে আমিও মনে মনে ভাবি ঠিক! ঠিক ! আর নয়। এবার মন দিয়ে কাজ করা দরকার । শীগগির যখন একটা গুরু দায়িত্ব ঘাড়ে চাপবে , আগের থেকেই ঘাড়টা একটু মজবুত করা উচিৎ কি বলেন ! মনের প্রতিজ্ঞা মনেই রয় । টিফিনের পরে উসখুসানি কমে না ॥
কেটে যাচ্ছিল এমনি করেই দিন । রঙবেরঙের সুতোয় গাঁথা জীবনও রঙিন ! কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় অন্য ! মার্চ মাসের মাঝামাঝি । গরমটা এরই মধ্যে পড়েছে ভালোই । রাতে ভালো ঘুম হয় না ।সেকথা সেদিন ভিক্টোরিয়ায় গাছের তলায় লতুর কোলে মাথা দিয়ে খুনসুটি করতে করতে বলে ফেলেছি । তাই না শুনে লতু বলছিল এখন যা করছো করো । বিয়ের পরে এ .সি কিন্তু চাই -ই -চাই । তারই দুদিন বাদে সবে অফিসে ঢুকেছি । সাহেবের আর্দালি বংশী এসে বললে বড় সাহেব এত্তেলা পাঠিয়েছেন । টিফিনের আগেই যেন দেখা করি । শুনেই তো বুকের মাঝে ঢেঁকির উঠাপড়া । কি জানি বাবা আবার কি ভুল করলাম! অনিকদার কাছে গিয়ে সিগারেট দিয়ে তৈলমর্দন করি । দাদা সাহেব কেন ডেকেছেন আপনি কি কিছু জানেন ? আসলে আগের থেকে যদি কিছু জানা যায় ! যা রাশভারী সাহেব ! ঢিপঢিপানি নিয়েই ঢুকলাম কামরায় । দেখি সাহেব দরজার দিকে পিছন ফিরে ফোনে কার সাথে কথা বলছেন । গলার স্বরে হার্টবিট দ্বিগুণ হল । চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি । মিনিট তিনেক পরে ঘুরতেই বললাম গুড মর্নিং স্যার ! আপনি আমায় ডেকেছেন ? মুখখানি আরও একটু গম্ভীর করে তিনি বললেন পাল , বিনীতা আগামী কাল থেকে মেটারনিটি লিভে যাচ্ছে সেটা জানা আছে নিশ্চয়ই ? আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম । সামনে ইয়ারএন্ডিং আবার তার সাথে অডিট । তোমাকে তোমার নিজের টেবিল সামলে বিনীতার টেবিলের কাজটাও সামলাতে হবে ।পারবে তো ? কোম্পানী অবশ্য বিনিময়ে স্পেশাল কিছু অ্যালাউন্স ----। ঘাড় নেড়ে বাইরে এলাম । নাড়া ছাড়া উপায় কি ! আমি তো কোন ছার , আজ পর্যন্ত সিনিয়ররাই কেউ সাহেবের আদেশ অমান্য করার সাহস করে নি ! টেবিলে ফিরে মনে মনে হিসাব করি । বিনীতার বিয়ে হল যেন কমাস ? তবে কি বিয়ের আগেই বাঁধিয়েছিল নাকি ? বেশ কয়েকবার ফোন করেছিল লতু । আমি বলি কি কাজের ঠ্যালায় চোখে সর্ষেফুল দেখছি তখন ! দেখা করব কি করে ? গতকাল অনেক রাতে ইয়ারএন্ডিং আর অডিটের কাজ শেষ। ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে আজ অফিসে এসেছি ।সই করে সোজা অনিকদার টেবিলে । একটা সিগারেট অফার করি। অনিকদা সিগারেট নিতে একটা চেয়ার টেনে তার আরও কাছ ঘেঁসে বসি । দুজনেই সিগারেট ধরাই । তারপর বলি অনিকদা একটা কথা ছিল । অনিকদা বললেন জানি জানি । একটু আগে বেরোবি এই তো ? তা যা । কদিন তোর যা খাটুনি গেল । আমি সাহেব ডাকলে ম্যানেজ করে নেবো'খন । ধন্যবাদ দিয়ে নিজের টেবিলে যাই । চেয়ারে বসেই মোবাইল বের করে ফোন করি । ওপাশে রিং হচ্ছে । আমি ভাবছি কি বলব । তবে ফ়োন তো কই তুলল না । আবার রিপিট করি । নো রেসপন্স । যা বাবা কি হল রে ! বাথরুম গেল নাকি ফ়োন টা ফেলে ? এটা তো ওর স্নানে যাওয়ার সময় নয় তবে ? চেয়ারে বসে মনে মনে প্ল্যান করি , আজ দুপুরে বেরিয়ে ওকে বাইকে বসিয়ে সোজা সেই গঙ্গার ঘাটে যাব, যেখানে আগেরবার গিয়েছিলাম ।নদীর ধারে বটের ছায়ায় সেই সিঁড়িতে বসব । দুজনে মিলে ভবিষ্যতের ছবি আঁকব।সামনে কুলু কুলু গঙ্গা ।তাতে ভেসে যাবে পাল তোলা নৌকা। নদীর থেকে ফুরফুরে বাতাস এসে ওর কুন্তল ওড়াবে । আমি সেই কুন্তল সরিয়ে আলতো করে একটা চুমু দেবো ইত্যাদি ইত্যাদি । আধাঘন্টা পরে আবার ফোন করি । ওদিকে সুইচ অফ । সেকি রে বাবা । আমার মিস কল দেখেও রিং ব্যাক না করে সুইচ অফ ! দুপুরে টিফিনের সময় বেরুলাম ।আগে সুলতাদের বাড়ি যাই নি কোনদিন । তবে নামটা জানি। নবোদয় কলোনী গড়িয়া ॥ অফিস থেকে পাক্কা চল্লিশ মিনিট বাইক চালিয়ে গেলাম ওদের কলোনীতে । দুজনকে ওর দাদার নাম বললাম । চেনে না বলল । একটা বাড়ির সামনে ফুটপাত ঘেঁসে বাইকটা দাঁড় করালাম একটা পা মাটিতে ঠেকিয়ে সিগারেট ধরালাম । আর কাকে জিগ্গেস করব ভাবছি ॥ পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলাম । রিং করলাম আবার । ওই তো রিং হচ্ছে । আমি কলার টোনে শুনছি "বসন্ত এসে গ্যাছে ।বসন্ত এসে গ্যা -অ্যা -ছে"। তিনবার রিং হয়ে কেটে গেল । আবার রিপিট করলাম । যথারীতি নো রেসপন্স । দেখা না করেই ফিরে যাবো ? নাকি ওর শরীর খারাপ হল? কিছু একটা হয়েছে নিশ্চয়ই । অন্যমনস্ক হয়ে এই সব ভাবছি । এমন সময় সামনের গেট খুলে ও কে বেরুল ? একি ওর সাথে লোকটা কে ? লতুর কপালে সিঁদুর ! হাতে শাঁখা -পলা ! আমার দুচোখ ঝাপসা । আমার এদিকে নিদাঘ তপ্ত দুপুর আর ওদিকে "- - - - - -
- - "॥